আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৩৪- ইসলামী রাষ্ট্রনীতির অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৭৬৩
৪১. শহীদদের জন্য জান্নাত অবধারিত হওয়ার প্রমাণ
৪৭৬৩। ইয়াহয়া ইবনে ইয়াহয়া তামীমী ও কুতায়বা ইবনে সাঈদ (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে কায়েস (রাহঃ) বলেনঃ আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, আর তিনি ছিলেন তখন শক্রর মুখোমুখি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ নিশ্চয়ই জান্নাত রয়েছে তরবারীর ছায়ায়। তখন আলুথালু বেশের এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালো এবং বললো, হে আবু মুসা! আপনি কি নিজে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে তা বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে ব্যক্তি তার সাথীদের কাছে ফিরে গেলো। তারপর বললো, আমি তোমাদেরকে (বিদায়ী) সালাম জানাচ্ছি। এরপর সে তার তরবারীর কোষ ভেঙ্গে ফেলে তা দুরে নিক্ষেপ করলো। তারপর নিজ তরবারীসহ শক্রদের কাছে গিয়ে উপনীত হলো। এবং তা দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেল।
باب ثُبُوتِ الْجَنَّةِ لِلشَّهِيدِ
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ يَحْيَى التَّمِيمِيُّ، وَقُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، - وَاللَّفْظُ لِيَحْيَى - قَالَ قُتَيْبَةُ حَدَّثَنَا وَقَالَ، يَحْيَى أَخْبَرَنَا جَعْفَرُ بْنُ سُلَيْمَانَ، عَنْ أَبِي عِمْرَانَ الْجَوْنِيِّ، عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ، عَبْدِ اللَّهِ بْنِ قَيْسٍ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ سَمِعْتُ أَبِي وَهُوَ، بِحَضْرَةِ الْعَدُوِّ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِنَّ أَبْوَابَ الْجَنَّةِ تَحْتَ ظِلاَلِ السُّيُوفِ " . فَقَامَ رَجُلٌ رَثُّ الْهَيْئَةِ فَقَالَ يَا أَبَا مُوسَى آنْتَ سَمِعْتَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ هَذَا قَالَ نَعَمْ . قَالَ فَرَجَعَ إِلَى أَصْحَابِهِ فَقَالَ أَقْرَأُ عَلَيْكُمُ السَّلاَمَ . ثُمَّ كَسَرَ جَفْنَ سَيْفِهِ فَأَلْقَاهُ ثُمَّ مَشَى بِسَيْفِهِ إِلَى الْعَدُوِّ فَضَرَبَ بِهِ حَتَّى قُتِلَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ ঘটনা দ্বারা আমরা জানতে পারি সাহাবায়ে কিরাম ইসলামের সাহায্য করার জন্য কেমন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। দীনের জন্য জান দিতে পারাকে তারা পরম সৌভাগ্য গণ্য করতেন। সেইসঙ্গে এটাও জানতে পারি যে, জান্নাতলাভের প্রতি তারা কেমন ব্যাকুল ছিলেন। যখন জানতে পারলেন দীনের জন্য শহীদ হতে পারলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, তখন হাতের খেজুর খেয়ে শেষ করার মত অপেক্ষাটুকুও বরদাশত করতে পারলেন না। এ খেজুর খেতে যে সময় লাগবে, ততক্ষণে শহীদ হয়ে তো জান্নাতে পৌছা যাবে। জান্নাতের অকল্পনীয় নি'আমত ও সুখশান্তির বিপরীতে দুনিয়া নিতান্তই তুচ্ছ। এ তুচ্ছ দুনিয়ার জন্য শুধু শুধু জান্নাতে যেতে দেরি করা কেন! তাই খেজুর ফেলে দিয়ে জিহাদের ময়দানে ছুটে গেলেন। ঐতিহাসিক মূসা ইব্ন 'উকবা রহ. তাঁর 'মাগাযী’ গ্রন্থে বলেন, এ দিনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম শহীদ হয়েছিলেন।
বস্তুত শাহাদাতলাভের জযবা ছিল সাহাবায়ে কিরামের সাধারণ চরিত্র। শাহাদাতের অনুপ্রেরণায় বিপুল উদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা এরকম আরও অনেক আছে। বিশিষ্ট সাহাবী থেকে নিয়ে অতি সাধারণ স্তরের সাহাবী পর্যন্ত সকলের মধ্যেই এই একই দৃশ্য লক্ষ করা যায়। হযরত আনাস ইব্ন মালিক রাযি. জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবীর ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একজন কালো রঙের মানুষ। আমার শরীরে দুর্গন্ধ। কোনও ধনসম্পদও আমার নেই। আমি যদি ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যাই, তবে আমার ঠিকানা হবে কোথায়? তিনি বললেন, জান্নাতে। অমনি তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন। খবর শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে আসলেন এবং বললেন, আল্লাহ তা'আলা তোমার চেহারা শুভ্র সমুজ্জ্বল করে দিন, তোমার শরীরকে সুরভিত করে দিন এবং তোমাকে ঐশ্বর্য দান করুন। দীনের খেদমত ও শাহাদাতের জযবা সম্বলিত তাদের এ সকল ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
এ হাদীছ দ্বারা আরও জানা যায় যে, সাহাবায়ে কিরাম কখনও অনুমানের উপর কোনও কাজ করতেন না। দীনের সঠিক জ্ঞান লাভের মাধ্যমে যখন কোনও বিষয় তাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যেত, তখনই তারা তাতে রত হতেন। আবার কোনও বিষয় জানার পর তা পালন করতেও তাদের একটুও বিলম্ব হত না। সুতরাং এ সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করে আগে জেনে নিলেন, শহীদ হতে পারলে তার কী পুরস্কার লাভ হবে। তারপর যখন তা জেনে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে শাহাদাত লাভের চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আরও জানা গেল, কোনও বিষয়ে জানতে হলে এমন ব্যক্তির কাছেই তা জিজ্ঞেস করতে হবে, যার কাছে সে বিষয়ের সঠিক জ্ঞান আছে। যে কারও কাছে জিজ্ঞেস করে আমল করতে গেলে বিপথগামিতার ভয় থাকে। সুতরাং জিজ্ঞেস করার ক্ষেত্রেও সতর্কতা জরুরি।
সাহাবায়ে কিরামের বিপরীতে নিজেদের অবস্থা একবার বিবেচনা করুন। আমাদের না আছে দীন শেখার আগ্রহ, না আছে আমলের উদ্দীপনা। দীনের জন্য ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকারের কোনও গরজ আমাদের মধ্যে নেই। কী করে পার্থিব জীবন গুছিয়ে নেওয়া যায়, ধনসম্পদ ও সুনামসুখ্যাতিতে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া যায়, সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু। দীনের জন্য প্রাণ দেওয়া তো নয়ই; দুনিয়ার জন্য আরও কতদিন বেঁচে থাকা যায়, আমরা তারই জন্য লালায়িত। অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামের আদর্শের সঙ্গে আমাদের মিল নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় আখিরাতে মুক্তি ও সাফল্য লাভের আশা আমরা কতটুকু করতে পারি? তা সত্ত্বেও আমরা সে আশা করি। আল্লাহ তা'আলা আমাদের মনের সে আশার সঙ্গে বাস্তব অবস্থাকে মিলিয়ে দিন। আমরাও যাতে তাদের মত দীনের জন্য জানমাল কুরবান করতে পারি এবং কোনও গড়িমসিকে প্রশ্রয় না দিয়ে যথাশীঘ্র দীনী কাজে জানমাল খরচ করতে পারি সেই তাওফীক তিনি আমাদের দান করুন, আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ


ক. এ হাদীছ আমাদেরকে দীনী কাজে গড়িমসি না করে যথাশীঘ্র আত্মনিয়োগের শিক্ষা দান করে।

খ. এ হাদীছ দ্বারা শিক্ষা পাই, যে-কোনও দীনী কাজ করার আগে সে সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করে নেওয়া উচিত।

গ. দীনের যে-কোনও কাজের ফযীলত জানা সে কাজে অনুপ্রেরণা লাভের পক্ষে সহায়ক।

ঘ. দুনিয়াবী কোনও স্বার্থ নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি ও জান্নাতলাভই হওয়া উচিত দীনী কাজের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু।