মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত শরীফ)

مشكاة المصابيح للتبريزي

৮- রোযার অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ

মোট হাদীস টি

অনুসন্ধান করুন

হাদীস নংঃ ১৯৫৬
details icon

পরিচ্ছেদঃ রোযার প্রারম্ভিক আলোচনাঃ

রোযার অর্থঃ
‘রোযা’—মূলে ‘সওম' (صوم) শব্দ রহিয়াছে, বহুবচনে 'সিয়াম'। ইহার অর্থ, বিরত থাকা, বিরত রাখা। শরীঅতে ইহার অর্থ, আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুবহে সাদেকের প্রারম্ভ হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পান, আহার ও স্ত্রী সহবাস হইতে বিরত থাকা।

রোযার ফরযিয়তঃ
রোযা ফরয বা অবশ্য করণীয় এবং ইসলামের একটি স্তম্ভ। ইহা কুরআন, হাদীস, ইজ্মা ও যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআনঃ আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“হে আল্লাহতে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হইল, যেভাবে উহা ফরয করা হইয়াছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাহাতে তোমরা সংযমী হও।” (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩) অপর জায়গায় আছেঃ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ “তোমাদের মধ্যে যে সে মাসকে পায়, সে যেন রোযা রাখে।” –সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫
হাদীসঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর নির্মিত (১) এই সাক্ষ্য দেওয়া, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা'বূদ নাই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বন্দা ও তাঁহার রাসূল। (২) নামায কায়েম করা। (৩) যাকাত দেওয়া। (৪) হজ্জ করা এবং (৫) রোযা রাখা। —বুখারী ও মুসলিম, হাদীস নং ৩
ইজমাঃ ইসলামের প্রথম যুগ হইতে এ যুগ পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমানই রোযা ফরয বলিয়া বিশ্বাস করিয়া এবং উহা পালন করিয়া আসিতেছেন।
যুক্তিঃ (ক) রোযা দ্বারা আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়, আর যাঁহাকে স্রষ্টা বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে, তাঁহার নির্দেশ পালন করা যুক্তিযুক্ত। (খ) রোযা দ্বারা সংযম শিক্ষা করা হয়, আর সংযম হইল একটি বাঞ্ছনীয় ও প্রশংসনীয় বিষয়। (গ) আল্লাহ্ তা'আলা যে, মানুষকে পানাহার করিবার ও যৌন ক্ষুধা মিটাইবার সামগ্রী দান করিয়াছেন, উহার কৃতজ্ঞতা আদায় করার জন্য তাঁহার নির্দেশে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উহা হইতে বিরত থাকাও যুক্তিসঙ্গত কথা।
রোযার উদ্দেশ্যঃ
বিষ পানে যেরূপ বাহ্যিক জীবনের অবসান হয়, পাপানুষ্ঠানেও তদ্রূপ মানবতার মৃত্যু ঘটে। সংবৎসরে এক মাসকাল পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হইতে বিরত থাকিয়া পাপ প্রবৃত্তি দমন ও সংযম সাধনাই রোযার উদ্দেশ্য। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলিয়াছেন, যে রোযা রাখিয়াও মিথ্যা কথা ও মিথ্যাচার ত্যাগ করে নাই, তাহার এই রোযাতে আল্লাহর কোন কাজ নাই।
রোযার উপকারিতাঃ
রোযা মানুষের দেহ ও আত্মার নানাবিধ উপকার সাধন করিয়া থাকে। রোযা দ্বারা মানুষের আত্মার পবিত্রতা ও চিন্তাশক্তির প্রখরতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই জাতিধর্ম নির্বিশেষে আবহমানকাল হইতেই মুনি ঋষিগণকে উপবাস করিতে এবং সুফী সাধকদিগকে রোযা রাখিতে দেখা যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও ইহার বিশেষ উপকারিতা স্বীকৃত হইয়াছে। ডাঃ সলোমন তাঁহার "গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য বিধি'তে মানব দেহকে ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করিয়া বলেন, ইঞ্জিন রক্ষাকল্পে মধ্যে মধ্যে ডকে নিয়া চুল্লি হইতে ছাই ও অঙ্গার সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশিত করা যেমনটা আবশ্যক— উপবাস দ্বারা মধ্যে মধ্যে 'পাকস্থলী' হইতে অজীর্ণ খাদ্যটি নিষ্কাশিত করাও তেমনটা দরকার।

রোযা কি মানব শরীরের
কোন ক্ষতি করেঃ
১৯৫৮ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ডাঃ গোলাম মোআজ্জাম সাহেব কর্তৃক মানব শরীরের উপর রোযার প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা চালান হয়—তাহাতে প্রমাণিত হয় যে, রোযার দ্বারা মানব শরীরের কোনই ক্ষতি হয় না; কেবল ওজন সামান্য কমে, তাহাও উল্লেখযোগ্য কিছুই নহে; বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে এইরূপ রোযা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ diet control অপেক্ষা বহু দিক দিয়াই শ্রেষ্ঠ। তৎকর্তৃক ১৯৬০ সালের গবেষণায় ইহাও প্রমাণিত হয় যে, যাহারা মনে করিয়া থাকে যে, রোযা দ্বারা পেটের শূল বেদনা বৃদ্ধি পায়, তাহাদের এ ধারণা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারণ, উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খাইলেই ইহা বাড়ে—এই অতি সত্য কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করিয়া শূল বেদনার রোগীকে রোযা রাখিতে নিষেধ করেন। ১৭ জন রোযাদারের পেটের রস পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, যাহাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশী বা খুব কম, রোযার ফলে তাহাদের এই উভয় দোষই সারিয়া গিয়াছে। এই গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয় যে, যাহারা মনে করেন যে, রোযা দ্বারা রক্তের ‘পটাসিয়াম' কমিয়া যায় এবং তাহাতে শরীরের ক্ষতি সাধিত হয়, তাহাদের এই ধারণাও অমূলক। কারণ, পটাসিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া প্রথমে দেখা দিয়া থাকে হৃৎপিণ্ডের উপর, অথচ ১১ জন রোযাদারের হৃৎপিণ্ড অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকডিওগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (রোযার পূর্বে ও রোযা রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, রোযা দ্বারা ইহাদের হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়ার কোনই ব্যতিক্রম ঘটে নাই।
সুতরাং বুঝা গেল যে, রোযা দ্বারা রক্তের যে পটাসিয়াম কমে তাহা অতি সামান্য এবং স্বাভাবিক সীমারেখার মধ্যে। তবে রোযা দ্বারা যে কোন কোন মানুষ কিছুটা খিটখিটে মেযাজ হইয়া যায়, তাহা সামান্য রক্ত-শর্করা কমার দরুনই হইয়া থাকে— যাহা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ক্ষতিকর নহে। অন্য সময় ক্ষুধা পাইলেও এইরূপ হইয়া থাকে। (চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগের দান সংখ্যা, আজাদ ২৮/১২/৬০ ইং)
এক কথায় রোযা মানব দেহের কোনরূপ ক্ষতি সাধন করে না; বরং উহার নানাবিধ উপকারই করিয়া থাকে। এ ছাড়া রোযা সফরে মুসাফিরকে এবং যুদ্ধের ময়দানে সেনানীকে পানাহার কষ্ট সহ্য করিতে অভ্যস্ত করিয়া তোলে এবং ‘নায-নেআমতে ডুবা' বড়লোকদিগকে অনাহার ক্লিষ্ট দীন দরিদ্রের ক্ষুৎপিপাসা কষ্ট উপলব্ধি করিতে সহায়তা করে।
রোযা পূর্বেও ফরয ছিলঃ
উপরি উক্ত প্রথম আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে যে, রোযা পূর্বের উম্মতগণের প্রতিও ফরয ছিল যদিও বিস্তারিতভাবে একথা জানা যায় নাই যে, কোন্ উম্মতের উপর রোযা কত দিন বা কোন মাসে ফরয ছিল। ইনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকাতে বলা হইয়াছে, জল, বায়ু, জাতি, ধর্ম ও পারিপার্শ্বিকতা ভেদে রোযার নিয়ম পদ্ধতি বিভিন্ন হইলেও এমন কোন ধর্মের নাম উল্লেখ করা কঠিন, যাহার ধর্মীয় বিধানে রোযার আবশ্যকতা স্বীকার করা হয় নাই।
রোযার অস্বীকারঃ
রোযার ফরযিয়ত যেহেতু কুরআন ও হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত, অতএব, রোযার অস্বীকার করা কুরআন ও হাদীসকে অস্বীকার করার নামান্তর এবং সাফ কুফরী। যে রোযাতে বিশ্বাস করে; কিন্তু উহা পালন করে না, সে ফাসেক, পূর্ণ মুসলমান নহে। ইসলামের গোটা একটি স্তম্ভকে বাদ দিয়া পূর্ণ মুসলমান বলিয়া দাবী করার অধিকার তাহার নাই ও থাকিতে পারে না। —অনুবাদক



প্রথম অনুচ্ছেদ।
১৯৫৬। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন: যখন রমযান মাস আসে আসমানের দরজাসমূহ খুলিয়া দেওয়া হয়। অপর বর্ণনায় রহিয়াছে, বেহেশতের দরজাসমূহ খুলিয়া দেওয়া হয় এবং দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, আর শয়তানকে শৃংখলিত করা হয়। অপর বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলিয়া দেওয়া হয়। -মোত্তাঃ

tahqiq

তাহকীক:

তাহকীক চলমান