আল মুওয়াত্তা-ইমাম মুহাম্মাদ রহঃ
موطأ الإمام مالك برواية الإمام محمد بن الحسن الشيباني
২- নামাযের অধ্যায় - এর পরিচ্ছেদসমূহ
মোট হাদীস ১ টি
অনুসন্ধান করুন...
হাদীস নং:৯৭
মুয়াযযিনের ইকামত দেয়ার সময় যে ব্যক্তি নামায পড়ে
৯৭। আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান (রাযিঃ) বলেন, কতক লোক (মসজিদে নববীতে) ইকামত শুনার পর (ফজরের) সুন্নত নামায পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেলো। নবী ﷺ বেরিয়ে এসে (তাদের নামাযরত অবস্থায় দেখে) বলেনঃ একই সঙ্গে দুই নামায?**
ইমাম মুহাম্মাদ (রাহঃ) বলেন, তাকবীরে তাহরীমা হয়ে যাওয়ার পর ফজরের দুই রাআত সুন্নত নামায ব্যতীত অন্য কোন নফল নামায পড়া মাকরূহ। শুধু ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়ায় কোন দোষ নেই, যদিও মুয়াযযিন ইকামত শুরু করে দিয়ে থাকেন। ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ)-রও এই মত।
* ফজরের নামাযের ইকামত অথবা জামাআত শুরু হয়ে যাওয়ার পর ফজরের দুই রাকআত সুন্নত নামায পড়া যাবে কিনা অথবা জামাআত শেষ হওয়ার পর এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে এই সুন্নত পড়া যাবে কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) ও তার সংগীগণ বলেন, যদি ফজরের জামাআত শুরু হয়ে থাকে এবং তখন সুন্নত দুই রাআত পড়তে গেলে জামাআতের দুই রাআতই হারিয়ে ফেলার আশংকা হয়, দ্বিতীয় রাআতের রুকূতেও ইমামের সাথে শরীক হতে পারার সম্ভাবনা না থাকে, তবে তখন সুন্নত নামায না পড়েই জামাআতে শামিল হবে। আর যদি পূর্ণ এক রাআত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে সুন্নত দুই রাআত পড়বে, অতঃপর জামাআতে শামিল হবে।
ইমাম আওযাঈও এই মত সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন, জামাআতের শেষ রাআত হারাবার আশংকা না থাকলে মসজিদের মধ্যে দাঁড়িয়েই সুন্নত দুই রাআত পড়া জায়েয।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রাহঃ) বলেন, জামাআতের শেষ রাকুআতও হারাবার আশংকা থাকলে সুন্নত পড়া শুরু করবে না, বরং জামাআতে শামিল হবে। অন্যথায় মসজিদে প্রবেশ করে থাকলে সেখানেই সুন্নত দুই রাআত পড়বে।
ইবনে হিব্বান (রাহঃ) বলেন, ইকামত শুরু হয়ে গেলে কোন অ-ফরয নামায শুরু করা যাবে না। তবে ফজরের দুই রাকআত সুন্নত এই নিয়মের ব্যতিক্রম।
ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) ও তার অনুরূপ মত পোষণকারীদের দলীল এই যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিঃ) ফজরের নামায পড়তে এসে দেখেন, ইমাম ফরয নামায পড়ছেন। তিনি জামাআতে শামিল না হয়ে হযরত হাফসা (রাযিঃ)-র ঘরে গিয়ে সুন্নত দুই রাকআত পড়েন, অতঃপর ইমামের সাথে জামাআতে শরীক হন।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আওযাঈ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) সম্পর্কিত বর্ণনাকে দলীল হিসাবে পেশ করেন। ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন, ফজরের জামাআত শুরু হয়ে গেছে। তিনি থামের পাশে দাঁড়িয়ে সুন্নত দুই রাআত পড়েন, অতঃপর জামাআতে শামিল হন (ইমাম কুরতুবীর তাফসীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৭)।
ইমাম মালেক (রাহঃ) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে দেখে যে, ফজরের জামাআত শুরু হয়ে গেছে, তখন সে ইমামের সাথে ফরয নামাযে শামিল হবে, সুন্নত পড়ায় লেগে যাবে না। কিন্তু সে যদি মসজিদে প্রবেশ না করে থাকে এবং এদিকে জামাআতও শুরু হয়ে থাকে, তবে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে সুন্নত দুই রাআত পড়বে, যদি জামাআতের অন্তত এক রাআত হারাবার আশংকা না থাকে। আর যদি শেষ রাকআতও ছুটে যাওয়ার আশংকা হয়, তবে জামাআতে শামিল হবে এবং সুন্নত পরে পড়বে (ঐ)।
ইমাম শাফিঈ (রাহঃ) বলেন, মসজিদে প্রবেশ করে কেউ যদি দেখে যে, ইকামত হয়ে গেছে, তবে সে ইমামের সাথে জামাআতে শামিল হবে। এ সময় সুন্নত দুই রাআত পড়াই যাবে না, মসজিদের ভিতরেও নয় এবং মসজিদের বাইরেও নয়। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম তাবারীও এই মত ব্যক্ত করেছেন। এই মতই অধিক যুক্তিসংগত ও সহীহ দলীল ভিত্তিক মনে হয়। তাদের দলীল এই যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “ইকামত হয়ে গেলে বা হতে থাকলে তখন সেই সময়কার নির্দিষ্ট ফরয নামায ছাড়া অন্য নামায পড়া যাবে না"। হাদীসটি সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে (ঐ)।
হযরত মালেক ইবনে বুহাইনা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ দেখলেন যে, এক ব্যক্তি ইকামত বলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়ছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ নামায শেষ করলে লোকেরা তাকে ঘিরে ধরলো। নবী ﷺ বলেনঃ সকাল বেলার নামায কি চার রাকআত, ভোরের নামায কি চার রাকআত (বুখারী, মুসলিম)।
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইকামত শুরু হয়ে যাওয়ার পর সুন্নত শুরু করা যাবে না, ইমাম বুখারীরও এই মত। তিনি যে অনুচ্ছেদের অধীনে এই হাদীস সংযোজন করেছেন তার শিরোনাম হচ্ছে, “ফজর নামাযের ইকামত শুরু হয়ে গেলে তখন সেই নামায ছাড়া অন্য কোন নামায পড়া যাবে না"।
ইমাম বুখারী (রাহঃ) তার গ্রন্থে এবং বাযযার ও অপরাপর মুহাদ্দিস আনাস (রাযিঃ)-এর সূত্রে মারফূ হাদীসরূপে বর্ণনা করেছেন যে, “ফজরের জামাআতের ইকামত শুরু হয়ে গেলে পর তার দুই রাআত সুন্নত পড়তে রাসূলুল্লাহ নিষেধ করেছেন"।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইকামতের পর দুই রাকআত সুন্নত পড়াও কি নিষেধ? তিনি বলেনঃ "ফজরের সুন্নত দুই রাকআতও পড়া যাবে না” (বুখারীর শরাহ ফাতহুল বারী)।
মোটকথা, ইকামত শুরু হয়ে গেলে কোনরূপ নফল বা সুন্নত নামায পড়া যাবে না। তবে একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ইমামদের মধ্যে এই মতবিরোধ বা রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর এই নিষেধাজ্ঞা চূড়ান্ত হারাম পর্যায়ের নয়, বরং মাকরূহ পর্যায়ভুক্ত।
ফজরের না পড়া সুন্নত
ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে যে সুন্নত পড়া সম্ভব হয়নি তা কখন পড়তে হবে, এ বিষয়েও ইমামদের মধ্যে মতভেদ আছে। হানাফী মাযহাবের বিশেষজ্ঞ আলেমদের মতে তা সূর্যোদয়ের পর পড়তে হবে। তাদের দলীলঃ
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “যে ব্যক্তি ফজরের দুই রাকআত সুন্নত (ফরযের পূর্বে) পড়ে নাই, সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর পড়ে” (তিরমিযী)।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ ফজরের ফরয নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অন্য কোন নামায পড়তে নিষেধ করেছেন (বুখারী)। তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসটি মুহাদ্দিস হাকেম (রাহঃ) এভাবে উল্লেখ করেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়তে ভুলে গেছে সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর পড়ে”।
কিন্তু ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ, সুফিয়ান সাওরী, ইসহাক ইবনে রাহওয়ায়হ্ এবং আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের মতে, ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দুই রাআত সুন্নত পড়ার সুযোগ না পেলে তা ফরয নামাযের শেষে এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়তে কোন দোষ নেই। তিরমিযীতে ইবনে উমার (রাযিঃ)-র এইরূপ আমলের উল্লেখ আছে। এই মতের স্বপক্ষে দলীলঃ
কায়েস ইবনে ফাহদ (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বের হয়ে এলেন এবং নামাযের ইকামত বলা হলো। আমি তাঁর সাথে ফজরের ফরয নামায পড়লাম। তিনি পিছন দিকে ফিরে আমাকে নামাযরত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি বলেনঃ হে কায়েস, থাম! তুমি কি একই সঙ্গে দুই নামায পড়ছো? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ফজরের সুন্নত দুই রাআত পড়তে পারিনি, এখন তাই পড়ছি। তিনি বলেনঃ তাহলে আপত্তি নেই (তিরমিযী, আবু দাউদ)। আবু দাউদের অপর বর্ণনায় আছেঃ “জবাব শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ নীরব থাকলেন"।
“তাহলে আপত্তি নেই (ফালা ইযান)" কথার ব্যাখ্যায় আবু তায়্যিব সিনদী হানাফী লিখেছেন, “আজকের ফজরের সুন্নতই যদি তুমি এখন পড়ে থাকো, তবে তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, তোমার কোন গুনাহ নেই এবং তুমি তিরস্কৃতও হবে না”। “রাসূলুল্লাহ ﷺ নীরব থাকলেন” কথার ব্যাখ্যায় ইবনে মালেক মুহাদ্দিস বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই নীরবতা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফজরের সুন্নত নামায ফরয নামাযের পূর্বে পড়তে না পারলে তা ফরয পড়ার পরপরই পড়া যেতে পারে”।
আল্লামা মোল্লা আলী আল-কারী লিখেছেন, এই হাদীসটি সপ্রমাণিত নয়। তাই এটা ইমাম আবু হানীফার মতের বিপক্ষে দলীল হতে পারে না। প্রতিপক্ষের তরফ থেকে এর জবাবে বলা হয়েছে, তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল ও অপ্রমাণিত হলেও তাতে কোন দোষ নেই । কারণ এই ঘটনার বিবরণ অন্যান্য কয়েকটি সহীহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া মুহাদ্দিস ইরাকী এই হাদীসের সনদকে 'হাসান' বলে অভিহিত করেছেন। ইবনে আবু শাইবা ও ইবনে হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিসগণও এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আর একই হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা যে পরস্পরের পরিপূরক ও ব্যাখ্যা দানকারী তা সর্বজন সমর্থিত।
আল্লামা ইমাম শাওকানী লিখেছেন, 'ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে সুন্নত দুই রাআত না পড়তে পারলে সূর্যোদয়ের পূর্বে তা পড়াই যাবে না এবং অবশ্যই সূর্যোদয়ের পর পড়তে হবে একথা হাদীসে বলা হয়নি। এতে শুধু সেই ব্যক্তির জন্যই নির্দেশ রয়েছে, যে এই দুই রাকআত ইতিপূর্বে পড়তে পারেনি। তাকে বলা হয়েছে, সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর পড়ে, যেন তা ভুলে না যায়। কেননা তা যথাসময়ে পড়ে না থাকলে তো যে কোন সময় পড়তেই হবে"। অতঃপর তিনি লিখেছেন, “সেই দুই রাআত সুন্নত ফরয নামাযের পরই পড়তে নিষেধ করা হয়েছে-এমন কথা এ হাদীস থেকে বুঝা যায় না”।
বরং দারু কুতনী, হাকেম ও বায়হাকীতে বলা হয়েছে, "যে লোক সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়তে পারেনি, সে যেন তা পড়ে নেয় অর্থাৎ ফরয নামাযের পরই তা পড়া দোষের নয়" (নাইলুল আওতার, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০)।
ফজর ও আসরের নামাযের পর কোন সুন্নত বা নফল নামায পড়ার যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা হারাম পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং মাকরূহ পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা (অনুবাদক)।
ইমাম মুহাম্মাদ (রাহঃ) বলেন, তাকবীরে তাহরীমা হয়ে যাওয়ার পর ফজরের দুই রাআত সুন্নত নামায ব্যতীত অন্য কোন নফল নামায পড়া মাকরূহ। শুধু ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়ায় কোন দোষ নেই, যদিও মুয়াযযিন ইকামত শুরু করে দিয়ে থাকেন। ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ)-রও এই মত।
* ফজরের নামাযের ইকামত অথবা জামাআত শুরু হয়ে যাওয়ার পর ফজরের দুই রাকআত সুন্নত নামায পড়া যাবে কিনা অথবা জামাআত শেষ হওয়ার পর এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে এই সুন্নত পড়া যাবে কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) ও তার সংগীগণ বলেন, যদি ফজরের জামাআত শুরু হয়ে থাকে এবং তখন সুন্নত দুই রাআত পড়তে গেলে জামাআতের দুই রাআতই হারিয়ে ফেলার আশংকা হয়, দ্বিতীয় রাআতের রুকূতেও ইমামের সাথে শরীক হতে পারার সম্ভাবনা না থাকে, তবে তখন সুন্নত নামায না পড়েই জামাআতে শামিল হবে। আর যদি পূর্ণ এক রাআত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে সুন্নত দুই রাআত পড়বে, অতঃপর জামাআতে শামিল হবে।
ইমাম আওযাঈও এই মত সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন, জামাআতের শেষ রাআত হারাবার আশংকা না থাকলে মসজিদের মধ্যে দাঁড়িয়েই সুন্নত দুই রাআত পড়া জায়েয।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রাহঃ) বলেন, জামাআতের শেষ রাকুআতও হারাবার আশংকা থাকলে সুন্নত পড়া শুরু করবে না, বরং জামাআতে শামিল হবে। অন্যথায় মসজিদে প্রবেশ করে থাকলে সেখানেই সুন্নত দুই রাআত পড়বে।
ইবনে হিব্বান (রাহঃ) বলেন, ইকামত শুরু হয়ে গেলে কোন অ-ফরয নামায শুরু করা যাবে না। তবে ফজরের দুই রাকআত সুন্নত এই নিয়মের ব্যতিক্রম।
ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) ও তার অনুরূপ মত পোষণকারীদের দলীল এই যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিঃ) ফজরের নামায পড়তে এসে দেখেন, ইমাম ফরয নামায পড়ছেন। তিনি জামাআতে শামিল না হয়ে হযরত হাফসা (রাযিঃ)-র ঘরে গিয়ে সুন্নত দুই রাকআত পড়েন, অতঃপর ইমামের সাথে জামাআতে শরীক হন।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আওযাঈ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) সম্পর্কিত বর্ণনাকে দলীল হিসাবে পেশ করেন। ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন, ফজরের জামাআত শুরু হয়ে গেছে। তিনি থামের পাশে দাঁড়িয়ে সুন্নত দুই রাআত পড়েন, অতঃপর জামাআতে শামিল হন (ইমাম কুরতুবীর তাফসীর, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৭)।
ইমাম মালেক (রাহঃ) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে দেখে যে, ফজরের জামাআত শুরু হয়ে গেছে, তখন সে ইমামের সাথে ফরয নামাযে শামিল হবে, সুন্নত পড়ায় লেগে যাবে না। কিন্তু সে যদি মসজিদে প্রবেশ না করে থাকে এবং এদিকে জামাআতও শুরু হয়ে থাকে, তবে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে সুন্নত দুই রাআত পড়বে, যদি জামাআতের অন্তত এক রাআত হারাবার আশংকা না থাকে। আর যদি শেষ রাকআতও ছুটে যাওয়ার আশংকা হয়, তবে জামাআতে শামিল হবে এবং সুন্নত পরে পড়বে (ঐ)।
ইমাম শাফিঈ (রাহঃ) বলেন, মসজিদে প্রবেশ করে কেউ যদি দেখে যে, ইকামত হয়ে গেছে, তবে সে ইমামের সাথে জামাআতে শামিল হবে। এ সময় সুন্নত দুই রাআত পড়াই যাবে না, মসজিদের ভিতরেও নয় এবং মসজিদের বাইরেও নয়। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম তাবারীও এই মত ব্যক্ত করেছেন। এই মতই অধিক যুক্তিসংগত ও সহীহ দলীল ভিত্তিক মনে হয়। তাদের দলীল এই যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “ইকামত হয়ে গেলে বা হতে থাকলে তখন সেই সময়কার নির্দিষ্ট ফরয নামায ছাড়া অন্য নামায পড়া যাবে না"। হাদীসটি সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে (ঐ)।
হযরত মালেক ইবনে বুহাইনা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ দেখলেন যে, এক ব্যক্তি ইকামত বলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়ছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ নামায শেষ করলে লোকেরা তাকে ঘিরে ধরলো। নবী ﷺ বলেনঃ সকাল বেলার নামায কি চার রাকআত, ভোরের নামায কি চার রাকআত (বুখারী, মুসলিম)।
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইকামত শুরু হয়ে যাওয়ার পর সুন্নত শুরু করা যাবে না, ইমাম বুখারীরও এই মত। তিনি যে অনুচ্ছেদের অধীনে এই হাদীস সংযোজন করেছেন তার শিরোনাম হচ্ছে, “ফজর নামাযের ইকামত শুরু হয়ে গেলে তখন সেই নামায ছাড়া অন্য কোন নামায পড়া যাবে না"।
ইমাম বুখারী (রাহঃ) তার গ্রন্থে এবং বাযযার ও অপরাপর মুহাদ্দিস আনাস (রাযিঃ)-এর সূত্রে মারফূ হাদীসরূপে বর্ণনা করেছেন যে, “ফজরের জামাআতের ইকামত শুরু হয়ে গেলে পর তার দুই রাআত সুন্নত পড়তে রাসূলুল্লাহ নিষেধ করেছেন"।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইকামতের পর দুই রাকআত সুন্নত পড়াও কি নিষেধ? তিনি বলেনঃ "ফজরের সুন্নত দুই রাকআতও পড়া যাবে না” (বুখারীর শরাহ ফাতহুল বারী)।
মোটকথা, ইকামত শুরু হয়ে গেলে কোনরূপ নফল বা সুন্নত নামায পড়া যাবে না। তবে একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ইমামদের মধ্যে এই মতবিরোধ বা রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর এই নিষেধাজ্ঞা চূড়ান্ত হারাম পর্যায়ের নয়, বরং মাকরূহ পর্যায়ভুক্ত।
ফজরের না পড়া সুন্নত
ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে যে সুন্নত পড়া সম্ভব হয়নি তা কখন পড়তে হবে, এ বিষয়েও ইমামদের মধ্যে মতভেদ আছে। হানাফী মাযহাবের বিশেষজ্ঞ আলেমদের মতে তা সূর্যোদয়ের পর পড়তে হবে। তাদের দলীলঃ
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ “যে ব্যক্তি ফজরের দুই রাকআত সুন্নত (ফরযের পূর্বে) পড়ে নাই, সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর পড়ে” (তিরমিযী)।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ ফজরের ফরয নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অন্য কোন নামায পড়তে নিষেধ করেছেন (বুখারী)। তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসটি মুহাদ্দিস হাকেম (রাহঃ) এভাবে উল্লেখ করেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়তে ভুলে গেছে সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর পড়ে”।
কিন্তু ইমাম শাফিঈ, ইমাম আহমাদ, সুফিয়ান সাওরী, ইসহাক ইবনে রাহওয়ায়হ্ এবং আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের মতে, ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দুই রাআত সুন্নত পড়ার সুযোগ না পেলে তা ফরয নামাযের শেষে এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে পড়তে কোন দোষ নেই। তিরমিযীতে ইবনে উমার (রাযিঃ)-র এইরূপ আমলের উল্লেখ আছে। এই মতের স্বপক্ষে দলীলঃ
কায়েস ইবনে ফাহদ (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বের হয়ে এলেন এবং নামাযের ইকামত বলা হলো। আমি তাঁর সাথে ফজরের ফরয নামায পড়লাম। তিনি পিছন দিকে ফিরে আমাকে নামাযরত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি বলেনঃ হে কায়েস, থাম! তুমি কি একই সঙ্গে দুই নামায পড়ছো? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ফজরের সুন্নত দুই রাআত পড়তে পারিনি, এখন তাই পড়ছি। তিনি বলেনঃ তাহলে আপত্তি নেই (তিরমিযী, আবু দাউদ)। আবু দাউদের অপর বর্ণনায় আছেঃ “জবাব শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ নীরব থাকলেন"।
“তাহলে আপত্তি নেই (ফালা ইযান)" কথার ব্যাখ্যায় আবু তায়্যিব সিনদী হানাফী লিখেছেন, “আজকের ফজরের সুন্নতই যদি তুমি এখন পড়ে থাকো, তবে তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, তোমার কোন গুনাহ নেই এবং তুমি তিরস্কৃতও হবে না”। “রাসূলুল্লাহ ﷺ নীরব থাকলেন” কথার ব্যাখ্যায় ইবনে মালেক মুহাদ্দিস বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর এই নীরবতা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফজরের সুন্নত নামায ফরয নামাযের পূর্বে পড়তে না পারলে তা ফরয পড়ার পরপরই পড়া যেতে পারে”।
আল্লামা মোল্লা আলী আল-কারী লিখেছেন, এই হাদীসটি সপ্রমাণিত নয়। তাই এটা ইমাম আবু হানীফার মতের বিপক্ষে দলীল হতে পারে না। প্রতিপক্ষের তরফ থেকে এর জবাবে বলা হয়েছে, তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল ও অপ্রমাণিত হলেও তাতে কোন দোষ নেই । কারণ এই ঘটনার বিবরণ অন্যান্য কয়েকটি সহীহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া মুহাদ্দিস ইরাকী এই হাদীসের সনদকে 'হাসান' বলে অভিহিত করেছেন। ইবনে আবু শাইবা ও ইবনে হিব্বান প্রমুখ মুহাদ্দিসগণও এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আর একই হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা যে পরস্পরের পরিপূরক ও ব্যাখ্যা দানকারী তা সর্বজন সমর্থিত।
আল্লামা ইমাম শাওকানী লিখেছেন, 'ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে সুন্নত দুই রাআত না পড়তে পারলে সূর্যোদয়ের পূর্বে তা পড়াই যাবে না এবং অবশ্যই সূর্যোদয়ের পর পড়তে হবে একথা হাদীসে বলা হয়নি। এতে শুধু সেই ব্যক্তির জন্যই নির্দেশ রয়েছে, যে এই দুই রাকআত ইতিপূর্বে পড়তে পারেনি। তাকে বলা হয়েছে, সে যেন তা সূর্যোদয়ের পর পড়ে, যেন তা ভুলে না যায়। কেননা তা যথাসময়ে পড়ে না থাকলে তো যে কোন সময় পড়তেই হবে"। অতঃপর তিনি লিখেছেন, “সেই দুই রাআত সুন্নত ফরয নামাযের পরই পড়তে নিষেধ করা হয়েছে-এমন কথা এ হাদীস থেকে বুঝা যায় না”।
বরং দারু কুতনী, হাকেম ও বায়হাকীতে বলা হয়েছে, "যে লোক সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের দুই রাআত সুন্নত পড়তে পারেনি, সে যেন তা পড়ে নেয় অর্থাৎ ফরয নামাযের পরই তা পড়া দোষের নয়" (নাইলুল আওতার, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০)।
ফজর ও আসরের নামাযের পর কোন সুন্নত বা নফল নামায পড়ার যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা হারাম পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং মাকরূহ পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা (অনুবাদক)।
أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، أَخْبَرَنَا شَرِيكُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي نُمَيْرٍ، أَنَّ أَبَا سَلَمَةَ بْنَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ، قَالَ: " سَمِعَ قَوْمٌ الإِقَامَةَ فَقَامُوا يُصَلُّونَ، فَخَرَجَ عَلَيْهِمُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أَصَلاتَانِ مَعًا "؟ ، قَالَ مُحَمَّدٌ: يُكْرَهُ إِذَا أُقِيمَتِ الصَّلاةُ، أَنْ يُصَلِّيَ الرَّجُلُ تَطَوُّعًا غَيْرَ رَكْعَتَيِ الْفَجْرِ خَاصَةً، فَإِنَّهُ لا بَأْسَ بِأَنْ يُصَلِّيَهُمَا الرَّجُلُ إِنْ أَخَذَ الْمُؤَذِّنُ فِي الإِقَامَةِ، وَكَذَلِكَ يَنْبَغِي، وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ

তাহকীক:
তাহকীক চলমান