প্রবন্ধ
ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ হেরে গেছেন : হেযবুত তওহীদ। পর্ব–২
আল্লাহ’র সিফাত অস্বীকার :
প্রিয় পাঠক, এখানে হেযবুত তওহীদ জয়-পরাজয়ের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে ‘যদি মানুষ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে, তবে ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহ জয়ী হবেন, আর যদি মানুষ আল্লাহ’র হুকুম প্রত্যাখ্যান করে তবে ইবলিস জয়ী হবে আল্লাহ পরাজিত হবেন’। আর যেহেতু দুনিয়াব্যাপী সবাই আল্লাহর হুকুম মানে না, সে হিশাবে আল্লাহ পরাজিত হয়েছেন ইবলিসের কাছে। নাউযুবিল্লাহ। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আল্লাহ-র রাজত্বের ওপর ইবলিস নামক মাখলুকের কর্মের প্রভাব রয়েছে। মহান আল্লাহ’র শানে কতোটা মারাত্মক বেয়াদবি! মূলত এই বক্তব্য দিয়ে তারা আল্লাহ’র কয়েকটি সিফাতকে অস্বীকার করেছে। অথচ আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য যেসকল সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলোর উপর পরিপূর্ণ ঈমান আনা ব্যতিত একজন ব্যক্তির তাওহীদ পূর্ণতা পায় না। কিন্তু হেযবুত তওহীদ আল্লাহপাক সম্পর্কে যে আক্বীদা প্রকাশ করেছে, তা বিশ্বাস করলে আল্লাহ’র বহু সিফাতের অস্বীকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
মনে রাখা চাই, ‘পরাজয়’ একটি ত্রুটি। অথচ আল্লাহ সকল দোষ-ত্রুটি হতে চিরপবিত্র। দেখুন আল্লাহপাকের একটি সিফাত হচ্ছে, তিনি الْقُدُّوس অর্থাৎ পূত পবিত্র, মহামহিম, মহিমাময়। তিনি সকল ত্রুটি, দুর্বলতা ও অকল্যাণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। যাবতীয় পূর্ণতা ও যোগ্যতার অধিকারী কেবল তিনি। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوس
তিনি (আল্লাহ) পূতপবিত্র মহান বাদশাহ। -সুরা হাশর : ২৩
এ ব্যাপারে সহিহ সনদে হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ كَانَ يَقُولُ فِي رُكُوعِهِ وَسُجُودِهِ : سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلائِكَةِ وَالرُّوح
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকু এবং সিজদায় বলতেন, (মহান আল্লাহ) পূত পবিত্র, মহিমাময় এবং ফেরেশতা মণ্ডলী ও জিবরাইলের রব্ব। -সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৪৮৭
যেখানে কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে তাঁর ক্ষেত্রে ‘পরাজয়ের’ ত্রুটি সাব্যস্ত করা কী তাওহীদ থেকে বিচ্যুতি নয়? নিন্মে মহান রবের আরো কয়েকটি সিফাত বা গুনাবলি নিয়ে আলোচনা করা হলো-
মহান আল্লাহ’র একটি সিফাত হলো, তিনি القَدِير অর্থাৎ সর্বশক্তিমান। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُعْجِزَهُ مِن شَيْءٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ إِنَّهُ كَانَ عَلِيمًا قَدِيرًا
আল্লাহ এমন নন যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কোন বস্তু তাকে ব্যর্থ করতে পারে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। -সুরা ফাত্বির : ৪৪
আল্লাহ’র আরেকটি সিফাত হচ্ছে, তিনি الْقَاهِرُ অর্থাৎ প্রতাপশালী, পরাক্রমশালী, প্রবল, অপ্রতিরোধ্য, পরাস্তকারী। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ ۚ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ
তিনি নিজ বান্দাদের উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, পরিপূর্ণভাবে অবগত। –সুরা আনআম : ১৮
ইমাম ইবনুল আসির রহি. الْقَاهِرُ শব্দের অর্থ লিখেছেন,
القاهر هو الغالب جميع الخلق
যিনি সকল সৃষ্টির উপর বিজয়ী। -লিসানুল আরব, (ইবনু মুনযির) খ. ৫ পৃ. ১২০
আল্লাহপাকের আরেকটি সিফাত হচ্ছে তিনি; الْقَهَّارُ অর্থাৎ মহা প্রতাপশালী, মহা প্রবল, মহা পরাক্রান্ত, মহা পরাক্রমশালী। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
(কেউ যদি এ বিভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকে, তবে তাকে) বলে দাও, কেবল আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি একাই এমন যে, তাঁর ক্ষমতা সবকিছুতে ব্যাপ্ত। -সুরা রা’দ : ১৬
ইমাম হালীমী রহি. “আল ক্বহহার” শব্দের অর্থে বলেন,
الَّذِي يَقْهَرُ وَلا يُقْهَرُ بِحَالٍ
যিনি পরাজিত করেন, কিন্তু কোনো অবস্থায় তাকে পরাজিত করা যায় না। -আল আসমা ওয়াস সিফাত, বাইহাক্বী, খ. ১ পৃ. ১৬৪
মহান আল্লাহ’র আরেকটি সিফাত হলো, তিনি الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ অর্থাৎ মহা পরাক্রমশালী, অতি প্রভাবশালী, মহা সম্মানিত। মহান রব বলেন,
وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ
এবং তিনিই শক্তিমান, পরাক্রমশালী। -সুরা শুরা : ১৯
উল্লেখ্য যে, আল্লাহপাকের গুনবাচক নাম ‘الْعَزِيزُ’ এর অর্থ হচ্ছে-
الغالب الذي لا يقهر
অর্থাৎ এমন বিজেতা, যাকে পরাজিত করা যায়না। – সফওয়াতুত তাফাসীর, খ. ২ পৃ. ৫৪৬
অন্য বর্ননায় এসেছে,
الغالب الذي لا يغلبه احد
এমন বিজয়ী, যার উপরে কেউই বিজয়ী হতে পারে না। –সফওয়াতুত তাফাসীর, খ. ২ পৃ. ৫৪৬
এ ব্যাপারে আরো অসংখ্য আয়াত এসেছে। যেমন–
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ ۚ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, তার রাজত্ব কেবল আল্লাহরই। তিনি সবকিছুর উপর পরিপূর্ণ ক্ষমতাবান। -সুরা মায়িদা : ১২০
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ ۚ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ
তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনি বাদশাহ, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা, নিরাপত্তাদাতা, সকলের রক্ষক, মহা ক্ষমতাবান, সকল দোষ-ত্রুটির সংশোধনকারী, গৌরবান্বিত, তারা যে শিরক করে, তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। -সুরা হাশর : ২৩
فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِندَ مَلِيكٍ مُّقْتَدِرٍ
সত্যিকারের মর্যাদাপূর্ণ আসনে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহা সম্রাটের সান্নিধ্যে। -সুরা ক্বামার : ৫৫
ইমাম খাত্বাবী রহি. المقتدر শব্দের অর্থ করতে গিয়ে বলেন,
المقتدر هو التام القدرة الذي لا يمتنع عليه شيء ولا يحتجز عنه بمنعة وقوة
যিনি সর্বশক্তিমান, যাকে কোন কিছুই বাধা দিতে পারেনা, আর কোনো কিছুই তাকে বাধা ও শক্তি প্রয়োগ করতঃ প্রতিরোধ করতে পারে না। -শুয়াবুল ঈমান (বাইহাকী) : পৃ. ২২৫
এইরূপ আরও বহু আয়াতে আল্লাহপাক নিজের শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে আল্লাহ তাআলা নিজের শানে স্বয়ং এমন পরাক্রমের পরিচয় দিয়েছেন, সেখানে সামান্য ইবলিস মহান আল্লাহ সামান্য একটি মাখলুক হয়ে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত করার আদৌ ক্ষমতা রাখে কী? এটা কী উদ্ভট বিষয় ন্য?
সৃষ্টির অবাধ্যতা স্রষ্টার রাজত্ব হ্রাস করে না :
সকল মাখলুক আল্লাহ-র হুকুম পালন করলে, যেমন তাঁর রাজত্বে কোনো বৃদ্ধি আসে না, ঠিক তেমনি সমগ্র মাখলুক তাঁর হুকুম প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁর রাজত্বে কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
إِن تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنكُمْ
তোমরা কুফর অবলম্বন করলে, নিশ্চিত জেনে রেখো আল্লাহ তোমাদের কারও মুখাপেক্ষী নন। -সুরা যুমার : ৭
وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
কেউ (এটা) অস্বীকার করলে, আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ হতে বেনিয়ায (অমুখাপেক্ষী) । -সুরা আলে ইমরান : ৯৭
وَقَالَ مُوسَىٰ إِن تَكْفُرُوا أَنتُمْ وَمَن فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا فَإِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ حَمِيدٌ
এবং মূসা বলেছিলো, তোমরা এবং পৃথিবীতে বসবাসকারী সকলেই যদি অকৃতজ্ঞতা করো, তবে (আল্লাহর কোনও ক্ষতি নেই। কেননা) আল্লাহ অতি বেনিয়ায, তিনি আপনিই প্রশংসার উপযুক্ত। -সুরা ইবরাহীম : ৮
উপরন্তু বিষয়টি হাদিসে কুদসিতে আরও স্পষ্ট করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذَلِكَ فِي مُلْكِي شَيْئًا يَا عِبَادِي لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مَا نقص ذلِكَ مِنْ مُلْكِي شَيْئًا
হে আমার বান্দারা, তোমাদের আদি-অন্ত, তোমাদের মানুষ ও জিন জাতির মধ্যে যার অন্তর আমাকে সবচাইতে বেশি ভয় পায়, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও, তাতে আমার রাজত্ব একটুও বৃদ্ধি পাবে না। হে আমার বান্দাগণ, তোমাদের আদি-অন্ত, তোমাদের সকল মানুষ ও জিন জাতির মধ্যে যার অন্তর সবচাইতে পাপিষ্ঠ, তোমরা সবাই যদি তার মতো হয়ে যাও, তাহলে আমার রাজত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পাবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৫৭৭
প্রিয় পাঠক, কুরআন-হাদিসের এমন সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, গোটা দুনিয়ার সকল মানুষও যদি কুফুরী করে তাহলেও আল্লাহ -র রাজত্বে কোনও কমতি আসে না। এমতাবস্থায় ‘বর্তমানে পৃথিবিতে আল্লাহর হুকুম কায়েম নেই’ এই অজুহাতে ইবলিসকে জয়ী এবং আল্লাহ তাআলাকে পরাজিত সাব্যস্ত করা কুফুরির শামিল। তাওহীদের দল বলে দাবিদার হেযবুত তওহীদের নিজেদের তাওহীদেরই যদি এমন বেহাল দশা হয়, তবে আর এই নামের যথার্থতা কোথায় রইল?
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৬ষ্ঠ পর্ব)
তাওরাত সম্পর্কে পৌলের অভিমত কিন্তু সেন্ট পৌলের অভিমত এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি তাওরাতকে একখানি বাতিল ...
খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ (৫ম পর্ব)
শূলবি দ্ধ হওয়ার বিশ্বাস হযরত ঈসা (আ)-এর সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস হল, ইহুদীরা তাঁকে পন্থীয় পী...
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র মুসলিম উম্মাহর করণীয়
কুরআন-হাদীসে ইয়াহুদী-খ্রিস্টানের পরিচয় ইয়াহুদী জাতি পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি। আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আ...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন