প্রবন্ধ
(আম্মাজান আয়েশা রা.এর পবিত্রতম বিবাহ, পারিবারিক জীবন , রাসূলের বয়স পার্থক্য ও বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তির নিরসন)
বিবাহের সূচনা..
গভীর ঘুমে রহমতের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। স্বপ্নে এলেন এক ফেরেশতা। তার হাতে এক খণ্ড রেশমি রুমাল । ধরে আছেন রাসুলের চোখের সামনে। ফেরেশতার চোখেও আনন্দ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি এটা? ফেরেশতা মুসকি হেসে বিনয়ী হয়ে বললেন, নিজ হাতে সরিয়ে দেখুন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা সরাতেই দেখেন অঙ্কিত এক ছবি। ছোট্ট এক বালিকার মুখচ্ছবি। এ তো প্রিয় বন্ধু আবু বকর-তনয়া আয়েশার মুখচ্ছবি। এ ছবি কেন ? তার আকৃতি আমাকে দেখানো হচ্ছে কেন?
বলা হল. 'এ-ই সেই সৌভাগ্যবতী মেয়ের মুখচ্ছবি, যে এ জনম এবং পর জনমেও আপনার স্ত্রী হবে। হবে প্রিয়দের মাঝে আপনার প্রিয়তমা'।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে জেগে উঠেন। মনের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব?
দ্বিতীয় রাতে স্বপ্নে আবার এলেন সেই ফেরেশতা। রাসূলকে নিশ্চয়তা দিতে। রাসূলকে সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে নিবৃত্তি দিতে। আজ তিনি আবার রাসুলের সামনে মেলে ধরলেন রেশমী রুমাল। সেই একই মুখচ্ছবি। একই স্বপ্ন। একই ওহী। একই ফেরেশতা রবের পক্ষ থেকে নিয়ে এলেন আম্মাজান আয়েশা রা. এর বিবাহের পয়গাম। এখন আর রাসূলের মনে দ্বিধা নেই। হৃদয়ে জমে ওঠা কোন শংকা নেই। নবীগণের স্বপ্নও ওহী । তিনি স্থির হলেন' এ ফায়সালা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে তাহলে আমি সাদরে গ্রহণ করে নিলাম এ মোবারক পয়গাম'।
অপর দিকে খাওলা বিনতে হাকীম। প্রখ্যাত সাহাবী ওসমান ইবনে মাজুনের স্ত্রী। যিনি খাদিজা রা. এর অন্তরঙ্গ বান্ধবী ছিলেন। খাদিজা রা. মারা যাওয়ার পর রাসূলের জন্য সাওদা রা.ও আয়েশা রা. এর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসা সৌভাগ্যবান নারী। তিনি খুব ভালোভাবেই সফল। আবু বকর রা. যখন রাসুলের জন্য আয়েশা রা-এর বিবাহের প্রস্তাব শুনেন তিনি অনেক খুশি হোন তবে বেশ বিষন্নও হয়ে ওঠেন। কারণ কিছুদিন আগেই তার এই কন্যা বয়সে ছোট হলেও মূতঈম ইবনে আদি নিজ ছেলে জুবায়ের ইবনে মুতঈমের জন্য পুত্রবধূ করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। আবু বকর রা.ও তার সে প্রস্তাবের সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। অবশ্য তদানীন্তন আরবে সামাজিকভাবে বিবাহের উপযুক্ত বয়স অনেকটা এমনই ছিলো। এ জন্য বয়স নিয়ে কোন ভাবনা নেই। ভাবনা হলো কিছু দিন পূর্বে মুতঈম ইবনে আদিকে বিবাহের কথা দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে। তাই তিনি রাসুলের প্রস্তাব পাওয়ার পর সরাসরি চলে যান মুতঈম ইবনে আদির বাড়িতে। জানতে চান তাদের চূড়ান্ত অভিমত?
মুতঈম ইবনে আদির স্ত্রী উম্মে ফাতার স্পষ্ট কথা,
ইবনে কুহাফা! এখন আমরা তোমার মেয়েকে আমাদের ছেলের বউ করে আনতে পারব না। তুমি আর তোমার মেয়ে তো ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করেছো। সে আমাদের ঘরে এলে আমাদের ছেলেকেও মুসলিম বানিয়ে ছাড়বে। সেটা আমি কখনোই হতে দিতে পারি না। আবু বকর রা. পুরাই নিশ্চিত হতে চাইলেন তিনি বলেন, ইবনে আদি! তুমি ছেলের পিতা, তোমার কি অভিমত? মুতঈম হয়তো ভেবেছিলেন তাদের অস্বীকৃতি শুনে আবু বকর রা. নিদারুণ কষ্ট পাবেন। ব্যথিত মন নিয়ে ফিরে যাবেন।
কিন্তু তারা ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারেননি তাদের না সূচক জবাব শুনে আবু বকর রা. কতোটা আনন্দিত হয়েছেন। মন থেকে কতোটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। এবং এখন তিনি শুধু 'না জবাব' শুনার জন্যই এসেছেন।
জবাব শুনে তিনি সেখানে আর এক মুহূর্তও দেরি করেননি। বাড়ির পথ ধরেন। বস্তুত যে বিয়ের বাগদান স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তার বাঁধা প্রদান করবে এমন সাধ্য কার?
রাসুলের সঙ্গে আম্মাজান আয়েশার বিবাহের সূচনাটা এভাবেই সম্পন্ন হয়। আর এই বিবাহ যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রিয় বন্ধুর এক অনন্য উপহার। অনাগত পৃথিবীর মানুষের জন্য হবে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র ভালোবাসার এক অমর উপাখ্যান। এ কথা হয়তো বুঝেছিলেন বলেই হযরত আবু বকর রা. এতোটা আনন্দিত। কেননা এই বন্ধনের মাধ্যমেই আজকের এই ছোট্ট ছয় বছর বয়সী আয়েশা রা. রাসূলের সংস্পর্শে হয়ে ওঠবেন মহাসৌভাগ্যের অধিকারী। রাসূলের প্রিয়তমা স্ত্রীদের অন্যতম। ছোট্ট সময় থেকেই উম্মুল মুমিনীন। উম্মাহর এক অনন্য মহাসম্পদ। যার বদৌলতেই উম্মাহ লাভ করবে তাইয়াম্মুমের বিধান। যার নির্দেশিকা ও দোষ মুক্তির সনদ নিয়ে জিবরীল আমীন স্বয়ং নেমে আসবেন সপ্তাকাশ থেকে। আর চারিত্রিক পাক-পবিত্রতা বর্ণনায় অবতীর্ণ হবে কুরআনের একাধিক আয়াত। যিনি হবেন মাত্র নয় বছরের সুহবতে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাত সাহাবীর একজন । আর রাসূলের ইন্তেকালের পর তিনি যখন কোন মাসআলার ব্যাপারে মতামত পেশ করবেন তখন সমগ্র মুসলিম সালতানাতে তার বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস কেউ পাবেনা। হযরত আবু হুরায়রা রা. ইবনে ওমর রা. ইবনে আব্বাস রা. আবু সাঈদ খুদরী রা. ও হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. এর মতো বিজ্ঞ সাহাবীগনও যার রায়কে বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিবেন। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিশালতাকে সকলেই সমীহ করবেন। একজন উম্মুল মুমিনীন হওয়ার পাশাপাশি তিনি হয়ে উঠবেন উম্মাহর সবচেয়ে বিজ্ঞ নারী ধর্মবেত্তা।
প্রিয় পাঠক!
আম্মাজান আয়েশা রা. বয়সে ছোট হলেও তিনি ছিলেন গুণধর, প্রচন্ড মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পন্ন, স্বতন্ত্র বোধ ও সক্ষমতার অধিকারী এবং উম্মাহর অমূল্য রত্ন এক মহিয়সী রমনী। তার ইচ্ছার বিপরীত জোর পূর্বক কিছু করা হবে বা সম্মতির বাইরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়া হবে আর তিনি তা মুখ বুজে সয়ে নিবেন। এমনটি কোনভাবেই সম্ভব নয়।
সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে এবিষয় বিস্তারিত তুলে ধরা কখনোই সম্ভব নয়। তাই সেই বিষয়টি এড়িয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. এর বিবাহ পরবর্তী পারিবারিক সৌন্দর্যের কিছু চিত্র তুলে ধরছি।
পারাবারিক সৌন্দর্য...
আম্মাজান আয়েশা রা. কে নয় বছর বয়সে নবী কারীম নিজ ঘরে তুলে আনেন। ঘর বলতে সুউচ্চ শানদার কোন অট্টালিকা নয় বরং বনু নিজারের মহল্লায় মসজিদে নববীর পাশে ছোট ছোট মাটির ও খেজুর পাতার ছাউনী ঘেরা অনেক হুজরা ছিল এগুলোরই একটি ছিল আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. এর বাসস্থান।
আসবাবপত্র বলতে চৌকি, চাটাই, বিছানা, বালিশ, খেজুর ও জব রাখার দুই একটা পাত্র, জগ-মগ এর বেশি কিছু না। রাতের পর রাত পার হয়ে যেত ঘরে আলো জ্বলতো না। তবুও সত্যিকার অর্থে সেই ঘরটাই ছিল পৃথিবী ও তামাম পৃথিবীবাসীর আলোর উৎস।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত আয়েশা রা. এর বহমান দাম্পত্য জীবনই তার প্রমাণ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
অর্থ: তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে ভালো মানুষ যে তার স্ত্রীর কাছেও সবচেয়ে ভালো মানুষ। আর আমি আমার স্ত্রীর কাছেও সবচেয়ে ভালো মানুষ।
রাসূলের এই বক্তব্যের যথার্থতা পাওয়া যায় হযরত আয়েশা রা. এর সঙ্গে তার দীর্ঘ নয় বছরের পবিত্র দাম্পত্য জীবন থেকে।
এতোদিনের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে (ঈলার ঘটনা ছাড়া) পারস্পরিক মনোমালিন্যের একটি ঘটনাও ঘটেনি।
সব সময় স্নেহ, মায়া, মমতা ভালোবাসা ও আন্তরিকতার চূড়ান্ত মধুর সম্পর্ক ছিল।
হযরত আমর ইবনুল আস যখন গাজওয়ায়ে সুলাসিল থেকে ফিরে এলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন, আয়েশাকে। হযরত আমর আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! প্রশ্ন পুরুষদের ব্যাপারে । রাসূল বলেন, আয়েশার পিতাকে।
কোন এক সফরে হযরত আয়েশা রা. এর সওয়ারী অনিয়ন্ত্রিত হয়ে একদিকে ছুট দেয় রাসুল এতোটাই পেরেশান হোন তার পবিত্র জবান থেকে বের হয়েগেল- ! وا عروساه হায় হায় আমার স্ত্রীর কি হবে?
রাসুল স্বামী হিসেবে স্ত্রীর প্রতি কতোটা যত্নশীল ছিলেন নিম্নোক্ত ঘটনাগুলো থেকেও তা সহজেই অনুমেয় হয়। স্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য মাঝেমধ্যে তিনি গল্পও বলতেন। একবার কথা প্রসঙ্গে খুরাফার নাম উঠলো। রাসূল বলেন জানো ! খুরাফা কে?
খুরাফা উজ্জা গোত্রের এক নামকরা লোক ছিল। খুরাফাকে জিনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। জিনদের দেশে গিয়ে সে যেসব আশ্চর্য জিনিস দেখেছিল। ফিরে এসে লোকদেরকে সেগুলোই সে বলতো। এজন্যই লোকেরা আশ্চর্য কিছু শুনলে বলতো, এতো খুরাফার গল্প। তারপর সেই এগার স্ত্রীর নিজেদের স্বামীর ভালোবাসা ও আলাপচারিতার দীর্ঘ এক গল্প স্ত্রীদের সামনে তুলে ধরেন। শেষে বলেন, আয়েশা! আবু জারা উম্মে জারার জন্য যেমন ছিল আমি তোমার জন্য তেমনই। তাইনা?
একবার ঈদের দিন। কতিপয় হাবশি সাহাবী অস্ত্রের মহড়া করছিলেন। হযরত আয়েশা দেখার আগ্রহ করেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর আয়েশা পিছনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে উচিয়ে দেখছিলেন। রাসূল সা. ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন যতক্ষণ না আয়েশার দেখা শেষ হলো।
কোন এক যুদ্ধে হযরত আয়েশা রা. সফরসঙ্গী ছিলেন। রাসূল সা বললেন, চলো দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আয়েশা রা. হালকা পাতলা ছিলেন তিনি আগে চলে গেলেন। কয়েক বছর পর প্রতিযোগিতা করার আরো একটা সুযোগ এলো। আয়েশা রা. তখন কিছুটা ভারী হয়ে গিয়েছিলেন। এবারের দৌড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লাম আগে চলে গেলেন তখন তিনি বলেন, আয়েশা! এটা সেটার জবাব।
রাসূল কস্মিনকালেও পারিবারিক জীবনটাকে যান্ত্রিক জীবনে পরিণত করেননি। দাম্পত্য জীবনে ছিল যথেষ্ট আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা , পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা। পারস্পরিক মুহাব্বত ও তৃপ্তি বোধের গভীরতা এসব ঘটনা থেকেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একবার রাসুল ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদে নববীর দিকে যাচ্ছিলেন। আয়েশা রা. রসিকতা করে পিছন থেকে রাসুলের শরীরে পানি ছিটিয়ে দিলেন। রাসুলও দেরী করেননি। আরেকটি পাত্র থেকে পানি নিয়ে আয়েশার শরীরে দিয়ে দিলেন।
দুজনের এমন খুনসুটিতে দুজনই হেসে উঠেন। হাসতে হাসতে রাসুল বলেন, দেখো আয়েশা! আমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করিনি বরং বদলা নিয়েছি। আর বদলা নেওয়ার ব্যাপারে তো কুরআন শরীফেই বলা আছে।
কিতাবে তো এমনটাও বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই হযরত আয়েশাকে সঙ্গে নিয়ে এক পাত্রে খাবার খেতেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে আয়েশা রা. যে হাড্ডি মুখে নিতেন রাসূলও সেই হাড্ডি মুখে নিতেন। আয়েশা রা পাত্রের যেখানে মুখ লাগাতেন রাসুলও সেই অংশে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন।
মোটকথা, রাসূল সা. পুরো দাম্পত্য জীবনে হযরত আয়েশা রা. কে এতোটা ভালোবাসেন যে, মৃত্যুর সময় হযরত আয়েশার ঘরেই হযরত আয়েশার কোলে মাথা রেখে আপন প্রভুর সমীপে আত্ম নিবেদন করেন। তাইতো রাসূল দুআ করতেন, হে আল্লাহ! যা আমার নিয়ন্ত্রণে অর্থাৎ স্ত্রীগণের প্রতি আচার ব্যবহার ও লেনদেন, তাতে অবশ্যই সমতা বিধান করি। কিন্তু যা আমার নিয়ন্ত্রণে নয় অর্থাৎ আয়েশার প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা তাতে আমাকে ক্ষমা করো।
রাসূল সা.বলেন. পুরুষদের মধ্যে অনেকেই কামেল হয়েছেন। কিন্তু নারীদের মধ্যে কামেল হয়েছেন শুধু ইমরান নাতনি মারিয়াম আ. ও ফেরাউন পত্নী আসিয়া রা.। নিঃসন্দেহে সকল খাদ্যের ভিতর সারীদ যেমন শ্রেষ্ঠ তেমনি সকল নারীর উপর আয়েশা রা. শ্রেষ্ঠ।
মূলত এসব কারণেই আম্মাজান আয়েশা রা রাসূলের কাছে ছিলেন এতোটা প্রিয়। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ছিলেন আম্মাজান আয়েশা রা এর কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং সর্বোচ্চ ভালোবাসার পাত্র।
রাসূলের প্রতি ভালোবাসা...
এতো ছিল হযরত আয়েশা রা. এর প্রতি রাসূলের সীমাহীন ভালবাসার মাত্র কয়েকটি চিত্র তেমনি রাসুলের প্রতি হযরত আয়েশার ভালোবাসার দাস্তানও অনেক লম্বা এবং দীর্ঘ। নিচে সামান্য তুলে ধরছি।
হযরত আয়েশা রা.ও রাসূলকে এতোটা বেশি ভালবাসতেন যে, সেটা শুধু ভালোবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না রাসুলের প্রতি তার ভীষণ অনুরাগ এবং প্রচন্ডরকম ঈর্শনীয় আসক্তিতেও পরিণত হয়ে ছিল। অন্য কেউ রাসূলকে ভালোবাসার কথা বললেও তিনি ভীষণ কষ্ট পেতেন।
পবিত্র স্ত্রীগনের প্রতি তার খুব নজর থাকতো। কখনো এমন হতো যে রাতে ঘুম ভেঙ্গেছে। দেখেন রাসুল পাশে নেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। একবার রাতে ঘুম ভেঙে গেলে রাসুলকে পেলেন না। ঘর অন্ধকার। এদিক সেদিক হাতড়াতে থাকেন। অবশেষে রাসুলের কদম মোবারকে হাত পড়ল । রাসূল সা. তখন সেজদাবনত।
আরো একবার রাসূলকে পাওয়া যাচ্ছিল না। মনে করলেন হয়তো অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। উঠে এদিক সেদিক দেখতে থাকেন। পরে বুঝলেন, তিনি তাসবীহ পড়ছেন। হযরত আয়েশা রা. মনে মনে খুব লজ্জিত হলেন। অবচেতন মনে বললেন, আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক। আমি কোন ধ্যানে ছিলাম আর আপনি কোন ধ্যানে আছেন। আর এক রাতে তো প্রিয়তম রাসূলের খোঁজে গোরস্থান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন।
এক সফরে আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. হাফসা রা.এর সাথে রাসুলের থাকার বিষয় নিয়ে হাওদা (উটের পিঠের আসন) বদলা-বদলি করেছিলেন। রাসূল সা. হযরত আয়েশা রা. এর হাওদা মনে করে হযরত হাফসা রা. এর হাওদায় চলে গেলেন। এদিকে হযরত আয়েশা রা. অধীর আগ্রহে বসে আছেন আর রাসূল সা. তো হযরত হাফসার হাওদায় চলে গিয়েছেন। কাফেলা থামল। হযরত আয়েশা রা. আর ধৈর্য ধরতে পারেননি। হাওদা থেকে নেমে পড়েন। দুই পা ঘাসের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বলতে থাকেন, আল্লাহ! আমি তো ওনাকে কিছু বলতে পারব না কিন্তু তুমি তো একটা সাপ বা বিচ্ছু পাঠাতে পারো। একটা সাপ বা বিচ্ছু পাঠাও এসে আমার পায়ে কামড় দিয়ে দিক।
দেখুন. এই অভিব্যক্তিতে কতোটা তীব্রভাবে স্বামীর প্রতি নারী মনের ভালোবাসা ও পবিত্রতার সাবলীল চিত্র ফুটে উঠেছে।
ইলার ঘটনায়ও এমনই দেখা যায়।
তাছাড়া রাসুল প্রায়ই হযরত আয়েশার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তেন। এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ আবু বকর রা. কোনো কারণে রাগান্বিত হয়ে ঘরে এসে মেয়েকে সজোরে খোঁচা মারেন। হযরত আয়েশা বলেন, আমি শুধু এজন্য নড়ে উঠিনি যে রাসূলের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। ভালোবাসা মহব্বত এবং শ্রদ্ধাবোধ কতোটা গভীর হলে এটা সম্ভব।
প্রায়ই বিভিন্ন প্রসঙ্গে রাসূল সা. খাদিজার কথা বলতেন। অন্য স্ত্রীগণও এতে কষ্ট পেতেন। একবার তিনি খাদীজার কথা বলছিলেন। হযরত আয়েশা সহ্য করতে না পেরে বলে উঠেন, আপনি কি ওই বুড়ির কথা ছাড়বেন?
আল্লাহ তো আপনাকে আরো ভালো ভালো স্ত্রী দান করেছেন।
আরেকবার হযরত আয়েশা রা. এর মাথা ব্যথা ছিল। তিনি আয়েশা রা.কে বললেন যদি তুমি আমার জীবদ্দশায় মারা যাও তাহলে নিজ হাতে তোমাকে দাফন কাফন দিব।
এই হাত দুটো তুলে আল্লাহর কাছে তোমার জন্য দুআ করব। হযরত আয়েশা রা, মর্মটা পুরোপুরি বুঝে ওঠেননি। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার মৃত্যু কামনা করছেন?
আমি মারা যাই তাহলে এই ঘরে বুঝি নতুন স্ত্রী আনবেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম হেঁসে উঠলেন।
রাসূলের প্রতি হযরত আয়েশা রা. এর অসম্ভব রকম ভালোবাসা ছিল। রাসুল যেটা যখন যেভাবে করতেন তিনিও সেটা সেভাবেই করতেন। রাসুলের চাশতের নামাজ পড়া দেখে তিনিও নিয়মিত চাশতের নামাজ পড়তেন। তিনি বলেন, যদি আমার পিতাও কবর থেকে উঠে আসেন আর এই নামাজ পড়তে নিষেধ করেন তবুও আমি এ নামাজ ছাড়বো না এবং তার কথা মানবো না।
একবার তিনি আরাফার দিন রোজা রেখেছিলেন এত বেশি গরম পড়েছিল বারবার মাথায় পানি ঢালতে হচ্ছিল। কেউ বললেন,আজ না হয় রোজা ভেঙে ফেলুন। তিনি বললেন, রাসুলের মুখে শুনেছি আরাফার দিন রোজা রাখলে সারা বছরের গুনাহ মাফ হয় তাহলে কেমন করে রোজা ভাঙবো?
অনিয়মিতভাবে রাসূল যে নামাজগুলো পড়তেন যেমন, সূর্য গ্রহণের নামাজ তাতেও হযরত আয়েশা শরীক থাকতেন। এমনকি মসজিদে নববীতে রাসূল সা. নামাজ পড়ানোর জন্য যখন দাঁড়াতেন তখন তিনিও ঘরের ভেতর নামাজের নিয়ত করতেন।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও তাহাজ্জুদ তো পড়তেনই রাসুলকে দেখে চাশতের নামাজও ছাড়তেন না।
প্রায়ই রোজা রাখতেন কখনো দুজনে মিলে একসঙ্গে রোজা রাখতেন। রমাযানে রাসূল সা. মসজিদে ইতিকাফে বসতেন আর আম্মাজান আয়েশা রা. মসজিদের আঙ্গিনায় তাবু টানিয়ে ইতিকাফে বসতেন।
তো আম্মাজান আয়েশা রা. স্বভাবজাত ভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে কথা , কাজ ও প্রতিটি স্পন্দনে রাসূল সা. কে মান্য করে অনুসরণ ও অনুকরণ করেছেন। সর্বোচ্চ ভালোবেসেছেন এবং অকৃত্রিম সে ভালোবাসা প্রদর্শনও করেছেন।
সুপ্রিয় পাঠক!
আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. এর বিবাহ ও পারিবারিক সৌন্দর্যের উপরোক্ত বিবরণ পাঠের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বয়স পার্থক্য নিয়ে কোন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করা একেবারেই অযৌক্তিক ও সম্পূর্ণ অবান্তর এবং চরম মিথ্যাচার ব্যতীত আর কিছুই হবে না। ইসলাম বিষয়ে প্রচন্ড রকম অজ্ঞ-মূর্খ এবং ইসলাম বিদ্বেষী জাহেল নাস্তিক ব্যতীত ভিন্ন কেউ এসব প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না। যার দরুন আমরা দেখতে পাই ১৯০৫ সালের আগ পর্যন্ত মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে আয়েশা রা. এর বিয়ের বয়স বিষয়ক কোন ইস্যুই ছিলো না। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ লেখক ডেভিড স্যামুয়েল মারগুলিউস তার "Mohammed and the Rise of Islam" বইতে সর্বপ্রথম এটা নিয়ে জল ঘোলা করেন। কারণ, এর আগে এটা সবার কাছে একদম স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোর শত্রু মক্কার কাফের আর মদীনার অভিশপ্ত ইহুদী সম্প্রদায়ও কখনো নারী লোভী বা শিশুকামী জাতীয় চারিত্রিক স্খলনের কোন অভিযোগ করেনি এবং করতেও পারেনি। তারা তাঁকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। যখন তাদের সংস্কৃতিতে অবৈধ যৌনাচার একদম স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল তখনও তারা রাসূলকে কোন নারীর নিকট কখনো গমন করতে দেখেনি বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গমন করেননি। তাছাড়া মক্কার সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ হয়েও এবং সর্বোচ্চ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোন কুমারী বা অল্প বয়সী নারীকে বিবাহ না করে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন ৪০ বছর বয়সী খাদিজা রা.কে। খাদিজা রা. এর মৃত্যু পর্যন্ত তার সাথে ঘর করেছেন একটানা পঁচিশ বছর এরপর বিয়ে করেন ৫০ বছর বয়সী সাওদা রা.কে। তারপর আল্লাহর নির্দেশেই বিয়ে করেন ৬ বছর বয়সী আয়েশা রা.কে। আজ হাজার বছর পার হয়ে গেলেও বিবাহের বয়স পার্থক্য নিয়ে কোন গোস্তাখে রাসূল কোন ধরনের আপত্তি করেনি। অথচ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হলে সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার হলো তাকে চারিত্রিক স্খলনের কোন অভিযোগে অভিযুক্ত করা। কিন্তু মক্কার কাফের সম্প্রদায়ও এমন অবাস্তব এবং উদ্ভট প্রশ্ন উত্থাপন করে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা হারাতে চায়নি। বা তারা হয়তো কখনো কল্পনাও করতে পারেনি যে, প্রায় হাজার পর তাদের কোন অবৈধ গণ্ডমূর্খ সন্তান তাদের মিশন বাস্তবায়নে এসব বিষয়ে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে ।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কিছু নামধারী মুসলিমরাও কখনো বলার চেষ্টা করে রাসূল সা. কম বয়সী আয়েশা রা.কে বিয়ে করে ঠিক কাজ করেননি (আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি)। অথচ স্বয়ং আল্লাহর সরাসরি নির্দেশে তিনি আয়েশা রা.কে বিবাহ করেন এবং স্বয়ং আয়েশা রা.এর সম্মতি ও পিতা-মাতার স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ এবং সম্পূর্ণ সামাজিকভাবেই প্রকাশ্যে বিবাহের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয়েছিল এবং এতে রাসূলের জানের দুশমন কট্টর কাফেররা পর্যন্ত কোন অভিযোগ কিংবা আপত্তি তোলেনি। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে পারিবারিকভাবেই জুবায়ের ইবনে মুতঈম রা. (তিনি তখনো ইসলাম কবুল করেননি) এর সঙ্গে হযরত আয়েশা রা. এর বিবাহের যে সিদ্ধান্ত ছিল যা আয়েশা রা. ইসলাম কবুল করায় ছেলের পরিবার তা বাতিল করে দিয়েছিল (যা প্রবন্ধের শুরুতেই আমরা অবগত হয়েছি)। এই ছেলের পরিবারও কখনও কাফের হাওয়া সত্বেও আয়েশা রা এর বিবাহ বিষয়ক রাসূলের বিপক্ষে কোন আপত্তি করেনি। তো তাদের কারো কাছেই আয়েশা রা. বিবাহের উপযুক্ত বয়সে উপনীত হয়েছেন কিনা বা তিনি সংসারের জন্য উপযোগী ছিলেন কিনা অথবা বয়ঃসন্ধির সময় হয়েছিল কিনা এসব বিষয় নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিলনা বা তারা এসব কিছুকেই বিবাহের অন্তরায়ও মনে করেননি। সেখানে হাজার বছর পর যখন ভোগলিক অবস্থানের ভিন্নতা, সামাজিক জীবন যাপনের বৈচিত্র্য, মানুষের শারীরিক ও মানসিক চাহিদার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী তখন সেই হাজার বছর পূর্বের একটি স্বীকৃত ও সমাদৃত বিষয়ে আপত্তি তুলে ধরা এক পর্যায়ের মস্তিষ্ক বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া আম্মাজান আয়েশা রা. রাসুলের ঘরে আসার পূর্বেই বয়োঃসন্ধিতে পৌঁছে ছিলেন। আম্মাজান আয়েশা রা. নিজেই বলেছেন ”কোনো বালিকা নয় বছরে পদার্পন করলে সে ইমরাআ’ (امْرَأَةٌ) অর্থাৎ মহিলা (স্ত্রী) বলে গণ্য হবে।”
এই সরল স্বীকারোক্তির দ্বারা স্পষ্টতই বোঝা যায়। সেই সময়ে বয়ঃসন্ধির বয়স ছিলো খুবই অল্প।
আম্মাজান আয়েশা রা. বর্ণনা করেন: বয়ঃসন্ধিকালে আমি আমার পিতামাতাকে ইসলাম অনুসরণ করতে দেখেছি। বুখারীর হাদীসে এসেছে’ আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ছয় বছর বয়সে আমাকে বিবাহ করেন। অতঃপর আমরা হিজরত করে মাদীনায় চলে এলাম এবং হারিস ইবনুল খাযরাজ গোত্রে আশ্রয় নিলাম। এখানে আমি জ্বরে আক্রান্ত হলে আমার মাথার চুল উঠে যায় এবং অল্প কিছু চুল অবশিষ্ট থাকে।
এই বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, আয়েশা রা. রাসুলের সাথে বিবাহের পূর্বেই বয়সঃসন্ধিতে পৌছেছিলেন।
হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী হঠাৎ করেই আয়েশা রা. এর চুল উঠে যায়। সাধারণ চুলপড়া বা অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া হয় বয়সঃসন্ধির পরে। সুতরাং স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে উক্ত সময়ে আয়েশা রা. বয়সঃসন্ধিতে পৌছেছিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো বর্ণনায় জ্বরের কথা এসেছে বলে জ্বরেই চুল পড়ে গেছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই, কেননা জ্বরের ফলে সাধারণত চুল পড়েনা বরং মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়ার ফলেই চুল পড়ে যায়।
সে সময়ের আরব অঞ্চলের জলবায়ু, লোকজন সম্পর্কে জানা যায় যে ৯ বছরে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানো খুবই স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো।
আব্বাদ ইবনে আব্বাদ আল-মুহলবি বলেছেন, “আমি মুহলাবাহতে একজন মহিলাকে দেখেছি যিনি ১৮ বছর বয়সে নানি হয়েছেন। তিনি তার নয় বছর বয়সে জন্মদান করেছেন (তার মেয়েকে) এবং তার মেয়ে তার সন্তানকে জন্ম দিয়েছে নয় বছর বয়সে, এভাবেই সেই মহিলা ১৮ বছরে নানি হয়ে গিয়েছেন।"
কিছু জার্মান গাইনোকলজিস্ট তাদের পর্যবেক্ষণলব্ধ উপাত্ত উল্লেখ করেছেন এভাবে, শৈত্য অঞ্চলের মেয়েদের ঋতু শুরু হয় গড়ে ১৪ বছর বয়সে, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ১২-১৩ বছর বয়সে, উষ্ণ অঞ্চলে ৮-১০বছর বয়সে ।
২০১৬ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে “এটি উপসংহারে পৌঁছেছে যে জলবায়ু মেনার্চে বয়সের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে কারণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য খাদ্য শক্তির গ্রহণ বাড়ায়”
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে উষ্ণ অঞ্চলে বয়ঃসন্ধির বয়স বর্তমান সময়েও কম পাওয়া যাচ্ছে পূর্বে তা আরও কম ছিলো। সুতরাং সেই প্রায় দেড় হাজার বছর আগের সময়কার নারীদের ক্ষেত্রে ৬-৯ বছরের মধ্যে বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা অসম্ভব কিছু নয়।
আজকের সমাজ, প্রেক্ষাপট এসকল কিছু পূর্বের সময়ের সাথে একই স্টেজে ছিলো না। যেমন, দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে আরবের বাইরে বিবাহের বৈধ বয়স ছিল (বাইজেন্টাইন এবং সাসানিদের সাম্রাজ্য) ছেলেদের জন্য ১৪ বছর এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে মেয়েদের জন্য ১২ বছর এবং সাসানিদের ক্ষেত্রে মেয়েদের আইনি বয়স প্রায় ১৫ বছর বা কখন কখন তারও কম। ফ্রান্সিস বেকনের যখন অ্যালিস বার্নহ্যাম এর সাথে বিয়ে হয়েছিল তখন বেকন চল্লিশ বছর বয়সী আর আলিস এর বয়স তখন মাত্র ১২ বছর ছিল। আর ইসাবেলা ভালোয়া এর যখন রিচার্ড দ্যা সেকেন্ড এর সাথে বিয়ে হয় তখন ইসাবেলা এর মাত্র ৫/৬ বছর ছিল আর রিচার্ড এর তখন ২৯ বা ৩০ বছর বয়স ছিল।। এমনকি ১ থেকে ১.৫ শ বছর আগেও ক্যাথোলিক চার্চ মেয়েদের বেট্রোথাল এজ বা বাগদানের বয়স মাত্র ৭ বছর করেছিল।
বেশিদূর যাওয়া লাগবে না, রবীন্দ্রানাথ এর বিয়েও মৃণালীণী দেবীর সাথে যখন হয়েছিল তখন মৃণালীণীর মাত্র ৯ বছর ছিল। আপনার দাদি কিংবা নানী বেঁচে থাকলে তাদের জিজ্ঞেস করুন তাদের কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। সম্ভব হলে তাদের কাছ থেকে জেনে নিন আপনার বড় দাদী এবং বড় নানীর বিয়ে কত বছর বয়সে হয়েছিল দেখবেন বয়সটা ৯/১৫ বছরের বেশি না।
এছাড়াও আপনি যত পূর্বের ইতিহাস ঘেটে দেখবেন দেখতে পাবেন হিস্টোরিক্যালি বয়ঃসন্ধির সময়, বিয়ের সময় এসবের মধ্যে বর্তমান সময়ের, কালচারের পার্থক্য ব্যাপক। অল্প সময়ে বিয়ে হওয়া, সন্তানের মা হওয়া এসব বিষয় তখনকার সময়ে ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটের নানান কালচারাল সমস্যা দেখিয়ে বর্তমানের প্রেক্ষাপটের কোনো সমস্যা অতীতের ঘটনার উপর এপ্লাই করা মস্তিষ্ক বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিষয়টা অনেকটা এমন' বর্তমান সময়ের কোন একটা জমির মূল্য পারিপার্শ্বিক উন্নতি ও বৈষয়িক পরিবর্তনের দরুন যদি কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় আর সেটার উপর নির্ভর করে আপনি অভিযোগ উত্থাপন করে সমালোচনা করেন যে, আপনার দাদা কেন সেই একই জমি আজ থেকে একশত বছর পূর্বে মাত্র একশত টাকা বিক্রি করেছিলেন? এটা যেমন নির্বুদ্ধিতা এবং মূর্খতা ঠিক তেমনি বর্তমান সময়ের পরিবর্তিত সমাজের মানসিকতার উপর নির্ভর করে দেড় হাজার বছর পূর্বের সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম নয় বা দশ বছর বয়সে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার উপর আপত্তি করার নামান্তর।
আর কেউ যদি মনে করেন আম্মাজান আয়েশা রা.এর প্রতি রাসূলের ভালোবাসার কারণ হয়তো তার সৌন্দর্য হবে। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল। পবিত্র স্ত্রীগনের মধ্যে হযরত জয়নাব রা. জুয়াইরিয়া রা. সাফিয়্যাহ রা. প্রমুখের সৌন্দর্যও কম ছিল না। তাদের সৌন্দর্যের কথা হাদীস, তারীখ ও সিয়ারের গ্রন্থগুলোতেও এসেছে। সে হিসেবে হযরত আয়েশা রা. এর সৌন্দর্যের কথা হাদীস ও সিয়ারের কিতাবগুলোতে তেমন আসেনি বললেই চলে। তবুও তিনি স্ত্রীগণের তুলনায় সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিলেন। কারণ হলো, যার দ্বারা ধর্মের সেবা সবচেয়ে বেশি হবে তিনিই রাসূলের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আয়েশা রা. এর মাসায়েল দক্ষতা, ইজতিহাদ ক্ষমতা, ধর্মীয় বিধি-বিধানের জ্ঞান শুধু নারী নয় অনেকাংশে পুরুষদেরকেও তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তাছাড়া রাসূলের জীবনে এমন একজন বুদ্ধিমতী মেধাবী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীর প্রয়োজন ছিল। যিনি সব দিক থেকে রাসুলকে ভালোবাসা ও প্রেরণা দিয়ে উজ্জীবিত করে রাখবেন। রাসূলের প্রতিটি কথা ও কাজকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারবেন এবং উম্মতের পরবর্তী অনুসারীদের জন্য সেসব নিজের ভিতরে আত্মস্থ করতে পারবেন। আম্মাজান আয়েশা সেটা করেছিলেন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি রাসূলের ঘরে আসেন।
একেবারেই কিশোরী। কিন্তু নিজের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, ভালোবাসা, প্রেম ও আবেগ দিয়ে তিনি আগলে রেখেছিলেন রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে। একাধারে নয়টি বছর তিনি রাসুলের সমগ্র সত্তাকে পারিবারিক ও দীনী সমগ্র চিত্রকে নিজ সত্তায় ধারণ করেছিলেন। রাসুলের প্রতিটি আচরণ, উচ্চারণ, প্রতিটি আবেগ ও কান্নাকে তিনি হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে শুধু অনুধাবনই করেননি বরং পরবর্তী উম্মতের জন্য এক মজবুত আধার হিসেবে রেখে গিয়েছেন। রাসূলের আর কোন পবিত্রতম স্ত্রী এভাবে রাসূলের আমানতকে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেননি। তাই আম্মাজান হযরত আয়েশা রা.এর বয়স স্বল্পতা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে পবিত্রতম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং পবিত্রতম সোহবত সমগ্র উম্মাহর জন্য আল্লাহর অবারিত রহমত এবং অফুরন্ত নেয়ামতকে উন্মুক্ত করেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে কিয়ামত পর্যন্ত এই পবিত্রতম দাম্পত্যের পুর্ণাঙ্গ অনুকরণ-অনুসরণ ও খোদা প্রদত্ত যাবতীয় কল্যাণ অর্জনের তাওফীক দান করুন আমীন।
তথ্যসূত্র:
সীরাতে আয়েশা রা.
লেখক: সাইয়েদ সুলাইমান নদভী রহ.
আর রাহীকুল মাখতূম
লেখক: আল্লামা ছফিউর রহমান মুবারকপুরী রহ.
নবীয়ে রহমত
লেখক: সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.
প্রিয়তমা
লেখক: সালাহুদ্দীন জাহাঙ্গীর
ও অন্যান্য নির্বাচিত প্রবন্ধ অবলম্বনে
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
টুপি পরিধান করার কোন প্রমাণ কি হাদীস বা আছারে সাহাবায় নেই?
...
সাহাবায়ে কিরামের ভ্রাতৃত্ব, মতভেদ ও আদর্শিক আচরণ: একটি শিক্ষনীয় চিত্র
নবী করীম ﷺ গভীরভাবে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতেন যে, উম্মতের টিকে থাকা ও অগ্রগতির একমাত্র উপায় হলো—পারস্...
اصحاب رسول صلی اللہ علیہ وسلم کی عظمت شان
اللہ تعالیٰ نے جس دین کو حضور ختمی مرتبت پر مکمل فرمایا اس کی تاریخ اصحابِ رسول صلی اللہ علیہ وسلم ...
সাহাবায়ে কেরামগণ সত্যের মাপকাঠি
সত্যের মাপকাঠি বলতে বুঝানো হয় যে, সাহাবায়ে কেরামগণ হক ও হক্কানিয়্যাত, দ্বীন ও ঈমানের ক্ষেত্রে যে মান...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন