প্রবন্ধ
যেসব কাজে অন্তর নষ্ট হয়ে যায়
মানবদেহে হৃৎপিণ্ড হলো এক মহারাজ্য, আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হলো তার প্রজা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
শরীরে একটি মাংসপিণ্ড আছে, যদি তা সুস্থ থাকে
তবে পুরো শরীর সুস্থ থাকে। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায়, তবে পুরো
শরীর নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেটি হলো কলব বা অন্তর। (সহিহ মুসলিম, হাদীস : ৩৯৪৯)
মুমিনের অন্তর হলো আল্লাহর মারিফাত ও ভালোবাসার আধার। কিন্তু
দুনিয়াবি কিছু বদভ্যাস ও পাপাচারের কারণে এই আয়নার মতো স্বচ্ছ অন্তরে মরিচা ধরে,
কালো দাগ পড়ে এবং ধীরে ধীরে তা আধ্যাত্মিকভাবে মৃত হয়ে যায়। অন্তর
নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের ভেতর থেকে আল্লাহর ভয়, ইবাদতের স্বাদ
এবং সত্য গ্রহণের যোগ্যতা হারিয়ে যায়। যেসব বিষয় অন্তরকে নষ্ট করে দেয় অন্তরকে
ধ্বংসকারী এমন কিছু বিষয় রয়েছে। এগুলোকে অন্তরের বিষ বলা হয়।
মানুষের সাথে অপ্রয়োজনে মেলামেশা : মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক
জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা এবং একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো মানুষের সহজাত
প্রবৃত্তি। ইসলামও বৈরাগ্যবাদ বা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে বনে-জঙ্গলে বসবাস করাকে সমর্থন
করে না। কিন্তু প্রতিটি বিষয়েরই একটি সীমারেখা বা ব্যালেন্স রয়েছে। যখনই মেলামেশা
প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে নিছক আড্ডা, সময়ক্ষেপণ বা
বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তখনই তা মুমিনের অন্তরের জন্য
বিষাক্ত হয়ে ওঠে। আর এই অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা আমাদের অন্তরকে অসুস্থ করে তোলে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর জিকর
ছাড়া বেশি কথা বলবে না। কেননা আল্লাহর জিকর ছাড়া কথা বেশি বললে মন কঠোর হয়ে যায়।
আর মানুষের মধ্যে কঠোর হূদয় ব্যক্তিই আল্লাহর (রহমত) থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : হাদিস : ২৪১১)
তাহলে কি আমরা মানুষের সাথে মিশব না? অবশ্যই
মিশব। তবে তার একটি মাপকাঠি থাকতে হবে। ওলামায়ে কেরাম বলেন, মানুষের
সাথে মেলামেশা হওয়া উচিত খাবারে লবণের মতো। তরকারিতে লবণের পরিমাণ যেমন ঠিকঠাক হলে
স্বাদ বাড়ে, কিন্তু বেশি হলে তা খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়;
তেমনি মেলামেশাও পরিমিত হতে হবে।
দীর্ঘ আশা বা তুলুল আমাল : মানুষের মন এক বিচিত্র জগত্। এখানে
যেমন ঈমান ও তাকওয়ার বীজ রোপিত হয়, তেমনি গাফিলতি ও দুনিয়াবি
মোহের আগাছাও জন্ম নেয়। আশা-অকাঙ্ক্ষা এমন এক সমুদ্র যার কোনো কূল-কিনার নেই। আর
অন্তর সুস্থতার অন্তরায় হলো হলো ‘তুলুল আমাল’ বা দীর্ঘ আশা। দীর্ঘ আশা বলতে আল্লাহর রহমতের আশা বোঝায় না; বরং এর অর্থ হলো, দুনিয়ায় বহুদিন বেঁচে থাকার মিথ্যা
স্বপ্ন দেখা এবং দুনিয়া অর্জনের জন্য অন্ত্মহীন পরিকল্পনা সাজানো। মৃত্যু ও
আখেরাতকে ভুলে গিয়ে দুনিয়ার চাকচিক্যের পেছনে এই অবিরাম ছুটই মানুষের অন্তরকে তিলে
তিলে ধ্বংস করে দেয়।
ইসলামী পরিভাষায় দীর্ঘ আশা হলো, এই
বিশ্বাস লালন করা যে আমার মৃত্যু এখনই হচ্ছে না, হাতে অনেক
সময় আছে, বার্ধক্যে ইবাদত করব, আগে দুনিয়াটা
গুছিয়ে নিই। এটি এমন এক মরীচিকা, যা মানুষকে মুসাফিরের
পরিবর্তে দুনিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ভাবতে শেখায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার
সাহাবিদের সামনে মাটিতে একটি চতুর্ভুজ আঁকলেন, তার মাঝখান
থেকে একটি রেখা বাইরে বের করে দিলেন। তিনি বললেন, ‘বাইরে
বেরিয়ে যাওয়া রেখাটি হলো মানুষের ‘আশা’, যা তার হায়াত বা আয়ুর চেয়েও দীর্ঘ।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস : ৬৪১৭)
অর্থাত্, মানুষ এমন সব পরিকল্পনা করে,
যা বাস্তবায়ন করার মতো আয়ু তার নেই।
আলী (রা.) বলেন,
إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ اثْنَتَانِ: اتِّبَاعُ الْهَوَىٰ، وَطُولُ الْأَمَلِ؛ فَأَمَّا اتِّبَاعُ الْهَوَىٰ فَيَصُدُّ عَنِ الْحَقِّ، وَأَمَّا طُولُ الْأَمَلِ فَيُنْسِي الْآخِرَةَ
আমি তোমাদের ব্যাপারে
দুটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, ১. কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ—
যা সত্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ২. দীর্ঘ আশা, যা
আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, হাদিস :
৩৪৪৯৫)
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে গভীর সম্পর্ক রাখা : আল্লাহ ছাড়া
অন্য কারো সাথে গভীর সম্পর্ক রাখার প্রভাব এটি অন্তরের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।
এর চেয়ে অনিষ্টকর আর কিছু নেই। বান্দাকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে এটি মূল
ভূমিকা পালন করে। এটি কল্যাণ ও গৌভাগ্য থেকেও ব্যক্তিকে বঞ্চিত রাখে। কারণ কেউ যখন
আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কারও সাথে সম্পর্কে জড়ায়, তখন আল্লাহ
তাকে সেই ব্যক্তির ওপরই ন্যস্ত করে দেন এবং তার মাধ্যমেই তাকে অপমানিত ও অপদস্থ
করেন। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে সম্পর্ক রাখে, তা-ও সফল হয়
না। সব আশা-উদ্দেশ্য নস্যাত্ হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা
আল্লাহর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে; এই আশায় যে,
তাদের সাহায্য করা হবে। অথচ এসব উপাস্য তাদের সাহায্য করার সক্ষমতা
রাখে না; বরং তারা হবে এদের (মতোই শাস্তিপ্রাপ্ত) এক বাহিনী,
যাদের হাজির করা হবে।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৭৪, ৭৫)
সর্বদা পরিতৃপ্তির সাথে আহার : খাদ্য মানুষের বেঁচে থাকার
প্রধান অবলম্বন। সুস্থ শরীর ও সবল মন নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য পরিমিত আহার
গ্রহণ করা অপরিহার্য। কিন্তু যখনই এই আহার প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা আর শক্তির উত্স থাকে না; বরং তা শরীর ও
আত্মার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। একে অতিভোজন বলা হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোজন
মানুষের অন্তরকে নষ্ট করে দেয়। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, পেট
হলো সমস্ত প্রবৃত্তি ও আবেগের উত্স। একে নিয়ন্ত্রণে না আনলে আত্মশুদ্ধি সম্ভব নয়।
মিকদাম ইবনে মাদিকারিব (রা.) বলেন, আমি
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, পেটের চেয়ে মন্দ কোন
পাত্র মানুষ ভরাট করে না। পিঠের দাঁড়া সোজা রাখার মত কয়েক লোকমা খানাই আদম
সন্তানের জন্য যথেষ্ট। আরো বেশি ছাড়া যদি তা সম্ভব না হয় তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ
খানার জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানির জন্য আরেক তৃতীয়াংশ
শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮০)
বেশি বেশি ঘুমানো : ঘুম মহান আল্লাহর
এক অশেষ নেয়ামত। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে শরীর ও মনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য
ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন, আমি
তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। (সুরা : নাবা, আয়াত : ৯)
কিন্তু প্রতিটি নেয়ামতের মতো ঘুমেরও একটি সীমা আছে। যখন এই সীমা অতিক্রম করা হয়, তখন তা আর বিশ্রাম থাকে না; তা পরিণত হয় ব্যাধিতে। অতিরিক্ত ঘুম অন্তরকে মৃত করে দেয়। এটি মানুষের মূল্যবান হায়াতকে সংক্ষিপ্ত করে দেয় এবং অন্তরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল বা উদাসীন করে ফেলে। (মাদারিজুস সালেকিন অবলম্বনে)
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার ১০ আমল ও কৌশল
গোনাহের সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ ক্ষতি হলো, মানুষ আল্লাহর ইবাদত থেকে মাহরুম হয়ে যায়। আল্লাহর ইবাদত ক...
কোরআনে মানুষের অন্তর সম্পর্কে কী বলা হয়েছে
কলব মানে অন্তর বা হৃদয় মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। কলব যদি ভালো হয়, তাহলে তা মানুষকে ভালো পথে পরিচালিত ...
মুজাহাদা কেন করবেন? কীভাবে করবেন?
আল্লাহ তাআলা জাহান্নামে যাওয়ার উপকরণসমূহকে মানুষের সামনে লোভনীয় করে দিয়েছেন। যে কারণে মানুষের মন সর্...
হুসনুল খাতিমা বা সুন্দর মৃত্যুর জন্য ১০ আমল
একজন মুমিনের মূল গন্তব্য আখেরাতপানে। দুনিয়ার সময়টা তার জন্য সামুদ্রিক-ভ্রমণের মত। তার সময় কিংবা জ...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন