প্রবন্ধ
মাজার কেন্দ্রিক প্রচলিত পীর-মুরিদী
কোরআনে পাকের আয়াত ও হাদীস শরীফের ভাষ্য দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, আল্লাহর কাছে আমলের মূল্যায়ন ও তার ওজন নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান ও নিয়তের অনুপাতেই হয়ে থাকে। বলা বাহুল্য!পূর্ণ ঈমান ব্যতিত নিয়ত পূর্ণরুপে খাঁটি হতে পারে না। কেননা পূর্ণ খাঁটি নিয়ত এই যে, আল্লাহ ব্যতিত কাউকে লাভ লোকসানের মালিক গণ্য করা যাবে না, নিজের কাজ-কর্মে কাউকে ক্ষমতাশালী মনে করা যাবে না এবং ইবাদত ও আনুগত্যে অপরের কল্পনা ও ধ্যান করা যাবে না।
সাহাবায়ে কেরামগণ মুসলমান সমপ্রদায়ের প্রথম সারিতে অবস্থিত। তালাশ করলে তাঁদের অনেকের আমল ও সাধনার পরিমাণ তেমন বেশি চোখে পড়ে না। এতদা সত্বেও তাঁদের সামান্য আমল ও সাধনা অবশিষ্ট উম্মতের বড় বড় আমল ও সাধনার চেয়েও অনেক বেশী উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠ। আর তা একমাত্র তাঁদের মজবুত ঈমান ও পূর্ণ নিষ্ঠার কারণেই ছিল।
আরবের মুশরেকরাও এ বিশ্বাস রাখতো যে, আল্লাহ তা’য়ালাই সৃষ্টিকর্তা, মালিক এবং সবকিছুতেই ক্ষমতাশালী। কিন্তু সাথে সাথে এ ধারণাও করতো যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর নৈকট্যশীল প্রিয় পাত্র, তাই এসব ফেরেশতাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করলে তারা সন্তুষ্ট হবে। তাই তারা নিজেদের কল্পনানুযায়ী ফেরেশতাগণের আকার আকৃতিতে মূর্তি-বিগ্রহ তৈরি করল। অথচ তারা জানতো যে, এসব মূর্তি-বিগ্রহ তাদের হাতের তৈরি। এদের কোন বুদ্ধি-জ্ঞান, চেতনা-চৈতন্য ও শক্তি-সামর্থ কিছুই নেই। কিন্তু তারপরও তারা এসব মূর্তি-বিগ্রহের পূজা আর্চনা করতো, কারণ তারা আল্লাহ তা’য়ালার দরবারকে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের দরবারের মতই মনে করতো। দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ’দের দরবারে যেমন বাদশাহ’র নৈকট্যশীল ব্যক্তি অন্যের জন্য সুপারিশ করে তাকেও বাদশাহ’র নৈকট্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে তাদের কল্পিত ফেরেশতাদের আকৃতিতে নির্মিত এসব মূর্তিরাও তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করে তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যবর্তী করে দিতে পারে। তারা এজন্য মূর্তির ইবাদত করত না যে, এসব মূর্তি তাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, বরং আল্লাহ যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা তাঁর নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে সুপারিশের জন্যই এসব মূর্তির ইবাদত ও তাদের কাছে প্রার্থনা করত। তাদের যাবতীয় সমস্যা এসব মূর্তির সামনেই পেশ করত, যাতে করে এসব মূর্তি আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়ে দেন। ও তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীলদের অন্তর্ভুক্তকরে দেন এবং পরকালে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন।
কিন্তু তাদের এসব ধারণা শয়তানী বিভ্রান্তি ও ভিত্তিহীন কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। যা তাদের মধ্যে ইলমে ওহীর আলো না থাকার কারণে তারা বুঝতে সক্ষম ছিল না। বরং এসব শিরকী কর্মকান্ডকে তারা দুনিয়া-আখেরাত উভয়ের জন্য অনেক বড় পূণ্যের কাজ মনে করত। আর এই দাবী করত যে, আমরা আল্লাহর জন্য ইবাদত করি। কিন্তু এসব মূর্তিদের ইবাদত উপাসনা এজন্য করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। তাদের এই দাবী খন্ডনকে কালামে পাকে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন-
اَلَا لِلّٰہِ الدِّیۡنُ الۡخَالِصُ ؕ وَالَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءَ ۘ مَا نَعۡبُدُہُمۡ اِلَّا لِیُقَرِّبُوۡنَاۤ اِلَی اللّٰہِ زُلۡفٰی ؕ اِنَّ اللّٰہَ یَحۡکُمُ بَیۡنَہُمۡ فِیۡ مَا ہُمۡ فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ۬ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِیۡ مَنۡ ہُوَ کٰذِبٌ کَفَّارٌ
স্মরণ রেখ, খালেস আনুগত্য তাঁরই প্রাপ্য। যারা তাঁকে ছাড়া অন্যসব অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে (এই কথা বলে যে,) আমরা তাদের উপাসনা করি কেবল এজন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে, আল্লাহ তাদের মধ্যে সেই বিষয়ে মীমাংসা করে দেবেন যার মাঝে তারা মতবিরোধ করছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন কোন ব্যক্তিকে পথে আনেন না, যে চরম মিথ্যুক, ঘোর কাফের। সূরা-যুমার-৩
অর্থাৎ- আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের যে পন্থা তারা অবলম্বন করেছিল, তা ছিল কেবল মাত্র তাদের মস্তিষ্ক প্রসূত ভ্রান্ত ধারনা। যা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য তো নয়’ই। উপরন্তুতা তাদের ধ্বংসের জন্য কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অথচ তারা এটাকে মহা বড় পূণ্যের কাজ বলে মনে করত।
ঠিক এমনিভাবেই মক্কার কাফের-মুশরিক ও বর্তমানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের শিরকী কর্ম-কান্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে মুসলিম সমাজেও শুরু হয়েছে, পীর পূজা ও মাজার পূজার মাধ্যমে শিরকের ছড়াছড়ি। পীরের নামে মান্নত করা, পীরের কাছে সন্তান চাওয়া, পীরকে সিজদাহ করা, পীরের আঙ্গুল চুষা, পীরকে আলেমুল গাইব ও হাজের-নাজেরবলে বিশ্বাস করা, পীরকে সব সমস্যার সমাধানকারী, বিপদ থেকে উদ্ধারকারী মনে করা ইত্যাদি ভ্রান্ত আক্বীদা সহ পীরের দরবারে চলে হর হামেশা আরো বিভিন্ন রকম শিরকী কর্মকান্ড, আবার পীর মারা গেলে সেখানে শুরু হয় পূর্বের তুলনায় আরো জোরদার ভাবে মাজার পূজা, মাজারে সিজদাহ করা, মাজারে মোমবাতি, আগর বাতিসহ বিভিন্ন ভাবে আলোকসজ্জা করা। তেমনিভাবে মাজারে গিয়ে কবরের কাছে সন্তান প্রার্থনা করা, সকল প্রকার প্রয়োজন পূরণের জন্য মৃত পীরের কাছে কাকুতি মিনুতি করা, গরু, মহিষ, উট, দুম্বা, ভেড়া ইত্যাদি পশু মাজারের মৃত পীরের নামে উৎসর্গ করা, জবেহ করার সময় আল্লাহর নামের সাথে সাথে পীরের নামে জবেহ করা। এছাড়াও চলে-তিনদিনা উরশ, সাপ্তাহিক উরশ, মাসিক উরশ, ত্রিমাসিক উরশ, ষান্মর্ষিক উরশ ও বাৎসরিক উরশ। কোথাও কোথাও আবার ১১ শরীফের নামেচলে গান-বাজনার মহা আয়োজন।
মূলত এসব মাজার সমূহে ওরশের নামে চলে শরীয়া বিরোধী যত অপকর্ম সমূহ। গান-বাজনা, নাচা-নাচিসহ পর্দাহীনভাবে নারী পুরুষের চলে অবাধ মেলামেশা। বিড়ি-সিগারেটসহ, গাজাখোর, হিরোইনখোরদের চলে জম-জমাট ব্যবসা।
পীর-বুযূর্গদেরকে মহাব্বত করা ও আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে সম্পর্ক রাখা অবশ্যই অনেক বড় পূণ্যের কাজ এবং ঈমানের দাবীও বটে। তেমনিভাবে তাদের মৃত্যুর পর বিভিন্ন নেক-আমলের মাধ্যমে তাদের রুহে ইসালে সওয়াব করা, কবর কাছে হলে মাঝে মাঝে যিয়ারত করা, তাদের রুহের মাগফিরাতের জন্য দো’য়া করা খুবই উত্তম কাজ এবং এগুলোর জন্য কোরআন-হাদীসেও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আত্মশুদ্ধি ও ইসালে সওয়াবের নামে এসব শরীয়া বিরোধী অপকীর্তি কখনই জায়েজ হবে না। বরং তাসাউফ ও ইসালে সওয়াবের জন্য কোরআন-হাদীসে যেমনিভাবে রয়েছে উৎসাহ ঠিক তেমনিভাবে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে’তাবেয়ীনগণের জীবনীতে রয়েছে তার বাস্তব নমুনা। তাই আত্মশুদ্ধি ও ইসালে সওয়াব করতে হলে তাদের জিন্দেগী অনুসরণ করেই করতে হবে। তাদের আদর্শের বাইরে যাওয়া মানেই শরীয়তের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়া। আর শরীয়তের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যে যত বড় আমল’ই করুক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তা পরিত্যাজ্য। অথচ বর্তমানে মাজারগুলোতে চলছে আত্মশুদ্ধি ও ইসালে সওয়াবের নামে শরীয়া বিরোধী কর্মকান্ড যা সম্পূর্ণ হারাম ও অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মাজারে সংঘটিত এসব কর্মকান্ড হারাম ও না’জয়েয হওয়ার কারণ সমূহ আমরা ক্রমান্নয়ে উল্লেখ করছি।
মাজারে সংঘটিত কর্মকান্ড সমূহ হারাম ও না’জয়েয হওয়ার প্রথম কারণঃ-
হাদিসের হুকুম অমান্য করাঃ-
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন, তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করবে না -সেই তিনটি হল ১/মসজিদে হারাম ২/মসজিদে আকসা ৩/আমার মসজিদ তথা মসজিদে নববী। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ২০৩৩
উক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রতিয়মান হয় যে উল্লেখিত তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ নয়। বলা বাহুল্য যে আল্লাহর ঘর মসজিদের ক্ষেত্রে'ই যখন এ হুকুম তখন মাজার কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ হতে পারে কিভাবে? বরং তা সম্পূর্ণ অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।
সুতরাং মাজার ও কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে সিলেট শাহ জালাল শাহ পরান মাইজভান্ডর আট রশি চন্দ্র পুরী মুরতাদ দেওয়ান বাগী সহ বিভিন্ন মাজার সফরে যাওয়ার যে প্রথা আমাদের দেশে রয়েছে তা সম্পুর্ণ অবৈধ নাজায়েয ও বর্তমান পরিস্থিতির দৃষ্টে হারাম
দ্বিতীয় কারণ
ওরশ ও তাতে সংঘটিত কর্মকান্ড সমুহঃ-
ইসালে সওয়াবের নামে মাজার সমূহে একত্রিত হয়ে গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, দুম্বা, বকরী জবেহ করে ধুমধামের সাথে খাওয়ার আয়োজন করার প্রচলন ইসলামের প্রথম তিন যূগে তো ছিলই না, বরং এভাবে দিন-ক্ষণ ঠিক করে কারো কবরের পাড়ে একত্রিত হতে হজুর (সাঃ) নিষেধ করে গিয়েছেন- যেমন হাদীস শরীফে আছে-
لا تجعلوا قبري عيدا
অর্থ- তোমরা আমার কবরের (পাড়ে একত্রিত হয়ে) ঈদের ন্যায় উৎসব করিও না। মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং: ৯২৬
অর্থাৎ- ঈদের সময় যেভাবে তোমরা সবাই একত্রিত হও আমার ইন্তেকালের পর আমার কবরের কাছে এভাবে একত্রিত হয়ো না।
সুতরাং- সর্বোচ্চ সম্মানে সম্মানিত শুধু তাই নয় বরং যার সম্মান ও মর্যাদার সাথে পৃথিবীর সকলের সম্মান ও মর্যাদা তুলনাও হতে পারে না, তার কবরের সামনে যখন এভাবে একত্রিত হতে নিষেধ করা হয়েছে, তখন অন্যদের কবরে তা জায়েয হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। বরং তা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
সুতরাং- ওরশের সময় মাজার সমূহে যেভাবে দল বেঁধে মানুষ একত্রিত হয় তা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম।
তৃতীয় কারণঃ-
কবরে সিজদাহ করাঃ-
এসব মাজারে সংঘটিত জঘন্যতম অপকর্ম সমূহের আরেকটি হলো পীরের পায়ে ও কবরকে সামনে রেখে সিজদাহ করা। অনেক স্থানে আবার কবরের উপর মসজিদ বানানো হয়। যা সম্পূর্ণ শিরকী কাজ, হিন্দু, ইহুদী, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এসব শিরকী কর্ম-কান্ড সম্পূর্ণ শয়তানের ধোঁকা। হাদীস শরীফে এসব কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদেরকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। অন্য আরেক হাদীসে আছে রাসূলে কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন-
ألا وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبيائهم وصالحيهم مساجد ألا فلا تتخذوا القبور مساجد إني أنهاكم عن ذلك
অর্থাৎ- সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তীগণ নবী ও বুযুর্গদের কবরকে সিজদার স্থান বানিয়ে নিয়েছিল। খবরদার! তোমরা কবর সমূহকে সিজদার স্থান বানিয়ো না। নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে এ কাজ থেকে নিষেধ করছি। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৫৩২
আরেক হাদীসে কবরকে সিজদার স্থান বানানে ওয়ালাদের প্রতি লা’নত করে বলেন-
لعن الله اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد
অর্থ- ইহুদী-খ্রীষ্টানদের উপর আল্লাহর লা’নত, তারা তাদের নবীগণের কবরসমূহকে সিজদার স্থান বানিয়েছে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৫৩০
উল্লেখিত হাদীস সমূহের মাধ্যমে জানা গেল যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণের ধ্বংসের অন্যতম কারণ হলো তাদের নবী ও বুযুর্গদের কবরকে সিজদার স্থান বানানো। আর সেই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেতে হুজুর (সাঃ) তাঁর উম্মতকে হুশিয়ার করে বলেন, যে পূর্ববর্তী ধ্বংস প্রাপ্ত লোকদের ন্যায় তোমরাও কবর সমূহকে সিজার স্থান বানিও না। তেমনিভাবে নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে অন্য হাদিসে কবরে সিজদা কারিদের প্রতি লা’নতও করেছেন।
বুঝার বিষয়! নবীগণের কবরকে সিজদার স্থান বানানোর দ্বারা যদি হুজুর (সাঃ) তাদের উপর লা’নত দিয়ে থাকেন, তবে পরবর্তী সাধারণ উম্মতগণের কবরে সিজদা করার ক্ষেত্রে কি হুজুর সন্তুষ্ট হবেন? অবশ্যই নয় বরং তারা (মাজারে সিজদাকারী ব্যক্তিরা)ও ঐ লা’নত প্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অথচ হাদীসের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এসব মাজার সমূহে চলছে পীরকে সিজদা করা, কবরকে সিজদা করা ও তাতে মসজিদ বানানো ইত্যাদি ঈমান ধ্বংসাত্মক শিরকী কর্ম-কান্ড সমূহ। যা থেকে বেঁচে থাকা ফরয, নচেৎ দুনিয়া আখেরাত উভয় জাহান ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে যাবে।
চতুর্থ কারণঃ-
মাজারে কবরের উপর ঘর বানানো ও তাতে সাজ-সজ্জা করাঃ-
عن أبي وائل، عن أبي هياج الأسدي، قال بعثني علي قال لي أبعثك على ما بعثني عليه رسول الله صلى الله عليه وسلم أن لا أدع قبرا مشرفا إلا سويته ولا تمثالا إلا طمسته
অর্থ- হযরত আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত! তিনি বলেন, হযরত আলী (রাঃ) আমাকে বলেছেন! আমি কি তোমাকে এমন কাজে পাঠাব না যেকাজে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে পাঠিয়েছিলেন? তা হচ্ছে-তুমি কোনো মূর্তি পেলে তা না ভেঙ্গে দাঁড়াবে না, আর কোন উঁচু কবর পেলে তা সমান না করে রাখবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ৩২১৮
এমনিভাবে হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে আছে। তিনি বলেন-
نهى النبي صلى الله عليه وسلم أن تجصص القبور وأن يكتب عليها وأن يبنى عليها وأن توطأ
অর্থাৎ- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কবরে চুনকাম (প্লাস্টার) করতে, তার উপর ঘর বানাতে এবং তার উপর বসতে নিষেধ করেছেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৯৭০; জামে তিরমিযী, হাদীস নং: ১০৫২
এমনিভাবে হযরত আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে আছেঃ-
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَائِرَاتِ الْقُبُورِ وَالْمُتَّخِذِينَ عَلَيْهَا الْمَسَاجِدَ وَالسُّرُجَ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কবর যিয়ারতকারিণী মহিলাদের উপর লা’নত করেছেন। আর যারা কবরের উপর মসজিদ বানায় এবং বাতি জ্বালায়, তাদের উপরও তিনি অভিসম্পাত করেছেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ৩২৩৬
উপরোল্লেখিত হাদিস সমূহের মাধ্যমে প্রতিয়মান হয় যে, কবর অধিক উঁচু করা, তাতেসাজ-সজ্জা করা, তার উপর ঘর বানানো, তাতে আলো জ্বালানো এ সবগুলো লা’নত প্রাপ্ত কাজ, অথচ বর্তমানে মাজার সমুহের ভিত্তি ঐ সমস্ত জিনিসের’ই উপর যেগুলোর ক্ষেত্রে হুজুর (সাঃ) কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। সুতরাং কবর সমুহের উপর নির্মিত বিভিন্ন রকমের সজ্জায় সজ্জিত মাজার নামের এসব ব্যবসা কেন্দ্র সমূহকে বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরী।
তবে ইহা কবর বা কবর ওয়ালার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনার্থে নয়, বরং মাজার ব্যবসা ও লা’নত প্রাপ্ত শিরকী কর্ম-কান্ড সমূহকে বন্ধ করা’ই হবে এর উদ্দেশ্য।
পঞ্চম কারণঃ-
মাজারে গান-বাজনাঃ-
বর্তমানে মাজার নামক এসব ধর্ম-ব্যবসার প্রতিষ্ঠান গুলোতে আল্লাহ’র গযব প্রাপ্ত কর্মকান্ড সমূহের আরেকটি হল- গান-বাজনা ও নাচা-নাচি করা, বিশেষ করে চট্রগ্রামের মাইজভান্ডারী ,মূসাবীয়া, ফরিদপুরের আটরশি, চন্দ্রপাড়া সহ দেওয়ানবাগী, কুতুববাগী, রাজারবাগী, কালীয়াপুরী ইত্যাদি স্থানের মাজার সমূহে চলে পূর্বে উল্লেখিত গর্হিত কর্মকান্ডের সাথে সাথে নাচ গানের আসর। বিশেষ করে ওরশের সময় আরো বড় ধরনের আয়োজন করে। গর্হিত এসব কর্মকান্ডের প্রতি হুশিয়ারি দিয়ে আল্লাহপাক কালামেপাকে ইরশাদ করেন-
وَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡتَرِیۡ لَہۡوَ الۡحَدِیۡثِ لِیُضِلَّ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ بِغَیۡرِعِلۡمٍ وَّیَتَّخِذَہَا ہُزُوًا ؕ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ
কতক মানুষ এমন, যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করার জন্য খরিদ করে এমন সব কথা, যা আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন করে দেয় এবং তারা আল্লাহর পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য আছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি। সুরা লুকমান-আয়াত-৬
হযরত ইবনে মাসউদ, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত যাবের ও হযরত হাসান বসরী (রাঃ) তাঁহারা বলেন, এখানে لهو الحديث (অবান্তর কথাবার্তা) বলেগান বাদ্য উদ্দেশ্য। (হাকেম, বায়হাকী)
তেমনিভাবে হযরত আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন-
قال النبي صلى الله عليه وسلم: إن الله تعالى بعثني رحمة للعالمين وهدى للعالمين وأمرني ربي عز وجل بمحق المعازف والمزامير والأوثان والصلب وأمر الجاهلية
নবী (ﷺ) বলিয়াছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে দুনিয়াবাসীর জন্য রহমত ও বরকত এবং দুনিয়া বাসীর জন্য হেদায়ত ও পথপ্রদর্শক হিসাবে পাঠাইয়াছেন এবং আমার সেই মহাপরাক্রমশালী প্রভু সর্বপ্রকারের ঢোল ও যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র, দেব-দেবীর মূর্তিসমূহ, (খৃষ্টানদের) শূলি ও ক্রুশ এবং জাহিলী যুগের বদ রসম ও কুসংস্কার নির্মূল ও ধ্বংস করার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়াছেন। মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং: ৩৬৫৪
এখন বুঝার বিষয় হচ্ছে, যে কাজের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে কঠিন শাস্তির হুমকি, যে কাজ মিটিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ’র পক্ষ থেকে রাসূল (সাঃ)-কে পাঠানো হয়েছে দুনিয়াতে, নিজেকে মুসলমান দাবী করে দম্ভভরে আবার সে কাজকেই করার সাহস পায় কিভাবে?
বস্তুত বর্তমানের এসব মাজারসমূহ হারাম-নাজায়েয ও শিরকী কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল। সুতরাং এসব মাজার ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থেকে দূরে থাকা ঈমানী দায়িত্ব।
মাজার ও তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধোঁকাবাজিঃ-
এসব মাজার সমূহে অবস্থানরত তথা কথিত পীর, খাদেম ও চেলা চামুন্ডারা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য এমন এমন কিছু ফন্দি এটে থাকে যাতে করে সাধারণ মানুষেরা সেদিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে তারা তাদের অর্থ-কড়ি সব হাতিয়ে নেয়। যাতে করে সাধারণ মানুষ একদিকে হারায় তাদের অর্থ কড়ি অন্যদিকে বরবাদ হয় তাদের দুনিয়া আখেরাত উভয় জাহান। তাদের এসব ধোঁকা সমূহের মাঝে অন্যতম হল ভবিষ্যদ্বানী করা, অর্থাৎ- আগামী ভবিষ্যতে কি হবে, না হবে বলে দেয়া। যাকে অনেকে গায়েব বলে মনে করে থাকে। কোন লোক মাজারে গেলেই ‘তোমার এটা হবে, ঐটা হবে’ বলে বিভিন্ন রকমের কথা বলে থাকে। যার মধ্যে অনেক সময় দু-একটা বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। আর তখনই সাধারণ মানুষেরা মনে করে যে, পীর সাহেব বা মাজারের খাদেম সাহেব গায়েব জানে। অথচ ইহা সম্পূর্ণ ধোঁকা। বরং দুনিয়াতে সংঘটিতব্য বিষয় সমূহ সম্পর্কে ফেরেশতাদের মধ্যে পরস্পরের আলোচনার সময় দুষ্ট-জ্বিন শয়তানেরা অনেক সময় চুরি করে দু’একটি কথা শুনে ফেলে। আর সেগুলোর সাথে আরো বাড়িয়ে কমিয়ে গনকদের কাছে বলে আর এই গনকেরা মাজার নামে ঈমান বিক্রির ব্যবসা খুলে বসে তা সাধারণ মানুষদের বলতে থাকে যার থেকে অনেক সময় দু’একটি কথা বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। আর সাধারণ জনগণ এটাকে অনেক বড় বূযূর্গী মনে করে তাদের সামনে সিজাদায় লুটিয়ে পড়ে। এমনিভাবে অনেক সময় বিভিন্ন যাদুর মাধ্যমে জনসাধরণকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। পানির উপর হেটে যাওয়া, বাতাসে উড়া ইত্যাদি। অনেকে আবার গোসল না করে চুল-দাড়িতে ময়লার জটলা বাঁধিয়ে বূযূর্গী প্রকাশ করে। আর এসব দেখে জনসাধারণ, বিশেষ করে মহিলারা বাবার মহাব্বতে সর্বশ বিলিয়ে দিয়ে দুনিয়া আখেরাত উভয় জাহানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় তারা এসব ধোঁকাবাজি বুঝতে পারে না। আগাম কোন খবর বলে দেয়া এটা কোনো বূযূর্গী নয়, যদি তাই হতো তাহলে গনকরা সবচেয়ে বড় বূযূর্গী হত। পানিতে হেটে যাওয়া, বাতাসে উড়া বা আশ্চার্যন্বিত কিছু দেখাতে পারা’ই যদি বূযূর্গী হত তাহলে জুয়েল আইচ, ডেভিট ব্যকহামের মত যাদুকররা সবচেয়ে বড় বূযূর্গ হত, ময়লা চুলে জট বাধানো’ই যদি বূযূর্গী হত তবে রাস্তার পাগলেরা যূগ সেরা বূযূর্গহত।
মূলত এগুলো বূযূর্গ ও আল্লাহ ওয়ালা হওয়ার নিদর্শন নয়, বরং বুযূর্গ ও আল্লাহ ওয়ালার হওয়ার নিদর্শন হল প্রত্যেক কাজ আল্লাহর হুকুম মত ও নবী কারীম (সাঃ) এর তরীকা মত করা। যার মধ্যে এইগুণ পাওয়া যাবে সে ব্যক্তি’ই আল্লাহ ওয়ালা-বুযূর্গ। যদিও সে পানিতে হাটতে না পারে, বাতাসে উড়তে না পারে। অথচ মাজার ব্যবসায়ী পীর-খাদেমদের মধ্যে আল্লাহর হুকুম-নবীর তরীকা তো নাই। বরং নানারকম পাপাচার অশ্লিলতা ও হারাম কর্ম-কান্ডের সাথে সাথে দুষ্ট জ্বিন শয়তানদের সাহায্যে গনক ও যাদুর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত করে মানুষের ঈমান নষ্ট করে থাকে। তাদের এই অপকর্মের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আল্লাহ পাক ঘোষনা কবরেনঃ-
وَلَا تَلۡبِسُوا الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَتَکۡتُمُوا الۡحَقَّ وَاَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
এবং সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং সত্যকে গোপনও করো না, যখন (প্রকৃত অবস্থা) তোমরা ভালোভাবে জান। সূরা বাক্বারা-৪২
মূলত বর্তমানে তথা কথিত এসব পীর, তাদের দরবার ও মাজার সমূহ ইহুদী-খ্রীষ্টানদের একটি চক্রান্ত। যার মাধ্যমে তারা মুসলমানদের ঈমানধ্বংসের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
অতএব প্রত্যেক মুসলমানকে এদের থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।
তাসাউফের সঠিক পদ্ধতিঃ-
যে আমলটিকে বিকৃত করে বর্তমানে মাজার ব্যবসায়ীরা পীর ও মাজারের জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে, তা হলো তাসাউফ তথা আত্মশুদ্ধি, যা আল্লাহ পাক রাব্বুুল আলামীন তাঁর হাবীব (সাঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরনের উদ্দেশ্য সমূহের মধ্যে অন্যতম। এ সম্পর্কে কালামে পাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষনা করেন-
ہُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَیُزَکِّیۡہِمۡ
অর্থাৎ- তিঁনি’ই সেই প্রভু যিনি উম্মীদের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছেন তাঁদের’ই মধ্য থেকে একজনকে। যিনি তাঁদের নিকট তাঁর আয়াত তেলাওয়াত করবে, তাঁদেরকে কিতাব ও কৌশল শিক্ষা দিবে এবং তাঁদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন। সূরা জুম’আহ-২
উল্লেখিত আয়াতে يُزَكِّيهِمْ শব্দটি تزكية থেকে উদ্ভ‚ত, যার অর্থ পরিশুদ্ধ করা, পবিত্র করা। তবে অভ্যন্তরীন দোষসমূহ থেকে পবিত্র করার অর্থেই অধিকতর ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ কুফর, শিরক, কুচরিত্রতা ইত্যাদি থেকে পবিত্র করা। কোন কোন সময় বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন উভয় প্রকার খারাপী থেকে পবিত্রতার জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, আর এখানে এই ব্যাপক অর্থই উদ্দেশ্য। মা’রেফুল কোরআন-১৩৬৯পৃঃ
তদ্রুপভাবে রাসূল (সাঃ)-এর জিন্দেগীতেও পাই সাহাবায়ে কেরামগণকে পরিশুদ্ধ করার বাস্তব নমুনা। যার মাধ্যমে তিনি তাঁর অন্যান্য অসংখ্য গুণসমূহের সাথে সাথে পৃথিবীর সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ পরিশুদ্ধকারী হিসেবেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আর এই পরিশুদ্ধ করার যতগুলো পন্থা আছে তন্মধ্যে ‘বাইয়াত নেয়া’ তথা সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রতিশ্র“তি নেয়া সেগুলোর অন্যতম। ঈমান-ইসলাম, জিহাদ, তাবলীগ, মু’য়ামেলা-মুয়াশারা ইত্যাদি বিষয় সমূহ শিক্ষা দেয়ার পাশা পাশি সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্যও রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণ থেকে প্রতিশ্র“তি নিতেন, যেমন- হযরত উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে- তিনি বলেনঃ-
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال وحوله عصابة من أصحابه " بايعوني على أن لا تشركوا بالله شيئا، ولا تسرقوا، ولا تزنوا، ولا تقتلوا أولادكم، ولا تأتوا ببهتان تفترونه بين أيديكم وأرجلكم، ولا تعصوا في معروف، فمن وفى منكم فأجره على الله، ومن أصاب من ذلك شيئا فعوقب في الدنيا فهو كفارة له، ومن أصاب من ذلك شيئا ثم ستره الله، فهو إلى الله إن شاء عفا عنه، وإن شاء عاقبه ". فبايعناه على ذلك
একদা একদল সাহাবা রাসূল (সাঃ)কে ঘিরে বসেছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা আমার নিকট এ মর্মে বাইয়াত হও যে, তোমরা কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করবেনা, চুরি করবেনা, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিবেনা, এবং সৎ কাজে অবাধ্য হবেনা। (অতঃপর জেনে রাখ!) যে কেউ এ ওয়াদা পালন করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর উপর ন্যস্ত, আর যে ব্যক্তি এগুলোর কোনো একটি করে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পায়। তার জন্য তা কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এগুলোর কোন একটি অপরাধ করে, এবং তা আল্লাহ তা’য়ালা প্রকাশ না করে গোপন রাখেন, তা হলে সে ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে মাফ করে দিবেন, আর ইচ্ছা করলে শাস্তি দিবেন। (রাবী বলেন) তখন আমরা ঐ শর্তে নবী কারীম (সাঃ)এর নিকট বাইয়াত হলাম। সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ১৮
এমনিভাবে পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে’তাবেয়ীগণ এবং পরবর্তী যূগের হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও বূযূর্গানে কেরামগণ এ তাসাউফের ধারাবাহিকতা চালু রেখেছেন এবং এর দ্বারা হাজার হাজার মানুষ আল্লাহর সঠিক পরিচয় পেয়েছে এবং সফলতার চুড়ান্ত শিখায় আরোহণ করেছে। হাজার হাজার পথ হারা মানুষ সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে, অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে এসেছে অসংখ্য উম্মতে মুহাম্মাদি, আর তা সম্ভব হয়েছে হুজুর (সাঃ)-এর মাধ্যমে পাওয়া তাসাউফের সঠিক পদ্ধতির উপর আমল করার কারণে।
সুতরাং- বর্তমানেও কেউ তাসাঊফ তথা আত্মশুদ্ধির আমলের মাধ্যমে আল্লাহকে পেতে চাইলে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের সঠিক আদর্শনুযায়ী তা করতে হবে। তাঁদের আদর্শের বাইরে থেকে তাসাউফের মাধ্যমে পূর্ণ উপকারীতা সম্ভব নয়।
তাসাউফের সঠিক দিক-নির্দেশনাঃ-
১. ইলমী, আমলী, সর্বদা সুন্নাতের অনুসরণকারী, বিদ’য়াত মুক্ত একজন হক্কানী পীর’কে খুজে বের করা। এক্ষেত্রে জনসাধারণ হক্বানী আলেমদের অনুসরন করা জরুরী।
২. হক্বানী পীর খুঁজে পাওয়ার পর সাথে সাথে বাইয়াত না হয়ে, কিছু দিন তার দরবারে থেকে, তার মন-মেজাজ লক্ষ্য করা যে, এ লোকটির মন-মেজাজের সাথে, তার মন-মেজাজ মিলবে কি না।
৩. যদি সব দিক থেকে মিলে যায় তবে বাইয়াত হবে এবং নিজের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ভালো ও মন্দ স্বভাব সম্পর্কে তাকে জ্ঞাত করবে। মন্দ ও গুনাহের কাজ সমূহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য তিনি যে আমল বাতলে দেন তা ঠিক ঠিক ভাবে পালন করা।
৪. পীরের প্রতি সর্বদা ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখা, মাঝে মাঝে তার সাথে সাক্ষাৎ করা ও নিজের আমলের অবস্থা সম্পর্কে তাকে জ্ঞাত করা।
৫. পীরের মন-মেজাজের সাথে তার মিল না হলে উক্ত পীরের অনুমতি নিয়ে অন্য কোনো হক্কানী পীরের কাছে যাওয়া।
বিঃ দ্রঃ- তবে মুরীদকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে-যে উক্ত পীরের সম্পর্কে হক্কানী আলেম-ওলামা কি বলেন। আলেম-ওলামা যে পীরকে সমর্থন করবে তাকে’ই জনসাধারণ পীর হিসেবে মানতে পারবে ও তার দ্বারা’ই ফায়দা হবে। আর আলেম-ওলামারা যাকে সমর্থন করেন না তাকে পীর মানা, তার হাতে বাইয়াত হওয়া জায়েয হবে না। বরং এমন লোককে পীর মেনে তার হাতে বাইয়াত হলে আখেরাত ধ্বংস ও বরবাদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ইমান ধ্বংসেরও সম্ভাবনা আছে। কেননা যে জিনিস যত বেশী দামী তার নকলও খুব বেশী হয়ে থাকে। যেমনি ভাবে স্বর্ণ খুব বেশী দামী তার নকল (খাঁদ)ও বেশী। আর এই খাঁদ বা নকল সবাই চিনতেও পারে না জওহারী ব্যতীত। ঠিক তেমনিভাবে এই তাসাউফ খুব দামী। তাই ইহুদী-খ্রীষ্টানরা মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার জন্য এই মূল্যবান আমলকে নকল করে গোলাম-আহমদ কাদীয়ানী, আকবরআলী রেঁজভী, দেওয়ান বাগী, কুতুব বাগী, চন্দ্রপুরী, আটরশি, মূসাবিয়া, ও সুরেশ্বরীর মত তাদের হাজার হাজার এজেন্টকে বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে তাদের দ্বারা কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা করিয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছে। তাঁরা প্রথমে এসেই অপব্যাখ্যা করেনা বরং অনেক বড় বুযূর্গ, সূফী-সাধক ইত্যাদি টাইটেল লাগিয়ে মুসলমানদের মাঝে ওয়াজ-নসিহত করতে থাকে। অতঃপর আস্তেআস্তে এমন এমন কিছু আকীদাহ ও এমন এমন কিছু আমল তারা জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করতে থাকে যার একটি দ্বারা’ই মানুষের ঈমান নষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অপর দিকে জনসাধারণ তাদের এই ধোঁকা বুঝতে না পেরে এক সময় তার মূল্যবান ঈমান খানা হারাতে হয়।
বস্তুত আলেম-ওলামারা কোরআন-হাদীস ও দ্বীনের ক্ষেত্রে জওহারীর ন্যায়। কোরআন-হাদীস ও দ্বীনের অপব্যাখ্যা তারাই বুঝতে সক্ষম হবে, জনসাধারণ নয়। তাই কোনো ব্যক্তিকে পীর বানানোর আগে কোরআন-হাদীসের কষ্টি পাথরে, শরীয়তের জওহারী সদৃশ্য আলেম ওলামা দ্বারা তাকে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে। আলেম-ওলামা যাকে সমর্থন করবে তাকে’ই গ্রহণ করতে হবে। আর যাকে বর্জন করতে বলবে তাকে বর্জন করতে হবে। নচেৎ ধোঁকা বাজদের ধোঁকায় পড়ে ঈমান হারাতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন-(আমীন)।
মাজার সংক্রান্ত দৃষ্টি ভঙ্গিঃ-
শরীয়তে তাসাউফ তথা আত্মশুদ্ধির কথা প্রমাণিত আছে। তাই এখানে সংক্ষেপে আত্মশুদ্ধির সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের এসব মাজারের বৈধতার কোনো সুযোগ শরীয়তে নেই। বরং বর্তমানের এসব মাজার-শিরক, বিদ’আত, গান-বাজনা ও সকল প্রকার অশ্লীলতা সহ চোর, বাটপার, হেরোইখোর, গাজাখোরদের এক জম-জমাট ব্যবসার স্থান। শরীয়া বিরোধী যতসব কুকর্মসহ রাষ্ট্রীয় আইন বিরোধী অনেক কাজ এসব মাজারে হয়ে থাকে। সুতরাং- সকল শ্রেণীর জনগণ এসব মাজার ও তৎসংশ্লিষ্টদের থেকে বেঁচে থাকা উচিৎ এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব মাজার ও তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
বর্তমান মাযার ও কবর পূজা এবং মুর্তিপূজা সাদৃশ্যতাঃ ভন্ড মাযারপন্থীদের মুখোশ উন্মোচন
শিরকের ইতিহাস হযরত নূহ আ: এর সময় প্লাবণে সকল কাফের মৃত্যু বরণ করার পর সবাই ছিল মুসলমান। তারপর এই মুস...
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন