২. আল বাকারা ( আয়াত নং - ২৪৩ )

bookmark
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ خَرَجُوۡا مِنۡ دِیَارِہِمۡ وَہُمۡ اُلُوۡفٌ حَذَرَ الۡمَوۡتِ ۪ فَقَالَ لَہُمُ اللّٰہُ مُوۡتُوۡا ۟ ثُمَّ اَحۡیَاہُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی النَّاسِ وَلٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَشۡکُرُوۡنَ
আলাম তারা ইলাল্লাযীনা খারাজূ মিন দিয়া-রিহিম ওয়া হুম উলূফুন হাযারাল মাওতি ফাকা-লা লাহুমুল্লা-হু মূতূ ছু ম্মা আহইয়া-হুম; ইন্নাল্লা-হা লাযূ ফাদলিন ‘আলান্নাছি ওয়ালা-কিন্না আকছারান্না-ছি লা-ইয়াশকুরূন।

অর্থঃ

মুফতী তাকী উসমানী

তুমি কি তাদের অবস্থা জান না, যারা মৃত্যু হতে বাঁচার জন্য নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল এবং তারা সংখ্যায় ছিল হাজার-হাজার? অতঃপর আল্লাহ তাদের বললেন, মরে যাও। তারপর তিনি তাদের জীবিত করলেন। ১৮২ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মানুষের প্রতি অতি অনুগ্রহশীল, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।

তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ

১৮২. এখান থেকে ২৬০ আয়াত পর্যন্ত দু’টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিহাদের প্রতি উৎসাহিত করা। কিন্তু মুনাফিক ও ভীরু প্রকৃতির লোক যেহতু মৃত্যুকে বড় ভয় পেত তাই তারা যুদ্ধে যেতে গড়িমসি করত, যে কারণে একই সঙ্গে দ্বিতীয় বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। তার সারমর্ম এই যে, জীবন ও মৃত্যু আল্লাহ তাআলারই হাতে। তিনি চাইলে যুদ্ধ ছাড়াও মৃত্যু দিতে পারেন এবং চাইলে ঘোরতর লড়াইয়ের ভেতরও প্রাণ রক্ষা করতে পারেন। বরং তার এ ক্ষমতাও রয়েছে যে, মৃত্যুর পরও তিনি মানুষকে জীবিত করতে পারেন। তাঁর এ ক্ষমতার সাধারণ প্রকাশ তো আখিরাতেই ঘটবে, কিন্তু এ দুনিয়াতেও তিনি জগতকে এমন কিছু নমুনা দেখিয়ে দিয়েছেন, যাতে মৃত লোককে আবার জীবিত করে তোলা হয়েছে। তার একটি দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছে এ আয়াতে (২৪৩)। তাছাড়া ২৫৩নং আয়াতে ইশারা করা হয়েছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে আল্লাহ তাআলা কয়েকজন মৃত লোককে জীবন দান করেছেন। এমনিভাবে ২৫৮নং আয়াতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও নমরূদের কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে, যাতে দেখানো হয়েছে মৃত্যু ও জীবন দানের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। চতুর্থ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ২৫৯নং আয়াতে। তাতে হযরত উযায়র (আ.)-এর ঘটনা দেখানো হয়েছে। তারপরে ২৬০নং আয়াতে পঞ্চম ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার কাছে আরজ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা মৃতকে কিভাবে জীবিত করেন তা তিনি দেখতে চান। বর্তমান আয়াত (নং ২৪৩)-এ যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, কুরআন মাজীদে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। কেবল এতটুকু বলা হয়েছে যে, কোনও এক কালে একটি সম্প্রদায় মৃত্যু থেকে বাঁচার লক্ষ্যে নিজেদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিল। তাদের সংখ্যা ছিল হাজার-হাজার। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঠিকই তাদের মৃত্যু ঘটান। তারপর আবার তাদেরকে জীবিত করে দেখিয়ে দেন, মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনও ব্যক্তি যদি আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্য করে কোনও কৌশলের আশ্রয় নেয়, তবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই যে, ঠিকই সে মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। যত বড় কৌশলই গ্রহণ করুক, তারপরও আল্লাহ তাআলা তাকে মৃত্যুর স্বাদ চাখাতে পারেন। এসব লোক কারা ছিল? কোন কালের ছিল? সেটা কি ছিল যে কারণে তারা মৃত্যু ভয়ে পালাচ্ছিল? এসব বিষয়ে কুরআন মাজীদে কিছু বলা হয়নি। বলা হয়নি এ কারণে যে, কুরআন মাজীদ তো কোন ইতিহাসগ্রন্থ নয়। এতে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার উদ্দেশ্য কেবল কোন বিষয়ে সবক দেওয়া। তাই আকছার ঘটনার সেই অংশই বর্ণিত হয়, যার দ্বারা সেই সবক লাভ হয়। এ ঘটনার যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তা দ্বারা উপরে বর্ণিত সবক লাভ হয়ে যায়। অবশ্য কুরআন মাজীদ যে ভঙ্গিতে ঘটনার প্রতি ইশারা করেছে তা দ্বারা অনুমান করা যায়, সে কালে এ ঘটনা মানুষের মধ্যে বিখ্যাত ও সুবিদিত ছিল। আয়াতের শুরুতে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘তুমি কি তাদের অবস্থা জান না”? এটা নির্দেশ করে, ঘটনাটি তখন প্রসিদ্ধ ছিল। সুতরাং হাফেজ ইবনে জারীর তাবারী (রহ.) এস্থলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) ও কয়েকজন তাবিঈ থেকে কয়েকটি রিওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন, যা দ্বারা জানা যায়, এটা বনী ইসরাঈলের ঘটনা। তারা সংখ্যায় হাজার-হাজার হওয়া সত্ত্বেও শত্রুর মুকাবিলা করতে সাহস পায়নি। উল্টো তারা প্রাণ ভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। অথবা তারা প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে এলাকা ছেড়েছিল। তারা যে স্থানকে নিরাপদ ভূমি মনে করেছিল, সেখানে পৌঁছামাত্র আল্লাহ তাআলার হুকুমে তাদের মৃত্যু এসে যায়। অনেক পরে যখন তাদের অস্থিরাজি জ্বরাজীর্ণ হয়ে যায় তখন হযরত হিযকীল আলাইহিস সালাম সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে আদেশ করলেন, তিনি যেন সে অস্থিরাজিকে লক্ষ্য করে ডাক দেন। তিনি ডাক দেওয়া মাত্র অস্থিসমূহে প্রাণ সঞ্চার হয় এবং পূর্ণ মানব আকৃতিতে তারা জীবিত হয়ে ওঠে। হযরত হিযকীল আলাইহিস সালামের এ ঘটনা বর্তমান বাইবেলেও বর্ণিত রয়েছে (দেখুন হিযকীল ৩৭:১-১৫)। কাজেই অসম্ভব নয় যে, মদীনায় এ ঘটনা ইয়াহুদীদের মাধ্যমে প্রচার লাভ করেছিল। ঘটনার উপরিউক্ত বিবরণ নির্ভরযোগ্য হোক বা না হোক, এতটুকু কথা তো কুরআন মাজীদের আয়াত দ্বারা সরাসরি ও সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, তাদেরকে সত্যিকারের মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করা হয়েছিল। আমাদের এ যুগের কোনও কোনও গ্রন্থকার মৃত লোকের জীবিত হওয়াকে অযৌক্তিক মনে করত এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন যে, আয়াতে মৃত্যু দ্বারা রাজনৈতিক ও চারিত্রিক মৃত্যু বোঝানো হয়েছে আর দ্বিতীয়বার জীবিত করার অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক বিজয়। কিন্তু এ জাতীয় ব্যাখ্যা এক তো কুরআন মাজীদের সুস্পষ্ট শব্দাবলীর সাথে খাপ খায় না, দ্বিতীয়ত এটা আরবী ভাষাশৈলী ও কুরআনী বর্ণনাভঙ্গীর সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সোজা-সাপ্টা কথা এই যে, আল্লাহ তাআলার অপার শক্তির উপর ঈমান থাকলে এ জাতীয় ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। সুতরাং এ রকম দূর-দূরান্তের ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন কি? বিশেষত এখান থেকে ২৬০নং আয়াত পর্যন্ত যে আলোচনা পরম্পরা চলছে, যার সারমর্ম পূর্বে বলা হয়েছে, সে আলোকে এস্থলে মৃত্যু ও জীবনের প্রকৃত অর্থই উদ্দিষ্ট হওয়া বেশি যুক্তিযুক্ত।