আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১৫- সূর্য-চন্দ্র গ্রহনের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ১০৪৪
৬৬৫. সূর্যগ্রহণের সময় সাদ্কা করা।
৯৮৭। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসলামা (রাহঃ) ......... আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সময় একবার সূর্যগ্রহণ হল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকদের নিয়ে নামায আদায় করেন। তিনি দীর্ঘ সময় কিয়াম করেন, এরপর দীর্ঘক্ষণ রুকু’ করেন। এরপর পুনরায় (নামাযে) তিনি উঠে দাঁড়ান এবং দীর্ঘ কিয়াম করেন। অবশ্য তা প্রথম কিয়ামের চাইতে অল্পস্থায়ী ছিল। আবার তিনি রুকু’ করেন এবং এ রুকু’ও দীর্ঘ করেন। তবে তা প্রথম রুকুর চাইতে অল্পস্থায়ী ছিল। এরপর তিনি সিজদা করেন এবং সিজদাও দীর্ঘক্ষণ করেন। এরপর তিনি প্রথম রাকআতে যা করেছিলেন তার অনুরূপ দ্বিতীয় রাক'আতেও করেন এবং যখন সূর্য প্রকাশিত হয় তখন নামায শেষ করেন।
এরপর তিনি লোকজনের উদ্দেশ্যে খুতবা দান করেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করেন। এরপর তিনি বলেনঃ সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন তোমরা আল্লাহর নিকট দুআ করবে। তাঁর মহত্ব ঘোষণা করবে এবং নামায আদায় করবে ও সাদ্কা প্রদান করবে। এরপর তিনি আরো বললেনঃ হে উম্মতে মুহাম্মাদী! আল্লাহর কসম, আল্লাহর কোন বান্দা যিনা করলে কিংবা কোন নারী যিনা করলে, আল্লাহর চাইতে বেশী অপছন্দকারী কেউ নেই। হে উম্মতে মুহাম্মাদী! আল্লাহর কসম, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে, তা হলে তোমরা অবশ্যই কম হাসতে ও বেশী কাঁদতে।
এরপর তিনি লোকজনের উদ্দেশ্যে খুতবা দান করেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ বর্ণনা করেন। এরপর তিনি বলেনঃ সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন তোমরা আল্লাহর নিকট দুআ করবে। তাঁর মহত্ব ঘোষণা করবে এবং নামায আদায় করবে ও সাদ্কা প্রদান করবে। এরপর তিনি আরো বললেনঃ হে উম্মতে মুহাম্মাদী! আল্লাহর কসম, আল্লাহর কোন বান্দা যিনা করলে কিংবা কোন নারী যিনা করলে, আল্লাহর চাইতে বেশী অপছন্দকারী কেউ নেই। হে উম্মতে মুহাম্মাদী! আল্লাহর কসম, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে, তা হলে তোমরা অবশ্যই কম হাসতে ও বেশী কাঁদতে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
সকল ইবাদতের সেরা ইবাদত নামায। প্রশ্ন হল, এই নামায কীভাবে সেরা নামায হিসেবে পরিগণিত হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন-
طول القنوت.
দীর্ঘ ‘কুনূত’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৬
এ ‘কুনূত’ শব্দ দিয়ে এখানে কী উদ্দেশ্য- এ বিষয়ে ইমাম নববী রাহ.-এর ভাষ্য হল, দীর্ঘ কুনূত মানে দীর্ঘ কিয়াম। দীর্ঘ সময় ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকা। আর দাঁড়িয়ে থাকা মানেই কুরআন তিলাওয়াত চালিয়ে যাওয়া।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর নির্দেশ-
یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ الَّیْلَ اِلَّا قَلِیْلًا، نِّصْفَهٗۤ اَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِیْلًا، اَوْ زِدْ عَلَیْهِ وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
হে কম্বলাবৃত! রাতে (নামাযে) দাঁড়িয়ে থাকো, কিছু অংশ ব্যতীত। অর্ধরাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম। অথবা তার চেয়ে কিছু বেশি। আর কুরআন তিলাওয়াত করো ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ১-৪
এ আদেশের বাস্তবায়ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে কীভাবে ঘটেছিল, এর একটি নমুনা আমরা লক্ষ করি হযরত মুগীরা ইবনে শু‘বা রা.-এর এ হাদীসে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন (দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে) তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আল্লাহ তো আপনার আগের-পরের সবকিছু ক্ষমা করে দিয়েছেন! (এরপরও কেন আপনি এত কষ্ট করছেন?) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا.
আমি কি তবে (আল্লাহ তাআলার) একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৬
আরেকটি উদাহরণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন রাতে নফল নামাযে দাঁড়ালেন। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাঁর সঙ্গে নামাযে শরীক হলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায এতটাই দীর্ঘ করছিলেন, যার সঙ্গে পেরে না উঠে হযরত ইবনে মাসউদ রা. নামায ছেড়ে দিতে চাইলেন। তার বক্তব্য এমন-
صَلّيْتُ مَعَ النّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَلَمْ يَزَلْ قَائِمًا حَتّى هَمَمْتُ بِأَمْرِ سَوْءٍ.
আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এক রাতে নামায পড়ছিলাম। তিনি এত দীর্ঘ সময় নামাযে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একপর্যায়ে আমি এক মন্দ চিন্তা করতে লাগলাম।
উপস্থিত ব্যক্তিরা জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কী চিন্তা করেছিলেন? তিনি উত্তর দিলেন-
هَمَمْتُ أَنْ أَقْعُدَ وَأَذَرَ النّبِيّ صلىالله عليه وسلم .
আমি চাইছিলাম, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এ নামায ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ি! -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৩৫
হযরত ইবনে মাসউদ রা. সম্পর্কে যারা জানেন, তারা জানেন- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রতি তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন! নবী-পরিবারের সদস্য না হয়েও তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তা সাহাবায়ে কেরামের কাফেলার মধ্যেও বিরল। স্বাভাবিক কথা, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নামাযের দীর্ঘতা সম্পর্কেও জেনে থাকবেন। কিন্তু সে ইবনে মাসউদ রা.-ই যখন নামায ছেড়ে দিতে চাইলেন, এতে সহজেই অনুমেয়- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে রাতের নামায কতটা দীর্ঘ হয়েছিল!
আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নফল নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন-
يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَأَلْ عَنْ حُسْنِهِنّ وَطُولِهِنّ ثُمّ يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَأَلْ عَنْ حُسْنِهِنّ وَطُولِهِنّ ثُمّ يُصَلِّي ثَلاَثًا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে প্রথমে (দুই রাকাত করে) চার রাকাত নামায পড়তেন। এগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথা তুমি জিজ্ঞেস করো না। এরপর আবার (দুই রাকাত করে) চার রাকাত পড়তেন। তুমি এগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথাও জানতে চেয়ো না। এরপর তিন রাকাত (বিতির) পড়তেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৭
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের মানুষ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব আমল তিনি নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত। অথচ সেই আমলের কথা যখন তিনি বর্ণনা করেছেন, কতটা বিস্ময় তার কথায় ঝরে পড়ছে, ভাবা যায়- ‘সে রাকাতগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তুমি জানতে চেয়ো না!’
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এলেন তখন আহলে কিতাব, যারা পূর্ববর্তী কোনো আসমানী কিতাবের অনুসারী, এককথায় ইহুদী-খ্রিস্টান, তাদের কেউ কেউ সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল, কেউ আবার মনেপ্রাণে গ্রহণ করল সে দাওয়াত। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কথাই শুধু নয়, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল তাদের কিতাবে। যাদের মধ্যে সত্যসন্ধানী মানসিকতা ছিল, তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে স্বীকার করল। এ শ্রেণির একটি পরিচয় মহান রাব্বুল আলামীন এভাবে দিয়েছেন-
مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ اُمَّةٌ قَآىِٕمَةٌ یَّتْلُوْنَ اٰیٰتِ اللهِ اٰنَآءَ الَّیْلِ وَ هُمْ یَسْجُدُوْنَ.
কিতাবীদের একটি দল এমন, যারা রাতের বিভিন্ন প্রহরে নামাযে দাঁড়িয়ে থেকে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১৩
দীর্ঘ সময় নিয়ে নামায পড়া, নামাযে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াতে ডুবে থাকা- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ তালীম গ্রহণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। পরবর্তী কালেও এ ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়নি কখনো। যুগে যুগেই নেককার বুযুর্গ ব্যক্তিগণের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- রাতের বেলা লম্বা সময় তারা নামায পড়তেন। ইমাম তিরমিযী রাহ. হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন- তারা এক রাকাতে পুরো কুরআন খতম করতেন। (দ্র. জামে তিরমিযী, ২৯৪৬ নং হাদীসের আলোচনা)
তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, হাদীসে যে দীর্ঘ সময় ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকাকে সর্বোত্তম নামায বলা হয়েছে, এর অর্থ এই নয়- কেবল নামাযের কিয়ামটুকুই দীর্ঘ হবে, আর রুকু-সিজদা ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত হবে; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ছিল এমন- তিনি যখন দীর্ঘক্ষণ নামাযে তিলাওয়াত করতেন, রুকু-সিজদাগুলোও দীর্ঘ করতেন। এভাবে তিনি পুরো নামাযের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেন। একবারের ঘটনা। রাতের বেলা সাহাবী হযরত হুযাইফা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়ছিলেন। হুযাইফা রা. নিজে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন-
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা বাকারা পড়তে শুরু করেছেন। আমি ভাবলাম, তিনি ১০০ আয়াত পড়ে রুকুতে যাবেন। ১০০ আয়াত শেষ করে তিনি আরও সামনে পড়তে লাগলেন। তখন ভাবলাম, তিনি হয়তো এক রাকাতেই সূরা বাকারা শেষ করবেন। সূরা বাকারা শেষ করার পর তিনি আরও পড়তে লাগলেন। এক সূরা। এরপর আরেক সূরা। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত ছিল খুবই ধীরস্থির। তিলাওয়াতের মাঝে যখন তাসবীহ পাঠের কথা আসত, তিনি তাসবীহ পাঠ করতেন, যখন দুআ করার কোনো বিষয় আসত, তিনি দুআ করতেন, যখন কোনো কিছু থেকে আশ্রয় চাওয়ার প্রসঙ্গ আসত, তিনি তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। এরপর সূরা বাকারা থেকে সূরা নিসা পর্যন্ত শেষ করার পর তিনি রুকুতে গেলেন। সেখানে রুকুর তাসবীহ পাঠ করলেন। তাঁর রুকুও ছিল তাঁর কিয়ামের প্রায় কাছাকাছি। এরপর দাঁড়ালেন। এবার দাঁড়ানো অবস্থায়ও রুকুর কাছাকাছি সময় কাটিয়ে দিলেন। এরপর সিজদায় গেলেন। সেখানে সিজদার তাসবীহ পাঠ করলেন। তাঁর সিজদাও ছিল দাঁড়িয়ে থাকার প্রায় কাছাকাছি সময় ধরে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭২
এভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে কিয়াম, রুকু, কওমা, সিজদা আদায় করার ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এই একটিই নয়। হাদীসের কিতাবে এমন বর্ণনা প্রচুর রয়েছে। এসব ঘটনা থেকে এ ভারসাম্যই প্রমাণিত হয়- নামাযের কিয়াম যখন দীর্ঘায়িত হবে, রুকু-সিজদাও দীর্ঘ হবে।
طول القنوت.
দীর্ঘ ‘কুনূত’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৬
এ ‘কুনূত’ শব্দ দিয়ে এখানে কী উদ্দেশ্য- এ বিষয়ে ইমাম নববী রাহ.-এর ভাষ্য হল, দীর্ঘ কুনূত মানে দীর্ঘ কিয়াম। দীর্ঘ সময় ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকা। আর দাঁড়িয়ে থাকা মানেই কুরআন তিলাওয়াত চালিয়ে যাওয়া।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহর নির্দেশ-
یٰۤاَیُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ الَّیْلَ اِلَّا قَلِیْلًا، نِّصْفَهٗۤ اَوِ انْقُصْ مِنْهُ قَلِیْلًا، اَوْ زِدْ عَلَیْهِ وَ رَتِّلِ الْقُرْاٰنَ تَرْتِیْلًا.
হে কম্বলাবৃত! রাতে (নামাযে) দাঁড়িয়ে থাকো, কিছু অংশ ব্যতীত। অর্ধরাত কিংবা তার চেয়ে কিছু কম। অথবা তার চেয়ে কিছু বেশি। আর কুরআন তিলাওয়াত করো ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে। -সূরা মুযযাম্মিল (৭৩) : ১-৪
এ আদেশের বাস্তবায়ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে কীভাবে ঘটেছিল, এর একটি নমুনা আমরা লক্ষ করি হযরত মুগীরা ইবনে শু‘বা রা.-এর এ হাদীসে-
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন (দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে) তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আল্লাহ তো আপনার আগের-পরের সবকিছু ক্ষমা করে দিয়েছেন! (এরপরও কেন আপনি এত কষ্ট করছেন?) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا.
আমি কি তবে (আল্লাহ তাআলার) একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৩৬
আরেকটি উদাহরণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন রাতে নফল নামাযে দাঁড়ালেন। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাঁর সঙ্গে নামাযে শরীক হলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায এতটাই দীর্ঘ করছিলেন, যার সঙ্গে পেরে না উঠে হযরত ইবনে মাসউদ রা. নামায ছেড়ে দিতে চাইলেন। তার বক্তব্য এমন-
صَلّيْتُ مَعَ النّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَلَمْ يَزَلْ قَائِمًا حَتّى هَمَمْتُ بِأَمْرِ سَوْءٍ.
আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এক রাতে নামায পড়ছিলাম। তিনি এত দীর্ঘ সময় নামাযে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একপর্যায়ে আমি এক মন্দ চিন্তা করতে লাগলাম।
উপস্থিত ব্যক্তিরা জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কী চিন্তা করেছিলেন? তিনি উত্তর দিলেন-
هَمَمْتُ أَنْ أَقْعُدَ وَأَذَرَ النّبِيّ صلىالله عليه وسلم .
আমি চাইছিলাম, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এ নামায ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ি! -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৩৫
হযরত ইবনে মাসউদ রা. সম্পর্কে যারা জানেন, তারা জানেন- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রতি তিনি কতটা যত্নবান ছিলেন! নবী-পরিবারের সদস্য না হয়েও তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তা সাহাবায়ে কেরামের কাফেলার মধ্যেও বিরল। স্বাভাবিক কথা, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নামাযের দীর্ঘতা সম্পর্কেও জেনে থাকবেন। কিন্তু সে ইবনে মাসউদ রা.-ই যখন নামায ছেড়ে দিতে চাইলেন, এতে সহজেই অনুমেয়- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে রাতের নামায কতটা দীর্ঘ হয়েছিল!
আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নফল নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন-
يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَأَلْ عَنْ حُسْنِهِنّ وَطُولِهِنّ ثُمّ يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَأَلْ عَنْ حُسْنِهِنّ وَطُولِهِنّ ثُمّ يُصَلِّي ثَلاَثًا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে প্রথমে (দুই রাকাত করে) চার রাকাত নামায পড়তেন। এগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথা তুমি জিজ্ঞেস করো না। এরপর আবার (দুই রাকাত করে) চার রাকাত পড়তেন। তুমি এগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথাও জানতে চেয়ো না। এরপর তিন রাকাত (বিতির) পড়তেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৭
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরের মানুষ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব আমল তিনি নিয়মিত দেখে অভ্যস্ত। অথচ সেই আমলের কথা যখন তিনি বর্ণনা করেছেন, কতটা বিস্ময় তার কথায় ঝরে পড়ছে, ভাবা যায়- ‘সে রাকাতগুলোর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তুমি জানতে চেয়ো না!’
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এলেন তখন আহলে কিতাব, যারা পূর্ববর্তী কোনো আসমানী কিতাবের অনুসারী, এককথায় ইহুদী-খ্রিস্টান, তাদের কেউ কেউ সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল, কেউ আবার মনেপ্রাণে গ্রহণ করল সে দাওয়াত। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের কথাই শুধু নয়, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল তাদের কিতাবে। যাদের মধ্যে সত্যসন্ধানী মানসিকতা ছিল, তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে স্বীকার করল। এ শ্রেণির একটি পরিচয় মহান রাব্বুল আলামীন এভাবে দিয়েছেন-
مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ اُمَّةٌ قَآىِٕمَةٌ یَّتْلُوْنَ اٰیٰتِ اللهِ اٰنَآءَ الَّیْلِ وَ هُمْ یَسْجُدُوْنَ.
কিতাবীদের একটি দল এমন, যারা রাতের বিভিন্ন প্রহরে নামাযে দাঁড়িয়ে থেকে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১৩
দীর্ঘ সময় নিয়ে নামায পড়া, নামাযে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াতে ডুবে থাকা- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ তালীম গ্রহণ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। পরবর্তী কালেও এ ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়নি কখনো। যুগে যুগেই নেককার বুযুর্গ ব্যক্তিগণের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- রাতের বেলা লম্বা সময় তারা নামায পড়তেন। ইমাম তিরমিযী রাহ. হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন- তারা এক রাকাতে পুরো কুরআন খতম করতেন। (দ্র. জামে তিরমিযী, ২৯৪৬ নং হাদীসের আলোচনা)
তবে লক্ষণীয় বিষয় হল, হাদীসে যে দীর্ঘ সময় ধরে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকাকে সর্বোত্তম নামায বলা হয়েছে, এর অর্থ এই নয়- কেবল নামাযের কিয়ামটুকুই দীর্ঘ হবে, আর রুকু-সিজদা ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত হবে; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ছিল এমন- তিনি যখন দীর্ঘক্ষণ নামাযে তিলাওয়াত করতেন, রুকু-সিজদাগুলোও দীর্ঘ করতেন। এভাবে তিনি পুরো নামাযের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেন। একবারের ঘটনা। রাতের বেলা সাহাবী হযরত হুযাইফা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়ছিলেন। হুযাইফা রা. নিজে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন-
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা বাকারা পড়তে শুরু করেছেন। আমি ভাবলাম, তিনি ১০০ আয়াত পড়ে রুকুতে যাবেন। ১০০ আয়াত শেষ করে তিনি আরও সামনে পড়তে লাগলেন। তখন ভাবলাম, তিনি হয়তো এক রাকাতেই সূরা বাকারা শেষ করবেন। সূরা বাকারা শেষ করার পর তিনি আরও পড়তে লাগলেন। এক সূরা। এরপর আরেক সূরা। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত ছিল খুবই ধীরস্থির। তিলাওয়াতের মাঝে যখন তাসবীহ পাঠের কথা আসত, তিনি তাসবীহ পাঠ করতেন, যখন দুআ করার কোনো বিষয় আসত, তিনি দুআ করতেন, যখন কোনো কিছু থেকে আশ্রয় চাওয়ার প্রসঙ্গ আসত, তিনি তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। এরপর সূরা বাকারা থেকে সূরা নিসা পর্যন্ত শেষ করার পর তিনি রুকুতে গেলেন। সেখানে রুকুর তাসবীহ পাঠ করলেন। তাঁর রুকুও ছিল তাঁর কিয়ামের প্রায় কাছাকাছি। এরপর দাঁড়ালেন। এবার দাঁড়ানো অবস্থায়ও রুকুর কাছাকাছি সময় কাটিয়ে দিলেন। এরপর সিজদায় গেলেন। সেখানে সিজদার তাসবীহ পাঠ করলেন। তাঁর সিজদাও ছিল দাঁড়িয়ে থাকার প্রায় কাছাকাছি সময় ধরে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৭২
এভাবে দীর্ঘ সময় নিয়ে কিয়াম, রুকু, কওমা, সিজদা আদায় করার ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে এই একটিই নয়। হাদীসের কিতাবে এমন বর্ণনা প্রচুর রয়েছে। এসব ঘটনা থেকে এ ভারসাম্যই প্রমাণিত হয়- নামাযের কিয়াম যখন দীর্ঘায়িত হবে, রুকু-সিজদাও দীর্ঘ হবে।
