আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
১৩- বিতর নামাযের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৯৯২
৬২৮. বিতর নামাযের অধ্যায়ঃ বিতরের বিবরণ।
৯৩৮। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসলামা (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তার খালা উম্মুল মু’মিনীন মাইমুনা (রাযিঃ) এর ঘরে রাত কাটান। (তিনি বলেন) আমি বালিশের প্রস্থের দিক দিয়ে শয়ন করলাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তার পরিবার সেটির দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে শয়ন করলেন। নবী (ﷺ) রাতের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত ঘুমালেন। এরপর তিনি জাগ্রত হলেন এবং চেহারা থেকে ঘুমের আবেশ দূর করেন। পরে তিনি সূরা আলে ইমরানের (শেষ) দশ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। তারপর নবী (ﷺ) একটি ঝুলন্ত মশকের নিকট গেলেন এবং উযু করলেন। এরপর তিনি নামাযে দাঁড়ালেন। আমিও তার মতই করলাম এবং তার পাশেই দাঁড়ালাম। তিনি তার ডান হাত আমার মাথার উপর রাখলেন এবং আমার কান ধরলেন। এরপর তিনি দু’রাকআত নামায আদায় করলেন। এরপর দু’রাকআত, এরপর দু’রাকআত, এরপর দু’রাকআত, এরপর দু’রাকআত, এরপর তিনি বিতর আদায় করলেন। তারপর তিনি শুয়ে পড়লেন। অবশেষে মুয়াযযিন তার কাছে এলো। তখন তিনি দাঁড়িয়ে দু’রাকআত নামায আদায় করলেন। তারপর বের হয়ে ফজরের নামায আদায় করলেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত তাহাজ্জুদের পর বিতর নামায পড়তেন। এটি ছিল নবীজীর সাধারণ অভ্যাস। বয়স ও পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অবস্থার কারণে তাহাজ্জুদের রাকাতসংখ্যা কম-বেশি হত। কিন্তু বিতর সর্বদা তিন রাকাতই পড়তেন। এক রাকাত বিতর পড়া নবীজী থেকে প্রমাণিত নয়। যে সব রেওয়ায়াতে পাঁচ, সাত বা নয় রাকাতের কথা এসেছে, তাতেও বিতর তিন রাকাতই। বর্ণনাকারী আগে-পরের রাকাত মিলিয়ে সমষ্টিকে ‘বিতর’ শব্দে ব্যক্ত করেছেন। হাদীসের রেওয়ায়াতসমূহে ব্যাপকভাবে বিতর ও তাহাজ্জুদের সমষ্টিকে ‘বিতর’ বলা হয়েছে। এটি একটি উপস্থাপনাগত বিষয়।
নবীজী বিতর তিন রাকাত পড়তেন। এটিই তাঁর অনুসৃত পন্থা। নিম্নের হাদীসসমূহ থেকে বিষয়টি সুপ্রমাণিত।
আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করেন যে, রমযানে নবীজীর নামায কেমন হত? তিনি উত্তরে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে এবং রমযানের বাইরে এগার রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না! এরপর আরও চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তো বলাই বাহুল্য! এরপর তিন রাকাত (বিতর) পড়তেন।-সহীহ বুখারী ১/১৫৪, হাদীস ১১৪৭; সহীহ মুসলিম ১/২৫৪, হাদীস ৭৩৮; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮, হাদীস ১৬৯৭; সুনানে আবু দাউদ ১/১৮৯, হাদীস ১৩৩৫; মুসনাদে আহমদ ৬/৩৬, হাদীস ২৪০৭৩
সা‘দ ইবনে হিশাম রাহ. বলেন, হযরত আয়েশা রা. তাকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। -সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; হাদীস ১৬৯৮; মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ১৫১ (বাবুস সালাম ফিল বিতর) মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৪, হাদীস ৬৯১২; সুনানে দারাকুতনী ২/৩২, হাদীস ১৫৬৫; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৩/৩১
এই হাদীসটি ইমাম হাকেম আবু আব্দুল্লাহ রাহ.ও ‘মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন। তার আরবী পাঠ এই- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يسلم في الركعتين الأوليين من الوتر অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। ইমাম হাকেম (রহ.) তা বর্ণনা করার পর বলেন- هذا حديث صحيح على شرط الشيخين অর্থাৎ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ। ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. ‘তালখীসুল মুস্তাদরাক’-এ হাকেম রাহ.-এর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। -মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন ১/৩০৪, হাদীস ১১৮০
এই হাদীস দ্বারা একদিকে যেমন প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাধারণ নিয়মে তিন রাকাত বিতর আদায় করতেন তেমনি একথাও প্রমাণিত হয় যে, তিন রাকাতের দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদের জন্য বসতেন, কিন্তু সালাম ফেরাতেন না। সালাম ফেরাতেন সবশেষে তৃতীয় রাকাতে। যদি দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক করার নিয়ম না থাকত তাহলে সালাম করার বা না করার প্রসঙ্গতই আসত না। কেননা সালাম তো ফেরানো হয়ে থাকে।
ইমাম ইবনে হাযম যাহেরী রাহ. ‘মুহাল্লা’ কিতাবে বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতির মাঝে আলোচিত পদ্ধতিটিও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বিতর তিন রাকাত পড়া হবে। দ্বিতীয় রাকাতে বসবে এবং (তাশাহহুদ পড়ে) সালাম ফেরানো ছাড়াই দাঁড়িয়ে যাবে। তৃতীয় রাকাত পড়ে বসবে, তাশাহহুদ পড়বে এবং সালাম ফেরাবে, যেভাবে মাগরিবের নামায পড়া হয়। এটিই ইমান আবু হানীফা রাহ.-এর মত। এর দলিল হচ্ছে, সাদ ইবনে হিশাম রাহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যাতে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। -মুহাল্লা ইবনে হাযম ২/৮৯
সাদ ইবনে হিশাম রাহ.-এর রেওয়ায়াতটি আরও একটি সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার আরবী পাঠ নিম্নরূপ- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث لا يسلم إلا في آخرهن অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন এবং শুধু সর্বশেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন। হাকেম রাহ. এই রেওয়ায়াতের পর লেখেন, আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.ও এভাবে বিতর পড়তেন এবং তাঁর সূত্রে মদীনাবাসীগণ তা গ্রহণ করেছেন। -মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন ১/৩০৪, হাদীস ১১৮১
(৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী কাইস বলেন- قلت لعائشة : بكم كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر؟ قالت: كان يوتر بأربع وثلاث, وست وثلاث, وثمان وثلاث, وعشر وثلاث, ولم يكن يوتر بأنقص من سبع, ولا بأكثر من ثلاث عشرة. অর্থাৎ আমি হযরত আয়েশা রা.-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবীজী বিতরে কত রাকাত পড়তেন? উত্তরে তিনি বলেন, চার এবং তিন, ছয় এবং তিন, আট এবং তিন, দশ এবং তিন। তিনি বিতরে সাত রাকাতের কম এবং তের রাকাতের অধিক পড়তেন না। -সুনানে আবু দাউদ ১/১৯৩, হাদীস ১৩৫৭ (১৩৬২); তহাবী শরীফ ১/১৩৯; মুসনাদে আহমদ ৬/১৪৯, হাদীস ২৫১৫৯
চিন্তা করে দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদ নামায কখনো চার রাকাত, কখনো ছয় রাকাত, কখনো আট রাকাত, কখনো দশ রাকাত পড়তেন; কিন্তু মূল বিতর সর্বদা তিন রাকাতই হত।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ফাতহুল বারী ৩/২৬ باب كيف صلاة الليل, كتاب التهجد)- এ লেখেন- هذا أصح ما وقفت عليه من ذلك, وبه يجمع بين ما اختلف عن عائشة في ذلك. والله أعلم আমার জানামতে এটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বাধিক সহীহ রেওয়ায়াত। এ বিষয়ে হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসের বর্ণনাকারীদের মাঝে যে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এর দ্বারা সে সবের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব।
(৪) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাহাজ্জুদ ও বিতর প্রত্যক্ষ করার জন্য হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এক রাতে তাঁর খালা উম্মুল মুমিনীন হযরত মাইমূনা রা.-এর ঘরে অবস্থান করেন। তিনি যা যা প্রত্যক্ষ করেছেন বর্ণনা করেছেন। তাঁর শাগরেদরা সে বিবরণ বিভিন্ন শব্দে বর্ণনা করেছেন। আমি এখানে সুনানে নাসায়ী ও অন্যান্য হাদীসের কিতাব থেকে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করছি- ‘মুহাম্মাদ ইবনে আলী তার পিতা থেকে, তিনি তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে শযা্য থেকে উঠলেন, এরপর মেসওয়াক করলেন, এরপর দুই রাকাত পড়লেন, এরপর শুয়ে গেলেন। তারপর পুনরায় শয্যা ত্যাগ করলেন, মেসওয়াক করলেন, অযু করলেন এবং দুই রাকাত পড়লেন; এভাবে ছয় রাকাত পূর্ণ করলেন। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন। এরপর দুই রাকাত পড়েন। حتى صلى ستا ثم أوتر بثلاث وصلى ركعتين -সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯, হাদীস ১৭০৪; মুসনাদে আহমাদ ১/৩৫০, হাদীস ৩২৭১; তহাবী শরীফ ১/২০১-২০২
(৫) প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম সাঈদ ইবনে জুবাইর, যিনি ইবনে আব্বাস রা.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث ويقرأ في الأولى سبح اسم ربك الأعلى, وفي الثانية قل يا أيها الكفرون, وفي الثالثة قل هو الله أحد. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন, প্রথম রাকাতে ‘সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আলা’, দ্বিতীয় রাকাতে ‘কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন’ এবং তৃতীয় রাকাতে ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ পড়তেন। -সুনানে দারেমী ১/৩১১, হাদীস ১৫৯৭; জামে তিরমিযী ১/৬১, হাদীস ৪৬২; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; হাদীস ১৭০২; তহাবী শরীফ ১/২০১, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/৫১২, হাদীস ৬৯৫১ ইমাম নববী রাহ. ‘আলখুলাসা’ কিতাবে উক্ত হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। -নাসবুর রায়াহ, জামালুদ্দীন যাইলায়ী ২/১১৯ বিতরের তিন রাকাতে উপরোক্ত তিন সূরা, এক এক রাকাতে এক এক সূরা, পড়া সম্পর্কে একাধিক সাহাবী থেকে রেওয়ায়াত বিদ্যমান রয়েছে। প্রতিটি রেওয়ায়াত প্রমাণ করে যে, বিতরের নামায তিন রাকাত। মোটকথা, বিতরের নামায তিন রাকাত হওয়ার বিষয়ে হাদীস ও সুন্নাহর বহু প্রমাণা রয়েছে এবং অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমলও তাই ছিল। এখানে আরেকটি হাদীস উল্লেখ করছি- عن ثابت قال: قال أنس: يا أبا محمد خذ عني فإني أخذت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم, وأخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الله, ولن تأخذ عن أحد أوثق مني, قال: ثم صلى بي العشاء, ثم صلى سب ركعات يسلم بين الركعتين, ثم أوتر بثلاث يسلم في آخرهن (الروياني وابن عساكر, ورجاله ثقات, كما في كنز العمال) প্রসিদ্ধ তাবেয়ী সাবেত বুনানী রাহ., বলেন, আমাকে হযরত আনাস ইবনে মালেক রাহ. বলেছেন, হে আবু মুহাম্মাদ! (সাবেত রা.-এর কুনিয়াত-উপনাম) আমার কাছ থেকে শিখে নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি। আর তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে নিয়েছেন। তুমি শেখার জন্য আমার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না। একথা বলে তিনি আমাকে নিয়ে ইশার নামায আদায় করেন। এরপর ছয় রাকাত পড়েন, তা এভাবে যে, প্রতি দুই রাকাতে সালাম ফেরান। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়েন এবং সবশেষে সালাম ফেরান। -মুসনাদে রুয়ানী, তারীখে ইবনে আসাকির; ইমাম সুয়ূতী রাহ. বলেন, এই হাদীসের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য (কানযুল উম্মাল ৮/৬৬-৬৭, হাদীস ২১৯০২ ‘আলবিতরু মিন কিতাবিস সালাত, কিসমুল আফআল)
জরুরি জ্ঞাতব্য
বিতর নামাযের ব্যাপারে আজকাল এক ব্যাপক অবহেলা এই পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, একে এমন এক নামায মনে করা হয় যার আগে কোন নফল নামায নেই, যেমন মাগরিবের নামায; এর আগে নফল নামায মাসনূন নয়; অথচ বিতরের ব্যাপারে শরীয়তের কাম্য এই যে, তা কিছু নফল নামায পড়ার পর আদায় করা। সবচেয়ে ভাল এই যে, যার শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য জাগার নিশ্চয়তা রয়েছে, সে তাহাজ্জুদের পরে বিতর পড়বে। যদি বিতর রাতের শুরু ভাগে ইশার পর পড়া হয় তবুও উত্তম এই যে, দুই-চার রাকাত নফল নামায পড়ার পর বিতর আদায় করবে। মাগরিবের মত আগে কোন নফল ছাড়া শুধু তিন রাকাত বিতর পড়া পছন্দনীয় নয়। হাদীস শরীফে আছে- لا توتروا بثلاث تشبهوا بصلاة المغرب, ولكن أوتروا بخمس, أو بسبع, أو بتسع, أو بإحدى عشرة ركعة, أو أكثر من ذلك. তোমরা শুধু তিন রাকাত বিতর পড়ো না, এতে মাগরিবের সাদৃশ্যপূর্ণ করে ফেলবে; বরং পাঁচ, সাত, নয়, এগার বা এরও অধিক রাকাতে বিতর পড়ো। -মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩০৪, হাদীস ১১৭৮; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৩/৩১, ৩২
মোটকথা, বিতরের আগে কিছু নফল অবশ্যই পড়-দুই, চার, ছয়, আট-যত রাকাত সম্ভব হয় পড়ে নাও। ৩ নং-এর অধীনে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর হাদীস উল্লিখিত হয়েছে, যাতে তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার এবং তিন, ছয় এবং তিন, আট এবং তিন, দশ এবং তিন-বিভিন্ন সংখ্যায় রাতের নামায আদায় করতেন। উল্লিখিত হাদীসে ওই নির্দেশনাই এসেছে যে, শুধু তিন রাকাত বিতর পড়ো না, আগে কিছু নফল অবশ্যই পড়। তবে বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাতই।
উক্ত হাদীসের সাথে একথার কোন সম্পর্ক নেই যে, তিন রাকাত এক বৈঠকেই পড়তে হবে, তাহলেই শুধু তা মাগরিবের সাদৃশ্য থেকে বেঁচে যাবে। তাই তিন রাকাত পড়তে হলে তা এক বৈঠকেই পড়তে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, মাগরিবের সাদৃশ্য থেকে বাঁচার পদ্ধতি হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তিন রাকাত বিতরের আগে নফল পড়ে নাও। হাদীসের ব্যাখ্যা ছেড়ে নিজের পক্ষ থেকে বিতরের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা বিভ্রানি- ছাড়া আর কিছুই নয়।
শরীয়তে সকল নামাযের মূলকথা এই যে, প্রতি দুই রাকাতে বৈঠক হবে এবং তাশাহহুদ পড়া হবে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে সহীহ মুসলিম ১/১৯৪, হাদীস ৪৯৮-এ একটি দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক ব্যাপক বাণী উদ্ধৃত রয়েছে। তাতে তিনি ইরশাদ করেন- وفي كل ركعتين التحية ‘প্রতি দুই রাকাতে তাশাহহুদ রয়েছে।’ একই হুকুম একাধিক সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত রয়েছে। শরীয়তের ব্যাপক শিক্ষা পরিহার করে কোন রেওয়ায়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে একথা বলা যে, তিন রাকাত বিতর পড়লে শুধু এক বৈঠকেই পড়া-এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد -এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা উম্মতকে উক্ত অনিষ্ট থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
আরো কিছু হাদীসঃ
১. আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘রমযানুল মুবারকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামায কীরূপ হত?’ উম্মুল মুমিনীন বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে ও রমযানের বাইরে এগারো রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন-এত সুন্দর ও দীর্ঘ সে নামায, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অতঃপর চার রাকাত পড়তেন-এরও দীর্ঘতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে চেয়ো না। এরপর তিন রাকাত পড়তেন।’ عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه سأل عائشة رضي الله عنها كيف كان صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم في رمضان؟ قالت ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة، يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي ثلاثا. (সহীহ বুখারী ১/১৫৪; সহীহ মুসলিম ১/২৫৪; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; সুনানে আবু দাউদ ১/১৮৯; মুসনাদে আহমদ ৬/৩৬)
২. সা’দ ইবনে হিশাম বলেন, (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা রা. বলেছেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ عن سعد بن هشام أن عائشة حدثته أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان لا يسلم في ركعتي الوتر. (সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫১)
৩. ইমাম হাকেম রাহ. সা’দ ইবনে হিশামের বিবরণ এভাবে বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يسلم في الركعتين الأوليين من الوتر. هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ولم يخرجاه (আলমুস্তাদরাক ১/৩০৪)
৪. অন্য সনদে বিবরণটি এভাবেও বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন এবং শুধু শেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন। আমীরুল মু’মিনীন উমর রা. এই নিয়মে বিতর পড়তেন এবং তাঁরই সূত্রে আহ্লে মদীনা এই নিয়ম গ্রহণ করেছে।’ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث، لا يسلم إلا في آخرهن. وهذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه، وعنه أخذه أهل المدينة. (আলমুস্তাদরাক)
৫. মুসনাদে আহমদ কিতাবে (৬/১৫৬) বিবরণটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার নামায আদায় করে ঘরে আসতেন এবং দুই রাকাত নামায পড়তেন। এরপর আরো দুই রাকাত পড়তেন, যা পূর্বের নামাযের চেয়ে দীর্ঘ হত। অতঃপর তিন রাকাত পড়তেন, যা মাঝখানে আলাদা করতেন না। এরপর বসে বসে দুই রাকাত নামায পড়তেন। রুকু-সেজদাও সেভাবেই করতেন। أن رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا صلى العشاء دخل المنزل ثم صلى ركعتين. ثم صلى بعدهما ركعتين أطول منهما، ثم أوتر بثلاث، لا يفصل بينهن ثم صلى ركعتين وهو جالس، يركع وهو جالس ويسجد وهو جالس.
৬. আবদুল্লাহ ইবনে আবু কায়স বলেন, আমি (উম্মুল মু’মিনীন) আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত রাকাত বিতর (আদায়) করতেন? উম্মুল মু’মিনীন বললেন, ‘চার ও তিন রাকাত, ছয় ও তিন রাকাত এবং আট ও তিন রাকাত। তিনি তেরো রাকাতের অধিক এবং সাত রাকাতের কম বিতর করতেন না।’ عن عبد الله بن أبي قيس قال سألت عائشة رضي الله عنها بكم كان رسول الله صلى الله صليه وسلم يوتر قالت : بأربع وثلاث، وست وثلاث، وثمان وثلاث ولم يكن يوتر بأكثر من ثلاث عشرة ولا أنقص من سبع. (সুনানে আবু দাউদ ১/১৯৩; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৩৯) উপরোক্ত হাদীসে তাহাজ্জুদ ও বিতরকে একত্রে ‘বিতর’ বলা হয়েছে। এতে মূল বিতর তিন রাকাত, বাকীগুলো তাহাজ্জুদ।
৭. আবদুল আযীয ইবনে জুরাইজ বলেন, ‘আমি (উম্মুল মু’মিনীন) আয়েশা সিদ্দীকা রা.কে জিজ্ঞাস করেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামাযে কী কী সূরা পাঠ করতেন? উম্মুল মু’মিনীন বলেছেন, তিনি প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ ও ‘মুআওয়াযাতাইন’ (ফালাক ও নাস) পাঠ করতেন।’ عن عبد العزيز بن جريج قال سألت عائشة رضي الله عنها بأي شيء كان يوتر رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ قال يقرأ في الأولى بسبح اسم ربك الأعلى، وفي الثانية بقل يا ايها الكافرون وفي الثالثة بقل هو الله احد والمعوذتين. قال أبو عيسى هذا حديث حسن غريب. (সুনানে আবু দাউদ ১/২০১; সুনানে তিরমিযী পৃ. ৬১; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ৭৩; মুসনাদে আহমদ ৬/২২৭; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক
৮. ‘আমরা বিনতে আবদুর রহমান উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন। প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন।’ عن عمرة عن عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يوتر بثلاث. يقرأ في الركعة الأولى بسبح اسم ربك الأعلى، وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد وقل اعوذ برب الفلق وقل اعوذ برب الناس. هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ولم يخرجاه. وقال الذهبي رواه ثقات عنه، وهو على شرط خ ـ م. (আলমুসতাদরাক ১/৩০৫)
৯. মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর পিতা আলী ইবনে আবদুল্লাহ থেকে, তিনি তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয্যাত্যাগ করলেন, অতঃপর মিসওয়াক করলেন এবং দুই রাকাত করে ছয় রাকাত নামায আদায় করে শয্যাগ্রহণ করলেন। কিছুক্ষণ পর পুনরায় শয্যাত্যাগ করলেন, মিসওয়াক করলেন এবং দুই রাকাত করে ছয় রাকাত আদায় করলেন। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন। এরপর আরো দুই রাকাত (অর্থাৎ ফজরের সুন্নত) আদায় করলেন।’ عن محمد بن علي عن أبيه عن جده عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قام من الليل فاستن ثم صلى ركعتين ثم نام ثم قام فاستن ثم توضأ فصلى ركعتين حتى صلى ستا ثم أوتر بثلاث وصلى ركعتين. (সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯)
১০. ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে আট রাকাত নামায পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। অতঃপর ফজরের নামাযের পূর্বে দুই রাকাত নামায পড়তেন।’ عن يحي بن الجزار عن ابن عباس رضي الله عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي من الليل ثمان ركعات ويوتر بثلاث ويصلي ركعتين قبل صلاة الفجر. (সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৪০)
১১. সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন, প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়তেন।’ عن سعيد بن جبير عن ابن عباس رضي الله عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث يقرأ في الأولى سبح اسم ربك الأعلى وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد. (সুনানে দারেমী ১/৩১১, হাদীস : ১৫৯৭; সুনানে তিরমিযী ১/৬১; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ৮৩; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৪০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ১/২৯৯; আল-মুহাল্লা, ইবনে হায্ম ২/৫১) ইমাম নববী ‘খুলাসা’ কিতাবে বলেন, بإسناد صحيح অর্থাৎ হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত। (নাসবুর রায়া ২/১১৯) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ছাড়াও বিতরের তিন রাকাতে তিন সূরা পাঠের হাদীস যাঁরা বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : ১. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবযা রা.। (নাসায়ী ১/২৫১; তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৮; আবদুর রাযযাক ২/৩৩) ২. হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা.। (নাসায়ী ১/২৪৮; ইবনে আবী শায়বা ২/৩০০) ৩. হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.। (তিরমিযী ১/৬১; আবদুর রাযযাক ৩/৩৪; তহাবী ১/১৪২) ৪. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৬. হযরত নু’মান ইবনে বাশীর রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৭. হযরত আবু হুরায়রা রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৯. হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রান.। (তহাবী ১/১৪২; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৮; মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪১; কানযুল উম্মাল ১/১৯৬) ১০. আবু খাইছামা রা. তাঁর পিতা হযরত মুয়াবিয়া ইবনে খাদীজ রা. থেকে। (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪১) ১২. আমির ইবনে শারাহীল শা’বী রাহ. বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতের নামায সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.কে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা বলেছেন, ‘তেরো রাকাত নামায পড়তেন। আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতর। অতঃপর সোবহে সাদেক হওয়ার পর আরো দুই রাকাত পড়তেন।’ عن عامر الشعبي قال سألت ابن عمر وابن عباس رضي الله عنهما كيف كان صلاة رسول الله صلى ا لله عليه وسلم بالليل فقالا ثلاث عشرة ركعة، ثمان ويوتر بثلاث، وركعتين بعد الفجر. (তহাবী ১/১৩৬)
১৩. ছাবিত আল বুনানী রাহ. বলেন, হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. আমাকে বললেন, ‘হে ছাবিত! আমার নিকট থেকে (দ্বীনের আহকাম) গ্রহণ কর। কারণ (এ বিষয়ে এখন) আমার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তুমি আর পাবে না। আমি (দ্বীন) গ্রহণ করেছি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে। তিনি জিব্রীল আ.-এর নিকট থেকে। আর জিব্রীল আ. গ্রহণ করেছেন আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে।’ এরপর আনাস রা. আমাকে নিয়ে ইশার নামায আদায় করলেন। অতঃপর ছয় রাকাত নামায এভাবে পড়লেন যে, প্রতি দু রাকাতে সালাম ফেরাতেন। শেষে তিন রাকাত বিতর পড়লেন ও সর্বশেষ রাকাতে সালাম ফেরালেন। عن ثابت البناني قال قال لي أنس بن مالك يا ثابت اخذ عني، فإنك لن تأخذ عن أحد أوثق مني، إني أخذته عن رسول الله صلى الله عليه وسلم وأخذه رسول الله صلى الله عليه وسلم عن جبريل وأخذ جبريل عن الله عز وجل، قال : ثم صلى بي العشاء ثم صلى ست ركعات يسلم بين كل ركعتين ثم يوتر بثلاث، يسلم في آخرهن. رواه الروياني وابن عساكر ورجاله ثقات. (কানযুল উম্মাল ৪/১৯৬)
১৪. ইমাম আবু হানীফা রাহ. ইমাম আবু জা’ফর বাকির রাহ. থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশা ও ফজরের মাঝে তেরো রাকাত নামায পড়তেন। আট রাকাত নফল, তিন রাকাত বিতর এবং দুই রাকাত ফজরের সুন্নত। أخبرنا أبو حنيفة، حدثنا أبو جعفر قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي ما بين صلاة العشاء إلى صلاة الصبح ثلاث عشرة ركعة ثمان ركعات تطوعا، وثلاث ركعات الوتر وركعتي الفجر. (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৪৯)
এই হাদীসগুলো থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণ হয়। যথা : ক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন।
খ. তিন রাকাত এক সালামে আদায় করতেন।
গ. বিশেষ কয়েকটি সূরা তেলাওয়াত করতেন।
এ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায কীভাবে আদায় করতেন সে বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এবার তাঁর কিছু বাণী উল্লেখ করছি।
১. হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘বিতর নামায শুধু তিন রাকাত পড়ো না; বরং পাঁচ রাকাত বা সাত রাকাত পড়। একে মাগরিবের নামাযের মতো বানিয়ে ফেলো না।’ عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لا توتروا بثلاث وأوتروا بخمس أو سبع، ولا تشبهوا بصلاة المغرب. وقال رجاله ثقات (তহাবী ১/১৪৩; দারাকুতনী পৃ. ১৭১; صحيح على شرط الشيخين হাকিম ১/৩০৪
২. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মাগরিব হল দিবসের বিতর। অতএব তোমরা রাতের নামাযকেও বিতর (বেজোড়) কর। عن ابن عمر رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال صلاة المغرب وتر النهار فأوتروا صلاة الليل. (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/২৮) মুসনাদে আহমদে রেওয়ায়েতটি এভাবে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাগরিবের নামায দিবসের নামাযকে বিতর (বেজোড়) করেছে। অতএব রাতের নামাযকেও বিতর (বেজোড়) কর। ولأحمد عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال صلاة المغرب أوترت صلاة النهار فأوتروا صلاة الليل. قال العراقي : سنده حسن. (যুরকানী শরহুল মুয়াত্তা ১/২৫৯; ইলাউস সুনান ৬/১১)
৩. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাগরিব যেমন তিন রাকাত তেমনি বিতরও তিন রাকাত।’ عن عائشة رضي الله عنها قالت : قال رسول الله صلى عليه وسلم الوتر ثلاث كثلاث المغرب. (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪২)
৪. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দিবসের বিতর অর্থাৎ মাগরিব যেমন তিন রাকাত তেমনি রাতের বিতরও তিন রাকাত।’ عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال رسول ا لله صلى الله عليه وسلم وتر الليل ثلاث كوتر النهار صلاة المغرب. (দারাকুতনী, নাসবুর রায়া ২/১১৯) উল্লেখ্য, শেষোক্ত রেওয়ায়েত দু’টি ‘মারফু’ হওয়ার বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের আপত্তি আছে, কিন্তু প্রথমত বর্ণনা দুটির বিষয়স্তু অন্যান্য সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত, দ্বিতীয়ত বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে রেওয়াত দু’টি ‘হাসান’ বলে গণ্য। তাছাড়া হযরত আয়েশা রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাণী সহীহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে, যা সামনে উল্লেখ করা হবে। আর এ ধরনের বিষয় যেহেতু নিছক যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায় না এজন্য মওকূফ হাদীসও এক্ষেত্রে ‘মারফু’ বলে গণ্য হবে। মোটকথা, উপরের হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে বিতর নামায মাগরিবের মতোই তিন রাকাত। তদ্রূপ মাগরিবের মাধ্যমে যেমন দিবসের নামায বেজোড় হয় তেমনি বিতরের মাধ্যমে রাতের নামায বেজোড় হয়ে যায়। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায শুধু তিন রাকাত পড়া পছন্দ করেননি; বরং বিতরের পূর্বে দু’ চার রাকাত হলেও নফল পড়ার আদেশ করেছেন। যেন বিতর ও মাগরিবের মাঝে পার্থক্য হয়। কারণ মাগরিবের পূর্বে নফল নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও কর্মের পর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কর্মপন্থা উল্লেখ করছি। এতে খায়রুল কুরূনের তা’আমুল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
১. মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রাহ. বলেন, ‘আমরা রাতের বেলায় আবু বকর সিদ্দীক রা.কে দাফন করলাম। উমর রা. বললেন, আমি এখনো বিতর পড়িনি। তিনি বিতরের নামায পড়তে দাড়ালেন, আমরা তার পিছনে কাতার করলাম। তিনি আমাদের নিয়ে তিন রাকাত নামায পড়লেন এবং শুধু শেষ রাকাতে সালাম ফেরালেন।’ (তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ১/২৯৩; আবদুর রাযযাক ৩/২০) বলাবাহুল্য, এই ঘটনায় বড় বড় সাহাবী উপসি'ত ছিলেন। তাঁরা সবাই হযরত উমর রা.-এর একতেদা করেছেন। তাঁদের সম্মিলিত কর্মের দ্বারা প্রমাণ হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায এক সালামে তিন রাকাত পড়তেন।
২. ইতিপূর্বে ‘মুসতাদরাকে হাকেমে’র উদ্ধৃতিতে (১/৩০৪) সা’দ ইবনে হিশামের রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের তৃতীয় রাকাতে সালাম ফেরাতেন। ঐ রেওয়ায়েতের শেষে এই অংশটুকুও আছে, ‘এবং আমীরুল মু’মিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.ও এই নিয়মে বিতরের নামায পড়তেন।’
৩. ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, ‘আমি তিন রাকাত বিতর পরিত্যাগ করা পছন্দ করি না, এর পরিবর্তে লাল বর্ণের (মূল্যবান) উট পেলেও। (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০)
৪. হাসান বসরী রাহ.কে বলা হল যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তো বিতর নামাযে দুই রাকাতের পর সালাম ফেরাতেন। তখন তিনি বললেন, ‘তাঁর ওয়ালিদ হযরত উমর রা. তাঁর চেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় রাকাতে সালাম না ফিরিয়ে আল্লাহু আকবার বলে (তৃতীয় রাকাতে) দাঁড়িয়ে যেতেন।’ (হাকিম ১/৩০৪)
৫. মাকহুল রাহ. থেকে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন। মাঝে সালাম ফিরিয়ে আলাদা করতেন না।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
৬. যাযান আবু উমর বলেন, ‘হযরত আলী রা.-এর আমলও এরূপ ছিল।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৫)
৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, দিবসের বিতর, অর্থাৎ মাগরিব যেমন তিন রাকাত তেমনি বিতরের নামাযও তিন রাকাত। عن مكحول عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنه أوتر بثلاث ركعات لم يفصل بينهن بسلام. (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০; তহাবী ১/১৪৩; আবদুর রাযযাক ২/১৯)
৮. আলকামা রাহ. বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আমাদেরকে বলেছেন যে, ‘বিতর সর্বনিম্ন তিন রাকাত।’ (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০) ৯. ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাণী বর্ণনা করেছেন যে, বিতর নামাযে এক রাকাত যথেষ্ট নয়। (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০)
১০. উকবা ইবনে মুসলিম বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.কে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম (তা কত রাকাত) তিনি বললেন, তুমি কি দিবসের বিতর সম্পর্কে জান? আমি বললাম, জ্বী হাঁ। মাগরিবের নামায হচ্ছে দিবসের বিতর। তিনি বললেন, তুমি ঠিক বলেছ এবং সুন্দর জওয়াব দিয়েছ। (অর্থাৎ রাতের বিতরও দিবসের বিতরের অনুরূপ।) ( তহাবী ১/১৩৬)
১১. আনাস রা. বলেন, বিতর নামায তিন রাকাত। তিনি নিজেও তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৩, ২৯৪) عن أنس رضي الله عنه قال الوتر ثلاث ركعات وكان يوتر بثلاث ركعات. وقال الحافظ في الدراية إسناده صحيح.
১২. আবু মানসুর বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.কে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বলেছেন, ‘(বিতর) তিন রাকাত।’ (তহাবী ১/১৪১)
১৩. আতা রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, ‘বিতর হচ্ছে মাগরিবের নামাযের মতো।’ (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০)
১৪. আবু ইয়াহইয়া বলেন, এক রাতে হযরত মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কথা বলছিলেন, ইতিমধ্যে লাল তারকা উদিত হল। তখন ইবনে আব্বাস রা. শয্যাগ্রহণ করলেন এবং আহলে যাওরার আওয়াজে তাঁর ঘুম ভাঙল। তখন তিনি সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি সূর্যোদয়ের আগে তিন রাকাত বিতর, এবং দুই রাকাত ফজরের সুন্নত ও দুই রাকাত ফরয পড়তে পারব? তারা বললেন, জ্বী হাঁ। এটা ছিল ফজরের আখেরী ওয়াক্ত। (তহাবী ১/১৪১)
এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করার পর ইমাম তহাবী রাহ. বলেন, ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকটে যদি বিতর নামায তিন রাকাতের চেয়ে কম পড়ার অবকাশ থাকত তাহলে এত সংকীর্ণ সময়ে, যখন ফজরের নামায কাযা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছিল, তিন রাকাত বিতর পড়তেন না।
১৫. সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘বিতর হল সাত রাকাত বা পাঁচ রাকাত। তিন রাকাত তো পুচ্ছহীন (অসম্পূর্ণ)। আমি পুচ্ছহীন নামায পছন্দ করি না।’ (তহাবী ১/১৪১; আবদুর রাযযাক ২/২৩)
১৬. সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহ. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.-এর বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘বিতর হচ্ছে সাত রাকাত বা পাঁচ রাকাত। আর তিন রাকাত তো পুচ্ছহীন।’ (তহাবী ১/১৪১; আবদুর রাযযাক ৩/২৩) দু’জন বিশিষ্ট সাহাবীর উপরোক্ত বক্তব্যের অর্থ হল, বিতর মূলত তিন রাকাত হলেও শুধু তিন রাকাত পড়া উচিত নয়। বিতরের পূর্বে দু’ চার রাকাত নফল নামায পড়া উচিত।
১৭. হাসান বসরী রাহ. বলেন, ‘হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন এবং শেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন, মাগরিবের নামাযের মতো।’ (আবদুর রাযযাক ৩/২৬)
১৮. আবু গালিব বলেন, ‘আবু উমামা রা. বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন।’ (তহাবী ১/১৪২; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
১৯.আবু খালিদা বলেন, আমি আবুল আলিয়া রাহ.কে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, বিতর নামায মাগরিবের নামাযের মতো, তবে বিতরের তৃতীয় রাকাতেও কিরাত হয়। এটি হচ্ছে রাতের বিতর আর মাগরিবের নামায দিবসের বিতর।’ (তহাবী ১/১৪৩) এই বর্ণনা থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামের নিকট মাগরিব ও বিতর আদায় করার পদ্ধতি অভিন্ন ছিল। শুধু এটুকু পার্থক্য যে, মাগরিবের তৃতীয় রাকাতে ফাতিহার সাথে কিরাত নেই, পক্ষান্তরে বিতর নামাযে ফাতিহার সাথে কুরআন তেলাওয়াত জরুরি।
২০. কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ রাহ. বলেন, ‘বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মানুষকে বিতর নামায তিন রাকাতই পড়তে দেখেছি। তবে সকল পন্থারই অবকাশ আছে এবং আশা করি, কোনোটাতেই সমস্যা হবে না।’ (সহীহ বুখারী ১/১৭৩) মুহাম্মাদ ইবনুল কাসিম রাহ. ছিলেন একজন তাবেয়ী ও মদীনার বিখ্যাত ‘ফুকাহায়ে সাব‘আ’ সাত ফকীহ্র অন্যতম। অতএব তাঁর এই বক্তব্যের অর্থ হল, সাহাবায়ে কেরাম ব্যাপকভাবে তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এটাই মূল ধারা। তবে কেউ কেউ যেহেতু ইজতিহাদের ভিত্তিতে এক রাকাত বিতরেরও ফতোয়া দিতেন তাই তিনি বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মূল সুন্নত তো বিতর নামায তিন রাকাত পড়া তবে যারা এক রাকাতের কথা বলেছেন তারা যেহেতু ইজিতহাদের ভিত্তিতে বলেছেন তাই তাদের সমালোচনা করার প্রয়োজন নেই।
২১. আলকামা রাহ. বলেন, ‘বিতর তিন রাকাত।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
২২. ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ... ‘(সাহাবায়ে কেরামের যুগে) এ কথাই বলা হত যে, তিন রাকাতের কম বিতর হয় না।’ (প্রাগুক্ত)
২৩. আবু ইসহাক রাহ. বলেন, ‘হযরত আলী রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সঙ্গীরা বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ (প্রাগুক্ত পৃ. ২৯৫)
২৪. আবুয যিনাদ রাহ. বলেন, ‘আমি মদীনার সাত ফকীহ, অর্থাৎ সায়ীদ ইবনুল মুসাইযিব, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ, উরওয়া ইবনুয যুবাইর, আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান, খারিজা ইবনে যায়েদ, উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার-এর যুগ পেয়েছি। তাছাড়া আরো অনেক শায়খের যামানা পেয়েছি, যারা ইলম ও তাকওয়ায় অনন্য ছিলেন। কখনো তাদের মধ্যে মতভেদ হলে তাদের অধিকাংশের মত অনুযায়ী কিংবা ফাকাহাতের বিচারে যিনি অগ্রগণ্য তার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হত। তো এই মূলনীতি অনুসারে তাদের সেসব সিদ্ধান্ত আমি ধারণ করেছি তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, বিতর নামায তিন রাকাত, যার শেষ রাকাতেই শুধু সালাম ফেরানো হবে। (তহাবী ১/১৪৫)
২৫. আবুয যিনাদ রাহ. বলেন, (খলীফায়ে রাশেদ) উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. ফকীহগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে ফয়সালা করেন যে, বিতর নামায তিন রাকাত, যার শেষ রাকাতেই শুধু সালাম ফেরানো হবে। (তহাবী ১/১৪৫)
২৬. হাসান বসরী রাহ. বলেন, ‘মুসলমানদের ইজমা রয়েছে যে, বিতর নামায তিন রাকাত, যার শুধু শেষ রাকাতেই সালাম ফেরানো হবে।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
সাহাবায়ে কেরামের আছার, মদীনার বিখ্যাত সাত ফকীহ ও অন্যান্য তাবেয়ীর ফতোয়া এবং খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর ফয়সালা দ্বারা দু’টি বিষয় প্রমাণ হয় :
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানা থেকে সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবেয়ীন পর্যন্ত বিতর নামায তিন রাকাতই ছিল। দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সাধারণভাবে তিন রাকাতই পড়া হত এবং তিন রাকাতের শিক্ষাই দেওয়া হত। একেই হাসান বসরী রাহ. মুসলমানদের ইজমা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২. কিছু রেওয়ায়েতের কারণে কোনো কোনো সাহাবী-তাবেয়ী বিতর নামায এক রাকাত হওয়ার কথাও বলেছেন। তবে ঐ সব রেওয়ায়েত পর্যালোচনার পর ফুকাহায়ে কেরাম তিন রাকাত বিতরের ফতোয়া দিয়েছেন এবং সেই ফতোয়া অনুযায়ী হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. ফয়সালা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহীহ হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরামের তা’আমুল ও মূল ধারার আমলের বিবেচনায় বিতর নামায তিন রাকাত হওয়াই যথার্থ। এর মোকাবেলায় অন্য মতগুলো দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন।
নবীজী বিতর তিন রাকাত পড়তেন। এটিই তাঁর অনুসৃত পন্থা। নিম্নের হাদীসসমূহ থেকে বিষয়টি সুপ্রমাণিত।
আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করেন যে, রমযানে নবীজীর নামায কেমন হত? তিনি উত্তরে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে এবং রমযানের বাইরে এগার রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না! এরপর আরও চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তো বলাই বাহুল্য! এরপর তিন রাকাত (বিতর) পড়তেন।-সহীহ বুখারী ১/১৫৪, হাদীস ১১৪৭; সহীহ মুসলিম ১/২৫৪, হাদীস ৭৩৮; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮, হাদীস ১৬৯৭; সুনানে আবু দাউদ ১/১৮৯, হাদীস ১৩৩৫; মুসনাদে আহমদ ৬/৩৬, হাদীস ২৪০৭৩
সা‘দ ইবনে হিশাম রাহ. বলেন, হযরত আয়েশা রা. তাকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। -সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; হাদীস ১৬৯৮; মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ১৫১ (বাবুস সালাম ফিল বিতর) মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/৪৯৪, হাদীস ৬৯১২; সুনানে দারাকুতনী ২/৩২, হাদীস ১৫৬৫; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৩/৩১
এই হাদীসটি ইমাম হাকেম আবু আব্দুল্লাহ রাহ.ও ‘মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন। তার আরবী পাঠ এই- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يسلم في الركعتين الأوليين من الوتر অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। ইমাম হাকেম (রহ.) তা বর্ণনা করার পর বলেন- هذا حديث صحيح على شرط الشيخين অর্থাৎ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক সহীহ। ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. ‘তালখীসুল মুস্তাদরাক’-এ হাকেম রাহ.-এর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। -মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন ১/৩০৪, হাদীস ১১৮০
এই হাদীস দ্বারা একদিকে যেমন প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাধারণ নিয়মে তিন রাকাত বিতর আদায় করতেন তেমনি একথাও প্রমাণিত হয় যে, তিন রাকাতের দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহহুদের জন্য বসতেন, কিন্তু সালাম ফেরাতেন না। সালাম ফেরাতেন সবশেষে তৃতীয় রাকাতে। যদি দ্বিতীয় রাকাতে বৈঠক করার নিয়ম না থাকত তাহলে সালাম করার বা না করার প্রসঙ্গতই আসত না। কেননা সালাম তো ফেরানো হয়ে থাকে।
ইমাম ইবনে হাযম যাহেরী রাহ. ‘মুহাল্লা’ কিতাবে বিতরের বিভিন্ন পদ্ধতির মাঝে আলোচিত পদ্ধতিটিও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বিতর তিন রাকাত পড়া হবে। দ্বিতীয় রাকাতে বসবে এবং (তাশাহহুদ পড়ে) সালাম ফেরানো ছাড়াই দাঁড়িয়ে যাবে। তৃতীয় রাকাত পড়ে বসবে, তাশাহহুদ পড়বে এবং সালাম ফেরাবে, যেভাবে মাগরিবের নামায পড়া হয়। এটিই ইমান আবু হানীফা রাহ.-এর মত। এর দলিল হচ্ছে, সাদ ইবনে হিশাম রাহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যাতে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। -মুহাল্লা ইবনে হাযম ২/৮৯
সাদ ইবনে হিশাম রাহ.-এর রেওয়ায়াতটি আরও একটি সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার আরবী পাঠ নিম্নরূপ- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث لا يسلم إلا في آخرهن অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন এবং শুধু সর্বশেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন। হাকেম রাহ. এই রেওয়ায়াতের পর লেখেন, আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.ও এভাবে বিতর পড়তেন এবং তাঁর সূত্রে মদীনাবাসীগণ তা গ্রহণ করেছেন। -মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন ১/৩০৪, হাদীস ১১৮১
(৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আবী কাইস বলেন- قلت لعائشة : بكم كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر؟ قالت: كان يوتر بأربع وثلاث, وست وثلاث, وثمان وثلاث, وعشر وثلاث, ولم يكن يوتر بأنقص من سبع, ولا بأكثر من ثلاث عشرة. অর্থাৎ আমি হযরত আয়েশা রা.-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবীজী বিতরে কত রাকাত পড়তেন? উত্তরে তিনি বলেন, চার এবং তিন, ছয় এবং তিন, আট এবং তিন, দশ এবং তিন। তিনি বিতরে সাত রাকাতের কম এবং তের রাকাতের অধিক পড়তেন না। -সুনানে আবু দাউদ ১/১৯৩, হাদীস ১৩৫৭ (১৩৬২); তহাবী শরীফ ১/১৩৯; মুসনাদে আহমদ ৬/১৪৯, হাদীস ২৫১৫৯
চিন্তা করে দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদ নামায কখনো চার রাকাত, কখনো ছয় রাকাত, কখনো আট রাকাত, কখনো দশ রাকাত পড়তেন; কিন্তু মূল বিতর সর্বদা তিন রাকাতই হত।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ফাতহুল বারী ৩/২৬ باب كيف صلاة الليل, كتاب التهجد)- এ লেখেন- هذا أصح ما وقفت عليه من ذلك, وبه يجمع بين ما اختلف عن عائشة في ذلك. والله أعلم আমার জানামতে এটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সর্বাধিক সহীহ রেওয়ায়াত। এ বিষয়ে হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসের বর্ণনাকারীদের মাঝে যে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এর দ্বারা সে সবের মাঝে সমন্বয় করা সম্ভব।
(৪) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাহাজ্জুদ ও বিতর প্রত্যক্ষ করার জন্য হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এক রাতে তাঁর খালা উম্মুল মুমিনীন হযরত মাইমূনা রা.-এর ঘরে অবস্থান করেন। তিনি যা যা প্রত্যক্ষ করেছেন বর্ণনা করেছেন। তাঁর শাগরেদরা সে বিবরণ বিভিন্ন শব্দে বর্ণনা করেছেন। আমি এখানে সুনানে নাসায়ী ও অন্যান্য হাদীসের কিতাব থেকে একটি রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করছি- ‘মুহাম্মাদ ইবনে আলী তার পিতা থেকে, তিনি তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে শযা্য থেকে উঠলেন, এরপর মেসওয়াক করলেন, এরপর দুই রাকাত পড়লেন, এরপর শুয়ে গেলেন। তারপর পুনরায় শয্যা ত্যাগ করলেন, মেসওয়াক করলেন, অযু করলেন এবং দুই রাকাত পড়লেন; এভাবে ছয় রাকাত পূর্ণ করলেন। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন। এরপর দুই রাকাত পড়েন। حتى صلى ستا ثم أوتر بثلاث وصلى ركعتين -সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯, হাদীস ১৭০৪; মুসনাদে আহমাদ ১/৩৫০, হাদীস ৩২৭১; তহাবী শরীফ ১/২০১-২০২
(৫) প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম সাঈদ ইবনে জুবাইর, যিনি ইবনে আব্বাস রা.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث ويقرأ في الأولى سبح اسم ربك الأعلى, وفي الثانية قل يا أيها الكفرون, وفي الثالثة قل هو الله أحد. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন রাকাত বিতর পড়তেন, প্রথম রাকাতে ‘সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আলা’, দ্বিতীয় রাকাতে ‘কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরূন’ এবং তৃতীয় রাকাতে ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ পড়তেন। -সুনানে দারেমী ১/৩১১, হাদীস ১৫৯৭; জামে তিরমিযী ১/৬১, হাদীস ৪৬২; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; হাদীস ১৭০২; তহাবী শরীফ ১/২০১, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/৫১২, হাদীস ৬৯৫১ ইমাম নববী রাহ. ‘আলখুলাসা’ কিতাবে উক্ত হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। -নাসবুর রায়াহ, জামালুদ্দীন যাইলায়ী ২/১১৯ বিতরের তিন রাকাতে উপরোক্ত তিন সূরা, এক এক রাকাতে এক এক সূরা, পড়া সম্পর্কে একাধিক সাহাবী থেকে রেওয়ায়াত বিদ্যমান রয়েছে। প্রতিটি রেওয়ায়াত প্রমাণ করে যে, বিতরের নামায তিন রাকাত। মোটকথা, বিতরের নামায তিন রাকাত হওয়ার বিষয়ে হাদীস ও সুন্নাহর বহু প্রমাণা রয়েছে এবং অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমলও তাই ছিল। এখানে আরেকটি হাদীস উল্লেখ করছি- عن ثابت قال: قال أنس: يا أبا محمد خذ عني فإني أخذت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم, وأخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الله, ولن تأخذ عن أحد أوثق مني, قال: ثم صلى بي العشاء, ثم صلى سب ركعات يسلم بين الركعتين, ثم أوتر بثلاث يسلم في آخرهن (الروياني وابن عساكر, ورجاله ثقات, كما في كنز العمال) প্রসিদ্ধ তাবেয়ী সাবেত বুনানী রাহ., বলেন, আমাকে হযরত আনাস ইবনে মালেক রাহ. বলেছেন, হে আবু মুহাম্মাদ! (সাবেত রা.-এর কুনিয়াত-উপনাম) আমার কাছ থেকে শিখে নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি। আর তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন থেকে নিয়েছেন। তুমি শেখার জন্য আমার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য কাউকে পাবে না। একথা বলে তিনি আমাকে নিয়ে ইশার নামায আদায় করেন। এরপর ছয় রাকাত পড়েন, তা এভাবে যে, প্রতি দুই রাকাতে সালাম ফেরান। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়েন এবং সবশেষে সালাম ফেরান। -মুসনাদে রুয়ানী, তারীখে ইবনে আসাকির; ইমাম সুয়ূতী রাহ. বলেন, এই হাদীসের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য (কানযুল উম্মাল ৮/৬৬-৬৭, হাদীস ২১৯০২ ‘আলবিতরু মিন কিতাবিস সালাত, কিসমুল আফআল)
জরুরি জ্ঞাতব্য
বিতর নামাযের ব্যাপারে আজকাল এক ব্যাপক অবহেলা এই পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, একে এমন এক নামায মনে করা হয় যার আগে কোন নফল নামায নেই, যেমন মাগরিবের নামায; এর আগে নফল নামায মাসনূন নয়; অথচ বিতরের ব্যাপারে শরীয়তের কাম্য এই যে, তা কিছু নফল নামায পড়ার পর আদায় করা। সবচেয়ে ভাল এই যে, যার শেষ রাতে তাহাজ্জুদের জন্য জাগার নিশ্চয়তা রয়েছে, সে তাহাজ্জুদের পরে বিতর পড়বে। যদি বিতর রাতের শুরু ভাগে ইশার পর পড়া হয় তবুও উত্তম এই যে, দুই-চার রাকাত নফল নামায পড়ার পর বিতর আদায় করবে। মাগরিবের মত আগে কোন নফল ছাড়া শুধু তিন রাকাত বিতর পড়া পছন্দনীয় নয়। হাদীস শরীফে আছে- لا توتروا بثلاث تشبهوا بصلاة المغرب, ولكن أوتروا بخمس, أو بسبع, أو بتسع, أو بإحدى عشرة ركعة, أو أكثر من ذلك. তোমরা শুধু তিন রাকাত বিতর পড়ো না, এতে মাগরিবের সাদৃশ্যপূর্ণ করে ফেলবে; বরং পাঁচ, সাত, নয়, এগার বা এরও অধিক রাকাতে বিতর পড়ো। -মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৩০৪, হাদীস ১১৭৮; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৩/৩১, ৩২
মোটকথা, বিতরের আগে কিছু নফল অবশ্যই পড়-দুই, চার, ছয়, আট-যত রাকাত সম্ভব হয় পড়ে নাও। ৩ নং-এর অধীনে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর হাদীস উল্লিখিত হয়েছে, যাতে তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার এবং তিন, ছয় এবং তিন, আট এবং তিন, দশ এবং তিন-বিভিন্ন সংখ্যায় রাতের নামায আদায় করতেন। উল্লিখিত হাদীসে ওই নির্দেশনাই এসেছে যে, শুধু তিন রাকাত বিতর পড়ো না, আগে কিছু নফল অবশ্যই পড়। তবে বিতর সর্বাবস্থায় তিন রাকাতই।
উক্ত হাদীসের সাথে একথার কোন সম্পর্ক নেই যে, তিন রাকাত এক বৈঠকেই পড়তে হবে, তাহলেই শুধু তা মাগরিবের সাদৃশ্য থেকে বেঁচে যাবে। তাই তিন রাকাত পড়তে হলে তা এক বৈঠকেই পড়তে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, মাগরিবের সাদৃশ্য থেকে বাঁচার পদ্ধতি হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তিন রাকাত বিতরের আগে নফল পড়ে নাও। হাদীসের ব্যাখ্যা ছেড়ে নিজের পক্ষ থেকে বিতরের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করা বিভ্রানি- ছাড়া আর কিছুই নয়।
শরীয়তে সকল নামাযের মূলকথা এই যে, প্রতি দুই রাকাতে বৈঠক হবে এবং তাশাহহুদ পড়া হবে। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে সহীহ মুসলিম ১/১৯৪, হাদীস ৪৯৮-এ একটি দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক ব্যাপক বাণী উদ্ধৃত রয়েছে। তাতে তিনি ইরশাদ করেন- وفي كل ركعتين التحية ‘প্রতি দুই রাকাতে তাশাহহুদ রয়েছে।’ একই হুকুম একাধিক সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণিত রয়েছে। শরীয়তের ব্যাপক শিক্ষা পরিহার করে কোন রেওয়ায়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে একথা বলা যে, তিন রাকাত বিতর পড়লে শুধু এক বৈঠকেই পড়া-এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد -এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা উম্মতকে উক্ত অনিষ্ট থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
আরো কিছু হাদীসঃ
১. আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘রমযানুল মুবারকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামায কীরূপ হত?’ উম্মুল মুমিনীন বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে ও রমযানের বাইরে এগারো রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত পড়তেন-এত সুন্দর ও দীর্ঘ সে নামায, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অতঃপর চার রাকাত পড়তেন-এরও দীর্ঘতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে চেয়ো না। এরপর তিন রাকাত পড়তেন।’ عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أنه سأل عائشة رضي الله عنها كيف كان صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم في رمضان؟ قالت ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة، يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن ثم يصلي ثلاثا. (সহীহ বুখারী ১/১৫৪; সহীহ মুসলিম ১/২৫৪; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; সুনানে আবু দাউদ ১/১৮৯; মুসনাদে আহমদ ৬/৩৬)
২. সা’দ ইবনে হিশাম বলেন, (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা রা. বলেছেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ عن سعد بن هشام أن عائشة حدثته أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان لا يسلم في ركعتي الوتر. (সুনানে নাসায়ী ১/২৪৮; মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫১)
৩. ইমাম হাকেম রাহ. সা’দ ইবনে হিশামের বিবরণ এভাবে বর্ণনা করেছেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের প্রথম দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يسلم في الركعتين الأوليين من الوتر. هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ولم يخرجاه (আলমুস্তাদরাক ১/৩০৪)
৪. অন্য সনদে বিবরণটি এভাবেও বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন এবং শুধু শেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন। আমীরুল মু’মিনীন উমর রা. এই নিয়মে বিতর পড়তেন এবং তাঁরই সূত্রে আহ্লে মদীনা এই নিয়ম গ্রহণ করেছে।’ كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث، لا يسلم إلا في آخرهن. وهذا وتر أمير المؤمنين عمر بن الخطاب رضي الله عنه، وعنه أخذه أهل المدينة. (আলমুস্তাদরাক)
৫. মুসনাদে আহমদ কিতাবে (৬/১৫৬) বিবরণটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশার নামায আদায় করে ঘরে আসতেন এবং দুই রাকাত নামায পড়তেন। এরপর আরো দুই রাকাত পড়তেন, যা পূর্বের নামাযের চেয়ে দীর্ঘ হত। অতঃপর তিন রাকাত পড়তেন, যা মাঝখানে আলাদা করতেন না। এরপর বসে বসে দুই রাকাত নামায পড়তেন। রুকু-সেজদাও সেভাবেই করতেন। أن رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا صلى العشاء دخل المنزل ثم صلى ركعتين. ثم صلى بعدهما ركعتين أطول منهما، ثم أوتر بثلاث، لا يفصل بينهن ثم صلى ركعتين وهو جالس، يركع وهو جالس ويسجد وهو جالس.
৬. আবদুল্লাহ ইবনে আবু কায়স বলেন, আমি (উম্মুল মু’মিনীন) আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত রাকাত বিতর (আদায়) করতেন? উম্মুল মু’মিনীন বললেন, ‘চার ও তিন রাকাত, ছয় ও তিন রাকাত এবং আট ও তিন রাকাত। তিনি তেরো রাকাতের অধিক এবং সাত রাকাতের কম বিতর করতেন না।’ عن عبد الله بن أبي قيس قال سألت عائشة رضي الله عنها بكم كان رسول الله صلى الله صليه وسلم يوتر قالت : بأربع وثلاث، وست وثلاث، وثمان وثلاث ولم يكن يوتر بأكثر من ثلاث عشرة ولا أنقص من سبع. (সুনানে আবু দাউদ ১/১৯৩; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৩৯) উপরোক্ত হাদীসে তাহাজ্জুদ ও বিতরকে একত্রে ‘বিতর’ বলা হয়েছে। এতে মূল বিতর তিন রাকাত, বাকীগুলো তাহাজ্জুদ।
৭. আবদুল আযীয ইবনে জুরাইজ বলেন, ‘আমি (উম্মুল মু’মিনীন) আয়েশা সিদ্দীকা রা.কে জিজ্ঞাস করেছি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামাযে কী কী সূরা পাঠ করতেন? উম্মুল মু’মিনীন বলেছেন, তিনি প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ ও ‘মুআওয়াযাতাইন’ (ফালাক ও নাস) পাঠ করতেন।’ عن عبد العزيز بن جريج قال سألت عائشة رضي الله عنها بأي شيء كان يوتر رسول الله صلى الله عليه وسلم؟ قال يقرأ في الأولى بسبح اسم ربك الأعلى، وفي الثانية بقل يا ايها الكافرون وفي الثالثة بقل هو الله احد والمعوذتين. قال أبو عيسى هذا حديث حسن غريب. (সুনানে আবু দাউদ ১/২০১; সুনানে তিরমিযী পৃ. ৬১; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ৭৩; মুসনাদে আহমদ ৬/২২৭; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক
৮. ‘আমরা বিনতে আবদুর রহমান উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন। প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করতেন।’ عن عمرة عن عائشة رضي الله عنها أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يوتر بثلاث. يقرأ في الركعة الأولى بسبح اسم ربك الأعلى، وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد وقل اعوذ برب الفلق وقل اعوذ برب الناس. هذا حديث صحيح على شرط الشيخين ولم يخرجاه. وقال الذهبي رواه ثقات عنه، وهو على شرط خ ـ م. (আলমুসতাদরাক ১/৩০৫)
৯. মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর পিতা আলী ইবনে আবদুল্লাহ থেকে, তিনি তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শয্যাত্যাগ করলেন, অতঃপর মিসওয়াক করলেন এবং দুই রাকাত করে ছয় রাকাত নামায আদায় করে শয্যাগ্রহণ করলেন। কিছুক্ষণ পর পুনরায় শয্যাত্যাগ করলেন, মিসওয়াক করলেন এবং দুই রাকাত করে ছয় রাকাত আদায় করলেন। এরপর তিন রাকাত বিতর পড়লেন। এরপর আরো দুই রাকাত (অর্থাৎ ফজরের সুন্নত) আদায় করলেন।’ عن محمد بن علي عن أبيه عن جده عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قام من الليل فاستن ثم صلى ركعتين ثم نام ثم قام فاستن ثم توضأ فصلى ركعتين حتى صلى ستا ثم أوتر بثلاث وصلى ركعتين. (সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯)
১০. ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে আট রাকাত নামায পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। অতঃপর ফজরের নামাযের পূর্বে দুই রাকাত নামায পড়তেন।’ عن يحي بن الجزار عن ابن عباس رضي الله عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي من الليل ثمان ركعات ويوتر بثلاث ويصلي ركعتين قبل صلاة الفجر. (সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৪০)
১১. সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন, প্রথম রাকাতে সূরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা কাফিরুন এবং তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাছ পড়তেন।’ عن سعيد بن جبير عن ابن عباس رضي الله عنهما قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بثلاث يقرأ في الأولى سبح اسم ربك الأعلى وفي الثانية قل يا ايها الكافرون وفي الثالثة قل هو الله احد. (সুনানে দারেমী ১/৩১১, হাদীস : ১৫৯৭; সুনানে তিরমিযী ১/৬১; সুনানে নাসায়ী ১/২৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ পৃ. ৮৩; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৪০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ১/২৯৯; আল-মুহাল্লা, ইবনে হায্ম ২/৫১) ইমাম নববী ‘খুলাসা’ কিতাবে বলেন, بإسناد صحيح অর্থাৎ হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণিত। (নাসবুর রায়া ২/১১৯) হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ছাড়াও বিতরের তিন রাকাতে তিন সূরা পাঠের হাদীস যাঁরা বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : ১. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবযা রা.। (নাসায়ী ১/২৫১; তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৮; আবদুর রাযযাক ২/৩৩) ২. হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা.। (নাসায়ী ১/২৪৮; ইবনে আবী শায়বা ২/৩০০) ৩. হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.। (তিরমিযী ১/৬১; আবদুর রাযযাক ৩/৩৪; তহাবী ১/১৪২) ৪. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৬. হযরত নু’মান ইবনে বাশীর রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৭. হযরত আবু হুরায়রা রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৪১) ৯. হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন রান.। (তহাবী ১/১৪২; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৮; মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪১; কানযুল উম্মাল ১/১৯৬) ১০. আবু খাইছামা রা. তাঁর পিতা হযরত মুয়াবিয়া ইবনে খাদীজ রা. থেকে। (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪১) ১২. আমির ইবনে শারাহীল শা’বী রাহ. বলেন, ‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাতের নামায সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.কে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা বলেছেন, ‘তেরো রাকাত নামায পড়তেন। আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতর। অতঃপর সোবহে সাদেক হওয়ার পর আরো দুই রাকাত পড়তেন।’ عن عامر الشعبي قال سألت ابن عمر وابن عباس رضي الله عنهما كيف كان صلاة رسول الله صلى ا لله عليه وسلم بالليل فقالا ثلاث عشرة ركعة، ثمان ويوتر بثلاث، وركعتين بعد الفجر. (তহাবী ১/১৩৬)
১৩. ছাবিত আল বুনানী রাহ. বলেন, হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. আমাকে বললেন, ‘হে ছাবিত! আমার নিকট থেকে (দ্বীনের আহকাম) গ্রহণ কর। কারণ (এ বিষয়ে এখন) আমার চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি তুমি আর পাবে না। আমি (দ্বীন) গ্রহণ করেছি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকে। তিনি জিব্রীল আ.-এর নিকট থেকে। আর জিব্রীল আ. গ্রহণ করেছেন আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে।’ এরপর আনাস রা. আমাকে নিয়ে ইশার নামায আদায় করলেন। অতঃপর ছয় রাকাত নামায এভাবে পড়লেন যে, প্রতি দু রাকাতে সালাম ফেরাতেন। শেষে তিন রাকাত বিতর পড়লেন ও সর্বশেষ রাকাতে সালাম ফেরালেন। عن ثابت البناني قال قال لي أنس بن مالك يا ثابت اخذ عني، فإنك لن تأخذ عن أحد أوثق مني، إني أخذته عن رسول الله صلى الله عليه وسلم وأخذه رسول الله صلى الله عليه وسلم عن جبريل وأخذ جبريل عن الله عز وجل، قال : ثم صلى بي العشاء ثم صلى ست ركعات يسلم بين كل ركعتين ثم يوتر بثلاث، يسلم في آخرهن. رواه الروياني وابن عساكر ورجاله ثقات. (কানযুল উম্মাল ৪/১৯৬)
১৪. ইমাম আবু হানীফা রাহ. ইমাম আবু জা’ফর বাকির রাহ. থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশা ও ফজরের মাঝে তেরো রাকাত নামায পড়তেন। আট রাকাত নফল, তিন রাকাত বিতর এবং দুই রাকাত ফজরের সুন্নত। أخبرنا أبو حنيفة، حدثنا أبو جعفر قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلي ما بين صلاة العشاء إلى صلاة الصبح ثلاث عشرة ركعة ثمان ركعات تطوعا، وثلاث ركعات الوتر وركعتي الفجر. (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৪৯)
এই হাদীসগুলো থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণ হয়। যথা : ক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন।
খ. তিন রাকাত এক সালামে আদায় করতেন।
গ. বিশেষ কয়েকটি সূরা তেলাওয়াত করতেন।
এ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায কীভাবে আদায় করতেন সে বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এবার তাঁর কিছু বাণী উল্লেখ করছি।
১. হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘বিতর নামায শুধু তিন রাকাত পড়ো না; বরং পাঁচ রাকাত বা সাত রাকাত পড়। একে মাগরিবের নামাযের মতো বানিয়ে ফেলো না।’ عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : لا توتروا بثلاث وأوتروا بخمس أو سبع، ولا تشبهوا بصلاة المغرب. وقال رجاله ثقات (তহাবী ১/১৪৩; দারাকুতনী পৃ. ১৭১; صحيح على شرط الشيخين হাকিম ১/৩০৪
২. আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মাগরিব হল দিবসের বিতর। অতএব তোমরা রাতের নামাযকেও বিতর (বেজোড়) কর। عن ابن عمر رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم قال صلاة المغرب وتر النهار فأوتروا صلاة الليل. (মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩/২৮) মুসনাদে আহমদে রেওয়ায়েতটি এভাবে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাগরিবের নামায দিবসের নামাযকে বিতর (বেজোড়) করেছে। অতএব রাতের নামাযকেও বিতর (বেজোড়) কর। ولأحمد عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال صلاة المغرب أوترت صلاة النهار فأوتروا صلاة الليل. قال العراقي : سنده حسن. (যুরকানী শরহুল মুয়াত্তা ১/২৫৯; ইলাউস সুনান ৬/১১)
৩. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাগরিব যেমন তিন রাকাত তেমনি বিতরও তিন রাকাত।’ عن عائشة رضي الله عنها قالت : قال رسول الله صلى عليه وسلم الوتر ثلاث كثلاث المغرب. (মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪২)
৪. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দিবসের বিতর অর্থাৎ মাগরিব যেমন তিন রাকাত তেমনি রাতের বিতরও তিন রাকাত।’ عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : قال رسول ا لله صلى الله عليه وسلم وتر الليل ثلاث كوتر النهار صلاة المغرب. (দারাকুতনী, নাসবুর রায়া ২/১১৯) উল্লেখ্য, শেষোক্ত রেওয়ায়েত দু’টি ‘মারফু’ হওয়ার বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের আপত্তি আছে, কিন্তু প্রথমত বর্ণনা দুটির বিষয়স্তু অন্যান্য সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত, দ্বিতীয়ত বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে রেওয়াত দু’টি ‘হাসান’ বলে গণ্য। তাছাড়া হযরত আয়েশা রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাণী সহীহ সনদেও বর্ণিত হয়েছে, যা সামনে উল্লেখ করা হবে। আর এ ধরনের বিষয় যেহেতু নিছক যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায় না এজন্য মওকূফ হাদীসও এক্ষেত্রে ‘মারফু’ বলে গণ্য হবে। মোটকথা, উপরের হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে বিতর নামায মাগরিবের মতোই তিন রাকাত। তদ্রূপ মাগরিবের মাধ্যমে যেমন দিবসের নামায বেজোড় হয় তেমনি বিতরের মাধ্যমে রাতের নামায বেজোড় হয়ে যায়। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায শুধু তিন রাকাত পড়া পছন্দ করেননি; বরং বিতরের পূর্বে দু’ চার রাকাত হলেও নফল পড়ার আদেশ করেছেন। যেন বিতর ও মাগরিবের মাঝে পার্থক্য হয়। কারণ মাগরিবের পূর্বে নফল নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও কর্মের পর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের কর্মপন্থা উল্লেখ করছি। এতে খায়রুল কুরূনের তা’আমুল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
১. মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রাহ. বলেন, ‘আমরা রাতের বেলায় আবু বকর সিদ্দীক রা.কে দাফন করলাম। উমর রা. বললেন, আমি এখনো বিতর পড়িনি। তিনি বিতরের নামায পড়তে দাড়ালেন, আমরা তার পিছনে কাতার করলাম। তিনি আমাদের নিয়ে তিন রাকাত নামায পড়লেন এবং শুধু শেষ রাকাতে সালাম ফেরালেন।’ (তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ১/২৯৩; আবদুর রাযযাক ৩/২০) বলাবাহুল্য, এই ঘটনায় বড় বড় সাহাবী উপসি'ত ছিলেন। তাঁরা সবাই হযরত উমর রা.-এর একতেদা করেছেন। তাঁদের সম্মিলিত কর্মের দ্বারা প্রমাণ হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর নামায এক সালামে তিন রাকাত পড়তেন।
২. ইতিপূর্বে ‘মুসতাদরাকে হাকেমে’র উদ্ধৃতিতে (১/৩০৪) সা’দ ইবনে হিশামের রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের তৃতীয় রাকাতে সালাম ফেরাতেন। ঐ রেওয়ায়েতের শেষে এই অংশটুকুও আছে, ‘এবং আমীরুল মু’মিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা.ও এই নিয়মে বিতরের নামায পড়তেন।’
৩. ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, ‘আমি তিন রাকাত বিতর পরিত্যাগ করা পছন্দ করি না, এর পরিবর্তে লাল বর্ণের (মূল্যবান) উট পেলেও। (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০)
৪. হাসান বসরী রাহ.কে বলা হল যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তো বিতর নামাযে দুই রাকাতের পর সালাম ফেরাতেন। তখন তিনি বললেন, ‘তাঁর ওয়ালিদ হযরত উমর রা. তাঁর চেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় রাকাতে সালাম না ফিরিয়ে আল্লাহু আকবার বলে (তৃতীয় রাকাতে) দাঁড়িয়ে যেতেন।’ (হাকিম ১/৩০৪)
৫. মাকহুল রাহ. থেকে বর্ণিত, উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন। মাঝে সালাম ফিরিয়ে আলাদা করতেন না।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
৬. যাযান আবু উমর বলেন, ‘হযরত আলী রা.-এর আমলও এরূপ ছিল।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৫)
৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, দিবসের বিতর, অর্থাৎ মাগরিব যেমন তিন রাকাত তেমনি বিতরের নামাযও তিন রাকাত। عن مكحول عن عمر بن الخطاب رضي الله عنه أنه أوتر بثلاث ركعات لم يفصل بينهن بسلام. (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০; তহাবী ১/১৪৩; আবদুর রাযযাক ২/১৯)
৮. আলকামা রাহ. বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আমাদেরকে বলেছেন যে, ‘বিতর সর্বনিম্ন তিন রাকাত।’ (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০) ৯. ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাণী বর্ণনা করেছেন যে, বিতর নামাযে এক রাকাত যথেষ্ট নয়। (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০)
১০. উকবা ইবনে মুসলিম বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.কে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম (তা কত রাকাত) তিনি বললেন, তুমি কি দিবসের বিতর সম্পর্কে জান? আমি বললাম, জ্বী হাঁ। মাগরিবের নামায হচ্ছে দিবসের বিতর। তিনি বললেন, তুমি ঠিক বলেছ এবং সুন্দর জওয়াব দিয়েছ। (অর্থাৎ রাতের বিতরও দিবসের বিতরের অনুরূপ।) ( তহাবী ১/১৩৬)
১১. আনাস রা. বলেন, বিতর নামায তিন রাকাত। তিনি নিজেও তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (তহাবী ১/১৪৩; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৩, ২৯৪) عن أنس رضي الله عنه قال الوتر ثلاث ركعات وكان يوتر بثلاث ركعات. وقال الحافظ في الدراية إسناده صحيح.
১২. আবু মানসুর বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.কে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বলেছেন, ‘(বিতর) তিন রাকাত।’ (তহাবী ১/১৪১)
১৩. আতা রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, ‘বিতর হচ্ছে মাগরিবের নামাযের মতো।’ (মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ১৫০)
১৪. আবু ইয়াহইয়া বলেন, এক রাতে হযরত মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কথা বলছিলেন, ইতিমধ্যে লাল তারকা উদিত হল। তখন ইবনে আব্বাস রা. শয্যাগ্রহণ করলেন এবং আহলে যাওরার আওয়াজে তাঁর ঘুম ভাঙল। তখন তিনি সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি সূর্যোদয়ের আগে তিন রাকাত বিতর, এবং দুই রাকাত ফজরের সুন্নত ও দুই রাকাত ফরয পড়তে পারব? তারা বললেন, জ্বী হাঁ। এটা ছিল ফজরের আখেরী ওয়াক্ত। (তহাবী ১/১৪১)
এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করার পর ইমাম তহাবী রাহ. বলেন, ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকটে যদি বিতর নামায তিন রাকাতের চেয়ে কম পড়ার অবকাশ থাকত তাহলে এত সংকীর্ণ সময়ে, যখন ফজরের নামায কাযা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছিল, তিন রাকাত বিতর পড়তেন না।
১৫. সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘বিতর হল সাত রাকাত বা পাঁচ রাকাত। তিন রাকাত তো পুচ্ছহীন (অসম্পূর্ণ)। আমি পুচ্ছহীন নামায পছন্দ করি না।’ (তহাবী ১/১৪১; আবদুর রাযযাক ২/২৩)
১৬. সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহ. উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা.-এর বাচনিক উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘বিতর হচ্ছে সাত রাকাত বা পাঁচ রাকাত। আর তিন রাকাত তো পুচ্ছহীন।’ (তহাবী ১/১৪১; আবদুর রাযযাক ৩/২৩) দু’জন বিশিষ্ট সাহাবীর উপরোক্ত বক্তব্যের অর্থ হল, বিতর মূলত তিন রাকাত হলেও শুধু তিন রাকাত পড়া উচিত নয়। বিতরের পূর্বে দু’ চার রাকাত নফল নামায পড়া উচিত।
১৭. হাসান বসরী রাহ. বলেন, ‘হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন এবং শেষ রাকাতে সালাম ফেরাতেন, মাগরিবের নামাযের মতো।’ (আবদুর রাযযাক ৩/২৬)
১৮. আবু গালিব বলেন, ‘আবু উমামা রা. বিতর নামায তিন রাকাত পড়তেন।’ (তহাবী ১/১৪২; ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
১৯.আবু খালিদা বলেন, আমি আবুল আলিয়া রাহ.কে বিতর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, বিতর নামায মাগরিবের নামাযের মতো, তবে বিতরের তৃতীয় রাকাতেও কিরাত হয়। এটি হচ্ছে রাতের বিতর আর মাগরিবের নামায দিবসের বিতর।’ (তহাবী ১/১৪৩) এই বর্ণনা থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামের নিকট মাগরিব ও বিতর আদায় করার পদ্ধতি অভিন্ন ছিল। শুধু এটুকু পার্থক্য যে, মাগরিবের তৃতীয় রাকাতে ফাতিহার সাথে কিরাত নেই, পক্ষান্তরে বিতর নামাযে ফাতিহার সাথে কুরআন তেলাওয়াত জরুরি।
২০. কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ রাহ. বলেন, ‘বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মানুষকে বিতর নামায তিন রাকাতই পড়তে দেখেছি। তবে সকল পন্থারই অবকাশ আছে এবং আশা করি, কোনোটাতেই সমস্যা হবে না।’ (সহীহ বুখারী ১/১৭৩) মুহাম্মাদ ইবনুল কাসিম রাহ. ছিলেন একজন তাবেয়ী ও মদীনার বিখ্যাত ‘ফুকাহায়ে সাব‘আ’ সাত ফকীহ্র অন্যতম। অতএব তাঁর এই বক্তব্যের অর্থ হল, সাহাবায়ে কেরাম ব্যাপকভাবে তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এটাই মূল ধারা। তবে কেউ কেউ যেহেতু ইজতিহাদের ভিত্তিতে এক রাকাত বিতরেরও ফতোয়া দিতেন তাই তিনি বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মূল সুন্নত তো বিতর নামায তিন রাকাত পড়া তবে যারা এক রাকাতের কথা বলেছেন তারা যেহেতু ইজিতহাদের ভিত্তিতে বলেছেন তাই তাদের সমালোচনা করার প্রয়োজন নেই।
২১. আলকামা রাহ. বলেন, ‘বিতর তিন রাকাত।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
২২. ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ... ‘(সাহাবায়ে কেরামের যুগে) এ কথাই বলা হত যে, তিন রাকাতের কম বিতর হয় না।’ (প্রাগুক্ত)
২৩. আবু ইসহাক রাহ. বলেন, ‘হযরত আলী রা. এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সঙ্গীরা বিতরের দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না।’ (প্রাগুক্ত পৃ. ২৯৫)
২৪. আবুয যিনাদ রাহ. বলেন, ‘আমি মদীনার সাত ফকীহ, অর্থাৎ সায়ীদ ইবনুল মুসাইযিব, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ, উরওয়া ইবনুয যুবাইর, আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান, খারিজা ইবনে যায়েদ, উবাইদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার-এর যুগ পেয়েছি। তাছাড়া আরো অনেক শায়খের যামানা পেয়েছি, যারা ইলম ও তাকওয়ায় অনন্য ছিলেন। কখনো তাদের মধ্যে মতভেদ হলে তাদের অধিকাংশের মত অনুযায়ী কিংবা ফাকাহাতের বিচারে যিনি অগ্রগণ্য তার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা হত। তো এই মূলনীতি অনুসারে তাদের সেসব সিদ্ধান্ত আমি ধারণ করেছি তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, বিতর নামায তিন রাকাত, যার শেষ রাকাতেই শুধু সালাম ফেরানো হবে। (তহাবী ১/১৪৫)
২৫. আবুয যিনাদ রাহ. বলেন, (খলীফায়ে রাশেদ) উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. ফকীহগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে ফয়সালা করেন যে, বিতর নামায তিন রাকাত, যার শেষ রাকাতেই শুধু সালাম ফেরানো হবে। (তহাবী ১/১৪৫)
২৬. হাসান বসরী রাহ. বলেন, ‘মুসলমানদের ইজমা রয়েছে যে, বিতর নামায তিন রাকাত, যার শুধু শেষ রাকাতেই সালাম ফেরানো হবে।’ (ইবনে আবী শায়বা ২/২৯৪)
সাহাবায়ে কেরামের আছার, মদীনার বিখ্যাত সাত ফকীহ ও অন্যান্য তাবেয়ীর ফতোয়া এবং খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ.-এর ফয়সালা দ্বারা দু’টি বিষয় প্রমাণ হয় :
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানা থেকে সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবেয়ীন পর্যন্ত বিতর নামায তিন রাকাতই ছিল। দু’ একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সাধারণভাবে তিন রাকাতই পড়া হত এবং তিন রাকাতের শিক্ষাই দেওয়া হত। একেই হাসান বসরী রাহ. মুসলমানদের ইজমা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
২. কিছু রেওয়ায়েতের কারণে কোনো কোনো সাহাবী-তাবেয়ী বিতর নামায এক রাকাত হওয়ার কথাও বলেছেন। তবে ঐ সব রেওয়ায়েত পর্যালোচনার পর ফুকাহায়ে কেরাম তিন রাকাত বিতরের ফতোয়া দিয়েছেন এবং সেই ফতোয়া অনুযায়ী হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. ফয়সালা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহীহ হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরামের তা’আমুল ও মূল ধারার আমলের বিবেচনায় বিতর নামায তিন রাকাত হওয়াই যথার্থ। এর মোকাবেলায় অন্য মতগুলো দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন।
