আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

১৩- যাকাতের অধ্যায়

হাদীস নং: ২২৩১
আন্তর্জাতিক নং: ১০২১-১
১৮. দানশীল ও কৃপণের দৃষ্টান্ত
২২৩১। আমরূন নাকিদ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (ﷺ) বলেন, অর্থ ব্যয়কারী ও সাদ্‌কাকারীর দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যার গায়ে বক্ষ থেকে কণ্ঠনালী পর্যন্ত দুটি লৌহবর্ম রয়েছে, যখন ব্যয়কারী ইচ্ছা করে, (অন্য রাবী বলেন, যখন সাদ্‌কাকারী সাদ্‌কা করার ইচ্ছা করে) তখন তা তার উপর প্রশস্ত বা সম্প্রসারিত হয়ে যায়। আর কৃপণ ব্যক্তি যখন দান করার ইচ্ছা করে তখন তা তার উপর সংকুচিত হয়ে যায় এবং বর্মের প্রতিটি আংটা সস্থানে দৃঢ়ভাবে এটে যায়। এমন কি তা তার নখাগ্র পর্যন্ত আবৃত করে ফেলে এবং তার পদচিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেয়। রাবী বলেন, আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন, অর্থাৎ সে বর্মটিকে প্রশস্ত ও বিস্তৃত করতে চায় কিন্তু তা বিস্তৃত হয় না।
باب مَثَلِ الْمُنْفِقِ وَالْبَخِيلِ
حَدَّثَنَا عَمْرٌو النَّاقِدُ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ، عَنْ أَبِي الزِّنَادِ، عَنِ الأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم . قَالَ عَمْرٌو وَحَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ قَالَ وَقَالَ ابْنُ جُرَيْجٍ عَنِ الْحَسَنِ بْنِ مُسْلِمٍ عَنْ طَاوُسٍ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَثَلُ الْمُنْفِقِ وَالْمُتَصَدِّقِ كَمَثَلِ رَجُلٍ عَلَيْهِ جُبَّتَانِ أَوْ جُنَّتَانِ مِنْ لَدُنْ ثُدِيِّهِمَا إِلَى تَرَاقِيهِمَا فَإِذَا أَرَادَ الْمُنْفِقُ - وَقَالَ الآخَرُ فَإِذَا أَرَادَ الْمُتَصَدِّقُ - أَنْ يَتَصَدَّقَ سَبَغَتْ عَلَيْهِ أَوْ مَرَّتْ وَإِذَا أَرَادَ الْبَخِيلُ أَنْ يُنْفِقَ قَلَصَتْ عَلَيْهِ وَأَخَذَتْ كُلُّ حَلْقَةٍ مَوْضِعَهَا حَتَّى تُجِنَّ بَنَانَهُ وَتَعْفُوَ أَثَرَهُ " . قَالَ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ فَقَالَ يُوَسِّعُهَا فَلاَ تَتَّسِعُ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে উপমা দ্বারা কৃপণ ও দানশীল ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা ও তাদের পরিণাম ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কৃপণ ও দানশীল ব্যক্তি উভয়ই যেন লোহার বর্ম পরিহিত অবস্থায় আছে। তা দ্বারা তাদের বুক থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকা রয়েছে। আকারে উভয়ের বর্ম একই পরিমাণ। কিন্তু দান-খয়রাত করা না করার ভিত্তিতে তা দুই রকম হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(খরচকারী ব্যক্তির অবস্থা হল এমন যে, সে যখনই খরচ করতে চায়, তখন বর্মটি তার চামড়ার উপর প্রসারিত হয়ে যায় বা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমনকি তার আঙ্গুলের মাথা পর্যন্ত ঢেকে ফেলে আর তার পায়ের ছাপ মুছে ফেলে)। অর্থাৎ এর দ্বারা মূলত তার দানশীল চরিত্রের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দানশীল ব্যক্তি যখনই দান করতে চায়, তার মন প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। মন তার ইচ্ছায় সাড়া দেয়। ফলে সে অকাতরে দান করতে পারে।আর যতই দান করে, মনের প্রসারতা বেড়ে যায়। আর এভাবে তার দানের গতিও বাড়তে থাকে। হাদীছে বলা হয়েছে, যতই সে দান-খয়রাত করে, ততোই সেটি বড় হতে থাকে। অর্থাৎ তার দানের প্রবণতা বাড়তে থাকে। বলা হয়েছে, সেটি বড় হতে হতে তার পুরো শরীর ঢেকে যায়। অর্থাৎ দানশীলতা তার গোটা সত্তাকে আচ্ছন্ন করে নেয়। বলা হয়েছে, এমনকি সেটি মাটিতেও হেঁচড়াতে থাকে। অর্থাৎ তার দানশীলতা তার সত্তাকে ছাপিয়ে যায়। পোশাক বড় হলে গোটা শরীর তার মধ্যে ঢাকা পড়ে যায়। আবার মাটিতে হেঁচড়ানোর ফলে তাতে তার পায়ের চিহ্নও মুছে যায়। ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে, তার পাপরাশি দান-খয়রাতের নিচে ঢাকা পড়ে যায়। কেবল ঢাকাই পড়ে না, পোশাকের বাড়তি অংশ দ্বারা যেমন পায়ের চিহ্ন মুছে যায়, তেমনি বাড়তি দান-খয়রাত দ্বারা তার পাপরাশিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে না, তার অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
(পক্ষান্তরে বখিল ব্যক্তির অবস্থা হল এই যে, যখনই সে কোনওকিছু খরচ করতে চায়, অমনি সেটির প্রতিটি আংটা আপন আপন স্থানে এঁটে যায়। সে তা প্রশস্ত করতে চায়, কিন্তু প্রশস্ত হয় না)। এর দ্বারা যেন তার মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার মনের ভেতর যেহেতু দানশীলতা নেই, তাই যখনই সে দান করতে চায়, তার মন সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে কিছুতেই সে দান করতে পারে না। তার কৃপণতা যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। তার হাত যেন বুকের সঙ্গে আটকা পড়ে যায়। কিছুতেই তা দান-খয়রাতের জন্য প্রসারিত করতে পারে না। হাদীছে বলা হয়েছে, এই ব্যক্তির বর্মের প্রতিটি আংটা আপন স্থানে এঁটে যায়। সে সেটি প্রশস্ত করতে চায়, কিন্তু প্রশস্ত হয় না। তার মানে পোশাকটি যেমন ছিল তেমনিই ছোট থেকে যায়। ফলে তার পোশাক দ্বারা সারা শরীর ঢাকে না। শরীরের বেশিরভাগই উন্মুক্ত থেকে যায়। ঠিক তেমনি দান-খয়রাত না করার ফলে কৃপণ ব্যক্তির মান-সম্মানের হেফাজত হয় না; বরং লোকসম্মুখে সে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। তার গুনাহসমূহ ঢাকা পড়ে না। দানশীল ব্যক্তি দান-খয়রাত করার দ্বারা যেমন পাপমুক্তির সুফল লাভ করে, এ ব্যক্তির পক্ষে তা লাভ করা সম্ভব হয় না।

কেউ কেউ বলেন, পোশাক বড় হওয়া না হওয়ার দ্বারা সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া না পাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যে ব্যক্তি দান-খয়রাত করে, তার সম্পদ বরকতের দিক থেকে তো বাড়েই, অনেক সময় বাহ্যিকভাবেও বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কৃপণতা করে, তার সম্পদে বরকত হয় না, ফলে বাহ্যিকভাবে বাড়লেও তা বাস্তবিকপক্ষে কল্যাণকর হয় না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. দানশীলতা মানুষের স্বভাবগত গুণ। চর্চা দ্বারা গুণটির বিকাশ হয়।

খ. কৃপণতাও মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সাধনার মাধ্যমে একে দমন করা না গেলে মানুষের পক্ষে দান-খয়রাত করা সম্ভব হয় না। তাই আল্লাহওয়ালার সাহচর্য ও পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে এ রিপুর দমন জরুরি।

গ. দান-খয়রাত দ্বারা মানুষের সম্মান বাঁচে ও গুনাহ মাফ হয়।

ঘ. কৃপণতা দ্বারা মানুষের সম্মান নষ্ট হয়।

ঙ. দানশীল ব্যক্তির সম্পদে বরকত হয়।

চ. কৃপণ ব্যক্তি সম্পদের প্রকৃত উপকারলাভ থেকে বঞ্চিত থাকে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)