আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৭- কুরআনে কারীমের ফাযায়েল ও আদাব-মাসাঈল

হাদীস নং: ১৮০৩
আন্তর্জাতিক নং: ৮৩২
১৭. যে সকল ওয়াক্তে নামায আদায় করা নিষেধ
১৮০৩। আহমাদ ইবনে জাফর আল মা’কিরী (রাহঃ) ......... ইকরিমা (রাহঃ) বলেন, শাদ্দাদ, আবু উমামা ও ওয়াসিলার সাথে তার সাক্ষাত হয়েছে এবং সিরিয়া ভ্রমণকালেও আনাস (রাযিঃ) এর সহচর ছিলেন। তিনি তার প্রশংসা করেছেন ও তার মহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। আবু উমামা (রাযিঃ) বলেন, আমর ইবনে আবাসা সুলামী (রাযিঃ) বলেন, আমি প্রাক ইসলাম যুগে সকল মানুষকে পথভ্রষ্ট বলে ধারণা করতাম। তারা কোন ধর্মের উপর নেই। তারা সবাই মুর্তি পূঁজা, দেব-দেবীর পূঁজা করত। তিনি বলেন, তখন আমি মক্কায় এমন এক ব্যক্তির কথা শুনলাম যিনি বিভিন্ন সংবাদ বর্ণনা করেন। তখন আমি সওয়ারীর উপর আরোহণ করে তাঁর নিকট এলাম এবং আমি জানতে পারলাম যে তিনি জনসমাবেশ থেকে নিজেকে দুরে রাখেন। তাঁর কওম তাঁর উপর নির্যাতন করে। আমি কৌশলে মক্কায় তার নিকট পৌছিলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনার পরিচয় কি?

তিনি বললেন, আমি নবী। আমি বললাম, নবী কি? তিনি বললেন, আল্লাহ আমাকে প্রেরণ করেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আল্লাহ আপনাকে কি দিয়ে পাঠিয়েছেন? তিনি বললেন, আমাকে আত্মীয়তার বন্ধন সুদূঢ় করা, দেব-দেবী ও মূর্তি ভেঙ্গে দেওয়া, আল্লাহকে এক বলে জানা এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছু শরীক না করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কারা আছে? তিনি বললেন, একজন স্বাধীন ব্যক্তি ও একজন কৃতদাস। তিনি বলেন যে, তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিলেন তাদের মধ্যে আবু বকর (রাযিঃ) ও বিলাল (রাযিঃ) ছিলেন। আমি বললাম, আমিও আপনার অনুসারী হাত চাই। তিনি বললেন, বর্তমান অবস্থায় তুমি তা পারবে না। তুমি আমার অবস্থা ও লোকজনের অবস্থা কি দেখছ না? তুমি বরং পরিজনদের কাছে ফিরে যাও। যখন আমি বিজয় লাভ করেছি বলে শুনতে পাবে তখন আমার কাছে এসো।

তিনি বললেন, আমি পরিজনদের কাছে চলে গেলাম। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হিজরত করে মদীনায় গমন করলেন। তখন আমি পরিজনদের মাঝে অবস্থান করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় গমন করার পর থেকে আমি সর্বদা এ বিষয়ে খোঁজ-খবর এবং মানুষকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলাম। মদীনাবাসীদের একদল লোক আমার কাছে এলেন। তাদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম। যে ব্যক্তি মদীনায় আগমন করেছেন তিনি কি করছেন, তাঁর অবস্থা কি? তারা বললেন, লোকজন অতি দ্রুত তাঁর সাহচর্যে যাচ্ছে তাঁর কওম তাঁকে হত্যা করতে চাচ্ছিল। কিন্তু তারা সফলকাম হয়নি। আমি এ কথা শুলে মদীনায় গেলাম এবং তাঁর কাছে পৌছলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে চিনতে পেরেছেন? তিনি বললেন হ্যাঁ, তুমি সে ব্যক্তি যে আমার সাথে মক্কায় সাক্ষাত করেছিলে।

(বর্ণনাকারী) বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি আবার বললাম, ইয়া-নবী আল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে যা কিছু শিখিয়েছেন, অথচ আমি তা জানি না, তা আমাকে শিক্ষা দিন। আমাকে নামায সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন, ফজরের নামায আদায় করবে। এরপর সূর্য উদিত হয়ে পরিষ্কারভাবে উপরে না উঠা পর্যন্ত তুমি নামায থেকে বিরত থাক। কেননা সূর্য যখন উদিত হয় তখন সেটা উদিত হয় শয়তানের দু’ শিং-এর মাঝখান দিয়ে। সে সময়ে কাফির তাকে সিজদা করে। এরপর নামায আদায় কর, তীরের ছায়া তার সমান না হওয়া পর্যন্ত। নামাযে ফিরিশতাগণের উপস্থিতি এবং সাক্ষ্যের ব্যাপার রয়েছে। এরপর নামায থেকে বিরত থাকো কেননা এ সময়ে জাহান্নামকে উত্তপ্ত করা হয়। এরপর যখন ছায়ায় পরিবর্তন শুরু হয় তখন নামায পড়তে থাক। ফিরিশতাগণ নামাযে উপস্থিত থাকেন। অর্থাৎ আসরের নামায আদায় করা পর্যন্ত, তারপর নামায হতে বিরত থাক সূর্য অস্তমিত না যাওয়া পর্যন্ত। কেননা সূর্য শয়তানের দু’শিং-এর মধ্যে দিয়ে অস্ত যায়। ঐ সময় কাফিররা তাকে সিজদা করে।

রাবী বলেন,আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! উযু সম্পর্কে আমাকে বলে দিন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমাদের কোন ব্যক্তির কাছে যখন ওযুর পানি পেশ করা হয়, এরপর সে কুলি করে ও নাকে পানি দেয় ও তা পরিষ্কার করে। তখন তার মুখমণ্ডলের মূখ গহব্বর ও নাকের সকল গুনাহ ঝরে যায়। তারপর যখন সে আল্লাহ পাকের নির্দেশ অনুসারে মুখমণ্ডল ধোয় তখন মুখমণ্ডলের চারিদিক থেকে সকল গুনাহ পানির সাথে ঝরে যায়। এরপর যখন দু’ হাত ধোয় কুনূই পর্যন্ত, তখন তার উভয় হাতের গুনাহসমূহ আঙ্গুল দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। এরপর উভয় পা গোড়ালী পর্যন্ত ধৌত করলে উভয় পায়ের গুনাহগুলো আঙ্গুল দিয়ে পানির সাথে ঝরে পড়ে। এরপর যদি সে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে আল্লাহর হামদ ও সানা বর্ণনা করে, যথাযথভাবে ও তাঁর অন্তরকে আল্লাহর জন্য মুক্ত করে নেয়, তাহলে সে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে সেদিনের মত যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করোছিল।

আমর ইবনে আবাসা (রাযিঃ)ও হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহাবী আবু উমামা (রাযিঃ) এর নিকট বর্ণনা করেন। তখন আবু উমামা (রাযিঃ) তাঁকে বললেন, হে আমর ইবনে আবাসা! ভেবে দেখ, তুমি কি বলছ! একই স্থানে ঐ ব্যক্তিকে এত মর্যাদা দেয়া হবে? তখন আমর (রাযিঃ) বললেন, হে আবু উমামা (রাযিঃ)! আমি বয়োবৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি। আমার হাড়গুলো নরম হয়ে গিয়েছে। আমার মৃত্যুকাল নিকটবর্তী হয়ে পড়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর উপর মিথ্যা আরোপের কোন প্রয়োজন আমার নেই। আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হতে না শুনতাম একবার দু’বার, তিনবার এমনকি তিনি সাত বার পর্যন্ত গণনা করলেন। তবে আমি কখনো এ হাদীস বর্ণনা করতাম না। আমি হাদীসটি সাত বারের চেয়েও অনেক বেশীবার শুনেছি।
باب الأَوْقَاتِ الَّتِي نُهِيَ عَنِ الصَّلاَةِ، فِيهَا .
حَدَّثَنِي أَحْمَدُ بْنُ جَعْفَرٍ الْمَعْقِرِيُّ، حَدَّثَنَا النَّضْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ، حَدَّثَنَا عِكْرِمَةُ بْنُ عَمَّارٍ، حَدَّثَنَا شَدَّادُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ أَبُو عَمَّارٍ، وَيَحْيَى بْنُ أَبِي كَثِيرٍ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، - قَالَ عِكْرِمَةُ وَلَقِيَ شَدَّادٌ أَبَا أُمَامَةَ وَوَاثِلَةَ وَصَحِبَ أَنَسًا إِلَى الشَّامِ وَأَثْنَى عَلَيْهِ فَضْلاً وَخَيْرًا - عَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ قَالَ عَمْرُو بْنُ عَبَسَةَ السُّلَمِيُّ كُنْتُ وَأَنَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ أَظُنُّ أَنَّ النَّاسَ عَلَى ضَلاَلَةٍ وَأَنَّهُمْ لَيْسُوا عَلَى شَىْءٍ وَهُمْ يَعْبُدُونَ الأَوْثَانَ فَسَمِعْتُ بِرَجُلٍ بِمَكَّةَ يُخْبِرُ أَخْبَارًا فَقَعَدْتُ عَلَى رَاحِلَتِي فَقَدِمْتُ عَلَيْهِ فَإِذَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مُسْتَخْفِيًا جُرَءَاءُ عَلَيْهِ قَوْمُهُ فَتَلَطَّفْتُ حَتَّى دَخَلْتُ عَلَيْهِ بِمَكَّةَ فَقُلْتُ لَهُ مَا أَنْتَ قَالَ " أَنَا نَبِيٌّ " . فَقُلْتُ وَمَا نَبِيٌّ قَالَ " أَرْسَلَنِي اللَّهُ " . فَقُلْتُ وَبِأَىِّ شَىْءٍ أَرْسَلَكَ قَالَ " أَرْسَلَنِي بِصِلَةِ الأَرْحَامِ وَكَسْرِ الأَوْثَانِ وَأَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ لاَ يُشْرَكُ بِهِ شَىْءٌ " . قُلْتُ لَهُ فَمَنْ مَعَكَ عَلَى هَذَا قَالَ " حُرٌّ وَعَبْدٌ " . قَالَ وَمَعَهُ يَوْمَئِذٍ أَبُو بَكْرٍ وَبِلاَلٌ مِمَّنْ آمَنَ بِهِ . فَقُلْتُ إِنِّي مُتَّبِعُكَ . قَالَ " إِنَّكَ لاَ تَسْتَطِيعُ ذَلِكَ يَوْمَكَ هَذَا أَلاَ تَرَى حَالِي وَحَالَ النَّاسِ وَلَكِنِ ارْجِعْ إِلَى أَهْلِكَ فَإِذَا سَمِعْتَ بِي قَدْ ظَهَرْتُ فَأْتِنِي " . قَالَ فَذَهَبْتُ إِلَى أَهْلِي وَقَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةَ وَكُنْتُ فِي أَهْلِي فَجَعَلْتُ أَتَخَبَّرُ الأَخْبَارَ وَأَسْأَلُ النَّاسَ حِينَ قَدِمَ الْمَدِينَةَ حَتَّى قَدِمَ عَلَىَّ نَفَرٌ مِنْ أَهْلِ يَثْرِبَ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ فَقُلْتُ مَا فَعَلَ هَذَا الرَّجُلُ الَّذِي قَدِمَ الْمَدِينَةَ فَقَالُوا النَّاسُ إِلَيْهِ سِرَاعٌ وَقَدْ أَرَادَ قَوْمُهُ قَتْلَهُ فَلَمْ يَسْتَطِيعُوا ذَلِكَ . فَقَدِمْتُ الْمَدِينَةَ فَدَخَلْتُ عَلَيْهِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتَعْرِفُنِي قَالَ " نَعَمْ أَنْتَ الَّذِي لَقِيتَنِي بِمَكَّةَ " . قَالَ فَقُلْتُ بَلَى . فَقُلْتُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ أَخْبِرْنِي عَمَّا عَلَّمَكَ اللَّهُ وَأَجْهَلُهُ . أَخْبِرْنِي عَنِ الصَّلاَةِ قَالَ " صَلِّ صَلاَةَ الصُّبْحِ ثُمَّ أَقْصِرْ عَنِ الصَّلاَةِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ حَتَّى تَرْتَفِعَ فَإِنَّهَا تَطْلُعُ حِينَ تَطْلُعُ بَيْنَ قَرْنَىْ شَيْطَانٍ وَحِينَئِذٍ يَسْجُدُ لَهَا الْكُفَّارُ ثُمَّ صَلِّ فَإِنَّ الصَّلاَةَ مَشْهُودَةٌ مَحْضُورَةٌ حَتَّى يَسْتَقِلَّ الظِّلُّ بِالرُّمْحِ ثُمَّ أَقْصِرْ عَنِ الصَّلاَةِ فَإِنَّ حِينَئِذٍ تُسْجَرُ جَهَنَّمُ فَإِذَا أَقْبَلَ الْفَىْءُ فَصَلِّ فَإِنَّ الصَّلاَةَ مَشْهُودَةٌ مَحْضُورَةٌ حَتَّى تُصَلِّيَ الْعَصْرَ ثُمَّ أَقْصِرْ عَنِ الصَّلاَةِ حَتَّى تَغْرُبَ الشَّمْسُ فَإِنَّهَا تَغْرُبُ بَيْنَ قَرْنَىْ شَيْطَانٍ وَحِينَئِذٍ يَسْجُدُ لَهَا الْكُفَّارُ " . قَالَ فَقُلْتُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ فَالْوُضُوءُ حَدِّثْنِي عَنْهُ قَالَ " مَا مِنْكُمْ رَجُلٌ يُقَرِّبُ وَضُوءَهُ فَيَتَمَضْمَضُ وَيَسْتَنْشِقُ فَيَنْتَثِرُ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا وَجْهِهِ وَفِيهِ وَخَيَاشِيمِهِ ثُمَّ إِذَا غَسَلَ وَجْهَهُ كَمَا أَمَرَهُ اللَّهُ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا وَجْهِهِ مِنْ أَطْرَافِ لِحْيَتِهِ مَعَ الْمَاءِ ثُمَّ يَغْسِلُ يَدَيْهِ إِلَى الْمِرْفَقَيْنِ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا يَدَيْهِ مِنْ أَنَامِلِهِ مَعَ الْمَاءِ ثُمَّ يَمْسَحُ رَأْسَهُ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا رَأْسِهِ مِنْ أَطْرَافِ شَعْرِهِ مَعَ الْمَاءِ ثُمَّ يَغْسِلُ قَدَمَيْهِ إِلَى الْكَعْبَيْنِ إِلاَّ خَرَّتْ خَطَايَا رِجْلَيْهِ مِنْ أَنَامِلِهِ مَعَ الْمَاءِ فَإِنْ هُوَ قَامَ فَصَلَّى فَحَمِدَ اللَّهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَمَجَّدَهُ بِالَّذِي هُوَ لَهُ أَهْلٌ وَفَرَّغَ قَلْبَهُ لِلَّهِ إِلاَّ انْصَرَفَ مِنْ خَطِيئَتِهِ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ " . فَحَدَّثَ عَمْرُو بْنُ عَبَسَةَ بِهَذَا الْحَدِيثِ أَبَا أُمَامَةَ صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لَهُ أَبُو أُمَامَةَ يَا عَمْرَو بْنَ عَبَسَةَ انْظُرْ مَا تَقُولُ فِي مَقَامٍ وَاحِدٍ يُعْطَى هَذَا الرَّجُلُ فَقَالَ عَمْرٌو يَا أَبَا أُمَامَةَ لَقَدْ كَبِرَتْ سِنِّي وَرَقَّ عَظْمِي وَاقْتَرَبَ أَجَلِي وَمَا بِي حَاجَةٌ أَنْ أَكْذِبَ عَلَى اللَّهِ وَلاَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ لَوْ لَمْ أَسْمَعْهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِلاَّ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا - حَتَّى عَدَّ سَبْعَ مَرَّاتٍ - مَا حَدَّثْتُ بِهِ أَبَدًا وَلَكِنِّي سَمِعْتُهُ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আমর ইবনে 'আবাসা রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করে জিজ্ঞেস করলেন-
مَا أَنْتَ؟ (আপনি কী?)। বলেননি যে, আপনি কে। কারণ তাঁর নাম-পরিচয় জানা উদ্দেশ্য নয়। তা তার জানাই ছিল। তিনি জানতে চাচ্ছেন তাঁর পদমর্যাদা ও গুণ-বৈশিষ্ট্য। যেমন বলা হয়, বাশীর কী? সে আলেম, না ডাক্তার নাম-পরিচয় উদ্দেশ্য হলে প্রশ্ন হবে, সে কে? উত্তর দেওয়া হবে, সে বাশীর। নবী কারীম আলাইহি ওয়াসাল্লামও তার প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন। তাই আমি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ না বলে বলেছেন, আমি নবী।

হযরত আমর ইবনে 'আবাসা রাযি.-এর জানা ছিলনা নবী কাকে বলা হয়। তাই আবার জিজ্ঞেস করলেন- নবী কী? অর্থাৎ নবী কাকে বলে, অন্যদের থেকে তার বিশেষত্ব কী?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-- (আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন)। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তাঁর বার্তা দিয়ে আমাকে মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা যুগে যুগে মানুষের হিদায়াতের জন্য তথা তারা কী করলে আল্লাহ তা'আলা খুশি হবেন আর কী করলে তিনি অখুশি হবেন তা বাতলানোর জন্য মানুষেরই মধ্য থেকে কিছু লোককে মনোনীত করেন। তিনি সেই মনোনীত ব্যক্তিবর্গকে ফিরিশতাদের মাধ্যমে এবং কখনও কখনও সরাসরি অন্তরে ভাব সঞ্চারের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেন। তাঁরা মানুষের কাছে তা প্রচার করেন এবং নিজেদের আচার-আচরণ দ্বারা তাদেরকে তা অনুসরণের পদ্ধতি বুঝিয়ে দেন। তাঁদেরকেই নবী ও রাসূল বলে। গঠন-প্রকৃতিতে তাঁরা মানুষই বটে, তবে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা তাদের নীতি-নৈতিকতা ও আখলাক-চরিত্র হয় অনন্য অসাধারণ। তাঁরা যে সত্যিই নবী, বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা দ্বারা আল্লাহ তা'আলা তা প্রমাণ করে দেন।

উত্তর সংক্ষেপ হলেও এর মর্মবস্তু হযরত আমর ইবনে 'আবাসা রাযি.ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই এ সম্পর্কে আর কোনও প্রশ্ন না করে জানতে চেয়েছেন আল্লাহ তা'আলা তাঁকে কী শিক্ষা দিয়ে পাঠিয়েছেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দেন-
ارسلني بصلة الأَرْحَامِ، وَكَسْرِ الْأوْثَانِ، وَأنْ يُوحد الله لا يُشرك به شيء
আমাকে পাঠিয়েছেন আত্মীয়তা রক্ষা, মূর্তি নিধন এবং আল্লাহকে এক বলে স্বীকার করা ও তাঁর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক না করার নির্দেশ দিয়ে)। এটাও সংক্ষিপ্ত উত্তর। তবে ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ এর মধ্যে এসে গেছে। ইসলামের মূল বিষয় দু'টি- হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ। হাক্কুল ইবাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আত্মীয়তা রক্ষা। হাক্কুল্লাহ'র প্রধান কথা আল্লাহ তা'আলাকে এক বলে বিশ্বাস করা, সে অনুযায়ী কেবল তাঁরই ইবাদত করা এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক না করা। এক আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করার সঙ্গে মূর্তির অস্তিত্ব মেনে নেওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না। তাই আল্লাহর ইবাদতকারীগণ তাদের ঘর-বাড়ি ও তাদের সমাজ থেকে মূর্তির উচ্ছেদ করবেই।

বোঝাই যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ও শিক্ষার এ ধারাসমূহ হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি.-এর অন্তর কবুল করেছে। তাই তিনি সাড়াদানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেছেন। তার আগে জানতে চাচ্ছেন এর মধ্যে কেউ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে কি না। সাড়া দিয়ে থাকলে তারা কারা?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দেন-
(একজন স্বাধীন ব্যক্তি ও একজন গোলাম)। স্বাধীন ব্যক্তি হলেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. আর গোলাম হলেন হযরত বিলাল রাযি। প্রশ্ন হয়, এছাড়াও তো আরও দু'জন ইতোমধ্যে ঈমান এনেছিলেন, তাদের একজন হলেন হযরত আলী রাযি. এবং আরেকজন হলেন উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজা রাযি.যিনি ঈমান এনেছিলেন সকলেরই আগে।

উত্তর হল, জিজ্ঞাসা ছিল পুরুষদের সম্পর্কে। তাই আম্মাজানের নাম এখানে উল্লেখ করা হয়নি। আর হযরত আলী রাযি. এর মধ্যে ঈমান আনলেও তিনি ছিলেন বালক বয়সী। পুরুষ বলতে প্রাপ্তবয়স্কদের বোঝায়।

এসব জানার পর হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি. ইসলাম গ্রহণের ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন-
.إِنَّكَ لَن تَسْتَطِيعَ ذَلِكَ يَوْمَكَ هذَا، ألا ترى حَالِي وَحَالَ النَّاسِ وَلَكِنِ ارْجِعْ إِلى أهلك، فإذَا سَمِعْتَ بِي قَدْ ظَهَرْتُ فَأْتِنِي
(তুমি এই দিনে আমার অনুসরণ করতে সক্ষম হবে না। তুমি আমার ও মানুষের অবস্থা দেখছ না? বরং তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যাও। যখন শুনতে পাবে আমি বিজয়ী হয়েছি, তখন আমার কাছে এসো)। এ কথার ব্যাখ্যায় কাযী ইয়ায রহ. বলেন, এর অর্থ এ নয় যে, তাঁর ইসলামগ্রহণ ছাড়াই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ফিরে যেতে বলেছিলেন। বরং তাঁকে তাঁর সাহচর্যে না থেকে বাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন। যেহেতু সময়টা ছিল ইসলামের শুরুকালীন, তখনও ইসলাম শক্তিশালী হয়ে উঠেনি, তাই তিনি ভয় পেয়েছিলেন বিদেশী লোক হওয়ার কারণে না জানি কুরায়শের লোকজন তাকে হত্যা করে ফেলে কিংবা তার অন্য কোনও ক্ষতিসাধন করে। এ হিসেবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যের সারমর্ম হল, ঠিক আছে, তুমি ইসলাম গ্রহণের ছাওয়াব পেয়ে গেছ। এখন ইসলামের হেফাজত কর এবং নিজ দেশে গিয়ে এর উপর চলতে থাক। তারপর যখন জানতে পারবে আমার বিজয় অর্জিত হয়েছে, তখন আমার কাছে চলে এসো।

এটা একটা ইঙ্গিত হল যে, নিজ বিজয় অর্জিত হওয়া সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চিত ছিলেন। তাই তাকে বললেন, যখন জানতে পারবে আমার বিজয় অর্জিত হয়েছে। তাঁর এ বিশ্বাস সত্যে পরিণত হয়েছিল বৈকি। এটিকে তাঁর একটি মু'জিযা বলা চলে।

হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি. নিজ এলাকায় চলে গেলেন। এদিকে নবী কারীম আল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হিজরত করে মদীনায় চলে যান। হযরত আমর রাযি. অপেক্ষা করতে থাকলেন। তিনি খায়বার যুদ্ধের পর মদীনায় এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ততদিনে মদীনা মুনাওয়ারা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ইহুদী গোষ্ঠীসমূহ হয় এলাকা ছেড়ে চলে গেছে, নয়তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে।

মাঝখানে বহু বছর গত হওয়ায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষে তাঁর কথা ভুলে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে চিনতে পেরেছেন?

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ, তুমি তো সেই, যে মক্কায় আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিল। এটাও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক অসাধারণত্ব। যার সঙ্গে একবার কথা হয়েছে তাকে আর কখনও ভোলেননি। আমর ইবন 'আবাসা রাযি. তাঁর সঙ্গে কতক্ষণই বা থেকেছিলেন? এর মধ্যে কত কঠিন সময় গত হয়েছে। মক্কার দিনগুলো ছিল কী দুর্বিসহ। তারপর পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ও কা'বার পবিত্র অঙ্গন ত্যাগ করে ইয়াছরিবে চলে আসা। এখানেও স্বস্তিহীন দিনযাপন। একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ। ভেতরে মুনাফিক ও ইহুদী গোষ্ঠীসমূহের চক্রান্ত মুকাবেলা। তার উপর নিত্যদিনের অভাব-অনটন। এতসব দুঃখ-কষ্ট, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার ভেতর সেই কবেকার ক্ষণিকের দেখা এক বিদেশীকে স্মৃতিপটে ধরে রাখা কেবল অলৌকিক শক্তিবলেই সম্ভব। আল্লাহু আকবার। কেমন সহজে বলে দিলেন, হাঁ, তুমি তো সেই, যে মক্কায় আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেছিল।

এবার হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি. ইসলামের বিস্তারিত শিক্ষা জানতে চাইলেন। বিশেষভাবে নামায সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নামাযের ওয়াক্ত শিক্ষা দিলেন। কখন কখন নামায পড়া যাবে না তাও বলে দিলেন। যেমন বললেন-
صل صلاة الصبح، ثم اقصر عن الصَّلاةِ حتى ترتفع الشمس قيد رمح
নামায পড়বে। তারপর যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয় এবং এক বর্শা পরিমাণ উঁচুতে ওঠ ততক্ষণ নামায থেকে বিরত থাকবে)। অর্থাৎ ফজরের নামায আদায়ের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনও নফল পড়বে না। সূর্যোদয়কালেও যে-কোনও নামায পড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। সূর্যোদয়ের পরও সূর্য এক বর্শা পরিমাণ উঁচুতে উঠা পর্যন্ত নামায থেকে বিরত থাকতে হবে।

সূর্যোদয়কাল ও তার আগের পরের সময়টায় নামায পড়া নিষেধ কেন, সে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- فإنها تطلعُ جيْن تَطْلُعُ بَيْنَ قَرْنَي شَيْطَان، وَحِينَئِذٍ يَسْجُدُ لَهَا الْكُفَّارُ
কেননা সূর্য উদিত হয় শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে এবং তখন কাফেরগণ তাকে সিজদা করে)। শয়তানের দুই শিং' বলে তার মাথার দুই প্রান্ত বোঝানো হয়েছে। প্রকৃত উদ্দেশ্য তার মাথা বোঝানো। শিংধারী পশু যেমন অন্যের উপর হামলা করার জন্য মাথা দিয়ে তাক করে, তেমনি শয়তানও সূর্যোদয়কালে মাথা উঁচিয়ে মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানায়, যাতে তাদেরকে বিপথগামী করতে পারে, তাদেরকে কুমন্ত্রণার ফাঁদে ফেলে নিজ অনুসারী বানিয়ে নিতে পারে। একশ্রেণীর মানুষ ঠিকই তার ফাঁদে পড়ে যায়। এবং সত্যদ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে সূর্যের পূজা শুরু করে দেয়। এভাবে যুগে যুগে বহু মানুষ আকল-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে সূর্যের পূজা করেছে। আজও করছে। শয়তান একই কাজ করে সূর্যাস্তকালেও। এ কারণেই এ দুই সময়ে নামায পড়া নিষেধ। কেননা এ সময়ে নামায পড়লে সূর্য-পূজারীদের সঙ্গে একরকম সাদৃশ্য হয়ে যায়।

নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে ঠিক দুপুর বেলায়ও। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময়টার পরিচয়দান করেন এই বলে যে- (যতক্ষণ না বর্শার ছায়া সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমে যায়)। মাটিতে পুঁতে রাখা বর্শা বা এরকম কোনও বস্তুর ছায়া কমতে কমতে যখন শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, তারপর আর না কমে বরং বাড়তে শুরু করে, তখন কোনও নামায পড়া জায়েয নয়। তার আগ পর্যন্ত যে কোনও নামায পড়া যাবে।

কেন এসময়ে নামায পড়া জায়েয নয় সে সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- (কেননা তখন জাহান্নাম উত্তপ্ত করা হয়)। অর্থাৎ যদিও জাহান্নাম সর্বক্ষণ প্রজ্বলিত থাকে, কিন্তু দুপুরবেলা তার উত্তাপ অন্য সময়ের তুলনায় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই এসময়ে নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে।

প্রশ্ন হতে পারে, নামায আল্লাহ তা'আলার রহমত লাভের উপায়, কাজেই নামায পড়ার দ্বারা আযার দূর হওয়ার আশা থাকে, এ হিসেবে যখন জাহান্নামের আগুন বেশি উত্তপ্ত করা হয় সেই দুপুর বেলায়ই তো নামায পড়া বেশি সমীচীন মনে হয়, তা সত্ত্বেও এ সময় নামায না পড়তে হুকুম করা হল কেন?
এর প্রকৃত উত্তর তো এই যে, বিধানদাতা নিজেই যখন কোনও কারণ বর্ণনা করেন, তখন আমাদের তা বুঝে আসুক বা না-ই আসুক, বান্দা হিসেবে তা গ্রহণ করে নেওয়াই কর্তব্য। তবে কেউ কেউ এর সপক্ষে যুক্তিও দেখিয়েছেন। যেমন যায়নুদ্দীন ইবনুল মুনায়্যির রহ. বলেন, আযাব ও গযবের প্রকাশকালে প্রার্থনা ফলপ্রসূ হয় না। তা ফলপ্রসূ হয় কেবল তার জন্যই, যাকে এরূপ সময় প্রার্থনার অনুমতি দেওয়া হয়, যেমন হাশরের ময়দানে চরম বিভীষিকার কালে আল্লাহ তা'আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শাফা'আত ও প্রার্থনার অনুমতি দেবেন এবং তা কবুলও করা হবে। অন্য কোনও নবীকে অনুমতি দেওয়া হবে না বলে তারা সুপারিশ করতেও সাহস পাবেন না। নামাযেও দু'আ ও প্রার্থনা থাকে। তাই যখন গযব ও ক্রোধের প্রকাশ হয়, সেই দুপুরবেলা নামায থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।

প্রকাশ থাকে যে, জাহান্নাম উত্তপ্ত করা, শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়া সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন ব্যাখ্যাদান করেছেন। তবে এ সম্পর্কে ইমাম খাত্তাবী রহ.-এর কথাই সর্বাপেক্ষা সুন্দর। তিনি বলেন, কোনও বিষয়: হারাম করা বা নিষিদ্ধ করার কারণ সম্পর্কে এরকম যা-কিছু উল্লেখ করা হয়ে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তার হাকীকত দৃষ্টিশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা অনুভব করা সম্ভব নয়। আমাদের কর্তব্য এর উপর ঈমান আনা, এর অন্তর্নিহিত অর্থ সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং এসব কারণের সঙ্গে যে বিধি-বিধান যুক্ত করা হয়েছে তা পালন করা।

নিষিদ্ধ সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ে নামায পড়তে উৎসাহদানের লক্ষ্যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-(কেননা নামায (ফিরিশতাদের) সাক্ষ্যের বিষয়, (তাতে তাদের) উপস্থিতি ঘটে)। অর্থাৎ সকালে ও সন্ধ্যায় পৃথিবীতে তাদের আসা যাওয়া পালাবদল হয়। তারা নামায কালে নামাযীদের নিকট উপস্থিত হয় এবং আল্লাহ তাআলার কাছে গিয়ে তাদের নামায সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يجتمع ملائِكَةُ اللَّيْلِ وَمَلائِكَةُ النَّهارِ عِندَ صَلاةِ الْفَجْرِ وَصَلاةِ الْعَصْرِ، فإذا عَرَجَتْ ملائكة النهار، قال الله عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ: مِنْ أَبْن جِئْتُمْ؟ فَيَقُولُونَ: جِئْنَاكَ مِن بن عباد لكَ، أَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ، وَجِثْناكَ وَهُمْ يُصَلُّوْنَ، فَإِذَا عَرَجَتْ مَلَائِكَةُ الليل، قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ: مِنْ أَيْنَ جِئْتُمْ؟ قَالُوا جِئْنَاكَ مِنْ عِنْدِ عِبَادِ لَكَ، أَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ، وَجِئْنَاكَ وَهُمْ يُصَلُّونَ.
রাতের ও দিনের ফিরিশতাগণ ফজর ও আসরের নামাযকালে একত্র হয়। দিনের ফিরিশতাগণ যখন উঠে যায় আল্লাহ তাআলা তাদের জিজ্ঞেস করেন তোমরা কোথা থেকে আসলে? তারা বলে, আমরা এসেছি আপনার একদল বান্দার নিকট থেকে। আমরা যখন তাদের কাছে এসেছিলাম তখন তারা নামায পড়ছিল। তারপর যখন তাদের নিকট থেকে আপনার কাছে আসি তখনও তারা নামায পড়ছিল। এমনিভাবে রাতের ফিরিশতাগণ যখন উঠে যায় আল্লাহ তা'আলা তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কোথা থেকে আসলে? তারা বলে, আমরা এসেছি আপনার একদল বান্দার নিকট থেকে। আমরা যখন তাদের কাছে এসেছিলাম তখন তারা নামায পড়ছিল। তারপর যখন তাদের নিকট থেকে আপনার কাছে আসি তখনও তারা নামায পড়ছিল।

হযরত আমর ইবনে ‘আবাসা রাযি. ওযুর ফযীলত সম্পর্কে জানতে চাইলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযুর প্রতিটি অঙ্গ সম্পর্কে জানান যে, ওযু করার দ্বারা সে সকল অঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুনাহসমূহ পানির সঙ্গে ঝরে যায় অর্থাৎ তা মাফ হয়ে যায়। তারপর সে ব্যক্তি যখন নামায আদায় করে ফেলে, সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়।

প্রকাশ থাকে যে, এর দ্বারা সগীরা গুনাহসমূহের কথা বলা হয়েছে। কেননা কবীরা গুনাহ মাফ হয় তাওবার মাধ্যমে। এ অবস্থায় প্রশ্ন আসে, ওযু ও নামায দ্বারা যদি কেবল সগীরা গুনাহই মাফ হয় তবে এর দ্বারা সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায় কি করে? তার তো কবীরা গুনাহ থাকতে পারে, যা মাফের জন্য তাওবার প্রয়োজন হবে? এর উত্তর হল, একজন প্রকৃত মুমিনের কবীরা গুনাহ থাকতেই পারে না। কেননা তার দ্বারা কবীরা গুনাহ হয়ে গেলে সে তো সঙ্গে সঙ্গেই তাওবার দ্বারা তা মাফ করিয়ে নেবে। তার বাকি থাকতে পারে কেবল সগীরা গুনাহ। ওযু ও নামায দ্বারা তাও মাফ হয়ে যায়। ফলে সে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ও পবিত্র হয়ে যায়।

নামাযের পরিপূর্ণ ফায়দা পাওয়ার জন্য পরিপূর্ণ ইখলাস জরুরি। পরিপূর্ণ ইখলাসের প্রতি ইঙ্গিত করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে ইরশাদ করেন-
(আল্লাহ তা'আলার জন্য তার অন্তর খালি করে দেয়)। অর্থাৎ নামাযী ব্যক্তি নিজ অন্তঃকরণ গায়রুল্লাহ'র সম্পর্ক থেকে ছিন্ন করে ফেলে। অন্য কোনওদিকে তার মনোযোগ থাকে না। দুনিয়ার ব্যতিব্যস্ততা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। কোনও মানুষকে দেখানো বা কোনও মাখলুককে খুশি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নিজ অন্তরে ঠাঁই দেয় না। এসব মলিনতা থেকে মনঃপ্রাণ পবিত্র করে সে একান্তভাবে আল্লাহ তা'আলার অভিমুখী হয়ে যায়। তার অন্তরে থাকে কেবলই আল্লাহপ্রেম। থাকে নামায কবুলের আশা। সেইসঙ্গে কবুল না হওয়ার আশংকাও। এটাই সত্যিকারের ইখলাস। এরূপ ইখলাসের সঙ্গে নামায পড়লেই নামাযের কাঙ্ক্ষিত ফায়দা হাসিল হয়। নামাযসহ যে-কোনও সৎকর্মে এরূপ ইখলাসই কাম্য। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এ নিআমত দান করুন।

হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি. অপর সাহাবী হযরত আবূ উমামা রাযি.-এর কাছে এ হাদীছটি বর্ণনা করলে তিনি বলে উঠেন- (তুমি কী বলছ চিন্তা করে দেখ। একই স্থানে ওই ব্যক্তিকে এতকিছু দেওয়া হবে)? এর মানে এ নয় যে, হযরত আবু উমামা রাযি. তাঁর কথা অবিশ্বাস করেছেন বা আল্লাহ তা'আলার এ বিপুল অনুগ্রহের কথায় অবাক হয়েছেন। কেননা আল্লাহ তা'আলার এ জাতীয় পুরস্কার ও প্রতিদান তাঁর কাছে অশ্রুতপূর্ব ছিল না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা'আলার অপরিমিত দানের কথা তাঁদেরকে বরাবরই শুনিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি.-কে সতর্ক করেছেন, যাতে এরূপ আশা সঞ্চারকারী হাদীছ বর্ণনায় তিনি পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করেন, কোনওরূপ ভুল যাতে না হয়ে যায়। এটাও বলা যায়, হযরত আবু উমামা রাযি. আল্লাহ তা'আলার এ বিশাল দান ও অনুগ্রহের বয়ান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এ কথাটি ছিল মূলত সেই উচ্ছ্বাস ও মুগ্ধতারই বহিঃপ্রকাশ।

হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি. যে সজ্ঞানে পূর্ণ নিশ্চয়তার সঙ্গে হাদীছটি নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে সত্যি সত্যিই এরূপ শুনেছেন, সে সম্পর্কে আশ্বস্ত করার জন্য প্রথমত নিজ বয়োবৃদ্ধতা, শারীরিক জরাজীর্ণতা ও মৃত্যুর নিকটবর্তীতার অজুহাত পেশ করেন। অর্থাৎ এর যে-কোনও একটি কারও জীবনে বিদ্যমান থাকলে তার মিথ্যা বলা চলে না।

বিশেষত দীনী বিষয়ে সে এরূপ অবস্থায় মিথ্যা বলতেই পারে না। কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি কবরের কিনারায় পৌঁছে মিথ্যা বলতে পারে কি? তিনি যেন বলতে চাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সূত্রে সত্য-সঠিক কথা বর্ণনা করার জন্য আমার বয়স ও শরীরের বর্তমান অবস্থাই যথেষ্ট। সুতরাং আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমি সত্য-সঠিক হাদীছই বর্ণনা করছি। বাড়তি নিশ্চয়তা প্রদানস্বরূপ তিনি হাদীছটি একবার দু'বার নয়; সাতবারের বেশি শোনার কথাটিও সামনে নিয়ে আসেন। এর দ্বারা শক্তপোক্তভাবে সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ বাণীটি সরাসরি ও সঠিকভাবেই শুনেছেন এবং এতে কোনও সংশয়-সন্দেহের অবকাশ নেই। এর দ্বারা শিক্ষালাভ হয় যে, দীন সম্পর্কিত যে-কোনও কথা বর্ণনায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি। দীনের কোনও বিষয় নিশ্চিতভাবে না জেনে কিছুতেই বর্ণনা করা উচিত নয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক.এ হাদীছটি ঈমানদারের অন্তরে আল্লাহ তা'আলার রহমতলাভের গভীর আশা সঞ্চার করে। আল্লাহ তা'আলা কত বড়ই না মেহেরবান যে, সহজ ও ছোট ছোট আমলের বিনিময়েও তিনি বিপুল বিশাল প্রতিদান দিয়ে থাকেন!

খ. দীনের উপর যে ব্যক্তির মজবুতী আসেনি, তাকে দীনী বিষয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরামর্শ দিতে নেই। বরং ঝুঁকিমুক্ত সহজ পন্থা গ্রহণের পথ দেখানো চাই। হযরত আমর ইবন 'আবাসা রাযি.-এর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করেছেন।

গ. নবী-রাসূলগণ আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক মনোনীত ও প্রেরিত হয়ে থাকেন। কেউ চেষ্টা-সাধনা দ্বারা নবী হতে পারে না।

ঘ. নবীগণের মু'জিযা সত্য। তাতে বিশ্বাস রাখা জরুরি।

ঙ. শিরক ও শিরকী কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে ঈমানবিরোধী। মুমিন ব্যক্তিকে সর্বপ্রচেষ্টায় এর থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

চ. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটিকে তাঁর মৌলিক শিক্ষামালার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

ছ. এ হাদীছ দ্বারা নামাযের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। এটা কত বড় ইবাদত যে, এ ইবাদত আদায়কালে ফিরিশতা উপস্থিত থাকে এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে এ সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়।

জ. সূর্যোদয়কালে, সুর্যাস্তকালে ও দুপুরবেলা নামায পড়া জায়েয নয় ।

ঝ. ফজরের নামায আদায়ের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত এবং আসরের নামায আদায়ের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনও নফল নামায পড়া জায়েয নয়।

ঞ. ওযূ দ্বারা যেমন বাহ্যিক পবিত্রতা হাসিল হয়, তেমনি আত্মিক পবিত্রতা অর্থাৎ পাপের পঙ্কিলতা থেকেও পবিত্রতা অর্জিত হয়। সুতরাং আমরা সুচারুরূপে অতি যত্নের সঙ্গে ওযূ করতে সচেষ্ট থাকব।

ট. জাহান্নাম সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তার অস্তিত্ব বর্তমান। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে নাজাত দিন।

ঠ. নামাযের প্রস্তুতিস্বরূপ নিজের মনঃপ্রাণকে দুনিয়ার সমস্তকিছু থেকে খালি ও মুক্ত করা চাই। নামাযের ভেতরেও অন্তরের এ অবস্থা বজায় রেখে সর্বান্তকরণে আল্লাহতে মগ্ন থাকা কাম্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
rabi
বর্ণনাকারী:
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ১৮০৩ | মুসলিম বাংলা