আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
৫- মসজিদ ও নামাযের স্থান সমূহের বর্ণনা
হাদীস নং: ১৪০৮
আন্তর্জাতিক নং: ৬৭৩ - ৩
৪৮. ইমামতির জন্য কে বেশী যোগ্য
১৪০৮। মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না (রাহঃ) ও ইবনে বাশশার (রাহঃ) ......... আবু মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের বলেছেন, সেই ব্যক্তি লোকদের ইমামতি করবে যে আল্লাহর কিতাব পাঠে অধিক অভিজ্ঞ এবং তার পাঠে সবার অগ্রগামী। যদি কিতাব পাঠে সকলেই সমান হয়, তবে সে ইমামতি করবে যে আগে হিজরত করেছে। যদি হিজরতেও সকলেই সমান হয়, তবে বয়সে যে বড়, সে ইমামতি করবে। তোমাদের কেউ অন্য কারো ঘরে কিংবা অন্য কারো কর্তৃত্বের স্থানে ইমামতি করবে না এবং অনুমতি ছাড়া কারো গৃহে তার আসনে বসবে না।
باب مَنْ أَحَقُّ بِالإِمَامَةِ
وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَابْنُ، بَشَّارٍ قَالَ ابْنُ الْمُثَنَّى حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ شُعْبَةَ، عَنْ إِسْمَاعِيلَ بْنِ رَجَاءٍ، قَالَ سَمِعْتُ أَوْسَ بْنَ ضَمْعَجٍ، يَقُولُ سَمِعْتُ أَبَا مَسْعُودٍ، يَقُولُ قَالَ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤُهُمْ لِكِتَابِ اللَّهِ وَأَقْدَمُهُمْ قِرَاءَةً فَإِنْ كَانَتْ قِرَاءَتُهُمْ سَوَاءً فَلْيَؤُمَّهُمْ أَقْدَمُهُمْ هِجْرَةً فَإِنْ كَانُوا فِي الْهِجْرَةِ سَوَاءً فَلْيَؤُمَّهُمْ أَكْبَرُهُمْ سِنًّا وَلاَ تَؤُمَّنَّ الرَّجُلَ فِي أَهْلِهِ وَلاَ فِي سُلْطَانِهِ وَلاَ تَجْلِسْ عَلَى تَكْرِمَتِهِ فِي بَيْتِهِ إِلاَّ أَنْ يَأْذَنَ لَكَ أَوْ بِإِذْنِهِ " .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে পর্যায়ক্রমিকভাবে যারা ইমাম হওয়ার অগ্রাধিকার রাখে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এতে পর্যায়ক্রমে তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়েছে— ইলম, হিজরত ও বয়স। বয়স ও হিজরতের ক্ষেত্রে ইলমী যোগ্যতাও বিবেচ্য। অর্থাৎ ইমামতের জন্য ইলম এক অপরিহার্য শর্ত। হিজরত ও বয়স বিবেচ্য হয় তখনই, যখন সমপর্যায়ের একাধিক আলেম থাকে। যদি সুযোগ্য আলেম একজনই হয়, তবে তিনিই ইমামত করবেন। যদি একাধিক হয়, তবে যে আলেম হিজরতের ক্ষেত্রে অগ্রগামী তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। ইলমী যোগ্যতায় সমান হওয়ার পাশাপাশি হিজরতের ক্ষেত্রেও যদি তারা সমকালীন হন, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এবারে হাদীছটির দিকে লক্ষ করুন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤهُمْ لِكتَابِ اللَّهِ (লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরআন বেশি জানে সে-ই তাদের ইমামত করবে)। কুরআন জানার দু'টি দিক আছে। এক হচ্ছে কুরআনের শব্দাবলী জানা, আরেক হচ্ছে অর্থ ও ব্যাখ্যা জানা। শব্দাবলী জানাও দু'রকম- শব্দ মুখস্থ থাকা ও সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে জানা। তাহলে ‘কুরআন জানা' কথাটি পুরোপুরিভাবে ওই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হয়, যে কুরআন সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে পারে, যথেষ্ট পরিমাণ মুখস্থও করেছে এবং অর্থ ও ব্যাখ্যাও বোঝে। সুতরাং এ তিনওটি দিক যার মধ্যে তুলনামূলক বেশি থাকবে, ইমামতের অগ্রাধিকারও তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অন্য বর্ণনায় তারপর ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنْ كَانُوا في الْقِراءَةِ سَواءً، فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ (যদি কুরআন পাঠে সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে)। সুন্নাহ অর্থ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা তথা দীন ও শরীআত। একে 'ফিকহ' শব্দেও ব্যক্ত করা হয়। কাজেই ‘সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে' এর অর্থ দীন ও শরীআতের জ্ঞান যার বেশি আছে, ফিক্হ সম্পর্কে যার জানাশোনা বেশি, এককথায় যিনি ফকীহ ও আলেম হিসেবে অন্যদের তুলনায় উচ্চস্তরের। বলাবাহুল্য এরূপ ব্যক্তির কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানও অন্যদের তুলনায় বেশিই থাকবে। অন্যথায় তার বড় ফকীহ হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
এমনিতে বড় আলেম ও বড় ফকীহ'র মর্যাদা বেশি হলেও ইমামতির জন্য 'বেশি কুরআন জানা'-কে প্রথম বিবেচনা করা হয়েছে। তা বিবেচনা করার কারণ হলো, সেকালে নামাযের প্রয়োজনীয় মাসাইল সাধারণভাবে অধিকাংশেরই জানা থাকত। কিন্তু কুরআন মাজীদ জানার ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। কেউ বেশি জানত, কেউ কম। তখন সাধারণত কুরআন মাজীদ নামাযে পড়াও হত বেশি বেশি। তখন কুরআন মাজীদ সংরক্ষণের কাজটি বিশেষভাবে মুখস্থকরণের মাধ্যমে করা হতো। তাই সকলের যাতে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যায়, সে লক্ষ্যেও নামাযে বেশি বেশি পড়ার প্রয়োজনও ছিল। এসকল কারণে কুরআন বেশি জানা ব্যক্তিকে ইমামতের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীকালে ইমামতের জন্য ইলম যার বেশি সেরকম লোকের জন্যই অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হয়। কেননা নামাযে কেরাত অপেক্ষা ইলমেরই প্রয়োজন বেশি হয়। নামাযের শত শত মাসআলা আছে। এমন বহু কারণ আছে, যাতে নামায নষ্ট হয়ে যায়, যদ্দরুন নামায পুনরায় পড়া জরুরি হয়। এমন অনেক ভুল আছে, সাহু সিজদা দ্বারা যার প্রতিকার হয়ে যায়। যথেষ্ট ইলম না থাকলে এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। আর এটা তো স্পষ্ট কথা যে, একজন আলেমের যথেষ্ট পরিমাণ কুরআনও জানা থাকে এবং তিনি সহীহ-শুদ্ধভাবেই তা পড়ে থাকেন। এসব বিবেচনায় ইমাম আবূ হানীফা রহ.-সহ বহু ফকীহ ইমামতের জন্য কারী অপেক্ষা আলেমকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁরা এ সিদ্ধান্ত হাদীছের ভিত্তিতেই নিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষজীবনে ইমামতের জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে মনোনীত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে তিনিই ছিলেন তাদের মধ্যে সবচে’ বড় আলেম । কিন্তু কারী হিসেবে বড় ছিলেন হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.।
যাহোক এ হাদীছে ইমামতের জন্য কারীকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি নামাযের সময় সমমানের একাধিক বড় আলেম একত্র হয়ে যায়, তখন অগ্রাধিকারের জন্য বিবেচ্য বিষয় কী হবে? হাদীছটিতে বলা হয়েছে-
(যদি সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে হিজরতে যে সকলের অগ্রগামী। এর দ্বারা হিজরতের মর্যাদা ও গুরুত্ব পরিস্ফুট হয়। বলাবাহুল্য হিজরত অতি বড় একটি ত্যাগ। নিজের দীন ও ঈমান রক্ষার্থে মাতৃভূমি ছেড়ে অজানা অপরিচিত এক দেশে চলে যাওয়া সহজ কথা নয়। এর জন্য পরিপক্ক ঈমান ও গভীর আখেরাতমুখিতা প্রয়োজন। সাহাবায়ে কেরামের তা ছিল। তাই অকাতরে হিজরতের কত কঠিন ত্যাগ তাঁরা স্বীকার করতে পেরেছিলেন। তাই আজ সম্মানজনক 'মুহাজির' নামে তাঁরা পরিচিত। কিয়ামত পর্যন্ত এ সম্মানজনক অভিধায় তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
যাহোক হিজরতের উচ্চমর্যাদার কারণে ইমামতের অগ্রাধিকারেও এটি বিবেচ্য। তবে বর্তমানকালে সাধারণভাবে মুহাজির না থাকায় অগ্রাধিকারদানের এ দিকটি বিবেচনা করা কঠিন। তাই এ পর্যায়ে অগ্রাধিকারের পরবর্তী দিকটি বিবেচ্য। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
(যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে বয়সে যে সকলের বড়)। অপর এক বর্ণনায় আছে- فَأَقْدَمُهُمْ سِلما (যে ব্যক্তি তাদের সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে)। বাহ্যত উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরিত্য লক্ষ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বৈপরিত্য নেই। কেননা প্রথম বর্ণনায় যে বয়সে বড় বলা হয়েছে, তা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ইসলাম গ্রহণের বয়স। অর্থাৎ যার ইসলাম গ্রহণের বয়স অন্যদের তুলনায় বেশি। তার মানে আগে ইসলাম গ্রহণ করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরে ইসলাম গ্রহণকারীর তুলনায় আগে ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগী বেশি করার সুযোগ হয়েছে এবং সে অধিকতর পুণ্য সঞ্চয় করতে পেরেছে। তাই ইমামতের মর্যাদাদানেও তাকে অগ্রগণ্য মনে করা হবে।
উল্লেখ্য, বেশি বয়স হওয়াকে বাস্তবিক বয়োজ্যেষ্ঠতার অর্থেও ধরা যেতে পারে। যেমন এক রেওয়ায়েতে আছে فَإِنْ كانُوا في الهِجْرَةِ سَوَاءً، فَليَؤُمُّهم اكبرهم سِنّاً (যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে ব্যক্তি বয়সে তাদের মধ্যে বড়)। যার বয়স বেশি তার পুণ্যও বেশি হয়ে থাকবে, বিশেষত তিনি যদি আলেমও হন। এস্থলে আলেম হওয়ার শর্ত তো আছেই। এক হাদীছে আছে-
خِيَارُكُمْ أَطْوَلُكُمْ أَعْمَارًا، وَأَحْسَنُكُمْ أَعْمَالَا
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যার বয়স বেশি এবং আমলও উৎকৃষ্ট।'১৯৩
এ অর্থ হিসেবেও উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কেননা বয়স্ক ব্যক্তি জন্মসূত্রে মুসলিম হলে সে অল্পবয়স্ক ব্যক্তি অপেক্ষা আগে ইসলাম গ্রহণকারীই তো হলো। অথবা বলা যায়, আগে ইসলাম গ্রহণ করা অগ্রাধিকার বিবেচনার একটি দিক, আর বয়স বেশি হওয়ার আরেকটি দিক। প্রথমটিতে সবাই সমান হলে দ্বিতীয়টির বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সামাজিক বিশেষ দু'টি শিষ্টাচার
অতঃপর হাদীছে দু'টি বিশেষ সামাজিক নীতির ব্যাপারে সচেতন করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে—(কোনও ব্যক্তি যেন কিছুতেই অপর ব্যক্তির ক্ষমতাবলয়ে অনুমতি ছাড়া তার ইমামত না করে)। ইমাম নববী রহ. বলেন- سُلْطَانِهِ এর দ্বারা কারও কর্তৃত্বাধীন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য (যেমন শাসক, প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি প্রমুখের আওতাধীন অঞ্চল। এমনিভাবে ওই মসজিদ, যেখানে সুনির্দিষ্ট ইমাম আছে)। অথবা এমন স্থান, যা তার জন্য নির্দিষ্ট (যেমন নিজ বাড়ি বা অবস্থানস্থল)। এরূপ স্থানে অতিথি বা আগুন্তুক অপেক্ষা শাসক, ইমাম ও গৃহকর্তারই ইমামত করার অগ্রাধিকার থাকবে। এদিকে লক্ষ রাখা খুবই জরুরি। এটা লঙ্ঘন করার দ্বারা অন্যের অধিকার খর্ব করা হয় এবং তা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আর দ্বিতীয় নীতিটি হলো- (এবং তার বাড়িতে তার আসনে অনুমতি ছাড়া না বসে)। ইমাম নববী রহ. বলেন, تَكْرِمتِهِ এর অর্থ কারও ব্যক্তিগত বিছানা, চেয়ার বা এরকম কোনও স্থান। এটাও আদাবুল মু'আশারাত (সামাজিক শিষ্টাচার)-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। অনেক সময় এদিকে লক্ষ করা হয় না। অনুমতি ছাড়াই অন্যের আসনে ও অন্যের বিছানায় শোয়া-বসা করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি অসামাজিকতা ও গর্হিত কাজ। এতেও অন্যের অধিকার খর্ব করা হয়। এর দ্বারা অন্যের মনে বিরক্তি ও বিতৃষ্ণারও সঞ্চার হয়, যা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই এর থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছের ভেতর বহু মূল্যবান শিক্ষা আছে। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখ করা গেল ।
ক. কুরআন-হাদীছের ইলম আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তাই প্রত্যেক মুসলিমের এ ইলম অর্জনে আগ্রহ থাকা চাই।
খ. ইমাম মনোনয়নে সুযোগ্য আলেমকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
গ. হিজরত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আমল। এ আমলকারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা একান্ত কর্তব্য।
ঘ. বয়স্ক ব্যক্তিদের সম্মান করা উচিত।
ঙ. অন্যের কর্তৃত্বধীন স্থানে ইমামতি করা বা অন্য কোনওরকম নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বমূলক আচরণ করা অনধিকার চর্চার শামিল। এর থেকে বিরত থাকা উচিত।
চ. অনুমতি ছাড়া অন্যের আসনে বসা বা অন্যের বিছানায় শোয়া একটি গর্হিত কাজ। এর থেকেও বিরত থাকা কর্তব্য।
১৯৩. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৮১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭২১২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪৪২২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫২৭
يَؤُمُّ الْقَوْمَ أَقْرَؤهُمْ لِكتَابِ اللَّهِ (লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরআন বেশি জানে সে-ই তাদের ইমামত করবে)। কুরআন জানার দু'টি দিক আছে। এক হচ্ছে কুরআনের শব্দাবলী জানা, আরেক হচ্ছে অর্থ ও ব্যাখ্যা জানা। শব্দাবলী জানাও দু'রকম- শব্দ মুখস্থ থাকা ও সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে জানা। তাহলে ‘কুরআন জানা' কথাটি পুরোপুরিভাবে ওই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হয়, যে কুরআন সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে পারে, যথেষ্ট পরিমাণ মুখস্থও করেছে এবং অর্থ ও ব্যাখ্যাও বোঝে। সুতরাং এ তিনওটি দিক যার মধ্যে তুলনামূলক বেশি থাকবে, ইমামতের অগ্রাধিকারও তার জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অন্য বর্ণনায় তারপর ইরশাদ হয়েছে-
فَإِنْ كَانُوا في الْقِراءَةِ سَواءً، فَأَعْلَمُهُمْ بِالسُّنَّةِ (যদি কুরআন পাঠে সকলে সমান হয়, তবে তাদের মধ্যে সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে)। সুন্নাহ অর্থ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা তথা দীন ও শরীআত। একে 'ফিকহ' শব্দেও ব্যক্ত করা হয়। কাজেই ‘সুন্নাহ সম্পর্কে যে বেশি জানে' এর অর্থ দীন ও শরীআতের জ্ঞান যার বেশি আছে, ফিক্হ সম্পর্কে যার জানাশোনা বেশি, এককথায় যিনি ফকীহ ও আলেম হিসেবে অন্যদের তুলনায় উচ্চস্তরের। বলাবাহুল্য এরূপ ব্যক্তির কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানও অন্যদের তুলনায় বেশিই থাকবে। অন্যথায় তার বড় ফকীহ হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
এমনিতে বড় আলেম ও বড় ফকীহ'র মর্যাদা বেশি হলেও ইমামতির জন্য 'বেশি কুরআন জানা'-কে প্রথম বিবেচনা করা হয়েছে। তা বিবেচনা করার কারণ হলো, সেকালে নামাযের প্রয়োজনীয় মাসাইল সাধারণভাবে অধিকাংশেরই জানা থাকত। কিন্তু কুরআন মাজীদ জানার ক্ষেত্রে তাদের পরস্পরের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। কেউ বেশি জানত, কেউ কম। তখন সাধারণত কুরআন মাজীদ নামাযে পড়াও হত বেশি বেশি। তখন কুরআন মাজীদ সংরক্ষণের কাজটি বিশেষভাবে মুখস্থকরণের মাধ্যমে করা হতো। তাই সকলের যাতে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যায়, সে লক্ষ্যেও নামাযে বেশি বেশি পড়ার প্রয়োজনও ছিল। এসকল কারণে কুরআন বেশি জানা ব্যক্তিকে ইমামতের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীকালে ইমামতের জন্য ইলম যার বেশি সেরকম লোকের জন্যই অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হয়। কেননা নামাযে কেরাত অপেক্ষা ইলমেরই প্রয়োজন বেশি হয়। নামাযের শত শত মাসআলা আছে। এমন বহু কারণ আছে, যাতে নামায নষ্ট হয়ে যায়, যদ্দরুন নামায পুনরায় পড়া জরুরি হয়। এমন অনেক ভুল আছে, সাহু সিজদা দ্বারা যার প্রতিকার হয়ে যায়। যথেষ্ট ইলম না থাকলে এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। আর এটা তো স্পষ্ট কথা যে, একজন আলেমের যথেষ্ট পরিমাণ কুরআনও জানা থাকে এবং তিনি সহীহ-শুদ্ধভাবেই তা পড়ে থাকেন। এসব বিবেচনায় ইমাম আবূ হানীফা রহ.-সহ বহু ফকীহ ইমামতের জন্য কারী অপেক্ষা আলেমকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁরা এ সিদ্ধান্ত হাদীছের ভিত্তিতেই নিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষজীবনে ইমামতের জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে মনোনীত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে তিনিই ছিলেন তাদের মধ্যে সবচে’ বড় আলেম । কিন্তু কারী হিসেবে বড় ছিলেন হযরত উবাঈ ইবন কা'ব রাযি.।
যাহোক এ হাদীছে ইমামতের জন্য কারীকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি নামাযের সময় সমমানের একাধিক বড় আলেম একত্র হয়ে যায়, তখন অগ্রাধিকারের জন্য বিবেচ্য বিষয় কী হবে? হাদীছটিতে বলা হয়েছে-
(যদি সকলে সমান হয় তবে তাদের মধ্যে হিজরতে যে সকলের অগ্রগামী। এর দ্বারা হিজরতের মর্যাদা ও গুরুত্ব পরিস্ফুট হয়। বলাবাহুল্য হিজরত অতি বড় একটি ত্যাগ। নিজের দীন ও ঈমান রক্ষার্থে মাতৃভূমি ছেড়ে অজানা অপরিচিত এক দেশে চলে যাওয়া সহজ কথা নয়। এর জন্য পরিপক্ক ঈমান ও গভীর আখেরাতমুখিতা প্রয়োজন। সাহাবায়ে কেরামের তা ছিল। তাই অকাতরে হিজরতের কত কঠিন ত্যাগ তাঁরা স্বীকার করতে পেরেছিলেন। তাই আজ সম্মানজনক 'মুহাজির' নামে তাঁরা পরিচিত। কিয়ামত পর্যন্ত এ সম্মানজনক অভিধায় তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
যাহোক হিজরতের উচ্চমর্যাদার কারণে ইমামতের অগ্রাধিকারেও এটি বিবেচ্য। তবে বর্তমানকালে সাধারণভাবে মুহাজির না থাকায় অগ্রাধিকারদানের এ দিকটি বিবেচনা করা কঠিন। তাই এ পর্যায়ে অগ্রাধিকারের পরবর্তী দিকটি বিবেচ্য। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
(যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে বয়সে যে সকলের বড়)। অপর এক বর্ণনায় আছে- فَأَقْدَمُهُمْ سِلما (যে ব্যক্তি তাদের সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে)। বাহ্যত উভয় বর্ণনার মধ্যে বৈপরিত্য লক্ষ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বৈপরিত্য নেই। কেননা প্রথম বর্ণনায় যে বয়সে বড় বলা হয়েছে, তা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ইসলাম গ্রহণের বয়স। অর্থাৎ যার ইসলাম গ্রহণের বয়স অন্যদের তুলনায় বেশি। তার মানে আগে ইসলাম গ্রহণ করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরে ইসলাম গ্রহণকারীর তুলনায় আগে ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগী বেশি করার সুযোগ হয়েছে এবং সে অধিকতর পুণ্য সঞ্চয় করতে পেরেছে। তাই ইমামতের মর্যাদাদানেও তাকে অগ্রগণ্য মনে করা হবে।
উল্লেখ্য, বেশি বয়স হওয়াকে বাস্তবিক বয়োজ্যেষ্ঠতার অর্থেও ধরা যেতে পারে। যেমন এক রেওয়ায়েতে আছে فَإِنْ كانُوا في الهِجْرَةِ سَوَاءً، فَليَؤُمُّهم اكبرهم سِنّاً (যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে ব্যক্তি বয়সে তাদের মধ্যে বড়)। যার বয়স বেশি তার পুণ্যও বেশি হয়ে থাকবে, বিশেষত তিনি যদি আলেমও হন। এস্থলে আলেম হওয়ার শর্ত তো আছেই। এক হাদীছে আছে-
خِيَارُكُمْ أَطْوَلُكُمْ أَعْمَارًا، وَأَحْسَنُكُمْ أَعْمَالَا
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যার বয়স বেশি এবং আমলও উৎকৃষ্ট।'১৯৩
এ অর্থ হিসেবেও উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কেননা বয়স্ক ব্যক্তি জন্মসূত্রে মুসলিম হলে সে অল্পবয়স্ক ব্যক্তি অপেক্ষা আগে ইসলাম গ্রহণকারীই তো হলো। অথবা বলা যায়, আগে ইসলাম গ্রহণ করা অগ্রাধিকার বিবেচনার একটি দিক, আর বয়স বেশি হওয়ার আরেকটি দিক। প্রথমটিতে সবাই সমান হলে দ্বিতীয়টির বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সামাজিক বিশেষ দু'টি শিষ্টাচার
অতঃপর হাদীছে দু'টি বিশেষ সামাজিক নীতির ব্যাপারে সচেতন করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে—(কোনও ব্যক্তি যেন কিছুতেই অপর ব্যক্তির ক্ষমতাবলয়ে অনুমতি ছাড়া তার ইমামত না করে)। ইমাম নববী রহ. বলেন- سُلْطَانِهِ এর দ্বারা কারও কর্তৃত্বাধীন স্থান বোঝানো উদ্দেশ্য (যেমন শাসক, প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি প্রমুখের আওতাধীন অঞ্চল। এমনিভাবে ওই মসজিদ, যেখানে সুনির্দিষ্ট ইমাম আছে)। অথবা এমন স্থান, যা তার জন্য নির্দিষ্ট (যেমন নিজ বাড়ি বা অবস্থানস্থল)। এরূপ স্থানে অতিথি বা আগুন্তুক অপেক্ষা শাসক, ইমাম ও গৃহকর্তারই ইমামত করার অগ্রাধিকার থাকবে। এদিকে লক্ষ রাখা খুবই জরুরি। এটা লঙ্ঘন করার দ্বারা অন্যের অধিকার খর্ব করা হয় এবং তা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আর দ্বিতীয় নীতিটি হলো- (এবং তার বাড়িতে তার আসনে অনুমতি ছাড়া না বসে)। ইমাম নববী রহ. বলেন, تَكْرِمتِهِ এর অর্থ কারও ব্যক্তিগত বিছানা, চেয়ার বা এরকম কোনও স্থান। এটাও আদাবুল মু'আশারাত (সামাজিক শিষ্টাচার)-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। অনেক সময় এদিকে লক্ষ করা হয় না। অনুমতি ছাড়াই অন্যের আসনে ও অন্যের বিছানায় শোয়া-বসা করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি অসামাজিকতা ও গর্হিত কাজ। এতেও অন্যের অধিকার খর্ব করা হয়। এর দ্বারা অন্যের মনে বিরক্তি ও বিতৃষ্ণারও সঞ্চার হয়, যা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই এর থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছের ভেতর বহু মূল্যবান শিক্ষা আছে। তার মধ্যে বিশেষ কয়েকটি উল্লেখ করা গেল ।
ক. কুরআন-হাদীছের ইলম আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। তাই প্রত্যেক মুসলিমের এ ইলম অর্জনে আগ্রহ থাকা চাই।
খ. ইমাম মনোনয়নে সুযোগ্য আলেমকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
গ. হিজরত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আমল। এ আমলকারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা একান্ত কর্তব্য।
ঘ. বয়স্ক ব্যক্তিদের সম্মান করা উচিত।
ঙ. অন্যের কর্তৃত্বধীন স্থানে ইমামতি করা বা অন্য কোনওরকম নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বমূলক আচরণ করা অনধিকার চর্চার শামিল। এর থেকে বিরত থাকা উচিত।
চ. অনুমতি ছাড়া অন্যের আসনে বসা বা অন্যের বিছানায় শোয়া একটি গর্হিত কাজ। এর থেকেও বিরত থাকা কর্তব্য।
১৯৩. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২৯৮১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭২১২; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪৪২২; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৫২৭
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
