আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

৫- মসজিদ ও নামাযের স্থান সমূহের বর্ণনা

হাদীস নং: ১৩৭১
আন্তর্জাতিক নং: ৩৩ -
৪৪. কোন ওযরবশত জামাআতে শরীক না হওয়া
১৩৭১। হারামালা ইবনে ইয়াহয়া (রাহঃ) ......... মাহমুদ ইবনুল রাবী আনসারী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, ইতবান ইবনে মালিক (রাযিঃ) যিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর একজন সাহাবী ছিলেন আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যিনি একজন আনসারও ছিলেন, আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং আমি (নামাযে) আমার গোত্রের ইমামতি করি। কিন্তু যখন বৃষ্টি হয় তখন আমার ও তাদের মধ্যকার উপত্যকা পানিতে ডুবে যায়। ফলে তখন আমি তাদের (নামাযের জন্য) মসজিদে আসতে পারি না। অতএব, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার ইচ্ছা হয় যে, আপনি আমার ঘরে আসবেন এবং আমার ঘরের কোন একটি অংশে নামায আদায় করবেন। আর আমি সেই স্থানটি আমার নামাযের স্থান হিসাবে ব্যবহার করব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ইনশাআল্লাহ শীগ্রই আমি তা করব।

ইতবান (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পরদিন দ্বিপ্রহরে আবু বকর (রাযিঃ) কে সঙ্গে নিয়ে তার ঘরে আসেন এবং প্রবেশের অনুমতি চান। আমি তাকে অনুমতি দিলে তিনি প্রবেশ করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তোমার ঘরের কোন অংশে আমার নামায আদায় পছন্দ কর? তখন আমি আমার ঘরের একটি কোণের প্রতি ইঙ্গিত করলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে দাঁড়িয়ে তাকবীর বললেন। আমরাও তার পেছনে দাঁড়ালাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দু’রাক'আত নামায আদায় করলেন এবং সালাম ফিরালেন।

ইতবান (রাযিঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য খাযীর* পাক করেছিলাম। এই জন্য তাঁকে আটকে রাখলাম। ইতিমধ্যে মহল্লার অন্যান্য প্রতিবেশীরাও এসে একত্রিত হলো। এ সময় তাদের মধ্যে একজন বলল, মালিক ইবনে দাখশান কোথায়? কেউ বলল, সে তো মুনাফিক, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালবাসেনা। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, এরূপ বলবে না। কেননা তোমরা কি দেখনা যে, আল্লাহকে রাযী করার উদ্দেশ্যে সে “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে?

রাবী বলেনঃ উপস্থিত লোকেরা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলেই তা ভাল জানেন। এক ব্যক্তি বলল, আমরা তো মুনাফিকদের প্রতিই তার প্রীতি ও সহানুভূতি দেখতে পাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলকে সন্তুষ্ট করার জন্য “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।

ইবনে শিহাব (রাহঃ) বলেন, আমি হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ আনসারী, যিনি সালিম গোত্রের লোক ছিলেন, তাঁকে মাহমুদ ইবনুর রাবী (রাযিঃ) এর হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি হাদীসটির যথার্থতা স্বীকার করেছেন।
حَدَّثَنِي حَرْمَلَةُ بْنُ يَحْيَى التُّجِيبِيُّ، أَخْبَرَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي يُونُسُ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ، أَنَّ مَحْمُودَ بْنَ الرَّبِيعِ الأَنْصَارِيَّ، حَدَّثَهُ أَنَّ عِتْبَانَ بْنَ مَالِكٍ وَهُوَ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِمَّنْ شَهِدَ بَدْرًا مِنَ الأَنْصَارِ أَنَّهُ أَتَى رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي قَدْ أَنْكَرْتُ بَصَرِي وَأَنَا أُصَلِّي لِقَوْمِي وَإِذَا كَانَتِ الأَمْطَارُ سَالَ الْوَادِي الَّذِي بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ وَلَمْ أَسْتَطِعْ أَنْ آتِيَ مَسْجِدَهُمْ فَأُصَلِّيَ لَهُمْ وَدِدْتُ أَنَّكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَأْتِي فَتُصَلِّي فِي مُصَلًّى . فَأَتَّخِذَهُ مُصَلًّى . قَالَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " سَأَفْعَلُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ " . قَالَ عِتْبَانُ فَغَدَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَأَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقُ حِينَ ارْتَفَعَ النَّهَارُ فَاسْتَأْذَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَأَذِنْتُ لَهُ فَلَمْ يَجْلِسْ حَتَّى دَخَلَ الْبَيْتَ ثُمَّ قَالَ " أَيْنَ تُحِبُّ أَنْ أُصَلِّيَ مِنْ بَيْتِكِ " . قَالَ فَأَشَرْتُ إِلَى نَاحِيَةٍ مِنَ الْبَيْتِ فَقَامَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَكَبَّرَ فَقُمْنَا وَرَاءَهُ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ سَلَّمَ - قَالَ - وَحَبَسْنَاهُ عَلَى خَزِيرٍ صَنَعْنَاهُ لَهُ - قَالَ - فَثَابَ رِجَالٌ مِنْ أَهْلِ الدَّارِ حَوْلَنَا حَتَّى اجْتَمَعَ فِي الْبَيْتِ رِجَالٌ ذَوُو عَدَدٍ فَقَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ أَيْنَ مَالِكُ بْنُ الدُّخْشُنِ فَقَالَ بَعْضُهُمْ ذَلِكَ مُنَافِقٌ لاَ يُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لاَ تَقُلْ لَهُ ذَلِكَ أَلاَ تَرَاهُ قَدْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ . يُرِيدُ بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ " . قَالَ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ . قَالَ فَإِنَّمَا نَرَى وَجْهَهُ وَنَصِيحَتَهُ لِلْمُنَافِقِينَ . قَالَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ . يَبْتَغِي بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ " . قَالَ ابْنُ شِهَابٍ ثُمَّ سَأَلْتُ الْحُصَيْنَ بْنَ مُحَمَّدٍ الأَنْصَارِيَّ - وَهُوَ أَحَدُ بَنِي سَالِمٍ وَهُوَ مِنْ سَرَاتِهِمْ - عَنْ حَدِيثِ مَحْمُودِ بْنِ الرَّبِيعِ فَصَدَّقَهُ بِذَلِكَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত ইতবান ইবন মালিক রাযি. নিজ গোত্র বনূ সালিমের মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শেষদিকে তিনি পরিপূর্ণ অন্ধই হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনকার কথা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর বাড়ি থেকে মসজিদে আসতে একটি উপত্যকা পার হতে হতো। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢলে উপত্যকা ভরে যেত। ফলে তাঁর পক্ষে সেটি পার হয়ে মসজিদে আসা সম্ভব হতো না, যেমনটা তিনি এ হাদীছে বর্ণনা করেছেন।

তিনি চাচ্ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাড়িতে এসে নির্দিষ্ট একটি স্থানে নামায পড়লে তিনি বরকতস্বরূপ সে স্থানটিকে নিজ নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করতেন। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর জন্য অনুরোধ করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেন।

একদিন তিনি সূর্যোদয়ের পর বেলা চড়ে আসলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসেন। পরে হযরত উমর ফারূক রাযি.-ও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। দিনটি ছিল শনিবার। তিনি হযরত ইতবান রাযি.-এর দেখানো স্থানে সকলকে নিয়ে দু' রাক'আত নামায আদায় করেন। তারপর তাঁর সামনে খাযীরা পেশ করা হয়। খাযীরা হল আটার সঙ্গে চর্বি মিশিয়ে তৈরি করা এক প্রকার খাদ্য। তিনি তা খেয়ে নেন। ইত্যবসরে মহল্লায় তাঁর আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন জমা হয়ে যায়।

হযরত মালিক ইবন দুখশুম রাযি. এ গোত্রেরই একজন সাহাবী। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তাঁকে দেখা না যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। কেউ একজন তাঁকে মুনাফিকও বলে বসে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেন যে, তিনি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্যই কালেমায়ে তায়্যিবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে থাকেন। এটা তাঁর মুমিন হওয়ার দলীল।

এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে মন্তব্যকারীর প্রতিবাদ করেছিলেন যে, সে কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি? ইবন ইসহাক রহ. তার মাগাযী গ্রন্থে এ কথাও বর্ণনা করেছেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মালিক ইবন দুখশুম ও মা'ন ইবন 'আদী রাযি.-কে মুনাফিকদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ- মসজিদে যিরার ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা সেটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এটাও তাঁর খাঁটি মুমিন হওয়া ও মুনাফিকী থেকে মুক্ত থাকার প্রমাণ বহন করে।

যারা তাঁকে মুনাফিক বলে মন্তব্য করেছিলেন তারা এর কারণ দেখিয়েছিলেন এই যে, তাঁকে মুনাফিকদের সঙ্গে উঠাবসা করতে দেখা যায়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেখানো এ কারণটিকে তাঁর মুনাফিকীর দলীলরূপে গ্রহণ করেননি। সম্ভবত তাদের সঙ্গে তাঁর উঠাবসা করার বিশেষ কোনও কারণ ছিল। সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালেমায়ে তায়্যিবার ফযীলত বয়ান করেছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এটা পাঠ করে, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এ ঘোষণা দান করে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেন। এ হারাম হওয়ার অর্থ ওই ব্যক্তির কবীরা গুনাহ না থাকলে জাহান্নামে আদৌ যাবে না। যদি কবীরা গুনাহ থাকে এবং আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করে দেন, তখনও সে জাহান্নামে যাবে না। আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা না করলে নির্দিষ্ট মেয়াদে শাস্তিভোগ করার পর সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। এ কালেমার কারণে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকতে হবে না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কারও বিশেষ ওজর থাকলে সে মসজিদে না গিয়ে ফরয নামায নিজ ঘরেও আদায় করতে পারে।

খ. তাবাররুকের ধারণা ইসলামবিরোধী নয়। তাবাররুক হিসেবেই হযরত ইতবান ইবন মালিক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায আদায়ের স্থানকে নিজের জন্য নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করেছিলেন।

গ. কারও বাড়িতে বিশেষ কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির শুভাগমন হলে মহল্লার লোকজনের উচিত তার সঙ্গে দেখা করতে আসা এবং কিছুক্ষণ তার সাহচর্যে কাটানো। বাড়িওয়ালারও উচিত তাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া।

ঘ. অকাট্য কারণ ছাড়া কালেমা পাঠকারী কোনও ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা উচিত নয়। কেননা দিলের খবর আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না।

ঙ. সঙ্গত কারণ ছাড়া কাফের-মুশরিক ও ফাসেক-ফাজেরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা উচিত না। তাতে অন্যদের মনে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হতে দেওয়া সমীচীন নয়।

চ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যে ব্যক্তি কালেমা পাঠ করে আর এ অবস্থায় মারা যায়, জাহান্নামের স্থায়ী শাস্তি তার জন্য নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন