আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

২- পবিত্রতা অর্জনের অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৮০
আন্তর্জাতিক নং: ২৫১ -
১৪. কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণভাবে উযু করার ফযীলত
৪৮০। ইয়াহয়া ইবনে আইয়ুব (রাহঃ), কুতায়বা ও ইবনে হুজর (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন (কাজের) কথা বলব না, যদ্বারা আল্লাহ তাআলা পাপরাশি দূর করে দিবেন এবং মর্যাদা উচু করে দিবেন? সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, তা হল, অসুবিধা ও কষ্ট সত্ত্বেও পরিপূর্ণভাবে উযু করা, মসজিদে আসার জন্য বেশী পদচারণা এবং এক নামাযের পর অন্য নামাযের জন্য অপেক্ষা করা। জেনে রাখ, এটাই হল রিবাত (তথা নিজেকেআটকে রাখা ও শয়তানের মুকাবিলায় নিজেকেপ্রস্তুত রাখা)।
باب فَضْلِ إِسْبَاغِ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ أَيُّوبَ، وَقُتَيْبَةُ، وَابْنُ، حُجْرٍ جَمِيعًا عَنْ إِسْمَاعِيلَ بْنِ جَعْفَرٍ، - قَالَ ابْنُ أَيُّوبَ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ، - أَخْبَرَنِي الْعَلاَءُ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ " . قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ " إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الصَّلاَةِ فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে তিনটি আমলকে সীমান্ত পাহারার সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং এর প্রত্যেকটির ফযীলত বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা পাপ মোচন করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।
তিনি প্রথমে সাহাবায়ে কিরামের উৎসাহ বর্ধনের উদ্দেশ্যে ওই ফযীলতের উল্লেখপূর্বক বলেন, তোমাদেরকে কি আমি এর কথা বলে দেব না? তাঁরাও উৎসাহী হয়ে বললেন, অবশ্যই বলুন ইয়া রাসূলাল্লাহ!
বস্তুত উৎসাহ বর্ধনের এটাও এক পন্থা যে, কোনও কাজের লাভ ও ফায়দা উল্লেখ করার পর কাজটি কী, সে সম্পর্কে শ্রোতা জানতে চায় কি না তা জিজ্ঞেস করা। এ জিজ্ঞাসা তাদের সচেতন করে তোলে এবং জানার জন্য তাদের মনে উৎসাহ যোগায়।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন জগতের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত হিকমতপূর্ণ। বিভিন্ন হাদীছের ভাষা ও বাকশৈলীর প্রতি লক্ষ করলে সেসব হিকমত উপলব্ধি করা যায়।
যাহোক, সাহাবায়ে কিরাম যখন জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন, তখন এক এক করে তিনটি আমল উল্লেখ করলেন। তার মধ্যে প্রথম হল কষ্টক্লেশের অবস্থায় পরিপূর্ণরূপে ওযূ করা।
কষ্টক্লেশ হতে পারে বিভিন্ন কারণে। শীতকালে যদি গরম পানির ব্যবস্থা না হয় তবে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওযূ করা কষ্ট বৈ কি। যদি পানির অভাব থাকে এবং ওযূ করার জন্য পানি কেনার প্রয়োজন হয়, তখন টাকাপয়সা খরচ করে পানি কিনতেও মনের উপর চাপ পড়তে পারে, বিশেষত যদি টাকাপয়সার অভাব থাকে। ধারেকাছে পানি না থাকলে তা খোঁজাখুঁজি করতেও একরকম কষ্ট হয়। এছাড়া কষ্ট হতে পারে স্বাস্থ্যগত কারণেও।
যেভাবেই কষ্ট হোক না কেন তা স্বীকার করে নিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করলে তখন হাদীছে বর্ণিত ফযীলত লাভ হয়। পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করার মানে যেসব অঙ্গ ধুইতে হয়। তার সব জায়গায় পানি পৌঁছানো। এমন তাড়াহুড়া না করা, যাতে কোনও অঙ্গের বিন্দু পরিমাণও শুকনো থেকে যায়। তাছাড়া অন্ততপক্ষে তিনবার ধোয়া, যেসব অঙ্গ খেলাল করতে হয় তা খেলাল করা এবং পূর্ণ মাথা মাসাহ করাও পরিপূর্ণতার অংশ। মোটকথা, ফরযের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নত, মুস্তাহাব ও আদবসমূহ রক্ষা করে ওযূ করলেই সে ওযূ পরিপূর্ণ হয়।
দ্বিতীয় আমল হচ্ছে মসজিদের দিকে বেশি বেশি হাঁটা। বেশি হাঁটার দুই অর্থ হতে পারে-
ক. মসজিদ থেকে বাড়ি দূরে হওয়ার কারণে বেশিপথ হাঁটা।

খ. বার বার মসজিদে যাওয়ার কারণে বেশি বেশি হাঁটা।

হাদীছ দ্বারা উভয় অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় অর্থ তো অতি স্পষ্ট। পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে জামাতে পড়লে পাঁচ বার হাঁটা হয়। এছাড়া অন্যান্য দীনী জরুরতে যাওয়া-আসা করার দ্বারা যে হাঁটা হয় তাও এর মধ্যে আসবে। আর যদি বাড়ি দূরে হয়, তবে সে দূরত্বের কারণে যে বেশি হাঁটা হয় তা দ্বারাও বেশি হাঁটার ফযীলত অর্জিত হবে। এ কারণেই বনূ সালিমা গোত্র যখন তাদের এলাকা ছেড়ে মসজিদের কাছে চলে আসতে চাইল, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই বলে নিষেধ করলেন যে, তোমরা আপন এলাকায়ই থাক। তাতে তোমাদের প্রতি পদক্ষেপের কারণে ছাওয়াব লেখা হবে।
মোটকথা, মসজিদের পথে বেশি হাঁটার পরিমাণ যে কারণেই হোক না কেন তা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। তাতে গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
তৃতীয় আমল হল এক নামাযের পর আরেক নামাযের জন্য অপেক্ষা করা। অর্থাৎ এক নামায আদায় করার পর পরবর্তী নামাযে কখন শরীক হবে, মনেপ্রাণে সে অপেক্ষায় থাকাটাও একটি ছাওয়াবের কাজ। সে অপেক্ষা মসজিদেও হতে পারে, মসজিদের বাইরেও হতে পারে। মসজিদে অপেক্ষা করার মানে এক নামায আদায়ের পর মসজিদেই থাকা এবং পরবর্তী নামায আদায় না করে চলে না যাওয়া। তা এই না যাওয়াটা যেহেতু কেবলই নামাযের জন্য, তাই এটাও নামাযরূপে গণ্য হবে এবং এ কারণে সে ছাওয়াব পাবে।
নামাযের অপেক্ষা হতে পারে মসজিদের বাইরেও। অর্থাৎ এক নামায আদায় করার পর বাড়িতে বা দোকানে কিংবা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নামাযের কথা ভুলে না যাওয়া। সে যেখানেই থাকুক না কেন, তার মন পড়ে থাকবে পরবর্তী নামাযের দিকে। দুনিয়ার কাজকর্ম তার মন ও চিন্তাচেতনাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারবে না যে, কখন নামায হয়ে গেছে সে খবরই তার নেই। মসজিদের বাইরের জীবন হবে তার কারাবাসের মত। কখন নামাযের সময় হয়ে যাবে আর সে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নামাযের জন্য ছুটে যাবে, সেজন্য তার মন উতলা হয়ে থাকবে। মনের এ অবস্থাকেই 'অপেক্ষা' শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। এ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত পসন্দনীয়। এর দ্বারা তিনি বান্দার গুনাহ মাফ করেন এবং জান্নাতে তার মর্যাদা উঁচু করেন।
এ আমল তিনটিকে 'রিবাত' বলা হয়েছে। রিবাত বলা হয় দেশের সীমান্তে পাহারাদারি করাকে, যাতে শত্রুসৈন্য দেশের মধ্যে ঢুকতে না পারে এবং মুসলমানদের জানমালের ক্ষতিসাধনের সুযোগ না পায়। এটা অত্যন্ত ফযীলতের কাজ। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

رِبَاطُ يَوْمٍ فِي سَبِيْلِ اللهِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا عَلَيْهَا

“আল্লাহর পথে একদিন পাহারাদারি করা দুনিয়া এবং এর মধ্যে যা-কিছু আছে তা অপেক্ষা উত্তম। সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৮৯২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৮৭২; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬৬৪; তবারানী, হাদীছ নং ৬১৩৪: বায়হাকী, হাদীছ নং ১৭৮৮৭

অপর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامٍ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ، وَإِنْ مَاتَ جَرى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُهُ

“একদিন ও একরাত সীমান্তপাহারা দেওয়া একমাস রোযা রাখা ও রাত জেগে ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম। আর এ অবস্থায় মারা গেলে সে যে আমল করত তার ছাওয়াব জারি থাকবে। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৯১৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৩৭২৮ ; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬০৬৪
রিবাত ও সীমান্তপাহারার ফযীলত সম্পর্কে আরও বহু হাদীছ আছে। এত বড় ফযীলতপূর্ণ আমলের সঙ্গে হাদীছে বর্ণিত আমল তিনটির তুলনা করা হয়েছে। অথচ সীমান্ত পাহারায় প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে এবং বাস্তবেও শত্রুর আক্রমণে অনেক সময়ই সীমান্তরক্ষীকে প্রাণ হারাতে হয়, কিন্তু আলোচ্য আমল তিনটিতে প্রাণের কোনও ঝুঁকি নেই; বরং এ কাজ তিনটি বহাল তবিয়তেই করা যায়। তা সত্ত্বেও এ তুলনার কারণ কী?
এর উত্তর এই যে, সীমান্ত পাহারা দ্বারা যেমন শত্রুসৈন্য থেকে দেশের হেফাজত করা হয়, তেমনি এ তিনটি আমল দ্বারা নফসের হামলা থেকে ঈমান ও আমলের হেফাজত করা হয়। মানুষের নফসও বাইরের শত্রুর মত শত্রুই বটে; বরং তারচে' আরও বড় শত্রু। কেননা বাইরের শত্রু তো মানুষের কেবল জানমালের ক্ষতি করে আর সে ক্ষতি কেবলই দুনিয়ার ক্ষতি। পক্ষান্তরে নফস হামলা করে মানুষের ঈমান-আমলের উপর। সে হামলা প্রতিরোধ করতে না পারলে মানুষের ঈমান ও আমল বরবাদ হয়ে যায় এবং তার পরকালীন জীবন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হাদীছে যে তিনটি আমলের কথা বলা হয়েছে, এর দ্বারা নফসের বিরুদ্ধে লড়াই করা হয়। এ তিনটি আমল যেন এমন কঠিন পাহারাদারি, যা ভেদ করে নফস মানুষের ঈমান ও আমলের ক্ষতি করতে সক্ষম হয় না। তাই একে 'রিবাত' বা সীমান্তপাহারার সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এর প্রত্যেকটির ছাওয়াব সীমান্তপাহারার ছাওয়াবের মত।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা আরও কিছু নেক কাজ সম্পর্কে জানা গেল, যা আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও ছাওয়াবের দিক থেকে অনেক বড়।

খ. যাদের ফিলহাল শত্রুর বিরুদ্ধে সসস্ত্র জিহাদের সুযোগ হয় না, তাদের পক্ষে এ হাদীছে বর্ণিত আমল তিনটি অনেক আশাব্যঞ্জক। তারা এর মাধ্যমে রিবাতের ছাওয়াব পেতে পারে, যা কিনা সসস্ত্র জিহাদেরই অংশ।

গ. আমাদের মত পাপীদের জন্য এ হাদীছ অনেক আশাব্যঞ্জক, যেহেতু এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা গুনাহ মাফ করে থাকেন।

ঘ. আমরা তো অতি অবশ্যই জান্নাতের উচ্চমর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষী। সে মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে আমাদের কর্তব্য এ আমল তিনটিতে যত্নবান থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন, আমীন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ৪৮০ | মুসলিম বাংলা