আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

১- ঈমানের অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৯৩
আন্তর্জাতিক নং: ২০২
৮১. উম্মতের জন্য নবী (ﷺ) এর দুআ ও তাদের প্রতি মমতায় তার ক্রন্দন
৩৯৩। ইউনূস ইবনে আব্দুল আলা আস সাদাফী (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল আস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর দুআ বর্ণনা করেনঃ (অর্থ) হে আমার প্রতিপালক! এ সকল প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে, সে আমার দলভূক্ত, কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি তো ক্ষমাশীল পরম দয়ালূ” (সূরা ইবরাহীমঃ ৩৬) তিলাওয়াত করেন। আর ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর দু'আ বর্ণনা করেছেনঃ (অর্থ) “তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর, তরে তো তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (সূরা মায়িদাঃ ১১৮)।

তারপর তিনি তাঁর উভয় হাত উঠালেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত! আর কেঁদে ফেললেন। তখন মহান আল্লাহ বললেনঃ হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদের কাছে যাও, তোমার রব তো সবই জানেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা কর, তিনি কাঁদছেন কেন? জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছিলেন, তা তাঁকে অবহিত করলেন। আর আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ। তখন আল্লাহ তাআলা বললেনঃ হে জিবরাঈল! তুমি মুহাম্মাদের কাছে যাও এবং তাঁকে বল, আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দেব, আপনাকে অন্তুষ্ট করব না।
باب دُعَاءِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم لأُمَّتِهِ وَبُكَائِهِ شَفَقَةً عَلَيْهِمْ
حَدَّثَنِي يُونُسُ بْنُ عَبْدِ الأَعْلَى الصَّدَفِيُّ، أَخْبَرَنَا ابْنُ وَهْبٍ، قَالَ أَخْبَرَنِي عَمْرُو بْنُ الْحَارِثِ، أَنَّ بَكْرَ بْنَ سَوَادَةَ، حَدَّثَهُ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم تَلاَ قَوْلَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فِي إِبْرَاهِيمَ ( رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي) الآيَةَ . وَقَالَ عِيسَى عَلَيْهِ السَّلاَمُ ( إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ) فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَقَالَ " اللَّهُمَّ أُمَّتِي أُمَّتِي " . وَبَكَى فَقَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ وَرَبُّكَ أَعْلَمُ فَسَلْهُ مَا يُبْكِيكَ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ - عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ - فَسَأَلَهُ فَأَخْبَرَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِمَا قَالَ . وَهُوَ أَعْلَمُ . فَقَالَ اللَّهُ يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمَّدٍ فَقُلْ إِنَّا سَنُرْضِيكَ فِي أُمَّتِكَ وَلاَ نَسُوءُكَ .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছের ভেতর উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতটা গভীর দরদ ও দয়ামায়া ছিল তা পরিস্ফুট হয়েছে। এক মজলিসে তিনি আপন আপন উম্মতের প্রতি পূর্বের দুই মহান নবীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সম্পর্কিত দু'টি আয়াত পাঠ করেন। প্রথম পাঠ করেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কিত আয়াত, যাতে তিনি এই বলে আল্লাহ তা'আলার সমীপে আপন উম্মত সম্পর্কে নিজ আকুলতা পেশ করেছিলেন-
رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِي
'হে আমার প্রতিপালক। ওইসব প্রতিমা বিপুল সংখ্যক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। সুতরাং যে-কেউ আমার অনুসরণ করবে, সে আমার দলভুক্ত।

অর্থাৎ এই পাথরের মূর্তিগুলো বহু লোকের বিপথগামী হয়ে যাওয়ার কারণ হয়েছে। তারপরও হে আল্লাহ! আপনি অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। যে-কেউ খালেস তাওহীদের পথ অবলম্বন করে আমার দেখানো পথে চলেছে, সে তো আমার দলভুক্ত হয়ে গেছে, যে কারণে আপনি নিজ রহমতে তাদের মুক্তিদান করবেন বলে তো আশা আছেই। তবে যারা আমার অবাধ্যতা করেছে, আমার দেখানো পথে চলেনি, তাদের ব্যাপারেও আমি আশা রাখি আপনি নিজ দয়ায় তাদেরকে ঈমান আনার ও আমার দেখানো পথে চলার তাওফীক দেবেন এবং এভাবে তাদের জন্য চিরমুক্তির ব্যবস্থা করবেন।

তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কিত আয়াত পাঠ করেন, যে আয়াতে নিজ উম্মত সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলার সমীপে তাঁর নিবেদন বর্ণিত হয়েছে যে-
إنْ تُعَذِبُهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনিই মহাপরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।'

হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা'আলার সমীপে এ কথাটি বলবেন হাশরের ময়দানে, যখন তাওহীদ থেকে তাঁর উম্মতের বিচ্যুতি সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন। আয়াতটির মর্ম এই যে, আপনি যদি তাদেরকে আযাব দিতে চান তবে তা দিতেই পারেন। আপনি পরাক্রমশালী। আপনি আযাব দিতে চাইলে তা ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নেই। আর আযাব দিলে তা সম্পূর্ণ ন্যায়-ইনসাফ হিকমত-মতই হবে। আবার আপনি চাইলে তাদেরকে ক্ষমাও করতে পারেন। ক্ষমা করার ক্ষমতাও আপনার আছে। ক্ষমা করলে তা কোনওরকম দুর্বলতা বা অবিবেচনার কারণে হবে না; বরং তা হবে প্রবল ক্ষমতাশালীর মহানুভবতারই প্রকাশ। মোটকথা অপরাধীদেরকে আপনি শাস্তিদান বা ক্ষমা প্রদর্শন যাই করেন না কেন, সবটাই আপনার মহাহিকমত ও ক্ষমতার ভিত্তিতেই হবে।

আয়াতদু'টি পাঠ করার পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'হাত তুলে এবং কেঁদে কেঁদে আল্লাহ তা'আলার কাছে মিনতি করেন যে-
(হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত)। অর্থাৎ আমর উম্মতের প্রতি দয়া করুন। আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন। অথবা হে আল্লাহ! আমার উম্মত তো আপনারই বান্দা। আপনি চাইলে তাদেরকে শাস্তিও দিতে পারেন এবং তা আপনার ইনসাফই হবে। তবে আপনি পরম দয়ালু, অতিশয় ক্ষমাশীল। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন। আপনি ক্ষমা করলে তাদের প্রতি তা আপনার রহমত ক্ষমাশীলতারই নিদর্শন হবে।

হাদীছটিতে এরপর বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে তার কারণ জিজ্ঞেস করার হুকুম দেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- (অবশ্য তোমার রব্ব ভালোভাবেই তা অবগত আছেন)। বাক্যটি দ্বারা একটি সংশয়ের নিরসন হয়েছে। সংশয়টি এই যে, কোনও বিষয়ে জিজ্ঞেস করা তো হয় তখন, যখন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাকারী অজ্ঞ থাকে। অথচ আল্লাহ তা'আলার অজ্ঞতা বলতে কিছু নেই। কুল মাখলুকাত সম্পর্কে তিনি পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। এ অবস্থায় তাঁর পক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করার মানে কী?

এ বাক্যটি দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য অজ্ঞতা দূর নয়; বরং যার কাছে প্রশ্ন করা হবে সেই মহান সত্তা মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান ও মর্যাদা তুলে ধরা, ফিরিশতাদের সামনে তাঁর কান্নার মর্যাদা প্রকাশ করা এবং যে উদ্দেশ্যে তিনি কেঁদেছেন তা যে পূরণ করা হবে, আগেই তার আভাস দেওয়া।

সুতরাং হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, কারণ হল নিজ উম্মতের নাজাতের চিন্তা। আর আল্লাহ তা'আলার তো তা জানাই আছে।

হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম ফিরে গিয়ে আল্লাহ তা'আলাকে এ কথা জানালে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে এই বলে পাঠালেন যে- (আমি আপনাকে আপনার উম্মতের বিষয়ে সন্তুষ্ট করব। আপনাকে কষ্ট দেব না)। অর্থাৎ আপনার উম্মতের সকলকেই মুক্তি দিয়ে দেব। যারা আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে ঈমান আনবে এবং পুরোপুরিভাবে আপনার দেওয়া শরী'আত মোতাবেক চলবে, তাদেরকে তো প্রথমেই নাজাত দিয়ে দেওয়া হবে। আর যারা ঈমান আনা সত্ত্বেও পাপাচারেও লিপ্ত থেকেছে তারা যদি বিনা তাওবায় মারা যায়, তবে চাইলে আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দেব, অন্যথায় তাদেরকে তাদের পাপ পরিমাণে শাস্তিদান করব এবং তারপর মুক্তি দিয়ে জান্নাতে স্থান দেব। এভাবে তাদের সকলের মুক্তির ব্যবস্থা করে আপনাকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করে দেব। কাউকে স্থায়ীভাবে জাহান্নামে রেখে আপনার মনে কষ্ট দেব না।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা উম্মতের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপরিসীম মমতা সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়।

খ. এর দ্বারা আরও জানা যায় আল্লাহ তা'আলার কাছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা কত উঁচু এবং তিনি তাঁর কত প্রিয়।

গ. এ হাদীছটি আমাদের জন্য এক মহাসুসংবাদ। আমাদের জন্য এটি অতিবড় আশার বাণী। আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে শুরুতেই জান্নাতবাসী করবেন, আমাদেরকেও তাদের মধ্যে শামিল রাখুন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন