আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ
১- ঈমানের অধ্যায়
হাদীস নং: ৩৭৮
আন্তর্জাতিক নং: ১৯৫
৮০. সর্বনিম্ন মর্যাদার জান্নাতবাসী
৩৭৮। মুহাম্মাদ ইবনে তারীফ ইবনে খলীফা আল-বাজালী ও আবু মালিক (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ আল্লাহ তাআলা সকল মানুষকে একত্র করবেন। মুমিনগণ দাঁড়িয়ে থাকবে। জান্নাত তাদের নিকটবতী করা হবে। অবশেষে সবাই আদমের কাছে এসে বলবে, আমাদের জন্য জান্নাত খুলে দেওয়ার প্রার্থনা করুন। আদম (আলাইহিস সালাম) বললেন, তোমাদের পিতা আদমের পদন্থলনের কারণেই তোমাদেরকে জান্নাত হতে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আমি এর যোগ্য নই। তোমরা আমার পুত্র ইবরাহীমের কাছে যাও। তিনি আল্লাহর বন্ধু।
[এরপর সবাই ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এর কাছে এলে] তিনি বলবেনঃ না, আমিও এর যোগ্য নই, আমি আল্লাহর বন্ধু ছিলাম বটে, তবে তা ছিল অন্তরাল থেকে। তোমরা মুসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপ করতেন। সবাই মুসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে আসবে। বলবেনঃ আমিও এর যোগ্য নই; বরং তোমরা ঈসার কাছে যাও। আল্লাহর দেওয়া কালিমা ও রুহ। সবাই তাঁর কাছে আসলে তিনি বলবেনঃ আমিও তার উপযুক্ত নই। তখন সকলে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর কাছে আসবে। তিনি দুআর নিমিত্তে দাড়াবেন এবং তাঁকে অনুমতি প্রদান করা হবে। আমানতকারী আত্মীয়তার সম্পর্ক পুলসিরাতের ডানে-বামে এসে দাঁড়াবে। আর তোমাদের প্রথম দলটি এ সিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হয়ে যাবে।
সাহাবী বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার জন্য আমার পিতামাতা উৎসর্গ হউক। আমাকে বলে দিন “বিদ্যুৎ গতির ন্যায়” কথাটির অর্থ কি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আকাশের বিদ্যুৎ চমক কি কখনো দেখনি? চক্ষের পলকে এখান থেকে সেখানে চলে যায় আবার ফিরে আসে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ এর পরবর্তী দলগুলি যথাক্রমে বায়ুর বেগে, পাখির গতিতে, তারপর লম্বা দৌড়ের গতিতে পার হয়ে! যাবে। প্রত্যেকেই তার আমল হিসাবে তা অতিক্রম করবে। আর তোমাদের নবী (ﷺ) সে অবস্থায় পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে এ দুআ করতে থাকবেঃ আল্লাহ এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন। এরূপে মানুষের আমল মানুষকে চলতে অক্ষম করে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এ সিরাত অতিক্রম করতে থাকবে।
শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে, সে নিতম্বের উপর ভর করে পথ অতিক্রম করছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো ইরশাদ করেনঃ সিরাতের উভয় পার্শের ঝুলানো থাকবে কাঁটাযুক্ত লৌহশলাকা। এরা আল্লাহর নির্দেশক্রমে চিহ্নিত পাপীদেরকে পাকড়াও করবে। তন্মধ্যে কাউকে তো ক্ষত-বিক্ষত করেই ছেড়ে দিবে; সে নাজাত পাবে। আর কতক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হবে। আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন, শপথ সে সত্তার, যার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ। জেনে রাখ, জাহান্নামের গভীরতা সত্তর খারীফ (অর্থাৎ সত্তর হাজার বছরের পথ তুল্য।)
[এরপর সবাই ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) এর কাছে এলে] তিনি বলবেনঃ না, আমিও এর যোগ্য নই, আমি আল্লাহর বন্ধু ছিলাম বটে, তবে তা ছিল অন্তরাল থেকে। তোমরা মুসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে যাও। কারণ তিনি আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপ করতেন। সবাই মুসা (আলাইহিস সালাম) এর কাছে আসবে। বলবেনঃ আমিও এর যোগ্য নই; বরং তোমরা ঈসার কাছে যাও। আল্লাহর দেওয়া কালিমা ও রুহ। সবাই তাঁর কাছে আসলে তিনি বলবেনঃ আমিও তার উপযুক্ত নই। তখন সকলে মুহাম্মাদ (ﷺ) এর কাছে আসবে। তিনি দুআর নিমিত্তে দাড়াবেন এবং তাঁকে অনুমতি প্রদান করা হবে। আমানতকারী আত্মীয়তার সম্পর্ক পুলসিরাতের ডানে-বামে এসে দাঁড়াবে। আর তোমাদের প্রথম দলটি এ সিরাত বিদ্যুৎ গতিতে পার হয়ে যাবে।
সাহাবী বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার জন্য আমার পিতামাতা উৎসর্গ হউক। আমাকে বলে দিন “বিদ্যুৎ গতির ন্যায়” কথাটির অর্থ কি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আকাশের বিদ্যুৎ চমক কি কখনো দেখনি? চক্ষের পলকে এখান থেকে সেখানে চলে যায় আবার ফিরে আসে। তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ এর পরবর্তী দলগুলি যথাক্রমে বায়ুর বেগে, পাখির গতিতে, তারপর লম্বা দৌড়ের গতিতে পার হয়ে! যাবে। প্রত্যেকেই তার আমল হিসাবে তা অতিক্রম করবে। আর তোমাদের নবী (ﷺ) সে অবস্থায় পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে এ দুআ করতে থাকবেঃ আল্লাহ এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন, এদেরকে নিরাপদে পৌছে দিন। এরূপে মানুষের আমল মানুষকে চলতে অক্ষম করে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এ সিরাত অতিক্রম করতে থাকবে।
শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে, সে নিতম্বের উপর ভর করে পথ অতিক্রম করছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো ইরশাদ করেনঃ সিরাতের উভয় পার্শের ঝুলানো থাকবে কাঁটাযুক্ত লৌহশলাকা। এরা আল্লাহর নির্দেশক্রমে চিহ্নিত পাপীদেরকে পাকড়াও করবে। তন্মধ্যে কাউকে তো ক্ষত-বিক্ষত করেই ছেড়ে দিবে; সে নাজাত পাবে। আর কতক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে জাহান্নামের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হবে। আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন, শপথ সে সত্তার, যার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ। জেনে রাখ, জাহান্নামের গভীরতা সত্তর খারীফ (অর্থাৎ সত্তর হাজার বছরের পথ তুল্য।)
باب أَدْنَى أَهْلِ الْجَنَّةِ مَنْزِلَةً فِيهَا
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ طَرِيفِ بْنِ خَلِيفَةَ الْبَجَلِيُّ، حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ فُضَيْلٍ، حَدَّثَنَا أَبُو مَالِكٍ الأَشْجَعِيُّ، عَنْ أَبِي حَازِمٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، وَأَبُو مَالِكٍ عَنْ رِبْعِيٍّ، عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالاَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " يَجْمَعُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى النَّاسَ فَيَقُومُ الْمُؤْمِنُونَ حَتَّى تُزْلَفَ لَهُمُ الْجَنَّةُ فَيَأْتُونَ آدَمَ فَيَقُولُونَ يَا أَبَانَا اسْتَفْتِحْ لَنَا الْجَنَّةَ . فَيَقُولُ وَهَلْ أَخْرَجَكُمْ مِنَ الْجَنَّةِ إِلاَّ خَطِيئَةُ أَبِيكُمْ آدَمَ لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ اذْهَبُوا إِلَى ابْنِي إِبْرَاهِيمَ خَلِيلِ اللَّهِ - قَالَ - فَيَقُولُ إِبْرَاهِيمُ لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ إِنَّمَا كُنْتُ خَلِيلاً مِنْ وَرَاءَ وَرَاءَ اعْمِدُوا إِلَى مُوسَى صلى الله عليه وسلم الَّذِي كَلَّمَهُ اللَّهُ تَكْلِيمًا . فَيَأْتُونَ مُوسَى صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُ لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ اذْهَبُوا إِلَى عِيسَى كَلِمَةِ اللَّهِ وَرُوحِهِ . فَيَقُولُ عِيسَى صلى الله عليه وسلم لَسْتُ بِصَاحِبِ ذَلِكَ . فَيَأْتُونَ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم فَيَقُومُ فَيُؤْذَنُ لَهُ وَتُرْسَلُ الأَمَانَةُ وَالرَّحِمُ فَتَقُومَانِ جَنَبَتَىِ الصِّرَاطِ يَمِينًا وَشِمَالاً فَيَمُرُّ أَوَّلُكُمْ كَالْبَرْقِ " . قَالَ قُلْتُ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَىُّ شَىْءٍ كَمَرِّ الْبَرْقِ قَالَ " أَلَمْ تَرَوْا إِلَى الْبَرْقِ كَيْفَ يَمُرُّ وَيَرْجِعُ فِي طَرْفَةِ يْنٍ ثُمَّ كَمَرِّ الرِّيحِ ثُمَّ كَمَرِّ الطَّيْرِ وَشَدِّ الرِّجَالِ تَجْرِي بِهِمْ أَعْمَالُهُمْ وَنَبِيُّكُمْ قَائِمٌ عَلَى الصِّرَاطِ يَقُولُ رَبِّ سَلِّمْ سَلِّمْ حَتَّى تَعْجِزَ أَعْمَالُ الْعِبَادِ حَتَّى يَجِيءَ الرَّجُلُ فَلاَ يَسْتَطِيعُ السَّيْرَ إِلاَّ زَحْفًا - قَالَ - وَفِي حَافَتَىِ الصِّرَاطِ كَلاَلِيبُ مُعَلَّقَةٌ مَأْمُورَةٌ بِأَخْذِ مَنْ أُمِرَتْ بِهِ فَمَخْدُوشٌ نَاجٍ وَمَكْدُوسٌ فِي النَّارِ " . وَالَّذِي نَفْسُ أَبِي هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ إِنَّ قَعْرَ جَهَنَّمَ لَسَبْعُونَ خَرِيفًا .
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে হাশরের ময়দানে দীর্ঘ অপেক্ষার পর মু'মিনগণ কিভাবে একেকজন নবীর কাছে শাফা'আতের জন্য যাবে, সবশেষে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা'আত করবেন, তারপর কিভাবে তারা পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে যাবে তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
জান্নাতকে নিকটবর্তী করে দেওয়ার অর্থ
এ হাদীছে বলা হয়েছে যে- تزلف لهم الجنة (জান্নাতকে তাদের নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে)। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছেঃ- وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ غَيْرَ بَعِيدٍ আর মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতকে নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে, কোনও দূরত্বই থাকবে না। (সূরা কাহফ (৫০), আয়াত ৩১)
হাশরের ময়দানে অবস্থানকালে জান্নাতকে মু'মিনদের নিকটবর্তী কিভাবে করা হবে, এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। এক ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ নৈকট্য স্থানগত নয়; বরং কালগত। অর্থাৎ যে জান্নাত লাভের জন্য তারা দুনিয়ায় উদগ্রীব ছিল এবং সে লক্ষ্যে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেছিল, সে জান্নাতে পৌঁছতে তাদের আর বেশি দেরি নেই। তারা কবরের জীবন পার হয়ে এসেছে, হাশরের ময়দানেও একটা কাল কেটেছে, বাস এখন কিছু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এর পরই তারা সেখানে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু অধিকাংশের মতে এ নৈকট্য স্থানগতই। তারও আবার বিভিন্ন উপায় হতে পারে। যেমন তাদের অবস্থানস্থল এবং জান্নাত এর মাঝখান থেকে সকল অন্তরায় সরিয়ে দেওয়া হবে। ফলে আপন আপন স্থান থেকেই তারা জান্নাত দেখতে পাবে। এই দেখতে পাওয়াকেই 'নিকটবর্তী করে দেওয়া' শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। অথবা আল্লাহ তা'আলা আপন কুদরতে মধ্যবর্তী দূরত্বকে সংকুচিত করে দেবেন। ফলে তারা জান্নাতকে কাছেই দেখতে পাবে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা'আলার পক্ষে এটাও সম্ভব যে, জান্নাতকেই তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে হাশর ময়দানের কাছে নিয়ে আসা হবে। যেভাবেই হোক না কেন আল্লাহ তা'আলা জান্নাতবাসীদেরকে জান্নাত দেখিয়ে দেবেন, তারপর তাদের লক্ষ্য করে বলবেনঃ-
هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِكُلِّ أَوَّابٍ حَفِيظٍ
এই (সেই জান্নাত), যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হচ্ছিল প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী, (গুনাহ থেকে) আত্মরক্ষাকারীর জন্য। (সূরা কাফ (৫০), আয়াত ৩২)
শাফা'আতের জন্য নবীদের কাছে ছোটাছুটি
স্বাভাবিকভাবেই জান্নাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও তার প্রাণকাড়া নি‘আমতরাশি দেখার পর তাতে প্রবেশের জন্য মু'মিনদের আর তর সইতে চাবে না। আল্লাহ তা'আলা যেন তাড়াতাড়ি তাদেরকে তাতে প্রবেশ করতে দেন সে লক্ষ্যে তারা সুপারিশের জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দেবে। সর্বপ্রথম যাবে হযরত আদম আলাইহিস সালামের কাছে এবং অনুরোধ করবে, আপনি আল্লাহ তা'আলার কাছে দরখাস্ত করুন যাতে আমাদের জান্নাতে প্রবেশের জন্য তার দরজা খুলে দেন। তিনি অপারগতা প্রকাশ করবেন এবং বলবেনঃ- وهل أخرجكم من الجنة إلا خطيئة أبيكم ؟ তোমাদের পিতার গুনাহই কি তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করেনি? অর্থাৎ আমাকে আমার গুনাহের কারণে জান্নাত থেকে বের করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আর এভাবে তোমাদেরও পৃথিবীতে আসতে হয়েছে। তাহলে তোমাদের পৃথিবীতে আসার কারণ হচ্ছে আমার গুনাহ। এ অবস্থায় তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য আমার সুপারিশ করার অধিকার থাকে কোথায়?
বলাবাহুল্য, এটা কেবলই আমাদের মহান আদি পিতার উচ্চতর বিনয়। কেননা তিনি কোনও গুনাহ ও পাপ করেননি। আর ভুল যা-ও হয়েছিল তা-ও তো আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করেই দিয়েছেন। তারপর একজন মহান নবী হওয়ায় পৃথিবীতে নিষ্পাপ। জীবন কাটানোর পাশাপাশি যা-কিছু ইবাদত-বন্দেগী করেছেন তাতে আল্লাহ তাআলার রহমতে তাঁর জান্নাতবাসী হওয়াই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সে ভুলের কারণে নিজ সন্তানদের জন্য কেন সুপারিশ করতে পারবেন না? প্রকৃতপক্ষে হাশরের ময়দান হবে এমনই বিভীষিকাময় যে, সেদিন সমস্ত নবী-রাসূল পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবেন। ফলে আল্লাহ তা আলার সামনে শাফা'আত নিয়ে যাওয়ার সাহস এমনিতেই কারও হবে না। তদুপরি হযরত আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, যে কারণে ভুল হয়ে যাওয়ার পর কোনও ওযর অজুহাত না দেখিয়ে সরাসরি আপন ভুল স্বীকার করে নিয়েছিলেন। হাশরের ময়দানেও যে সে কথার পুনরাবৃত্তি করবেন এবং নিজেকে সুপারিশ করার অযোগ্য সাব্যস্ত করবেন, তার একটা কারণ তাঁর ওই স্বভাবগত বিনয়ও।
হযরত আদম আলাইহিস সালাম কি পাপ করেছিলেন?
খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস হযরত আদম আলাইহিস সালাম পাপ করেছিলেন। তাদের এ বিশ্বাস মনগড়া । আসমানী শিক্ষা এ কথা বলে না। আমরা কুরআন-হাদীছ দ্বারা জানতে পারি সমস্ত নবী নিষ্পাপ ছিলেন। আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামও একজন মহান নবী। তিনিও সম্পূর্ণ মা‘সূম ও নিষ্পাপ। এটাই মুসলিম উম্মাহ'র সংখ্যাগরিষ্ঠের আকীদা। কিছু কিছু লোক আছে, যারা কোনও কোনও আয়াতকে অন্যান্য আয়াত ও হাদীছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করে থাকে এবং তার বাহ্যিক অর্থ ধরে নিয়ে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে থাকে। তাদের সে মত নিঃসন্দেহে ভুল। যে আয়াতের ভিত্তিতে তারা ভিন্নমত পোষণ করে তা হচ্ছেঃ-
وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى
আর (এভাবে) আদম নিজ প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল ও বিভ্রান্ত হল। (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ১২১)
প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত দ্বারা ভিন্নমত পোষণের কোনও সুযোগ নেই। কেননা হযরত আদম আলাইহিস সালামের নিষিদ্ধ ফল খাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার তিরস্কারমূলক উক্তি এই একটিই নয়; আয়াত এ ছাড়া আরও আছে। সবগুলো সামনে রাখলে তাঁর সে ফল খাওয়াকে পাপ মনে করার কোনও সুযোগ থাকে না।
হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর জান্নাতে স্থান দেওয়া, তারপর ফল খেতে নিষেধ করা, তারপর তাঁর দ্বারা ফল খাওয়ার ঘটনা ঘটা, তারপর তাঁর তাওবা করা, তারপর তাঁর পৃথিবীতে আসা—এ যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহে যে তথ্য ও তত্ত্বমূলক বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তাতে গভীরভাবে লক্ষ করলে যে ধারণা লাভ হয় তার সারমর্ম এরকম—
আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে পৃথিবীতে নিজ খলিফা বানিয়ে পাঠানোর জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু সৃষ্টি করার পর তাঁকে প্রথমেই পৃথিবীতে না পাঠিয়ে তার আগে জান্নাতে থাকতে দিলেন। তারপর ফল খাওয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো ঘটল। এর উদ্দেশ্য দৃশ্যত এই যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম যাতে জান্নাতের নি‘আমতসমূহ চোখে দেখে নিজের আসল ঠিকানা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিতে পারেন এবং পৃথিবীতে পৌঁছার পর এ ঠিকানা অর্জনে কী রকমের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে এবং কোন্ পন্থায় তা থেকে মুক্তি লাভ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেন। যেহেতু ফিরিশতাগণের বিপরীতে মানুষের স্বভাবের ভেতরই ভালো ও মন্দ উভয়ের যোগ্যতা রাখা হয়েছে, তাই এ বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবীতে আসার আগেই এ রকমের একটা অভিজ্ঞতা লাভ করা তাঁর জন্য জরুরি ছিল।
নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার দ্বারা তাঁর সে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বিশেষ এক গাছের দিকে ইঙ্গিত করে তার ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় তিনি সে ফল খেয়ে ফেলেন। শয়তান তাঁকে আল্লাহর নামে কসম করে বলেছিলঃ-
يَاآدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَى شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَى
হে আদম! তোমাকে কি এমন একটা গাছের সন্ধান দেব, যা দ্বারা অনন্ত জীবন ও এমন রাজত্ব লাভ হয়, যা কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না? (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ১২০)
ইবলীস বোঝাতে চাচ্ছিল যে, এ গাছের একটা বৈশিষ্ট্য হল, কেউ এর ফল খেলে সে ফিরিশতা হয়ে যায় অথবা তাকে স্থায়ী জীবন দান করা হয়। তাই এ ফল খাওয়ার জন্য বিশেষ শক্তি দরকার হয়। প্রথম দিকে আপনাদের সে শক্তি ছিল না, তাই নিষেধ করা হয়েছিল। যেহেতু জান্নাতের পরিবেশে আপনারা বেশ কিছুদিন যাবৎ থাকছেন, তাই ইতোমধ্যে আপনাদের সে শক্তি অর্জন হয়ে গেছে। সুতরাং এখন এ ফল খেলে কোনও অসুবিধা নেই। সে আল্লাহর নামে কসম করে এ কথা বলল।
ইব্ন আব্বাস রাযি. বলেন, হযরত আদম আলাইহিস সালামের ধারণা ছিল, আল্লাহর নামে কেউ মিথ্যা কসম করতে পারে না। তাই মিথ্যা কসমকে অবলম্বন করে সে তাঁদের সাথে প্রতারণা করতে পেরেছিল। এভাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম সে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলেন। এ খাওয়াটা ছিল তাঁর ইজতিহাদী ভুল অর্থাৎ চিন্তাগত ভুল। তিনি শয়তানের কুমন্ত্রণার ফলে আল্লাহ তাআলার নির্দেশকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর সীমাবদ্ধ মনে করেছিলেন। অন্যথায় তাঁর পক্ষ হতে সরাসরি আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হওয়ার কল্পনাও করা যায় না। তথাপি একজন নবীর পক্ষে এ জাতীয় ভুলও যেহেতু শোভনীয় ছিল না, তাই উল্লিখিত আয়াতে এটাকে গুনাহ বা সীমালঙ্ঘন শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা গুনাহ বা পাপ ছিল না। এটা যে পাপ ছিল না। সেদিকে কুরআন মাজীদের এক আয়াতে ইঙ্গিতও করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ- فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا কিন্তু সে তা ভুলে গেল এবং আমি তার মধ্যে পাইনি প্রতিজ্ঞা। (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ১১৫) অর্থাৎ ফল খেয়ে ফেলার এ কাজটি তাঁর দ্বারা ঘটেছিল ভুলবশত। এতে তাঁর প্রতিজ্ঞার কোনও ভূমিকা ছিল না। অর্থাৎ তিনি তা খাওয়ার সংকল্প করেছিলেন বা নাফরমানী করার ইচ্ছায় হুকুম অমান্য করেছিলেন এমন নয়; বরং অসতর্কতাবশত তাঁর ভুল হয়ে গিয়েছিল। তারপরও তাঁর উচ্চমর্যাদা হিসেবে এ ভুলও যেহেতু তাঁর পক্ষে শোভনীয় ছিল না, তাই আল্লাহ তা'আলা এজন্য তাঁকে তিরস্কার করেন । তিনিও যেহেতু নিজের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাই এ ভুলকে তুচ্ছ মনে না করে অত্যন্ত গুরুত্বের দৃষ্টিতেই দেখেন। ফলে নিতান্তই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না, আল্লাহ তাআলার কাছে কী শব্দে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। তাই তাঁর মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছিল না।
আল্লাহ তাআলা তো অন্তর্যামী এবং তিনি পরম দয়ালু ও দাতাও বটে। তিনি হযরত আদম আলাইহিস সালামের মনের এ অবস্থার কারণে নিজেই তাঁকে তাওবার ভাষা শিখিয়ে দিলেন, যা সূরা আরাফে বর্ণিত আছে এবং তা এরূপঃ-
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের সত্তার প্রতি জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন,তবে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।
এভাবে পৃথিবীতে পাঠানোর আগেই মানুষকে আল্লাহ তাআলা শিখিয়ে দিলেন যে, সে যদি কখনও শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে কিংবা ইন্দ্রিয় পরবশতার কারণে কোনও গুনাহ করে ফেলে, তবে তার কর্তব্য তৎক্ষণাৎ তাওবা করে ফেলা।
আশা করি এতক্ষণে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং উল্লিখিত আয়াতে যে হযরত আদম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে 'হুকুম অমান্য করা' ও 'বিভ্রান্ত হওয়া' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা দ্বারা তিনি পাপ করেছেন বলে বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং এতটা উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এ ভুল তিনি কেন করলেন সে জন্য কেবল তিরস্কার করাই উদ্দেশ্য—তাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কাজেই আয়াতটি দ্বারা এ দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করার কোনও সুযোগ থাকল না যে, আমাদের মহান আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম কোনও পাপকর্ম করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি এবং সকল নবী-রাসূলের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।
শাফা'আত করতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অপারগতা প্রকাশের ব্যাখ্যা
মু'মিনগণ যখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে শাফা'আত করার অনুরোধ জানাবে, তখন তিনি এই বলে অপারগতা প্রকাশ করবেন যে إنما كنت خليلا من وراء وراء 'আমি তো আল্লাহর খলীল ছিলাম অনেক পেছন থেকে।' অর্থাৎ যদিও আমি আল্লাহ তা'আলার খলীল ও বন্ধু, তথাপি আমি আল্লাহ তা'আলার অতটা নিকটবর্তী নই, যতটা নৈকট্য অন্য কারও কারও অর্জিত হয়েছিল। যেমন, আল্লাহ তা'আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন, কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর সেরকম কথোপকথন হয়নি। আর আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মি'রাজের মহামর্যাদাও দান করেছিলেন, যে মর্যাদা আমাকে দেওয়া হয়নি।
এমনও হতে পারে যে, অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য ছিল যে, একজন বান্দা যত উচ্চমর্যাদার অধিকারীই হোক না কেন এবং আল্লাহ তা'আলা আপন রহমত ও করুণায় তাঁকে নিজ খলীল ও বন্ধু বলে যতটা গৌরবান্বিতই করুন না কেন, আল্লাহ তা'আলার জালাল ও কিবরিয়া এবং তাঁর মহাগৌরব ও মর্যাদার অসীম উচ্চতা হিসেবে তা এমন কোনও ধর্তব্যবস্তু নয়, যার ভিত্তিতে সুপারিশ করার সাহস দেখানো যেতে পারে। অতএব তিনি সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন এ কারণে যে, তাঁর সঙ্গে যেহেতু আল্লাহ তা'আলা সরাসরি কথা বলেছেন, সেই সুবাদে হয়তো তাঁর কিছুটা ভরসা হবে। কিন্তু সাহস হবে না তাঁরও। তিনি পরামর্শ দেবেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়ার।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কালেমা ও তাঁর রূহ হওয়ার অর্থ
এ হাদীছে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে দু'টি উপাধির সাথে উল্লেখ করা হয়েছে- ক. কালিমাতুল্লাহ এবং খ. রূহুল্লাহ।
কালিমাতুল্লাহ মানে আল্লাহর কালেমা। কালেমা অর্থ শব্দ, বাক্য, প্রমাণ ও কথা। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কালেমা এ অর্থে যে, তিনি বিনা পিতায় সরাসরি আল্লাহ তা'আলার 'কুন্' (হও) কালিমা (শব্দ) দ্বারা কুমারী মারয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। অথবা তিনি আল্লাহর কালেমা এ হিসেবে যে, তাঁর জন্ম ছিল বান্দার ওপর আল্লাহ তা'আলার নিজ কুদরতের প্রমাণস্বরূপ। কেউ কেউ বলেন, তিনি যেহেতু জন্মের পরপরই কথা বলেছিলেন, সে হিসেবে তাঁকে আল্লাহর কালেমা বলা হয়েছে। যেন বোঝানো হচ্ছে তাঁর সেই কালেমা বা কথা অন্যান্যদের কথার মত সাধারণ কথা ছিল না; বরং তা ছিল আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ। তাঁর কুদরতের প্রকাশ কেবল কথা হিসেবেই ছিল না; বরং সে কথা ছিল অত্যন্ত সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণও। তা ছিল যথারীতি একটি মনোজ্ঞ বক্তৃতা। সূরা মারয়ামের শুরুর দিকে তাঁর দেওয়া সে বক্তৃতাটি দেখা যেতে পারে।
খ. রূহুল্লাহ। এর অর্থ আল্লাহর রূহ। তাঁর এ উপাধিরও বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন- তিনি আল্লাহর সৃষ্ট এমন এক রূহের অধিকারী, যা কুমারী মারয়াম আলাইহাস-সালামের গর্ভে পিতার মধ্যস্থতা ছাড়া লাভ হয়েছে। অথবা তাঁকে রূহুল্লাহ বলা হয়েছে এ কারণে যে, তিনি আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় মৃতকে জীবিত করতে পারতেন এবং তিনি পাখির আকৃতি তৈরি করতেন, তারপর আল্লাহর ইচ্ছায় তা জীবিত হয়ে উড়ে যেত।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সুপারিশ করতে অপরাগতা প্রকাশ করবেন। বস্তুত আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষত্বের অধিকারী হওয়া এক কথা, আর তাঁর মহাপ্রতাপান্বিত দরবারে সুপারিশ করা আরেক কথা। সম্ভবত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অন্তরে একটা লজ্জাবোধও কাজ করবে, যেমনটা কোনও কোনও বর্ণনায় আছে যে, তাঁর উম্মত তাঁকে ও তাঁর মাকে মা'বূদ বানিয়ে তাঁদের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। এ কারণে কিয়ামতে আল্লাহ তা'আলার দরবারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদেরও সম্মুখীন হতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে হাশর ময়দানের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নিজে উদ্যোগী হয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ নিয়ে যাওয়া বলতে গেলে একটা অসম্ভব ব্যাপারই। এটা সম্ভব কেবল তাঁরই পক্ষে, যাঁকে আল্লাহ তা'আলা নিজে অনুমতি দান করবেন। ইরশাদ হয়েছেঃ-
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ
কে আছে, যে তাঁর সমীপে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করবে? (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৫৫)
আল্লাহর দরবারে শাফা'আত করার মহামর্যাদা শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যই সংরক্ষিত। তাই সবশেষে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর কাছেই যাওয়ার পরামর্শ দেবেন।
সুতরাং সবশেষে মু'মিনগণ তাঁর কাছে গিয়ে শাফা'আতের অনুরোধ জানাবে। তিনি উঠে আরশের নিচে চলে যাবেন। সেখানে সিজদা অবস্থায় আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করতে থাকবেন। তিনি তখন কী কী বলে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করবেন তা দুনিয়ায় থাকা অবস্থায় তাঁকে জানানো হয়নি। ওই সিজদাকালেই আল্লাহ তা'আলা তাঁর অন্তরে তা ঢেলে দেবেন। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। তুমি কী চাও বল। তোমার প্রার্থনা কবুল করা হবে এবং তোমার শাফা'আত গৃহীত হবে। তখন তিনি উঠে শাফা'আত করবেন। হাশরের ময়দানে তাঁর সে শাফা'আতই হবে সর্বপ্রথম শাফা'আত। একে 'শাফাআতে কুবরা' (মহাসুপারিশ) বলা হয়। তারপর একের পর এক বিভিন্নজন সুপারিশ করতে থাকবেন। এমনকি সুপারিশ করবে আত্মীয়তা এবং আমানতও, যা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
আখিরাতের মুক্তিতে আমানত ও আত্মীয়তার ভূমিকা আমানত ও আত্মীয়তা সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ-
وترسل الأمانة والرحم فيقومان جنبتي الصراط يمينا وشمالا
তারপর আমানত ও আত্মীয়তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারা উঠে পুলসিরাতের দু'পাশে ডানে ও বামে দাঁড়াবে। অর্থাৎ আত্মীয়তা ও আমানতকে বিশেষ আকৃতি দান করা হবে। তারপর তারা পুলসিরাতের দু'পাশে দাঁড়িয়ে যাবে। দুনিয়ায় যারা আত্মীয়তা রক্ষা করেছে ও আমানত আদায় করেছে তাদের পক্ষে তারা সুপারিশ করবে। ফলে তারা সহজেই পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। আর যারা এর বিপরীত কাজ করেছে তারা তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ জানাবে। ফলে তারা পুলসিরাত পার হতে পারবে না।
এর দ্বারা আত্মীয়তা ও আমানত রক্ষা করা শরী'আতের কত গুরুত্বপূর্ণ বিধান তা অনুমান করা যায়। কুরআন ও হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষার জোর তাগিদ করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদে ইরশাদঃ-
وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ
এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)-কে ভয় কর। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ- لا يدخل الجنة قاطع ‘আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৮৪: সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫৪; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩৫৩৭)
অপর এক হাদীছে ইরশাদঃ-
أنا الله وأنا الرحمن، خلقت الرحم وشققت لها اسمي، فمن وصلها وصلته، ومن قطعها قطعته
আমি আল্লাহ। আমি রহমান। আমি 'রহিম' (তথা আত্মীয়তা)-কে সৃষ্টি করেছি এবং আমার একটি নাম থেকে এ নামটি বের করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯৪; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬৮১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৬৫; সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৮৮, সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৪৩)
আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব এবং এটা শরী'আতের এক অবশ্যপালনীয় বিধান হওয়া সম্পর্কে আরও বহু হাদীছ আছে। আর আমানত রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কেও আলোচ্য অধ্যায়ের ছাড়াও বহু হাদীছ রয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই, বিশেষত যখন জানা গেল আখিরাতে মুক্তিলাভের ব্যাপারেও এ দু'টি আমলের বিশেষ ভূমিকা আছে।
পুলসিরাত
এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপিত থাকবে এবং সকলকেই তার ওপর দিয়ে যেতে হবে। কেউ নাজাত পাবে এবং কেউ আটকে যাবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তা (অর্থাৎ জাহান্নাম) অতিক্রম করবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের পক্ষে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। অতঃপর যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে আমি নিষ্কৃতি দেব আর জালিমদেরকে তাতে (জাহান্নামে) মুখ থুবড়ানো অবস্থায় ফেলে রাখব। (সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৭১-৭২)
পুলসিরাত কেমন হবে তাও বিভিন্ন হাদীছে বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন আলোচ্য হাদীছে আছে, পুলসিরাতের দু'পাশে বড় বড় আঁকড়া থাকবে। যখনই কেউ তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে চাবে, সে আঁকড়াগুলো তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করবে। কিন্তু যারা নেককার মু'মিন তাদেরকে ধরতে পারবে না। তাদের কেউ বিদ্যুৎ বেগে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার বেগে পার হয়ে যাবে। এভাবে নেককার মু'মিনগণ আপন আপন আমল অনুযায়ী একেকজন একেক গতিতে পুলসিরাতের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে। কেউ কেউ এমনও হবে যে, আঁকড়ার আঁচড় তার গায়ে লেগে যাবে, কিন্তু তাকে ধরতে পারবে না। ক্ষত-বিক্ষত হলেও নিজেকে তা থেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হবে। হাঁ, যারা কাফের ও কঠিন পাপী তারা আটকা পড়ে যাবে। তারা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে জাহান্নামে পতিত হবে।
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহ 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
ولجهنم جسر أدق من الشعر وأحد من السيف
জাহান্নামের ওপর যে সেতু আছে তা চুলের চেয়ে চিকন এবং তরবারির চেয়ে ধারালো। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৭৭: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৬১)
আল্লাহ তা'আলার শক্তি অসীম। তাঁর পক্ষে জাহান্নামের ওপর এমন সেতু স্থাপিত করা কঠিন কোনও ব্যাপার নয়, যা হবে চুলের চেয়ে চিকন ও তরবারির চেয়ে ধারালো। আবার তাঁর পক্ষে এটাও অসম্ভব নয় যে, তিনি সেই ধারালো সেতুর ওপর দিয়ে মু'মিনদেরকে অক্ষতরূপে পার করিয়ে নেবেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও সে ভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত রাখুন।
পুলসিরাতের ওপর দিয়ে সর্বপ্রথম পার হবেন আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহ 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তারপর অন্যান্য নবীগণ, তারপর এ উম্মত, তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নবীগণের উম্মত। পুলসিরাত পার হওয়ার সময় নবীগণ ছাড়া আর কেউ কোনও কথা বলবে না। নবীগণও কেবল আপন আপন উম্মতের মুক্তির জন্য বলতে থাকবেন হে আল্লাহ! তাদেরকে নিরাপদ রাখ, তাদেরকে নিরাপদ রাখ।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমরা বিশ্বাস করি জান্নাত ও জাহান্নাম আছে। আমাদের আরও বিশ্বাস জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত থাকার বিষয়টিও সত্য। আরও বিশ্বাস করি আখিরাতে সর্বপ্রথম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা'আত করবেন। এ হাদীছে এ চারওটি গুরুত্বপূর্ণ আকীদার উল্লেখ আছে।
খ. এ হাদীছ দ্বারা আমানত রক্ষার গুরুত্ব কত বেশি তা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমরা কোনও অবস্থায়ই কোনওরকম আমানতের খেয়ানত করব না।
গ. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্বও জানা যায়।
ঘ. যার আমল যত উন্নত হবে সে তত দ্রুতগতিতে পুলসিরাত পার হবে। অতএব আমাদের প্রত্যেককে আপন আপন আমল উন্নত করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
৫. এ হাদীছ দ্বারা আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কেও অবগতি লাভ হয়। সবার আগেই তিনিই শাফা'আত করার অনুমতি পাবেন, অন্য কোনও নবী নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর উম্মত বানিয়েছেন। এজন্য আমাদের কতই না শোকর আদায় করা দরকার।
জান্নাতকে নিকটবর্তী করে দেওয়ার অর্থ
এ হাদীছে বলা হয়েছে যে- تزلف لهم الجنة (জান্নাতকে তাদের নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে)। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছেঃ- وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ غَيْرَ بَعِيدٍ আর মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতকে নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে, কোনও দূরত্বই থাকবে না। (সূরা কাহফ (৫০), আয়াত ৩১)
হাশরের ময়দানে অবস্থানকালে জান্নাতকে মু'মিনদের নিকটবর্তী কিভাবে করা হবে, এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। এক ব্যাখ্যা হচ্ছে, এ নৈকট্য স্থানগত নয়; বরং কালগত। অর্থাৎ যে জান্নাত লাভের জন্য তারা দুনিয়ায় উদগ্রীব ছিল এবং সে লক্ষ্যে আল্লাহর আনুগত্য করে চলেছিল, সে জান্নাতে পৌঁছতে তাদের আর বেশি দেরি নেই। তারা কবরের জীবন পার হয়ে এসেছে, হাশরের ময়দানেও একটা কাল কেটেছে, বাস এখন কিছু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এর পরই তারা সেখানে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু অধিকাংশের মতে এ নৈকট্য স্থানগতই। তারও আবার বিভিন্ন উপায় হতে পারে। যেমন তাদের অবস্থানস্থল এবং জান্নাত এর মাঝখান থেকে সকল অন্তরায় সরিয়ে দেওয়া হবে। ফলে আপন আপন স্থান থেকেই তারা জান্নাত দেখতে পাবে। এই দেখতে পাওয়াকেই 'নিকটবর্তী করে দেওয়া' শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। অথবা আল্লাহ তা'আলা আপন কুদরতে মধ্যবর্তী দূরত্বকে সংকুচিত করে দেবেন। ফলে তারা জান্নাতকে কাছেই দেখতে পাবে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা'আলার পক্ষে এটাও সম্ভব যে, জান্নাতকেই তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে হাশর ময়দানের কাছে নিয়ে আসা হবে। যেভাবেই হোক না কেন আল্লাহ তা'আলা জান্নাতবাসীদেরকে জান্নাত দেখিয়ে দেবেন, তারপর তাদের লক্ষ্য করে বলবেনঃ-
هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِكُلِّ أَوَّابٍ حَفِيظٍ
এই (সেই জান্নাত), যার প্রতিশ্রুতি তোমাদেরকে দেওয়া হচ্ছিল প্রত্যেক আল্লাহ অভিমুখী, (গুনাহ থেকে) আত্মরক্ষাকারীর জন্য। (সূরা কাফ (৫০), আয়াত ৩২)
শাফা'আতের জন্য নবীদের কাছে ছোটাছুটি
স্বাভাবিকভাবেই জান্নাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও তার প্রাণকাড়া নি‘আমতরাশি দেখার পর তাতে প্রবেশের জন্য মু'মিনদের আর তর সইতে চাবে না। আল্লাহ তা'আলা যেন তাড়াতাড়ি তাদেরকে তাতে প্রবেশ করতে দেন সে লক্ষ্যে তারা সুপারিশের জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দেবে। সর্বপ্রথম যাবে হযরত আদম আলাইহিস সালামের কাছে এবং অনুরোধ করবে, আপনি আল্লাহ তা'আলার কাছে দরখাস্ত করুন যাতে আমাদের জান্নাতে প্রবেশের জন্য তার দরজা খুলে দেন। তিনি অপারগতা প্রকাশ করবেন এবং বলবেনঃ- وهل أخرجكم من الجنة إلا خطيئة أبيكم ؟ তোমাদের পিতার গুনাহই কি তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করেনি? অর্থাৎ আমাকে আমার গুনাহের কারণে জান্নাত থেকে বের করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আর এভাবে তোমাদেরও পৃথিবীতে আসতে হয়েছে। তাহলে তোমাদের পৃথিবীতে আসার কারণ হচ্ছে আমার গুনাহ। এ অবস্থায় তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য আমার সুপারিশ করার অধিকার থাকে কোথায়?
বলাবাহুল্য, এটা কেবলই আমাদের মহান আদি পিতার উচ্চতর বিনয়। কেননা তিনি কোনও গুনাহ ও পাপ করেননি। আর ভুল যা-ও হয়েছিল তা-ও তো আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করেই দিয়েছেন। তারপর একজন মহান নবী হওয়ায় পৃথিবীতে নিষ্পাপ। জীবন কাটানোর পাশাপাশি যা-কিছু ইবাদত-বন্দেগী করেছেন তাতে আল্লাহ তাআলার রহমতে তাঁর জান্নাতবাসী হওয়াই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সে ভুলের কারণে নিজ সন্তানদের জন্য কেন সুপারিশ করতে পারবেন না? প্রকৃতপক্ষে হাশরের ময়দান হবে এমনই বিভীষিকাময় যে, সেদিন সমস্ত নবী-রাসূল পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবেন। ফলে আল্লাহ তা আলার সামনে শাফা'আত নিয়ে যাওয়ার সাহস এমনিতেই কারও হবে না। তদুপরি হযরত আদম আলাইহিস সালাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, যে কারণে ভুল হয়ে যাওয়ার পর কোনও ওযর অজুহাত না দেখিয়ে সরাসরি আপন ভুল স্বীকার করে নিয়েছিলেন। হাশরের ময়দানেও যে সে কথার পুনরাবৃত্তি করবেন এবং নিজেকে সুপারিশ করার অযোগ্য সাব্যস্ত করবেন, তার একটা কারণ তাঁর ওই স্বভাবগত বিনয়ও।
হযরত আদম আলাইহিস সালাম কি পাপ করেছিলেন?
খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস হযরত আদম আলাইহিস সালাম পাপ করেছিলেন। তাদের এ বিশ্বাস মনগড়া । আসমানী শিক্ষা এ কথা বলে না। আমরা কুরআন-হাদীছ দ্বারা জানতে পারি সমস্ত নবী নিষ্পাপ ছিলেন। আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামও একজন মহান নবী। তিনিও সম্পূর্ণ মা‘সূম ও নিষ্পাপ। এটাই মুসলিম উম্মাহ'র সংখ্যাগরিষ্ঠের আকীদা। কিছু কিছু লোক আছে, যারা কোনও কোনও আয়াতকে অন্যান্য আয়াত ও হাদীছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করে থাকে এবং তার বাহ্যিক অর্থ ধরে নিয়ে এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে থাকে। তাদের সে মত নিঃসন্দেহে ভুল। যে আয়াতের ভিত্তিতে তারা ভিন্নমত পোষণ করে তা হচ্ছেঃ-
وَعَصَى آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَى
আর (এভাবে) আদম নিজ প্রতিপালকের হুকুম অমান্য করল ও বিভ্রান্ত হল। (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ১২১)
প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত দ্বারা ভিন্নমত পোষণের কোনও সুযোগ নেই। কেননা হযরত আদম আলাইহিস সালামের নিষিদ্ধ ফল খাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার তিরস্কারমূলক উক্তি এই একটিই নয়; আয়াত এ ছাড়া আরও আছে। সবগুলো সামনে রাখলে তাঁর সে ফল খাওয়াকে পাপ মনে করার কোনও সুযোগ থাকে না।
হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর জান্নাতে স্থান দেওয়া, তারপর ফল খেতে নিষেধ করা, তারপর তাঁর দ্বারা ফল খাওয়ার ঘটনা ঘটা, তারপর তাঁর তাওবা করা, তারপর তাঁর পৃথিবীতে আসা—এ যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহে যে তথ্য ও তত্ত্বমূলক বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তাতে গভীরভাবে লক্ষ করলে যে ধারণা লাভ হয় তার সারমর্ম এরকম—
আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে পৃথিবীতে নিজ খলিফা বানিয়ে পাঠানোর জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু সৃষ্টি করার পর তাঁকে প্রথমেই পৃথিবীতে না পাঠিয়ে তার আগে জান্নাতে থাকতে দিলেন। তারপর ফল খাওয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো ঘটল। এর উদ্দেশ্য দৃশ্যত এই যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম যাতে জান্নাতের নি‘আমতসমূহ চোখে দেখে নিজের আসল ঠিকানা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিতে পারেন এবং পৃথিবীতে পৌঁছার পর এ ঠিকানা অর্জনে কী রকমের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে এবং কোন্ পন্থায় তা থেকে মুক্তি লাভ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেন। যেহেতু ফিরিশতাগণের বিপরীতে মানুষের স্বভাবের ভেতরই ভালো ও মন্দ উভয়ের যোগ্যতা রাখা হয়েছে, তাই এ বৈশিষ্ট্যের কারণে পৃথিবীতে আসার আগেই এ রকমের একটা অভিজ্ঞতা লাভ করা তাঁর জন্য জরুরি ছিল।
নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার দ্বারা তাঁর সে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বিশেষ এক গাছের দিকে ইঙ্গিত করে তার ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় তিনি সে ফল খেয়ে ফেলেন। শয়তান তাঁকে আল্লাহর নামে কসম করে বলেছিলঃ-
يَاآدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَى شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَى
হে আদম! তোমাকে কি এমন একটা গাছের সন্ধান দেব, যা দ্বারা অনন্ত জীবন ও এমন রাজত্ব লাভ হয়, যা কখনও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না? (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ১২০)
ইবলীস বোঝাতে চাচ্ছিল যে, এ গাছের একটা বৈশিষ্ট্য হল, কেউ এর ফল খেলে সে ফিরিশতা হয়ে যায় অথবা তাকে স্থায়ী জীবন দান করা হয়। তাই এ ফল খাওয়ার জন্য বিশেষ শক্তি দরকার হয়। প্রথম দিকে আপনাদের সে শক্তি ছিল না, তাই নিষেধ করা হয়েছিল। যেহেতু জান্নাতের পরিবেশে আপনারা বেশ কিছুদিন যাবৎ থাকছেন, তাই ইতোমধ্যে আপনাদের সে শক্তি অর্জন হয়ে গেছে। সুতরাং এখন এ ফল খেলে কোনও অসুবিধা নেই। সে আল্লাহর নামে কসম করে এ কথা বলল।
ইব্ন আব্বাস রাযি. বলেন, হযরত আদম আলাইহিস সালামের ধারণা ছিল, আল্লাহর নামে কেউ মিথ্যা কসম করতে পারে না। তাই মিথ্যা কসমকে অবলম্বন করে সে তাঁদের সাথে প্রতারণা করতে পেরেছিল। এভাবে হযরত আদম আলাইহিস সালাম সে নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলেন। এ খাওয়াটা ছিল তাঁর ইজতিহাদী ভুল অর্থাৎ চিন্তাগত ভুল। তিনি শয়তানের কুমন্ত্রণার ফলে আল্লাহ তাআলার নির্দেশকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর সীমাবদ্ধ মনে করেছিলেন। অন্যথায় তাঁর পক্ষ হতে সরাসরি আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হওয়ার কল্পনাও করা যায় না। তথাপি একজন নবীর পক্ষে এ জাতীয় ভুলও যেহেতু শোভনীয় ছিল না, তাই উল্লিখিত আয়াতে এটাকে গুনাহ বা সীমালঙ্ঘন শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা গুনাহ বা পাপ ছিল না। এটা যে পাপ ছিল না। সেদিকে কুরআন মাজীদের এক আয়াতে ইঙ্গিতও করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ- فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا কিন্তু সে তা ভুলে গেল এবং আমি তার মধ্যে পাইনি প্রতিজ্ঞা। (সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ১১৫) অর্থাৎ ফল খেয়ে ফেলার এ কাজটি তাঁর দ্বারা ঘটেছিল ভুলবশত। এতে তাঁর প্রতিজ্ঞার কোনও ভূমিকা ছিল না। অর্থাৎ তিনি তা খাওয়ার সংকল্প করেছিলেন বা নাফরমানী করার ইচ্ছায় হুকুম অমান্য করেছিলেন এমন নয়; বরং অসতর্কতাবশত তাঁর ভুল হয়ে গিয়েছিল। তারপরও তাঁর উচ্চমর্যাদা হিসেবে এ ভুলও যেহেতু তাঁর পক্ষে শোভনীয় ছিল না, তাই আল্লাহ তা'আলা এজন্য তাঁকে তিরস্কার করেন । তিনিও যেহেতু নিজের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাই এ ভুলকে তুচ্ছ মনে না করে অত্যন্ত গুরুত্বের দৃষ্টিতেই দেখেন। ফলে নিতান্তই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না, আল্লাহ তাআলার কাছে কী শব্দে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। তাই তাঁর মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছিল না।
আল্লাহ তাআলা তো অন্তর্যামী এবং তিনি পরম দয়ালু ও দাতাও বটে। তিনি হযরত আদম আলাইহিস সালামের মনের এ অবস্থার কারণে নিজেই তাঁকে তাওবার ভাষা শিখিয়ে দিলেন, যা সূরা আরাফে বর্ণিত আছে এবং তা এরূপঃ-
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের সত্তার প্রতি জুলুম করে ফেলেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন,তবে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।
এভাবে পৃথিবীতে পাঠানোর আগেই মানুষকে আল্লাহ তাআলা শিখিয়ে দিলেন যে, সে যদি কখনও শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে কিংবা ইন্দ্রিয় পরবশতার কারণে কোনও গুনাহ করে ফেলে, তবে তার কর্তব্য তৎক্ষণাৎ তাওবা করে ফেলা।
আশা করি এতক্ষণে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে এবং উল্লিখিত আয়াতে যে হযরত আদম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে 'হুকুম অমান্য করা' ও 'বিভ্রান্ত হওয়া' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা দ্বারা তিনি পাপ করেছেন বলে বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং এতটা উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এ ভুল তিনি কেন করলেন সে জন্য কেবল তিরস্কার করাই উদ্দেশ্য—তাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কাজেই আয়াতটি দ্বারা এ দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করার কোনও সুযোগ থাকল না যে, আমাদের মহান আদিপিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম কোনও পাপকর্ম করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রতি এবং সকল নবী-রাসূলের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন।
শাফা'আত করতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের অপারগতা প্রকাশের ব্যাখ্যা
মু'মিনগণ যখন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে শাফা'আত করার অনুরোধ জানাবে, তখন তিনি এই বলে অপারগতা প্রকাশ করবেন যে إنما كنت خليلا من وراء وراء 'আমি তো আল্লাহর খলীল ছিলাম অনেক পেছন থেকে।' অর্থাৎ যদিও আমি আল্লাহ তা'আলার খলীল ও বন্ধু, তথাপি আমি আল্লাহ তা'আলার অতটা নিকটবর্তী নই, যতটা নৈকট্য অন্য কারও কারও অর্জিত হয়েছিল। যেমন, আল্লাহ তা'আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন, কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর সেরকম কথোপকথন হয়নি। আর আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মি'রাজের মহামর্যাদাও দান করেছিলেন, যে মর্যাদা আমাকে দেওয়া হয়নি।
এমনও হতে পারে যে, অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং বোঝানো উদ্দেশ্য ছিল যে, একজন বান্দা যত উচ্চমর্যাদার অধিকারীই হোক না কেন এবং আল্লাহ তা'আলা আপন রহমত ও করুণায় তাঁকে নিজ খলীল ও বন্ধু বলে যতটা গৌরবান্বিতই করুন না কেন, আল্লাহ তা'আলার জালাল ও কিবরিয়া এবং তাঁর মহাগৌরব ও মর্যাদার অসীম উচ্চতা হিসেবে তা এমন কোনও ধর্তব্যবস্তু নয়, যার ভিত্তিতে সুপারিশ করার সাহস দেখানো যেতে পারে। অতএব তিনি সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন এ কারণে যে, তাঁর সঙ্গে যেহেতু আল্লাহ তা'আলা সরাসরি কথা বলেছেন, সেই সুবাদে হয়তো তাঁর কিছুটা ভরসা হবে। কিন্তু সাহস হবে না তাঁরও। তিনি পরামর্শ দেবেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে যাওয়ার।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কালেমা ও তাঁর রূহ হওয়ার অর্থ
এ হাদীছে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে দু'টি উপাধির সাথে উল্লেখ করা হয়েছে- ক. কালিমাতুল্লাহ এবং খ. রূহুল্লাহ।
কালিমাতুল্লাহ মানে আল্লাহর কালেমা। কালেমা অর্থ শব্দ, বাক্য, প্রমাণ ও কথা। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কালেমা এ অর্থে যে, তিনি বিনা পিতায় সরাসরি আল্লাহ তা'আলার 'কুন্' (হও) কালিমা (শব্দ) দ্বারা কুমারী মারয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। অথবা তিনি আল্লাহর কালেমা এ হিসেবে যে, তাঁর জন্ম ছিল বান্দার ওপর আল্লাহ তা'আলার নিজ কুদরতের প্রমাণস্বরূপ। কেউ কেউ বলেন, তিনি যেহেতু জন্মের পরপরই কথা বলেছিলেন, সে হিসেবে তাঁকে আল্লাহর কালেমা বলা হয়েছে। যেন বোঝানো হচ্ছে তাঁর সেই কালেমা বা কথা অন্যান্যদের কথার মত সাধারণ কথা ছিল না; বরং তা ছিল আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ। তাঁর কুদরতের প্রকাশ কেবল কথা হিসেবেই ছিল না; বরং সে কথা ছিল অত্যন্ত সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণও। তা ছিল যথারীতি একটি মনোজ্ঞ বক্তৃতা। সূরা মারয়ামের শুরুর দিকে তাঁর দেওয়া সে বক্তৃতাটি দেখা যেতে পারে।
খ. রূহুল্লাহ। এর অর্থ আল্লাহর রূহ। তাঁর এ উপাধিরও বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যেমন- তিনি আল্লাহর সৃষ্ট এমন এক রূহের অধিকারী, যা কুমারী মারয়াম আলাইহাস-সালামের গর্ভে পিতার মধ্যস্থতা ছাড়া লাভ হয়েছে। অথবা তাঁকে রূহুল্লাহ বলা হয়েছে এ কারণে যে, তিনি আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় মৃতকে জীবিত করতে পারতেন এবং তিনি পাখির আকৃতি তৈরি করতেন, তারপর আল্লাহর ইচ্ছায় তা জীবিত হয়ে উড়ে যেত।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সুপারিশ করতে অপরাগতা প্রকাশ করবেন। বস্তুত আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষত্বের অধিকারী হওয়া এক কথা, আর তাঁর মহাপ্রতাপান্বিত দরবারে সুপারিশ করা আরেক কথা। সম্ভবত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের অন্তরে একটা লজ্জাবোধও কাজ করবে, যেমনটা কোনও কোনও বর্ণনায় আছে যে, তাঁর উম্মত তাঁকে ও তাঁর মাকে মা'বূদ বানিয়ে তাঁদের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। এ কারণে কিয়ামতে আল্লাহ তা'আলার দরবারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদেরও সম্মুখীন হতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে হাশর ময়দানের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নিজে উদ্যোগী হয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ নিয়ে যাওয়া বলতে গেলে একটা অসম্ভব ব্যাপারই। এটা সম্ভব কেবল তাঁরই পক্ষে, যাঁকে আল্লাহ তা'আলা নিজে অনুমতি দান করবেন। ইরশাদ হয়েছেঃ-
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ
কে আছে, যে তাঁর সমীপে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করবে? (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৫৫)
আল্লাহর দরবারে শাফা'আত করার মহামর্যাদা শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যই সংরক্ষিত। তাই সবশেষে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর কাছেই যাওয়ার পরামর্শ দেবেন।
সুতরাং সবশেষে মু'মিনগণ তাঁর কাছে গিয়ে শাফা'আতের অনুরোধ জানাবে। তিনি উঠে আরশের নিচে চলে যাবেন। সেখানে সিজদা অবস্থায় আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করতে থাকবেন। তিনি তখন কী কী বলে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করবেন তা দুনিয়ায় থাকা অবস্থায় তাঁকে জানানো হয়নি। ওই সিজদাকালেই আল্লাহ তা'আলা তাঁর অন্তরে তা ঢেলে দেবেন। পরিশেষে আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। তুমি কী চাও বল। তোমার প্রার্থনা কবুল করা হবে এবং তোমার শাফা'আত গৃহীত হবে। তখন তিনি উঠে শাফা'আত করবেন। হাশরের ময়দানে তাঁর সে শাফা'আতই হবে সর্বপ্রথম শাফা'আত। একে 'শাফাআতে কুবরা' (মহাসুপারিশ) বলা হয়। তারপর একের পর এক বিভিন্নজন সুপারিশ করতে থাকবেন। এমনকি সুপারিশ করবে আত্মীয়তা এবং আমানতও, যা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
আখিরাতের মুক্তিতে আমানত ও আত্মীয়তার ভূমিকা আমানত ও আত্মীয়তা সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ-
وترسل الأمانة والرحم فيقومان جنبتي الصراط يمينا وشمالا
তারপর আমানত ও আত্মীয়তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারা উঠে পুলসিরাতের দু'পাশে ডানে ও বামে দাঁড়াবে। অর্থাৎ আত্মীয়তা ও আমানতকে বিশেষ আকৃতি দান করা হবে। তারপর তারা পুলসিরাতের দু'পাশে দাঁড়িয়ে যাবে। দুনিয়ায় যারা আত্মীয়তা রক্ষা করেছে ও আমানত আদায় করেছে তাদের পক্ষে তারা সুপারিশ করবে। ফলে তারা সহজেই পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। আর যারা এর বিপরীত কাজ করেছে তারা তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ জানাবে। ফলে তারা পুলসিরাত পার হতে পারবে না।
এর দ্বারা আত্মীয়তা ও আমানত রক্ষা করা শরী'আতের কত গুরুত্বপূর্ণ বিধান তা অনুমান করা যায়। কুরআন ও হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষার জোর তাগিদ করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদে ইরশাদঃ-
وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ
এবং আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক। এবং আত্মীয়দের (অধিকার খর্ব করা)-কে ভয় কর। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ- لا يدخل الجنة قاطع ‘আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৮৪: সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৫৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫৪; তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩৫৩৭)
অপর এক হাদীছে ইরশাদঃ-
أنا الله وأنا الرحمن، خلقت الرحم وشققت لها اسمي، فمن وصلها وصلته، ومن قطعها قطعته
আমি আল্লাহ। আমি রহমান। আমি 'রহিম' (তথা আত্মীয়তা)-কে সৃষ্টি করেছি এবং আমার একটি নাম থেকে এ নামটি বের করেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষা করবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তা ছিন্ন করবে, আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯৪; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬৮১; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৬৫; সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৮৮, সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৪৩)
আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্ব এবং এটা শরী'আতের এক অবশ্যপালনীয় বিধান হওয়া সম্পর্কে আরও বহু হাদীছ আছে। আর আমানত রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কেও আলোচ্য অধ্যায়ের ছাড়াও বহু হাদীছ রয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই, বিশেষত যখন জানা গেল আখিরাতে মুক্তিলাভের ব্যাপারেও এ দু'টি আমলের বিশেষ ভূমিকা আছে।
পুলসিরাত
এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপিত থাকবে এবং সকলকেই তার ওপর দিয়ে যেতে হবে। কেউ নাজাত পাবে এবং কেউ আটকে যাবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
وَإِنْ مِنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِينَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তা (অর্থাৎ জাহান্নাম) অতিক্রম করবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের পক্ষে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। অতঃপর যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে আমি নিষ্কৃতি দেব আর জালিমদেরকে তাতে (জাহান্নামে) মুখ থুবড়ানো অবস্থায় ফেলে রাখব। (সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৭১-৭২)
পুলসিরাত কেমন হবে তাও বিভিন্ন হাদীছে বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন আলোচ্য হাদীছে আছে, পুলসিরাতের দু'পাশে বড় বড় আঁকড়া থাকবে। যখনই কেউ তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে চাবে, সে আঁকড়াগুলো তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করবে। কিন্তু যারা নেককার মু'মিন তাদেরকে ধরতে পারবে না। তাদের কেউ বিদ্যুৎ বেগে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার বেগে পার হয়ে যাবে। এভাবে নেককার মু'মিনগণ আপন আপন আমল অনুযায়ী একেকজন একেক গতিতে পুলসিরাতের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে। কেউ কেউ এমনও হবে যে, আঁকড়ার আঁচড় তার গায়ে লেগে যাবে, কিন্তু তাকে ধরতে পারবে না। ক্ষত-বিক্ষত হলেও নিজেকে তা থেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হবে। হাঁ, যারা কাফের ও কঠিন পাপী তারা আটকা পড়ে যাবে। তারা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে জাহান্নামে পতিত হবে।
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহ 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
ولجهنم جسر أدق من الشعر وأحد من السيف
জাহান্নামের ওপর যে সেতু আছে তা চুলের চেয়ে চিকন এবং তরবারির চেয়ে ধারালো। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭৩৭৭: বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩৬১)
আল্লাহ তা'আলার শক্তি অসীম। তাঁর পক্ষে জাহান্নামের ওপর এমন সেতু স্থাপিত করা কঠিন কোনও ব্যাপার নয়, যা হবে চুলের চেয়ে চিকন ও তরবারির চেয়ে ধারালো। আবার তাঁর পক্ষে এটাও অসম্ভব নয় যে, তিনি সেই ধারালো সেতুর ওপর দিয়ে মু'মিনদেরকে অক্ষতরূপে পার করিয়ে নেবেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও সে ভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত রাখুন।
পুলসিরাতের ওপর দিয়ে সর্বপ্রথম পার হবেন আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহ 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তারপর অন্যান্য নবীগণ, তারপর এ উম্মত, তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নবীগণের উম্মত। পুলসিরাত পার হওয়ার সময় নবীগণ ছাড়া আর কেউ কোনও কথা বলবে না। নবীগণও কেবল আপন আপন উম্মতের মুক্তির জন্য বলতে থাকবেন হে আল্লাহ! তাদেরকে নিরাপদ রাখ, তাদেরকে নিরাপদ রাখ।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমরা বিশ্বাস করি জান্নাত ও জাহান্নাম আছে। আমাদের আরও বিশ্বাস জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত থাকার বিষয়টিও সত্য। আরও বিশ্বাস করি আখিরাতে সর্বপ্রথম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাফা'আত করবেন। এ হাদীছে এ চারওটি গুরুত্বপূর্ণ আকীদার উল্লেখ আছে।
খ. এ হাদীছ দ্বারা আমানত রক্ষার গুরুত্ব কত বেশি তা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমরা কোনও অবস্থায়ই কোনওরকম আমানতের খেয়ানত করব না।
গ. এ হাদীছ দ্বারা আত্মীয়তা রক্ষার গুরুত্বও জানা যায়।
ঘ. যার আমল যত উন্নত হবে সে তত দ্রুতগতিতে পুলসিরাত পার হবে। অতএব আমাদের প্রত্যেককে আপন আপন আমল উন্নত করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
৫. এ হাদীছ দ্বারা আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কেও অবগতি লাভ হয়। সবার আগেই তিনিই শাফা'আত করার অনুমতি পাবেন, অন্য কোনও নবী নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাঁর উম্মত বানিয়েছেন। এজন্য আমাদের কতই না শোকর আদায় করা দরকার।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
