আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

১- ঈমানের অধ্যায়

হাদীস নং: ২২১
আন্তর্জাতিক নং: ১২১
৫৪. ইসলাম গ্রহণ, হিজরত ও হজ্জ দ্বারা পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যাবে
২২১। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না আল আনাযী, আবু মাআন আল রাকাশী ও ইসহাক ইবনে মনসুর (রাহঃ) ......... ইবনে শামাসা আল মোহরী (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমরা আমর ইবনে আস (রাযিঃ)-এর মুমুর্ষ অবস্থায় তাকে দেখতে উপস্থিত হলাম। তখন তিনি দেওয়ালের দিকে মুখ করে অনেকক্ষণ কাঁদছিলেন। তার পুত্র তাঁকে তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রদত্ত বিভিন্ন সুসংবাদের উল্লেখ পূর্বক প্রবোধ দিচ্ছে যে, আব্বা! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ দেননি? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ দেননি? রাবী বলেন, তখন তিনি পুত্রের দিকে মুখ ফিরালেন এবং বললেন, আমার সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয় হচ্ছে ″লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ″ এ কালিমার সাক্ষ্য দেয়া। আর আমি অতিক্রম করেছি আমার জীবনের তিনটি পর্যায়।

এক সময় তো আমি এমন ছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর বিরুদ্ধাচরণে আমার চেয়ে কঠোরতর আর কেউই ছিল না। আমি যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে কবজায় পেতাম আর হত্যা করতে পারতাম, এ ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ভাবনা। যদি সে অবস্থায় আমার মৃত্যু হতো, তবে নিশ্চিত আমাকে জাহান্নামে যেতে হতো।

এরপর আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি বায়আত করতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন, তখন আমি আমার হাত টেনে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আমর, কি ব্যাপার? বললাম, পূর্বে আমি শর্ত করে নিতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি শর্ত করবে? আমি উত্তর করলাম, আল্লাহ যেন আমার সব গুনাহ মাফ করে দেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ আমর! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম পূর্ববর্তী সকল অন্যায় মিটিয়ে দেয়। হিজরত পূর্বেকৃত গুনাহসমুহ মিটিয়ে দেয় এবং হজ্জও পূর্বের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়। আমর বলেন, এ পর্যায়ে আমার অন্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অপেক্ষা বেশী প্রিয় আর কেউ ছিল না। আমার চোখে তিনি অপেক্ষা মহান আর কেউ ছিল না। অপরির্সীম শ্রদ্ধার কারণে আমি তার প্রতি চোখ ভরে তাকাতেও পারতাম না। আজ যদি আমাকে তাঁর দেহ আকৃতির বর্ণনা করতে বলা হয়, তবে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। কারণ চোখভরে আমি কখনোই তাঁর প্রতি তাকাতে পারি নি। ঐ অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হতো তবে অবশ্যই আমি জান্নাতী হওয়ার আশাবাদী থাকতাম।

পরবর্তীকালে আমরা নানা বিষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছি, তাই জানিনা, এতে আমার অবস্থান কোথায়? সুতরাং আমি যখন মারা যাব, তখন যেন কোন বিলাপকারিণী অথবা আগুন যেন আমার জানাযার সাথে না থাকে। আমাকে যখন দাফন করবে তখন আমার উপর আস্তে আস্তে মাটি ফেলবে এবং দাফন সেরে একটি উট যবাই করে তার গোশত বল্টন করতে যে সময় লাগে, ততক্ষণ আমার কবরের পাশে অবস্থান করবে। যেন তোমাদের উপস্থিতির কারণে আমি আতঙ্কমুক্ত অবস্থায় চিন্তা করতে পারি যে, আমার প্রতিপালকের দূতের কি জবাব দেব।
باب كَوْنِ الإِسْلاَمِ يَهْدِمُ مَا قَبْلَهُ وَكَذَا الْهِجْرَةُ وَالْحَجُّ
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى الْعَنَزِيُّ، وَأَبُو مَعْنٍ الرَّقَاشِيُّ وَإِسْحَاقُ بْنُ مَنْصُورٍ كُلُّهُمْ عَنْ أَبِي عَاصِمٍ، - وَاللَّفْظُ لاِبْنِ الْمُثَنَّى - حَدَّثَنَا الضَّحَّاكُ، - يَعْنِي أَبَا عَاصِمٍ - قَالَ أَخْبَرَنَا حَيْوَةُ بْنُ شُرَيْحٍ، قَالَ حَدَّثَنِي يَزِيدُ بْنُ أَبِي حَبِيبٍ، عَنِ ابْنِ شَمَاسَةَ الْمَهْرِيِّ، قَالَ حَضَرْنَا عَمْرَو بْنَ الْعَاصِ وَهُوَ فِي سِيَاقَةِ الْمَوْتِ . فَبَكَى طَوِيلاً وَحَوَّلَ وَجْهَهُ إِلَى الْجِدَارِ فَجَعَلَ ابْنُهُ يَقُولُ يَا أَبَتَاهُ أَمَا بَشَّرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِكَذَا أَمَا بَشَّرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِكَذَا قَالَ فَأَقْبَلَ بِوَجْهِهِ . فَقَالَ إِنَّ أَفْضَلَ مَا نُعِدُّ شَهَادَةُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ إِنِّي قَدْ كُنْتُ عَلَى أَطْبَاقٍ ثَلاَثٍ لَقَدْ رَأَيْتُنِي وَمَا أَحَدٌ أَشَدَّ بُغْضًا لِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنِّي وَلاَ أَحَبَّ إِلَىَّ أَنْ أَكُونَ قَدِ اسْتَمْكَنْتُ مِنْهُ فَقَتَلْتُهُ فَلَوْ مُتُّ عَلَى تِلْكَ الْحَالِ لَكُنْتُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَلَمَّا جَعَلَ اللَّهُ الإِسْلاَمَ فِي قَلْبِي أَتَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقُلْتُ ابْسُطْ يَمِينَكَ فَلأُبَايِعْكَ . فَبَسَطَ يَمِينَهُ - قَالَ - فَقَبَضْتُ يَدِي . قَالَ " مَا لَكَ يَا عَمْرُو " . قَالَ قُلْتُ أَرَدْتُ أَنْ أَشْتَرِطَ . قَالَ " تَشْتَرِطُ بِمَاذَا " . قُلْتُ أَنْ يُغْفَرَ لِي . قَالَ " أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ " . وَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبَّ إِلَىَّ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ أَجَلَّ فِي عَيْنِي مِنْهُ وَمَا كُنْتُ أُطِيقُ أَنْ أَمْلأَ عَيْنَىَّ مِنْهُ إِجْلاَلاً لَهُ وَلَوْ سُئِلْتُ أَنْ أَصِفَهُ مَا أَطَقْتُ لأَنِّي لَمْ أَكُنْ أَمْلأُ عَيْنَىَّ مِنْهُ وَلَوْ مُتُّ عَلَى تِلْكَ الْحَالِ لَرَجَوْتُ أَنْ أَكُونَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ثُمَّ وَلِينَا أَشْيَاءَ مَا أَدْرِي مَا حَالِي فِيهَا فَإِذَا أَنَا مُتُّ فَلاَ تَصْحَبْنِي نَائِحَةٌ وَلاَ نَارٌ فَإِذَا دَفَنْتُمُونِي فَشُنُّوا عَلَىَّ التُّرَابَ شَنًّا ثُمَّ أَقِيمُوا حَوْلَ قَبْرِي قَدْرَ مَا تُنْحَرُ جَزُورٌ وَيُقْسَمُ لَحْمُهَا حَتَّى أَسْتَأْنِسَ بِكُمْ وَأَنْظُرَ مَاذَا أُرَاجِعُ بِهِ رُسُلَ رَبِّي .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আমর ইবনুল 'আস রাযি. একজন বিখ্যাত সাহাবী। তিনি প্রখর বুদ্ধিমান ও অসম বীরপুরুষ ছিলেন। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ওফাতের পর বহু রণক্ষেত্রে নেতৃত্বদান করেছেন। মিশর বিজয়ে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি। দীনের বহুবিধ খেদমত সত্ত্বেও মৃত্যুকালে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি দীর্ঘক্ষণ কাঁদছিলেন। তখন তাঁর মহান পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. তাঁকে বিভিন্ন কথা বলে সান্ত্বনাদান করছিলেন।

ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার শাস্তির ভয়ে ভীত থাকার পাশাপাশি তাঁর রহমতের জন্য আশাবাদীও থাকা। ভয় ও আশার মাঝখানেই ঈমান। তবে মৃত্যুকালে ভয়ের তুলনায় আশাটাই বেশি রাখা উচিত। তাই মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে যারা উপস্থিত থাকে, তাদের কর্তব্য তাকে শুনিয়ে এমন এমন কথা বলা, যাতে সে আশান্বিত হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা'আলার বিপুল ক্ষমাশীলতা ও তাঁর অসীম রহমতের কথা তুলে ধরা। এ সম্পর্কিত আয়াত ও হাদীছ তার সামনে বর্ণনা করা। সেইসঙ্গে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, আপনি তো এই এই ভালো কাজ করেছেন, আশা করা যায় এসব আমলের অসিলায় আল্লাহ তা'আলা আপনাকে মুক্তিদান করবেন ইত্যাদি।

হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. এ কাজই করেছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখন কী সুসংবাদ দিয়েছিলেন তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এর উত্তরে হযরত আমর ইবনুল 'আস রাযি. নিজ জীবনের তিনটি ধাপের কথা তুলে ধরেন। একটা হল তাঁর ঈমান আনার আগের জীবন। দ্বিতীয় হল ঈমান-পরবর্তী জীবন, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবিত অবস্থায় পার করেছেন। আর তৃতীয় ধাপ হল তাঁর জীবনের ওই সময়কাল, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে কাটিয়েছেন।

ঈমান আনার আগে তিনি ছিলেন ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোর শত্রু। কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যেসকল সাহাবী হাবশা হিজরত করেছিলেন, তাদেরকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য যে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল, তিনি সে দলের নেতৃত্বদান করেছিলেন। এ হাদীছে তিনি নিজেই বলছেন যে, ওই সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আমার কাছে সবচে' ঘৃণিত ব্যক্তি এবং ওই সময়ে যদি সুযোগ পেতাম, তবে অবশ্যই তাঁকে হত্যা করতাম এবং তাঁকে হত্যা করাটা হতো আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় কাজ। তিনি বলছেন, 'এই সময় মারা গেলে আমি অবশ্যই জাহান্নামী হতাম'। কেননা জাহান্নামই বেঈমান ব্যক্তির ঠিকানা। ঈমান ছাড়া কেউ জাহান্নাম থেকে নাজাত পেতে পারে না।

তারপর মক্কাবিজয়ের আগে হিজরী ৮ম সনের সফর মাসে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এটা তাঁর জীবনের দ্বিতীয় ধাপ। ঈমান আনার সঙ্গে সঙ্গেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন। এর আগে তো তাঁকে হত্যা করতে পারাটা ছিল তাঁর কাছে সর্বাপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত কাজ। এখন এমন হয়ে গেলেন যে, তাঁর জন্য নিজ জীবন দিতে পারাটাই হয়ে গেল তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রত্যাশিত বিষয়। ভালোবাসার পাশাপাশি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ। যে কারণে সরাসরি চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাতেও পারতেন না। তাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এ অবস্থায় মারা গেলে আমি হয়তো জান্নাতবাসী হতাম।

হাদীছটিতে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে তাঁর বায়'আত গ্রহণের বিবরণ। তিনি বায়'আতের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর পবিত্র হাত তাঁর দিকে বিস্তার করে দিয়েছেন। অথচ তিনি সেই পবিত্র হাত না ধরে নিজ হাত টেনে নেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো অবাক! বায়'আতের জন্য হাত বাড়িয়ে সে হাত আবার ফিরিয়ে নিচ্ছে কেন! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হল আমর?
হযরত আমর ইবনুল 'আস রাযি.-এর অন্তরে তো অতীত গুনাহের ভয়। এতদিন ইসলাম ও মুসলমানদের মূলোৎপাটনের জন্য কত তৎপরতাই না তিনি চালিয়েছেন। সবচে' বড় কথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তিনি কী ভয়ানক ঘৃণা পোষণ করতেন। তাঁকে হত্যা পর্যন্ত করতে আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কী কঠিন কঠিন পাপ এ যাবৎকাল হয়ে গেছে। এসব কি ক্ষমা করা হবে? ক্ষমাই যদি লাভ না হয়, তবে এ বায়'আত এ ইসলামগ্রহণ কী কাজে আসবে? তাঁর অন্তরে গভীর অনুতাপ। অতীত গুনাহের জন্য তিনি ভীষণ লজ্জিত। তা থেকে পরিত্রাণ তো চাই। তাই তিনি শর্ত জুড়ে দিলেন- আমার পাপরাশি যদি ক্ষমা করা হয়, তবেই আমি বায়'আত গ্রহণ করব। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে আশ্বাসবাণী শোনালেন-
أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الْإِسْلَامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ (তুমি কি জন না ইসলাম তার পূর্ববর্তী সবকিছু মিটিয়ে দেয়)? অর্থাৎ ইসলামগ্রহণ দ্বারা সগীরা গুনাহ, কবীরা গুনাহ, আল্লাহর হক সম্পর্কিত গুনাহ ও বান্দার হক সম্পর্কিত গুনাহ সবই মাফ হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ
‘(হে নবী!) যারা কুফর অবলম্বন করেছে তাদেরকে বলে দাও, তারা যদি নিবৃত্ত হয়, তবে অতীতে যা-কিছু হয়েছে তাদেরকে তা ক্ষমা করে দেওয়া হবে।(সূরা আনফাল (৮), আয়াত ৩৮)
অর্থাৎ পৌত্তলিকগণ যদি মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে তাওহীদের ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করে নেয়, খ্রিষ্টানগণ যদি ত্রিত্ববাদ পরিত্যাগ করে ইসলামের একত্ববাদে চলে আসে, ইহুদিগণ যদি তাদের মনগড়া ধর্মাচার থেকে নিবৃত্ত হয়ে আল্লাহপ্রদত্ত ইসলামী অনুশাসন মেনে নেয়, অগ্নিপূজারীগণ যদি আগুনের পূজা ত্যাগ করে এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, নাস্তিকগণ যদি নাস্তিক্যবাদ পরিহার করে আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা ও মা'বৃদ বলে মেনে নেয়, মোটকথা যত রকম কুফরী মতবাদ আছে, তার অনুসারীগণ সেসব বিপথগামিতা বাদ দিয়ে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ে আসা সত্য-সঠিক পথের অনুসারী হয়ে যায়, তবে তাদের সকলেই আল্লাহর কাছে নিজেদের যাবতীয় পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। পাপ থেকে মুক্তিলাভ করাই দুনিয়ার সমস্ত মানুষের আসল লক্ষ্যবস্তু। সে লক্ষ্যবস্তু অর্জনের জন্য ইসলাম তার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করো, তো যে যত বড় পাপীই হও না কেন, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দেবেন। এভাবে সার্বজনীন দীন ইসলাম সমস্ত মানুষকে মহামুক্তির সত্য-সরল পথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

হাদীছটিতে এর পরে জানানো হয়েছে, ইসলাম যেমন মানুষের অতীতকালীন পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়, তেমনি হিজরত ও হজ্জও অতীতকালীন পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। তবে ইসলামগ্রহণ দ্বারা সগীরা ও কবীরা সমস্ত গুনাহই মাফ হয়ে যায়। কিন্তু হিজরত ও হজ্জ দ্বারা মাফ হয় কেবল সগীরা গুনাহ। কবীরা গুনাহর ক্ষেত্রে ক্ষমা পাওয়ার জন্য তাওবা করা শর্ত। অবশ্য হজ্জের ক্ষেত্রে কেউ কেউ বলেছেন যে, হজ্জ যদি যথাযথভাবে পালন করা হয়, তবে আল্লাহ তা'আলা নিজ দয়ায় কবীরা গুনাহসমূহও ক্ষমা করে দেবেন। এমনকি বান্দার কোনও হকও যদি তার কাঁধে থেকে যায়, তাও আল্লাহ তা'আলা এভাবে মাফ করে দেবেন যে, পাওনাদার ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ ছাওয়াব দেবেন, ফলে সে খুশি হয়ে যাবে। সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُث ، وَلَمْ يَفْسُق ، رَجَعَ كَيَوْم وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্জ করে এবং কোনও অশ্লীল কাজ করে না, কোনও সীমালঙ্ঘনও করে না, সে হজ্জ থেকে (পাপমুক্ত হয়ে) ফিরে আসে ওইদিনের মতো,যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছে।’(সহীহ বুখারী: ১৫২১; সহীহ মুসলিম: ১৩৫০; জামে তিরমিযী: ৮১১; সুনানে নাসাঈ: ২৫১৪; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৮৮৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩৬৯৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা: ২৫১৪)

হযরত আমর ইবনুল আস রাযি. তাঁর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বলেন- ثُمَّ وَلِيْنَا أَشْيَاءَ مَا أَدْرِي مَا حَالِي فِيهَا (তারপর আমরা বিভিন্ন দায়-দায়িত্বে নিয়োজিত হই। আমি জানি না তাতে আমার অবস্থা কী হবে)। এটা তাঁর বিনয়। এরূপ ভয় থাকা পরিপক্ক ঈমানের আলামত। তিনি একজন পরিপক্ক মুমিন তো বটেই, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা বিজ্ঞ আলেম ছিলেন, তিনি তাদেরও একজন। সব সাহাবীই বিশ্বস্ত ছিলেন। তারা ইচ্ছাকৃত কবীরা গুনাহ করতেন না। বার বার সগীরা গুনাহ করা হতেও বিরত থাকতেন।

তারপর তিনি কয়েকটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন। যেমন তিনি বলেন- فَإِذَا أَنَا مِت فَلَا تَصْحَبَنِّي نَائِحَةٌ وَلَا نَارٌ (আমি যখন মারা যাব, তখন আমার জানাযায় যেন কোনও বিলাপকারিনী অংশ না নেয় এবং কোনও আগুনও যেন সঙ্গে নেওয়া না হয়)। কেননা কোনও কোনও হাদীছে এটা নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া মৃতব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কাঁদা হারাম। এরূপ ব্যক্তির প্রতি লা'নত করা হয়েছে। লা'নতপ্রাপ্ত ব্যক্তির কারও লাশের সঙ্গে না যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। আর আগুন সঙ্গে নেওয়া এ কারণেও নিষেধ যে, এটা জাহিলী যুগের বৈশিষ্ট্য। সে যুগে লাশের সঙ্গে আগুন নেওয়া হত। আর আগুন দিয়ে তো জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। যে মুমিন সম্পর্কে জান্নাতের আশা করা হয়,তার লাশের সঙ্গে আগুন নেওয়া শোভনীয় হতে পারে না। হাঁ, অন্ধকারে আলোর জন্য যদি আগুন জ্বালানো হয়, সেটা আলাদা কথা।

পরের অসিয়ত হল- فَإِذَا دَفَنتُمُوْنِي، فَشُنوْا عَلَيَّ التُرَابَ شَنا (যখন আমাকে দাফন করবে, তখন আমার কবরে অল্প অল্প করে মাটি ফেলবে)। কবরে অল্প অল্প করে আস্তে আস্তে মাটি ফেলা মুস্তাহাব। এর দ্বারা কবরবাসীর প্রতি মমত্ব ও ভালোবাসার প্রকাশ হয়।

সবশেষের অসিয়ত হল- ثُمَّ أَقِيمُوا حَوْلَ قَبْرِي قَدْرَ مَا تُنْحَرُ جَزُورٌ ، وَيُقْسَمُ لَحْمُهَا ،حَتَّى أَسْتَأْنِسَ بِكُمْ، وَأَنْظُرَ مَا أرَاجِعُ بِهِ رُسُلَ رَبِّي (তারপর আমার কবরের পাশে এতটুকু সময় অবস্থান করবে, যে সময়ের মধ্যে উট জবাই করে তার গোশত বণ্টন করা যায়। যাতে আমি তোমাদের দ্বারা নিঃসঙ্গতা কাটাতে পারি এবং ভেবে দেখতে পারি আমার প্রতিপালকের দূতগণের প্রশ্নের কী উত্তর দিই)। কবরের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। কবরবাসী দুনিয়ায় যতদিন ছিল, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ছিল। ছিল প্রশস্ত জায়গায়। আরামের বিছানায়। ছিল আলোর ভেতর। কবরে এ সবকিছু থেকেই সে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। নিঃসঙ্গ অবস্থা এমনিই ভীতিকর। তা যদি হয় অন্ধকার ও সংকীর্ণ স্থানে, তখন ভয়ের অবস্থাটা কেমন হতে পারে? এ কারণেই মৃতব্যক্তিকে দাফন করার পর কিছুক্ষণ কবরের পাশে অবস্থান করা চাই। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা ধারণা পাওয়া যায়, কবরের পাশে লোকজন থাকার বিষয়টি কবরবাসী অনুভব করতে পারে। এতে করে হয়তো তার নিঃসঙ্গতার ভীতি কিছুটা হলেও লাঘব হয়। দাফন হয়ে যাওয়ার পর মুনকার নাকীর সুওয়াল করতে আসে। সেটা অধিকতর উদ্বেগের বিষয়। কবরে যেহেতু সুওয়াল-জাওয়াব হয়, তাই এর দ্বারা বোঝা যায় কবরজগতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এক রকম চেতনাও কবরবাসীর থাকে। হয়তো সেই চেতনার দ্বারা সে কবরের পাশে অবস্থানকারী লোকজন সম্পর্কে অনুভব করতে পারে। ফলে নিঃসঙ্গতার ভার কিছুটা লাঘব হয় এবং মুনকার-নাকীরের সুওয়ালের জবাব দেওয়ার জন্য কিছুটা মানসিক শক্তিও সে পায়, যা দ্বারা সে জবাবের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। সে শক্তি পাওয়ার একটা বিশেষ কারণ এইও যে, দাফনের পর যারা কবরের পাশে কিছুক্ষণ অবস্থান করবে, তারা কবরবাসীর জন্য তো দু'আও করবে। হাদীছে দু'আ করতে বলাও হয়েছে। হযরত উছমান রাযি. থেকে বর্ণিত-
كَانَ النَّبِيُّ ﷺ إِذَا فَرَغَ مِنْ دَفْنِ الْمَيِّتِ قَالَ : اسْتَغْفِرُوا لِمَيِّتِكُمْ وَسَلُوْا لَهُ التَّثْبِيْتَ فَإِنَّهُ الْآنَ يُسْأَلُ
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মায়্যিতকে দাফন করার পর বলতেন, তোমরা তোমাদের মায়্যিতের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করো এবং দু'আ করো আল্লাহ তা'আলা যেন তাকে স্থির-অবিচল রাখেন। কেননা এখন তাকে সুওয়াল করা হবে।’( মুসনাদে আহমাদ: ৮৫৪৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১৩৭২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ৭০৬৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৫২৩)

সুতরাং অবস্থানকারীগণ দু'আ করতে থাকলে আশা করা যায় আল্লাহ তা'আলা মায়্যিতের প্রতি দয়া করবেন এবং তাকে ভয়-ভীতি ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে স্থিরতা দান করবেন। ফলে শান্তমনে সে মুনকার-নাকীরের সুওয়ালের জবাব দিতে সক্ষম হবে। হযরত আমর ইবনুল 'আস রাযি. হয়তো সে কারণেই এ অসিয়ত করেছেন।

অসিয়ত শেষ করার পর হযরত আমর ইবনুল 'আস রাযি. তাঁর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রাযি.-কে বললেন, একটা রশি নিয়ে এসো। তা দ্বারা আমার দুই হাত আমার ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে ফেলো। পিতার নির্দেশে পুত্র এ কাজ করতে বাধ্য হলেন। তারপর হযরত আমর ইবনুল আস রাযি. আকাশের দিকে চোখ তুলে বললেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আদেশ করেছ, আমি তা অমান্য করেছি। আমাকে নিষেধ করেছ, আমি তা লঙ্ঘন করেছি। আমি শক্তিমান নই যে, নিজেকে তোমার শাস্তি থেকে রক্ষা করব। আমি নির্দোষ নই যে, অজুহাত পেশ করব। তবে হাঁ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি ছাড়া কোনও মা'বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তোমার বান্দা ও রাসূল"। তারপর তিনি এক চিন্তিত ও অনুতপ্ত ব্যক্তির মতো মুখে আঙ্গুল রাখলেন। এ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল। রাযিয়াল্লাহু তা'আলা 'আনহু।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মুমূর্ষু ব্যক্তিকে এমন এমন কথা শোনানো উচিত, যাতে সে আল্লাহ তা'আলার রহমতের আশাবাদী হয়।

খ. ইসলামগ্রহণ দ্বারা অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

গ. হজ্জ ও হিজরত দ্বারাও গুনাহ মাফ হয়।

ঘ. মৃতব্যক্তিকে দাফনের জন্য নেওয়ার সময় কিছুতেই বিলাপ করে কাঁদা উচিত নয় এবং তাঁর সঙ্গে আগুন না নেওয়া মুস্তাহাব।

ঙ. মৃতব্যক্তিকে কবরে শোওয়ানোর পর ধীরে ধীরে মমতার সঙ্গে মাটি ফেলা চাই।

চ. দাফনের পর কবরের পাশে কিছু সময় কাটানো মুস্তাহাব।

ছ. কবরে মুনকার নাকীরের সুওয়াল সত্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন