আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

১- ঈমানের অধ্যায়

হাদীস নং: ২১৪
আন্তর্জাতিক নং: ১১৮
৫১. ফিতনা প্রকাশের পূর্বেই নেক আমলের প্রতি অগ্রসর হওয়ার জন্য উৎসাহ দান
২১৪। ইয়াহয়া ইবনে আইয়ুব, কুতায়বা ও ইবনে হুজর (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেনঃ অন্ধকার রাতের মত ফিতনা আসার আগেই তোমরা নেক আমলের প্রতি অগ্রসর হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে। বিকালে মুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দ্বীন বিক্রি করে দেবে।
باب الْحَثِّ عَلَى الْمُبَادَرَةِ بِالأَعْمَالِ قَبْلَ تَظَاهُرِ الْفِتَنِ
حَدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ أَيُّوبَ، وَقُتَيْبَةُ، وَابْنُ، حُجْرٍ جَمِيعًا عَنْ إِسْمَاعِيلَ بْنِ جَعْفَرٍ، - قَالَ ابْنُ أَيُّوبَ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ، - قَالَ أَخْبَرَنِي الْعَلاَءُ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " بَادِرُوا بِالأَعْمَالِ فِتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا أَوْ يُمْسِي مُؤْمِنًا وَيُصْبِحُ كَافِرًا يَبِيعُ دِينَهُ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে প্রত্যেককে বর্তমান সময়কে কাজে লাগাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সময়কে কাজে লাগানোর উপায় হচ্ছে সৎকর্মে ব্যস্ত থাকা। সৎকর্ম বলতে ওই কাজকে বোঝানো হয়, যা শরী'আতসম্মত হয় এবং সে কাজ দ্বারা আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি হাসিল করা উদ্দেশ্য হয়। এর মধ্যে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব সব আমলই দাখিল। এমনিভাবে এ আমল যেমন হতে পারে নামায, রোযা ও দান-সদাকা, তেমনি সৃষ্টির সেবা করা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা, দীন শেখানো ও দীনী ইলমের প্রচার করা, বিপন্ন মানুষের পাশে দাড়ানো ইত্যাদি সবই হতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে ফরয-ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি যার পক্ষে যে দীনী কাজ করা সম্ভব হয়, সে কাজ এখনই শুরু করে দেওয়া উচিত।
এ হাদীছ বলছে- আগামী দিনের অপেক্ষায় না থেকে নগদ সময়কে দীনী কাজে ব্যবহার কর। কারণ আগামী দিন এ সুযোগ না-ও পেতে পার। আমল করার জন্য ফিতনাফাসাদমুক্ত স্বস্তিকর সময় দরকার। সে সময় তোমার এখন আছে। ভবিষ্যতে না-ও থাকতে পারে। তখন আফসোসই করতে পারবে, কিন্তু আমল করা সম্ভব হবে না।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- অচিরেই ব্যাপক ফিতনাফাসাদ দেখা দেবে। তা নিরবচ্ছিন্নভাবে একের পর এক আসতেই থাকবে। তিনি তার তুলনা করেছেন অন্ধকার রাতের সঙ্গে। অন্ধকার রাতের এক অংশকে অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এমন নয় যে, কিছুক্ষণ অন্ধকার থাকার পর আলো দেখা দেয়, তারপর আবার অন্ধকার আসে। বরং টানা অন্ধকার চলতেই থাকে। ক্ষণিক সময় অন্ধকার থাকার পর আবার যে সময় আসে সেটাও অন্ধকারই হয়। সমস্ত রাত এভাবেই চলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাচ্ছেন, ভবিষ্যতে যে ফিতনাসমূহ আসবে, তা অন্ধকার রাতের অংশসমূহের মতই হবে। অর্থাৎ এক ফিতনা শেষ হওয়ামাত্র অন্য ফিতনা দেখা দেবে। মাঝখানে কোনও বিরতি পাওয়া যাবে না যে, সেই বিরতির সময় আমল করবে। প্রথম ফিতনায় যেমন দিশেহারা ছিলে, কোনও আমলের সুযোগ পাওয়া যায়নি, তদ্রূপ পরবর্তী ফিতনায়ও অস্থিরতার মধ্যেই কাটাতে হবে। না ফিতনা অবস্থায় আমলের সুযোগ পাবে, না এমন কোনও বিরতি পাওয়া যাবে যখন আমলের অবকাশ হবে। সুতরাং সেই সময় আসার আগে এখনই আমলে মশগুল হয়ে পড়।
হাদীছে যে ফিতনার কথা বলা হয়েছে তা নানারকম হতে পারে। যেমন মুসলিম জাতির মধ্যে পারস্পরিক মারামারি-হানাহানি। তা দীনী বিষয় নিয়েও হতে পারে, দুনিয়াবী বিষয় নিয়েও। দীনী বিষয় নিয়ে এভাবে ফিতনা দাঁড়াতে পারে যে, কেউ কুরআন ও হাদীছের অপব্যাখ্যা করে একটি নতুন দল সৃষ্টি করল। তার কিছু অনুসারীও জুটে গেল। তারা সে নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য উগ্রপন্থা অবলম্বন করল আর এভাবে সমগ্র জাতির ভেতর মহাফাসাদ সৃষ্টি হয়ে গেল। অতীতে খারিজী, মু'তাযিলা, বাতিনী প্রভৃতি ফেরকার দ্বারা মুসলিম সমাজে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের ফিতনা তো এখনও পর্যন্ত চালু আছে। তাদের বাইরেও মুসলিম উম্মাহকে বাহাঈ, কাদিয়ানী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ফিতনা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে সবচে' বড় ফিতনা হয় ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে। অতীতে অনেক সময় বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের জন্য মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। সেসব গোষ্ঠীকে দমন করার জন্য ইসলামী খেলাফতকে বিপুল শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছে। আজও দেশে দেশে ক্ষমতা রক্ষা ও ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে নানারকম দলাদলির জাঁতাকলে আম জনতাকে পিষ্ট হতে হচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের লড়াই সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ধ্বংস করছে। এমন বহু অঞ্চল আছে, যেখানে ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। সেসব অঞ্চলের মানুষ নেক কাজে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায় না। কিভাবে ইজ্জত-আব্রুর হেফাজত করবে, এমনকি কিভাবে প্রাণ রক্ষা করবে, সেই উপায় সন্ধানেই তাদের জীবন সারা।
ফিতনাফাসাদ হতে পারে বাইরের শত্রুর আক্রমণ দ্বারা। মুসলিম রাষ্ট্রের উপর অমুসলিম রাষ্ট্র আগ্রাসন চালাতে পারে। বর্তমানে সেরকম আগ্রাসন বহুদেশে চলছে। অতীতেও অনেক হয়েছে। আবার একই দেশের মধ্যে অমুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারা মুসলিম জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হতে পারে। হতে পারে জাতিগত নিধনের স্বীকার, যেমনটা সম্প্রতি রোহিঙ্গা মুসলিমগণ হয়েছে। এর আগে হয়েছে পূর্ব ইউরোপের বসনিয়ায়। তার আগে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায়। এখনও বহু দেশ আপন আপন সীমানার ভেতর মুসলিম জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার নীলনকশা তলে তলে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চক্রান্তের ভেতর যে সকল মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিন কাটছে, তারা জানে শান্তি ও নিরাপত্তা কী অমূল্য সম্পদ! তার অভাবে কী কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তাদের সময় যাচ্ছে এবং এ অবস্থায় দীন ও ঈমান রক্ষা তাদের পক্ষে কী দুরূহ!!
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী এ হাদীছে করেছেন, ইতোমধ্যে তার বাস্তবায়নও হয়ে গেছে। একইসঙ্গে সারা মুসলিম জাহানে না হলেও একেক বার একেক অঞ্চলে এমন টানা ফিতনাফাসাদ দেখা দিয়েছে যে, তখন সাধারণ জনগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষা করতেই হিমশিম খেয়েছে। এ অবস্থায় নফল আমল তো দূরের কথা, ফরয ইবাদত-বন্দেগী পালন করাই তো প্রায় অসম্ভব। এরকম পরিস্থিতি যে-কোনও সময় যে-কোনও এলাকায়ই দেখা দিতে পারে। তাই যারা এখনও শান্তি ও নিরাপত্তার ভেতর দিন কাটাতে পারছে, তাদের কর্তব্য, এ অবস্থাকে আল্লাহ তা'আলার মহানি‘আমত গণ্য করা এবং সে নি‘আমতের শোকরস্বরূপ ফরয-ওয়াজিবের পাশাপাশি যথাসম্ভব নফল ইবাদত-বন্দেগীও করতে থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
ফিতনা কত ভয়াবহ হবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মানুষ সকালবেলায় মু'মিন থাকবে কিন্তু সন্ধ্যাকালে কাফের হয়ে যাবে! আবার সন্ধ্যাকালে মু'মিন থাকবে কিন্তু ভোরবেলা কাফের হয়ে যাবে!!
এ কাফের হওয়াটা আক্ষরিক অর্থেও হতে পারে এবং রূপকার্থেও হতে পারে। আক্ষরিক অর্থে কাফের হওয়া মানে তো ঈমানহারা হয়ে যাওয়া। আর রূপকার্থে কাফের হওয়া মানে কাফেরসুলভ কাজ করা। এ হাদীছে দুই অর্থের যে-কোনও অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ দুনিয়ার লোভলালসায় পড়ে অথবা জুলুমনির্যাতনের কারণে সম্পূর্ণরূপে বেঈমান হয়ে যাবে। অথবা বেঈমান না হলেও বেঈমানদের মত কাজকর্ম করবে। এর ধরন কী রকম হতে পারে, সামনের বাক্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়ার তুচ্ছ সম্পদের বিনিময়ে দীন ও ঈমান বিক্রি করে দেবে।
দুনিয়ার তুচ্ছ স্বার্থে দীন ও ঈমান বিক্রি করার নজির অতীতে দেখা গেছে। কখনও এমন হয়েছে যে, কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে খ্রিষ্টান শাসক বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিল আর সেই সুযোগসুবিধা পেয়ে ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হয়ে গেল। এমনও হয়েছে যে, মুসলিম শাসক পুরোপুরি দীনের উপর নেই। সে কোনও ভ্রান্ত মতাদর্শের অনুসারী। সে জনগণের উপর সেই ভ্রান্ত মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চাইল। তখন কেউ তার প্রলোভনে পড়ে সেই ভ্রান্ত মতাদর্শ গ্রহণ করে নিল এবং কেউ তা গ্রহণ করল রক্তচক্ষুতে প্রভাবিত হয়ে।
একশ্রেণির ‘উলামায়ে-ছু’ (علماء سوء)-কে দেখা গেছে পার্থিব সুযোগসুবিধার লোভে সরকারের মনমত ফাতওয়া দিয়েছে। সরকার কোনও ভ্রান্তপথ অবলম্বন করলে তারা কুরআন-হাদীছের অপব্যবহার করে তা বৈধ ও সঠিক বলে প্রচার করেছে। এমনটা দেখা গেছে বনু আব্বাসিয়া'র শাসনামলে বাগদাদে। দেখা গেছে সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষে। বরং আল্লাহ ও আখিরাতের ভয়ডরহীন শাসকচক্র সব সময়ই নিজেদের হীন স্বার্থে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী বিভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে থাকে। আর তাদের প্রলোভনে পড়ে একশ্রেণির আলেম, সত্যিকার অর্থে 'আলেম' উপাধির উপযুক্ত যারা আদৌ নয়, সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে তারা উলামায়ে-ছু। হাদীছটির ভবিষ্যদ্বাণী তাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য।
যে-কোনও প্রলোভনকে উপেক্ষা করার জন্য অনেক শক্ত ঈমানের প্রয়োজন। সে ঈমান যাদের নেই তারা লোভলালসার ফাঁদে পড়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অন্তরে ঈমানী দৃঢ়তা দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ফিতনাফাসাদহীন নিরাপদ ও স্বস্তিকর সময় অনেক বড় নি'আমত। প্রত্যেকের উচিত সেই নি'আমতকে কাজে লাগানো।

খ. কোনও নেক কাজে গড়িমসি করা উচিত নয়। কেননা জানা নেই আগামী দিন তা করার সুযোগ পাওয়া যাবে কি না।

গ. সর্বাবস্থায় দীন ও ঈমান মজবুতভাবে ধরে রাখা উচিত, যাতে পার্থিব কোনও প্রলোভনে পড়ে তার ক্ষতিসাধন করা না হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ২১৪ | মুসলিম বাংলা