আল মুসনাদুস সহীহ- ইমাম মুসলিম রহঃ

১- ঈমানের অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬৭
আন্তর্জাতিক নং: ৯১ -
৩৯. অহংকারের বিবরণ ও তা হারাম হওয়া
১৬৭। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না, মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার ও ইবরাহীম ইবনে দীনার (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ যার অন্তরে অনু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, মানুষ চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক, এও কি অহংকার? রাসুল বললেনঃ আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালবাসেন। অহমিকা হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায় অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা।
باب تَحْرِيمِ الْكِبْرِ وَبَيَانِهِ
وَحَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، وَمُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ، وَإِبْرَاهِيمُ بْنُ دِينَارٍ، جَمِيعًا عَنْ يَحْيَى بْنِ حَمَّادٍ، - قَالَ ابْنُ الْمُثَنَّى حَدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ حَمَّادٍ، - أَخْبَرَنَا شُعْبَةُ، عَنْ أَبَانَ بْنِ تَغْلِبَ، عَنْ فُضَيْلٍ الْفُقَيْمِيِّ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ النَّخَعِيِّ، عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ " . قَالَ رَجُلٌ إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حَسَنًا وَنَعْلُهُ حَسَنَةً . قَالَ " إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ " .

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে সতর্ক করা হয়েছে যে, কারও অন্তরে বিন্দু পরিমাণ কিন্তু (অহংকার) থাকলেও সে জান্নাতে যেতে পারবে না। কিবর দু’প্রকার। এক হল আল্লাহর সঙ্গে কিবর। তার মানে অহংকারবশত আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করা ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতে অস্বীকার করা। এরূপ কিবর কুফরী। যার অন্তরে এটা আছে, সে কোনওদিনই জান্নাতে যেতে পারবে না।

আরেক কিবর হল মানুষের সঙ্গে। এটা দু’প্রকার। এক হল মানুষের প্রতি অহমিকাবশত আল্লাহ তা'আলার কোনও হুকুম মানতে অস্বীকার করা। যেমন ইবলীস হযরত আদম আলাইহিস সালামের প্রতি অহমিকাবশত আল্লাহ তা'আলার হুকুম মানেনি। সে আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করেনি। এরকম কিবরও কুফরী। এরকম কিবরে লিপ্ত হওয়ার কারণে ইবলীস অভিশপ্ত হয়েছে। এটাও স্থায়ী জাহান্নামবাসকে অবধারিত করে।

মানুষের প্রতি আরেক কিবর এমন, যদ্দরুন সরাসরি আল্লাহ তা'আলার হুকুম প্রত্যাখ্যান করা হয় না বটে, কিন্তু মানুষের হক নষ্ট করা হয়। এরকম কিবর কবীরা গুনাহ ও মহাপাপ। যেমন অহংকারবশত কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, কারও পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা। এরকম কিবর যদি কারও মধ্যে থাকে, তবে তার প্রথমে জান্নাতে প্রবেশ করা বাধাগ্রস্ত হবে। শুরুতে তাকে এর জন্য জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। সে শাস্তিভোগ শেষ হওয়ার পর ঈমানের বদৌলতে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এ হাদীছটিতে যে বলা হয়েছে 'অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না', তা দ্বারা উল্লিখিত যে-কোনওরকমের অহংকারই বোঝানো উদ্দেশ্য হতে পারে। কুফরী পর্যায়ের অহংকার হলে সে তো কোনওদিনই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর যদি কুফরী পর্যায়ের না হয়, তবে প্রথমে অহংকার পরিমাণে শাস্তি ভোগ করার পর সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, তারপর জান্নাতে প্রবেশ করবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে এ কথা শোনার পর জনৈক সাহাবীর মনে প্রশ্ন জাগল যে, তবে কি সুন্দর পোশাক-আশাক পরা যাবে না? তা পরা কি অহংকার বলে গণ্য হবে? সুতরাং তিনি এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন-
إِنَّ الرَّجُلَ يُحِبُّ أَنْ يَكُوْنَ ثَوْبُهُ حَسَنًا، وَنَعْلُهُ حَسَنَةً؟ ‘কোনও ব্যক্তি পসন্দ করে তার পোশাক ভালো হোক ও তার জুতা ভালো হোক (এটাও কি অহংকার)'? এ প্রশ্নকারী কে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কেউ বলেন তিনি হযরত মালিক ইবন মুরারা রাযি.। কেউ বলেন তিনি আবু রায়হানা শামা'ঊন রাযি.। কেউ বলেন রাবী'আ ইবন আমির রাযি.। কেউ বলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি.। কারও মতে তিনি হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.।

এর উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ (আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পসন্দ করেন)। অর্থাৎ মৌলিক, নিখুঁত ও পরিপূর্ণ সৌন্দর্য কেবল আল্লাহ তা'আলারই আছে। তাঁর সত্তা, তাঁর গুণাবলি, তাঁর কাজকর্ম সবই সুন্দর ও উৎকৃষ্ট। তাই তিনি তোমাদের দিক থেকেও সৌন্দর্য পসন্দ করেন। যেমন তিনি মহাদাতা, তোমাদের দিক থেকেও তিনি দান-খয়রাত পসন্দ করেন। তিনি জ্ঞানময় সত্তা, তোমাদের পক্ষ হতেও জ্ঞানের চর্চা পসন্দ করেন। তিনি পরম সত্যবাদী, তোমাদের দিক থেকেও সত্যবাদিতা পসন্দ করেন। তিনি গুণগ্রাহী, তোমাদের দিক থেকেও গুণগ্রাহিতা পসন্দ করেন। এর দ্বারা বোঝা গেল সৌন্দর্যপ্রিয়তা অহংকার নয়। এটা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ। এটা অহংকার হয় তখনই, যখন বড়াই করা বা মানুষের সামনে নিজ বড়ত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে করা হয়। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্য যদি হয় মহৎ, তবে তা কিছুতেই অহংকার নয়। মহৎ উদ্দেশ্য এরকম হতে পারে যে, পোশাক আল্লাহ তা'আলার দান। আল্লাহ তা'আলা পোশাক দিয়েছেন মানুষের সৌন্দর্য বিকাশের জন্যও। এমনিভাবে টাকা-পয়সাও আল্লাহ তা'আলারই দান। কাজেই আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায়ের জন্য আমি চাই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সুন্দর পোশাক পরব। এবং যেহেতু এটা আল্লাহর দান, তাই একে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করে রাখব। আমি আমার পোশাক ময়লা করে রাখব না। তাতে নি'আমতের অমর্যাদা হবে। তাছাড়া দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে যাবে এবং তাতে মানুষ কষ্ট পাবে। এমনিভাবে যদি পোশাক মলিন করে রাখি কিংবা আপন অবস্থা অনুপাতে নিম্নমানের পোশাক পরি, তবে লোকে আমাকে অভাবগ্রস্ত মনে করবে এবং তখন তারা আমার প্রতি দান-দক্ষিণা করতে চাইবে। তাতে করে আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে এবং আল্লাহ তা'আলা আমাকে যে ভালো অবস্থায় রেখেছেন তা লুকানো হবে, যা কিনা নি'আমতের এক প্রকার অকৃতজ্ঞতা। আল্লাহ তা'আলা চান তিনি যাকে যে নি'আমত দিয়েছেন তার দ্বারা সে নি'আমতের প্রকাশ ঘটুক। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ (11)
‘এবং তোমার প্রতিপালকের যে নি'আমত (পেয়েছ), তার চর্চা করতে থাকো।’(সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ১১)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ أَنْ يَرَى أَثَرَ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ
আল্লাহ তা'আলা নিজ বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নি'আমতের ছাপ দেখতে পসন্দ করেন।(জামে তিরমিযী: ২৮১৯; মুসনাদে আহমাদ: ৬৭০৮; মুসনাদে আবু দাউদ তয়ালিসী: ২৩৭৫; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৩০৩৭; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৪৬৬৮)

অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিবর বা অহংকারের ব্যাখ্যাদান করেন যে- اَلْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ (অহংকার হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা ও মানুষকে তাচ্ছিল্য করা)। অর্থাৎ সত্যকে সত্য বলে জানা সত্ত্বেও তা গ্রহণ না করা ও উপেক্ষা করা। সে সত্য যদি পরম সত্য তথা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর দীন হয়ে থাকে, তবে তো তা প্রত্যাখ্যান করা চরম অহংকার অর্থাৎ কুফর। আর যদি সে সত্য মানুষের পারস্পরিক কথাবার্তা ও অধিকারের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে, তবে তা প্রত্যাখ্যান করা অবশ্যই গুনাহ, কিন্তু কুফর পর্যায়ের নয়। এটাও অহংকার। হাঁ, যদি সত্য সত্যরূপে পরিস্ফুট না হয়; বরং তা সত্য হওয়া-না হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ থাকে আর সে সন্দেহের কারণে তা গ্রহণ করা না হয়, তবে তা অহংকারের আলামত।

আর মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাও অহংকার। কাউকে তুচ্ছ গণ্য করার কোনও সুযোগ নেই। সকলেই আদমসন্তান। যদি কেউ কাফের হয়, তবে তার ক্ষেত্রে এ সম্ভাবনা আছে যে, মৃত্যুর আগে কখনও আল্লাহ তা'আলা তাকে ঈমান দিয়ে দেবেন। আর যদি মুমিন হয় এবং পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তবে হতে পারে তার এমন কোনও নেক আমল আছে, যা আল্লাহ তা'আলা কবুল করে নিয়েছেন। আর পাপাচারের বিষয়ে সম্ভাবনা রয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা তাকে তাওবার তাওফীক দেবেন। অপরদিকে নিজের ক্ষেত্রে আমল কবুল না হওয়ার ভয় রয়ে গেছে। এমনও হতে পারে যে, কোনও পাপকর্ম রয়ে গেছে, কিন্তু তা থেকে তাওবা করা হয়নি। আর কার শেষ পরিণতি কেমন হবে তা তো কেউ জানে না। এ অবস্থায় নিজেকে উত্তম ভেবে অন্যকে তুচ্ছ গণ্য করার অবকাশ থাকে কোথায়? অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার অর্থই দাঁড়ায় যে, সে নিজেকে তারচে' বড় ও উত্তম মনে করে। এটা স্পষ্টই অহংকার। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সর্বপ্রকার অহংকার থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে দিন। আমীন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জান্নাতলাভে প্রত্যাশী ব্যক্তির কোনও অবস্থায়ই অহংকার করা সাজে না।

খ. আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায়ের উদ্দেশ্যে উত্তম পোশাক-পরিচ্ছদ গ্রহণ করাতে দোষ নেই এবং তা অহংকারও নয়।

গ. সৌন্দর্যপ্রিয়তা আল্লাহ তা'আলার পসন্দ।

ঘ. কোনও অবস্থায়ই সত্য প্রত্যাখ্যান করতে নেই, তা যে-ই বলুক না কেন।

ঙ. কাউকে তার বর্তমান ও বাহ্যিক অবস্থা দেখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ মুসলিম - হাদীস নং ১৬৭ | মুসলিম বাংলা