আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৯- আযান-ইকামতের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৭৪১
৪৮০. নামাযে খুশু' (বিনয়, নম্রতা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও তন্ময়তা)।
৭০৫। ইসমাঈল (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা কি মনে কর যে, আমার কিবলা শুধুমাত্র এ দিকে? আল্লাহর শপথ, তোমাদের রুকু তোমাদের খুশু’, কোন কিছুই আমার কাছে গোপন থাকে না। আর নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের দেখি আমার পিছন দিক থেকেও।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজের হুকুমদানের আগে আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাসের বরাত দিয়েছেন। অর্থাৎ যার এ বিশ্বাস আছে তার এ বিষয়টি পালনে যত্নবান থাকা একান্ত কর্তব্য।

ঈমানের মূল স্তম্ভ সাতটি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস, তাকদীরে বিশ্বাস এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস। এ হাদীছে তার মধ্যে মাত্র দু'টি অর্থাৎ আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ এ দু'টির উপর যার বিশ্বাস আছে, বাকি পাঁচটিতে বিশ্বাস আপনা-আপনিই তার উপর অবধারিত হয়ে যায়। শরীআতের যাবতীয় বিধানের ভিত্তি মূলত এ দু'টি বিশ্বাসের উপরই। কেননা যার আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে এবং আখেরাতের হিসাব-নিকাশেরও ভয় আছে, সেই তো শরীআত মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবে। এরূপ বিশ্বাস থাকলেই সে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলের শিক্ষার দ্বারস্থ হবে। নবী-রাসূলের শিক্ষার উৎস আসমানী কিতাব, যা তাঁরা ফিরিশতাদের মাধ্যমে লাভ করে থাকেন। সুতরাং বিশ্বাসীগণ আসমানী কিতাব ও ফিরিশতাদের উপরও ঈমান রাখবে। আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস থাকলে তাতে বর্ণিত কোনওকিছুর উপরই অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। ফলে তাকদীর ও পুনরুত্থানে বিশ্বাসও অবধারিত হয়ে যায়। ব্যস এভাবে আল্লাহ ও শেষদিবসের বিশ্বাস অন্যসব কিছুর বিশ্বাসকেও অবধারিত করে।

যাহোক এ হাদীছে বলা হয়েছে (যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার কর্তব্য অতিথির প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা)। অতিথি গরীব-ধনী, আত্মীয়-অনাত্মীয় যেই হোক না কেন তাকে খুশিমনে গ্রহণ করা চাই। এমন কোনও আচরণ তার সঙ্গে করা যাবে না, যা অতিথির পক্ষে মর্যাদাকর নয়। সুতরাং মেজবানের কর্তব্য তার সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাত করা, নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তার জন্য ভালো মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা, সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে ভালো জায়গায় থাকতে দেওয়া, তার ওযূ-গোসলের প্রতি লক্ষ রাখা, তাকে সঙ্গ দেওয়া, বিদায়কালে তাকে এগিয়ে দেওয়া, সম্ভব হলে তার পথখরচা দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার প্রতি সম্মানজনক আচরণের একটি হলো অতিথি যেখানে বসবে, নিজে তার চেয়ে একটু নিচে বসা।

এ হাদীছে আত্মীয়তা রক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তা রক্ষা করে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও বহু হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় আত্মীয়তা রক্ষা করা ফরয। ছিন্ন করা নাজায়েয ও কবীরা গুনাহ। আত্মীয়তা রক্ষার বিভিন্ন স্তর আছে। তার সর্বনিম্ন স্তর হলো দেখাসাক্ষাত ও যোগাযোগ বন্ধ না করা এবং সালাম দেওয়া ও কথাবার্তা বলা। যদি এতটুকুও করা না হয়, তবে তা আত্মীয়তা ছিন্ন বলে গণ্য হবে। এর উপরে সাহায্য-সহযোগিতা করা,উপহার-উপঢৌকন দেওয়া ও সৌজন্যমূলক আচরণ করার বিষয়টি প্রত্যেকের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। কাজেই সামর্থ্যভেদে এর মধ্যে বিভিন্ন স্তরভেদ হতে পারে।প্রত্যেকেই নিজ সামর্থ্য বোঝে। কাজেই আত্মীয়তা রক্ষার ফযীলত লাভের জন্য প্রত্যেকের উচিত আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী আত্মীয়ের সঙ্গে যতবেশি সম্ভব হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করা ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা।

হাদীছে বলা হয়েছে- (যে আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার কর্তব্য ভালো কথা বলা, নয়তো চুপ থাকা)। অর্থাৎ বলবে কেবল সেই কথাই, যা ভালো হয়। বোঝা যাচ্ছে চুপ থাকাটাই আসল। কথা বলার অনুমতি আছে তখনই, যখন কথাটা ভালো হয়। ভালো কথা মানে এমন কথা, যাতে কোনও গুনাহ নেই বরং ছাওয়াব আছে। যেমন সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, ভালো পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

'মানুষের বহু গোপন কথায় কোনও কল্যাণ নেই। তবে কোনও ব্যক্তি দান সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে, সেটা ভিন্ন কথা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এরূপ করবে, আমি তাকে মহাপ্রতিদান দেব।৪০

যে কথায় ছাওয়াবও নেই গুনাহও নেই, এরকম প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী কথা বলারও অনুমতি আছে। কিন্তু যে কথার কোনও প্রয়োজন নেই, তা বাহ্যত বৈধ হলেও সে কথা পরিহার করা উচিত। কেননা তাতে অন্ততপক্ষে সময় তো নষ্ট হয়। অহেতুক সময় নষ্ট করাও ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। এক হাদীছে ইরশাদ-

من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه

'অহেতুক সবকিছু পরিহার করা কোনও ব্যক্তির ইসলামের সুষ্ঠুতার পরিচায়ক।৪১
অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝা যায় সে একজন ভালো মুসলিম, সে নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলামের উপর আছে।

বলা হয়েছে, যদি ভালো কিছু বলার না থাকে তাহলে চুপ থাকবে। অর্থাৎ চুপ থাকাটা হতে হবে ইচ্ছাকৃত, অক্ষমতার কারণে নয়। যেমন এক ব্যক্তি বোবা, সে কথাই বলতে পারে না অথবা বাকশক্তি আছে বটে, কিন্তু কোনওকিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস রাখে না, তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে আছে, এরূপ চুপ থাকাটা কোনও ছাওয়াবের কাজ নয়। চুপ থাকা ছাওয়াবের কাজ হবে তখনই, যখন তা ইচ্ছাকৃত হয়। যেমন চাইলে সে কোনও শক্ত ও রূঢ় কথা বলতে পারে, তা সত্ত্বেও বলছে না, এ ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা একটি ছাওয়াবের কাজরূপে গণ্য হবে। একবার এক সাহাবী আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে পৌঁছাবে। উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একের পর এক বিভিন্ন আমলের কথা বলতে থাকেন। সবশেষে ইরশাদ করেন-

فإن لم تطق ذلك، فكف لسانك إلا من خير

‘যদি তাও না পার, তবে ভালো কথা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তোমার জিহ্বা সংযত রাখবে।৪২
অপর এক হাদীছে ইরশাদ من صمت نجا “যে ব্যক্তি নীরবতা অবলম্বন করল সে মুক্তি পেল।"

আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা গুনাহের কাজও বটে। যেমন কারও সামনে কেউ অন্যায় কিছু বলছে, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তার প্রতিবাদ করছে না, এটা অন্যায়কে সমর্থন করারই নামান্তর। এরূপ চুপ থাকা নিঃসন্দেহে একটি গুনাহের কাজ। তাই বলা হয়, যে ব্যক্তি সত্য বলার স্থানে চুপ করে থাকে সে এক বোবা শয়তান। (অবশ্য এটি হাদীছ নয়)।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অন্যায় ও অনুচিত কথা বলা হতে বিরত থাকাও একটি সৎকর্ম

খ. অতিথির সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা ঈমানের দাবি।

গ. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজ জিহ্বা সংযত রাখা। হয় ভালো কথা বলবে, নয়তো চুপ থাকবে।

ঘ. আত্মীয়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করা ও সর্বাবস্থায় আত্মীয়তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা ঈমানের দাবি।

৪০. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৪

৪১. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮৮৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৩২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৩২

৪২. বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৭৪; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৭৪৩; সুনানু দারা কুতনী, হাদীছ নং ২০৫৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২১৩১৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৫৮০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪১৯

৪৩. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৮১; সুনানুদ্ দারিমী, হাদীছ নং ২৭৫৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬২৯
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন