আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

১- ঈমানের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং:
২. ঈমানের অধ্যায়ঃ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বাণীঃ ইসলামের ভিত্তি পাঁচটিঃ মৌখিক স্বীকৃতি (ইয়াকীনসহ) এবং কর্মই ঈমান এবং তা বাড়ে ও কমে।
আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেনঃ যাতে তারা তাদের ঈমানের সাথে ঈমান দৃঢ় করে নেয় (৪৮ : ৪)। আমরা তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। (১৮ঃ ১৩)। এবং যারা সৎপথে চলে আল্লাহ্ তাদের অধিক হিদায়াত দান করেন (১৯ঃ ৭৬)। এবং যারা সৎপথ অবলম্বন করে আল্লাহ্ তাদের অধিক হিদায়াত বাড়িয়ে দেন এবং তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দেন (৪৭ঃ ১৭), যাতে মু’মিনদের ঈমান বেড়ে যায় (৭৪ঃ ৩১)।
আল্লাহ্ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, এটা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বাড়িয়ে দিল? যারা মু’মিন এ তো তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয়। (৯ঃ ১২৪) এবং তাঁর বাণীঃ (فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا) ″সুতরাং তোমরা তাদের ভয় কর; আর এটা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দিয়েছিল″ (৩ঃ ২৭৩)। (وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا) ″আর এতে তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বাড়লো।″ (৩৩ঃ ২২)।
আর আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা ঈমানের অংশ।
উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রাহঃ) আদী ইবনে আদী (রাহঃ) এর কাছে এক পত্রে লিখেছিলেন, ঈমানের কতকগুলো ফরয, কতকগুলো হুকুম-আহকাম, বিধি-নিষেধ এবং সুন্নত রয়েছে। যে এগুলো পরিপূর্ণরূপে আদায় করে তার ঈমান পূর্ণ হয়। আর যে এগুলো পূর্ণভাবে আদায় করে না, তার ঈমান পূর্ণ হয় না। আমি যদি বেঁচে থাকি তবে অচিরেই এগুলো তোমাদের নিকট বর্ণনা করব, যাতে তোমরা তার উপর আমল করতে পার। আর যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে জেনে রাখ, তোমাদের সাহচর্যে থাকার জন্য আমি লালায়িত নই।
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) বলেন, (وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي) ‘তবে এ তো কেবল চিত্ত প্রশান্তির জন্য’- (২ঃ ২৬০)।
মুআয (রাযিঃ) বলেন, ‘এসো আমাদের সঙ্গে বস, কিছুক্ষণ ঈমানের আলোচনা করি।’
ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) বলেন, ‘ইয়াকীন হল পূর্ণ ঈমান।’
ইবনে উমর (রাযিঃ) বলেন, ‘বান্দা প্রকৃত তাকওয়ায় পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে, মনে যে বিষয় সন্দেহের সৃষ্টি করে, তা পরিত্যাগ না করে।’
মুজাহিদ (রাহঃ) شرع لكم من الدين ما وصى به نوحا এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, شرع لكم من الدين أوصيناك يا محمد وإياه دينا واحدا অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আমি আপনাকে এবং নূহকে একই ধর্মের আদেশ করেছি।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, (شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا) অর্থাৎ পথ ও পন্থা—এবং তোমাদের দুআ অর্থাৎ তোমাদের ঈমান।
৭। উবাইদুল্লাহ্ ইবনে মুসা (রাহঃ) ......... ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি।
১। আল্লাহ্ ছাড়া ইলাহ্ নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য দান।
২। নামায কায়েম করা
৩। যাকাত দেয়া
৪। হজ্জ করা এবং
৫। রমযান এর রোযা পালন করা।
كتاب الإيمان بَابُ قَوْلِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ
وَهُوَ قَوْلٌ وَفِعْلٌ، وَيَزِيدُ وَيَنْقُصُ، قَالَ اللَّهُ تَعَالَى {لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ} [الفتح: 4] {وَزِدْنَاهُمْ هُدًى} [الكهف: 13] {وَيَزِيدُ اللَّهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى} [مريم: 76] {وَالَّذِينَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَآتَاهُمْ تَقْوَاهُمْ} [محمد: 17] وَقَوْلُهُ: {وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا} [المدثر: 31] وَقَوْلُهُ: {أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا [ص:11] الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا} [التوبة: 124] وَقَوْلُهُ جَلَّ ذِكْرُهُ: {فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا} [آل عمران: 173] وَقَوْلُهُ تَعَالَى: {وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا} [الأحزاب: 22] وَالحُبُّ فِي اللَّهِ وَالبُغْضُ فِي اللَّهِ مِنَ الإِيمَانِ " وَكَتَبَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ العَزِيزِ إِلَى عَدِيِّ بْنِ عَدِيٍّ: «إِنَّ لِلْإِيمَانِ فَرَائِضَ، وَشَرَائِعَ، وَحُدُودًا، وَسُنَنًا، فَمَنِ اسْتَكْمَلَهَا اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَكْمِلْهَا لَمْ يَسْتَكْمِلِ الإِيمَانَ، فَإِنْ أَعِشْ فَسَأُبَيِّنُهَا لَكُمْ حَتَّى تَعْمَلُوا بِهَا، وَإِنْ أَمُتْ فَمَا أَنَا عَلَى صُحْبَتِكُمْ بِحَرِيصٍ» وَقَالَ إِبْرَاهِيمُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي» وَقَالَ مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ: «اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنْ سَاعَةً» وَقَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ: «اليَقِينُ الإِيمَانُ كُلُّهُ» وَقَالَ ابْنُ عُمَرَ: «لاَ يَبْلُغُ العَبْدُ حَقِيقَةَ التَّقْوَى حَتَّى يَدَعَ مَا حَاكَ فِي الصَّدْرِ» وَقَالَ مُجَاهِدٌ: «شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ أَوْصَيْنَاكَ يَا مُحَمَّدُ وَإِيَّاهُ دِينًا وَاحِدًا» وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: «شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا» سَبِيلًا وَسُنَّةً باب** دُعَاؤُكُمْ إِيمَانُكُمْ لِقَوْلِهِ عَزَّ وَجَلَّ: {قُلْ مَا يَعْبَأُ بِكُمْ رَبِّي لَوْلاَ دُعَاؤُكُمْ} [الفرقان: 77] وَمَعْنَى الدُّعَاءِ فِي اللُّغَةِ الإِيمَانُ

** قال الحافظ في فتح الباري (1/ 49):
(قوله دعاؤكم إيمانكم) قال النووي يقع في كثير من النسخ هنا باب وهو غلط فاحش وصوابه بحذفه ولا يصح إدخال باب هنا إذ لا تعلق له هنا قلت ثبت باب في كثير من الروايات المتصلة منها رواية أبي ذر ويمكن توجيهه لكن قال الكرماني إنه وقف على نسخة مسموعة على الفربري بحذفه وعلى هذا فقوله دعاؤكم إيمانكم من قول بن عباس وعطفه على ما قبله كعادته في حذف أداة العطف حيث ينقل التفسير وقد وصله بن جرير من قول بن عباس قال في قوله تعالى قل ما يعبأ بكم ربي لولا دعاؤكم قال يقول لولا إيمانكم…
حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ مُوسَى، قَالَ أَخْبَرَنَا حَنْظَلَةُ بْنُ أَبِي سُفْيَانَ، عَنْ عِكْرِمَةَ بْنِ خَالِدٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ".

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইসলামের আসল অর্থ হচ্ছে নিজেকে কারো কাছে সমর্পণ করে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ তারই নির্দেশের অধীন হয়ে যাওয়া। আর মহান আল্লাহর প্রেরিত ও তাঁর রাসূলগণ কর্তৃক আনীত দ্বীনের নাম 'ইসলাম' এজন্যই রাখা হয়েছে যে, এখানে বান্দা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দেয় এবং তাঁর সার্বিক আনুগত্যকে নিজের জীবন সাধনার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নেয়।
বস্তুতঃ এটাই হচ্ছে ইসলামের হাকীকত ও তাৎপর্য এবং আমাদের কাছে এরই দাবী করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন তোমাদের আল্লাহ্ তো একক আল্লাহ, সুতরাং তোমরা মুসলিম অর্থাৎ তাঁরই আজ্ঞাধীন হয়ে যাও। (সূরা হজ্জঃ আয়াত 08)

এই ইসলাম সম্পর্কেই বলা হয়েছে। তার চেয়ে উত্তম মানুষ আর কে হতে পারে, যে
নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দিয়েছে এবং সে এভাবে মুসলিম বান্দা হয়ে গিয়েছে।
(সূরা নিসা : আয়াত ১২৫)

এই ইসলাম সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অবলম্বন করতে চায়, তার পক্ষ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে হবে আখেরাতে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ৮৫)

মোটকথা, ইসলামের মূল প্রাণশক্তি ও এর হাকীকত এটাই যে, বান্দা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দেবে এবং সর্বক্ষেত্রে তাঁরই আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে।।

নবী-রাসূলদের আনীত শরীঅতসমূহে এই ইসলামের জন্য বিশেষ কিছু মৌলিক বিধি বিধানও থাকে, যেগুলোর অবস্থান এই মূল ইসলামের অবয়ব তুল্য। আর এই মূলের ক্রমবৃদ্ধি ও এর সজীবতা এ সকল বিধি-বিধানের দ্বারাই হয়ে থাকে। এই বিষয়গুলি সম্পূর্ণ অনুসৃত বিষয় হয়ে থাকে এবং এই বিষয়গুলো দ্বারাই বাহ্যত তাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়, যারা ইসলামকে নিজেদের জীবনবিধান বানিয়ে নিয়েছে আর যারা তা করেনি।

শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলামের যে সর্বশেষ ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান আমাদের কাছে এসেছে, এর মধ্যে আল্লাহর একত্বতার বিশ্বাস, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রেসালতের সাক্ষ্য প্রদান, নামায, যাকাত, রোযা ও বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জকে ইসলামের স্তম্ভ ও মৌলিক বিষয় সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর স্থাপিত।

যা হোক, ইসলামের পরিচয় সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে এই হাদীসে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পাঁচটি জিনিসকে উল্লেখ করেছেন, এগুলোই হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ। আর এগুলোই মূল ইসলামের দৃষ্ট অবয়ব। এই জন্যই ইসলামের পরিচয় দিতে গিয়ে এই বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয়েছে।

এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রূপকভাষায় ইসলামকে এমন একটি ইমারতের সাথে তুলনা করেছেন, যা কয়েকটি স্তরের উপর দাঁড়ানো থাকে। তিনি এখানে বলে দিয়েছেন যে, ইসলামের এই ইমারত ও সৌধ এ পাঁচটি জিনিসের উপরই প্রতিষ্ঠিত। তাই কোন মুসলমানের জন্য এ অবকাশ নেই যে, সে এইসব বিধি-বিধান পালনে কোন প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করবে। কেননা, এগুলো হচ্ছে ইসলামের মূল খুঁটি।
মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিষয়সমূহ এ পাঁচটি বিধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর বাইরেও অনেক জরুরী বিধি-বিধান রয়েছে, যেমন আল্লাহর পথে জেহাদ করা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা ইত্যাদি। কিন্তু এ পাঁচটি বিষয়ের যে গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এ বৈশিষ্ট্য যেহেতু অন্য বিধানাবলীতে নেই, তাই ইসলামের ভিত্তিমূল কেবল এ পাঁচটি জিনিসকেই সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আর ঐ সকল বৈশিষ্ট্য এবং গুরুত্ব উহাই, যা পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে 'হাদীসে জিব্রাঈল' এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখা হয়েছে। যার সারবস্তু এই যে, এই পঞ্চ রোকন ইসলামের জন্য দৃষ্ট অবয়বের মত। তাছাড়া এগুলোই আল্লাহর দাসত্বসুলভ এমন বিষয়, যা সত্তাগতভাবে কাম্য ও উদ্দেশ্য এবং এগুলোর অপরিহার্যতা কোন সাময়িক বিষয় ও কোন বিশেষ অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত নয়; বরং এগুলো হচ্ছে মৌলিক ও স্থায়ী বিধি-বিধান । পক্ষান্তরে জেহাদ ও সৎ কাজের আদেশের বিষয়টি এমন নয়। কেননা, সেটা বিশেষ অবস্থা ও বিশেষ পরিস্থিতিতে ফরয হয়ে থাকে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন