আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

২- ইলমের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৮
আন্তর্জাতিক নং: ৬৮
৫২. কথা ও আমলের পূর্বে ইলম অর্জন জরুরী।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদঃ فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ “সুতরাং জেনে রাখ, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই।” (৪৭ঃ ১৯)।
এখানে আল্লাহ তাআলা ইলমের কথা আগে বলেছেন। আলিমগণই নবীগণের ওয়ারিস। তারা ইলমের ওয়ারিস হয়েছেন। তাই যে ইলম হাসিল করে সে বিরাট অংশ লাভ করে। আর যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের উদ্দেশ্যে পথ চলে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলিমগণই তাকে ভয় করে (৩৫ঃ ২৮)।
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেনঃ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلاَّ الْعَالِمُونَ “আলিমগণ ছাড়া তা কেউ বুঝেনা”।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেঃ وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ তারা বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহলে আমরা জাহান্নামী হতাম না। (৬৭ঃ ১০)।
আরো ইরশাদ করেনঃ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ “বল, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? (৩৯ঃ ৯)
নবী কারীম (ﷺ) বলেনঃ আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আর অধ্যয়নের মাধ্যমেই ইলম অর্জিত হয়।
আবু যর (রাযিঃ) তাঁর ঘাড়ের দিকে ইশারা করে বলেন, যদি তোমরা এখানে তরবারি ধর, এরপর আমি বুঝতে পারি যে, তোমরা আমার ওপর সে তরবারী চালাবার আগে আমি একটু কথা বলতে পারব,যা নবী কারীম (ﷺ) থেকে শুনেছি, তবে অবশ্যই আমি তা বলে ফেলব।
নবী কারীম (ﷺ) এর বাণীঃ উপস্থিত ব্যক্তিরা যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে (আমার বাণী) পৌঁছে দেয়।
ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, كُونُوا رَبَّانِيِّينَ (তোমরা রবানি হও)। এখানে رَبَّانِيِّينَ মানে প্রজ্ঞাবান, আলিম ও ফকীহগণ। আরো বলা হয় رباني সে ব্যক্তি কে বলা হয় যিনি মানুষকে জ্ঞানের বড় বড় বিষয়ের পূর্বে ছোট ছোট বিষয় শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলেন।
পরিচ্ছেদঃ ৫৩. রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) ওয়ায-নসীহতে ও ইলম শিক্ষা দানে উপযুক্ত সময়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন, যাতে লোকজন বিরক্ত না হয়ে পড়ে।
৬৮। মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ......... ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) আমাদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে নির্দিষ্ট দিনে ওয়ায-নসীহত করতেন, যাতে আমাদের কারো মধ্যে বিরক্তিভাব না আসে।
بَابٌ: العِلْمُ قَبْلَ القَوْلِ وَالعَمَلِ
لِقَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى: {فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ} [محمد: 19] فَبَدَأَ بِالعِلْمِ «وَأَنَّ العُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ، وَرَّثُوا العِلْمَ، مَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ، وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَطْلُبُ بِهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الجَنَّةِ» وَقَالَ جَلَّ ذِكْرُهُ: {إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ العُلَمَاءُ} [فاطر: 28] وَقَالَ: {وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا العَالِمُونَ} [العنكبوت: 43] {وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ} [الملك: 10] وَقَالَ: {هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لاَ يَعْلَمُونَ} [الزمر: 9] وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ» [ص:25] وَإِنَّمَا العِلْمُ بِالتَّعَلُّمِ " وَقَالَ أَبُو ذَرٍّ: «لَوْ وَضَعْتُمُ الصَّمْصَامَةَ عَلَى هَذِهِ - وَأَشَارَ إِلَى قَفَاهُ - ثُمَّ ظَنَنْتُ أَنِّي أُنْفِذُ كَلِمَةً سَمِعْتُهَا مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَبْلَ أَنْ تُجِيزُوا عَلَيَّ لَأَنْفَذْتُهَا» وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: {كُونُوا رَبَّانِيِّينَ} [آل عمران: 79] " حُلَمَاءَ فُقَهَاءَ، وَيُقَالُ: الرَّبَّانِيُّ الَّذِي يُرَبِّي النَّاسَ بِصِغَارِ العِلْمِ قَبْلَ كِبَارِهِ "
بَابُ مَا كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَخَوَّلُهُمْ بِالْمَوْعِظَةِ وَالعِلْمِ كَيْ لاَ يَنْفِرُوا
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يُوسُفَ، قَالَ أَخْبَرَنَا سُفْيَانُ، عَنِ الأَعْمَشِ، عَنْ أَبِي وَائِلٍ، عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَتَخَوَّلُنَا بِالْمَوْعِظَةِ فِي الأَيَّامِ، كَرَاهَةَ السَّآمَةِ عَلَيْنَا.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করার জন্য উপযুক্ত সময়ের সন্ধান করতেন- আমাদের বিরক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কায়)। يَتَخَوَّلُنَا শব্দটিকে তিনভাবে পড়া হয়েছে। এক তো خ এর সঙ্গে, এখানে যেমনটা আছে। দ্বিতীয় হল خ এর পরিবর্তে ح এর সঙ্গে يَتَحَوَّلُنَا । আর তৃতীয় হল خ এর সঙ্গেই, তবে শেষে ل এর স্থানে ن অর্থাৎ ا يَتَخَوَّنُنَا

يَتَحَوَّلُ এর মাসদার হল التَّحَوُّلُ। এর অর্থ تَفَقّدُ الْأَحْوَالِ । অর্থাৎ তিনি তাদের অবস্থা খতিয়ে দেখতেন। যখন তাদের মধ্যে উপদেশ শোনার আগ্রহ-উদ্দীপনা থাকত, তখন উপদেশ দিতেন। তবে তারা যাতে বিরক্ত হয়ে না পড়ে, সেজন্য খুব লম্বা-চওড়া নসীহত করতেন না।

يَتَخَوَّنُ এর মাসদার হল اَلتَّخَوُّنُ। এর অর্থও اَلتَّعَهدُ। ইমাম আসমা‘ঈ রহ, শব্দটিকে এভাবেই পড়তেন। মাজমা'উল গারাইব গ্রন্থে আছে, ইমাম আসমা'ঈ রহ. বলেন, আমার ধারণা শব্দটি হবে يَتَخَوَّلُ) يَتَخَوَّنُ নয়)। একবার ইমাম আ‘মাশ রহ. এ হাদীছটি يَتَخَوَّلُ এর সঙ্গে বর্ণনা করলে আবূ আমর ইবনুল ‘আলা রহ. আপত্তি করেন এবং বলেন, শব্দটি হবে يَتَخَوَّنُ। কিন্তু হাদীছটি তিনি তাঁর উস্তাযবর্গের নিকট যেহেতু এভাবেই শুনেছেন, তাই তিনি সে আপত্তি গ্রহণ করেননি। প্রকৃতপক্ষে উভয় শব্দই সহীহ। তবে সাধারণভাবে এটি يَتَخَوَّلُ রূপেই বেশি বর্ণিত।

يَتَخَوَّلُ এর মাসদার (ক্রিয়ামূল) হল اَلتَّخَوُّلُ। এর অর্থ اَلتَّعَهدُ (লক্ষ রাখা, যত্ন নেওয়া, পরিচর্যা করা, তদারকি করা, পরিচালনা করা, সম্পাদন করা)। বলা হয়, خَالَ المَالَ 'সে তার সম্পদের পরিচর্যা করল এবং তার উত্তম বন্দোবস্ত করল'। সুতরাং শব্দটি দ্বারা এ হাদীছে বোঝানো হচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের প্রতি লক্ষ রাখতেন। তাদের দীনী জীবন গঠনের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন। তিনি তাদের উত্তম পরিচালনা করতেন। সে হিসেবে শিক্ষাদান ও উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি লক্ষ রাখতেন যাতে তা দ্বারা তাদেরকে উত্তমরূপে গঠন করা যায়। আর সে লক্ষ্যে তিনি প্রতিদিন শিক্ষাদান করতেন না এবং উপর্যুপরি উপদেশও দিতেন না। বরং সময়-সুযোগ ও পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ রাখতেন এবং যখন যা শিক্ষা দেওয়ার বা যখন যে উপদেশ দেওয়ার তা দিতেন।

এটা প্রতিদিন করলে এ আশঙ্কা ছিল যে, তারা বিরক্ত হয়ে পড়বেন। ফলে আগ্রহের সঙ্গে তা গ্রহণ করবেন না। আর এতে করে তাদেরকে উত্তমরূপে গড়ে তোলার যে উদ্দেশ্য ছিল তাও সফল হবে না। উল্টো শুধু শুধুই তাদেরকে কষ্ট দেওয়া হবে। একজন মহান শিক্ষকরূপে তিনি তা পসন্দ করতেন না। কুরআন মাজীদে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-
عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
‘তোমাদের যে-কোনও কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।’ (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২৮)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহ না হারায়, সেদিকে লক্ষ রাখাও একজন শিক্ষকের দায়িত্ব। সুতরাং যে আচরণ ও কর্মপন্থা তাদের উৎসাহ ক্ষুণ্ণ করতে পারে, শিক্ষককে অবশ্যই তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

খ. শ্রোতা যতটুকু বুঝতে ও মনে রাখতে সক্ষম হবে, সেদিকে লক্ষ রেখেই ওয়াজ-নসীহত করা উচিত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন