আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৮১- খবরে ওয়াহিদের প্রামাণিকতা
হাদীস নং: ৬৭৫২
আন্তর্জাতিক নং: ৭২৪৬
৩০৬৮. সত্যবাদী বর্ণনাকারীর খবরে ওয়াহিদ আযান, নামায, রোযা ইত্যাদী যাবতীয় ফরয ও অন্যান্য আহকামের বিষয়ে গ্রহণযোগ্য।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ “তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বহির্গত হয় না কেন? যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয় (৯ঃ ১২২)।
طَائِفَة শব্দটি এক ব্যক্তিকেও বলা যায়। কেননা আল্লাহ তাআলার বাণীঃ মু’মিনদের দুই দল দ্বন্ধে লিপ্ত হলে ......... (৪৯ঃ ৯)। অতএব যদি দুই ব্যক্তি দ্বন্ধে লিপ্ত হয় তবে তা এ আয়াতের অর্থের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ যদি কোন পাপাচারী তোমাদের কাছে কোন বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত না কর ...... (৪৯ঃ ৬)।
নবী (ﷺ) কিরূপে তার আমীরদের পর্যায়ক্রমে একজনের পর একজনকে পাঠাতেন, যেন তাদের কেউ ভুল করলে তাকে সুন্নতের দিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ “তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বহির্গত হয় না কেন? যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয় (৯ঃ ১২২)।
طَائِفَة শব্দটি এক ব্যক্তিকেও বলা যায়। কেননা আল্লাহ তাআলার বাণীঃ মু’মিনদের দুই দল দ্বন্ধে লিপ্ত হলে ......... (৪৯ঃ ৯)। অতএব যদি দুই ব্যক্তি দ্বন্ধে লিপ্ত হয় তবে তা এ আয়াতের অর্থের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ যদি কোন পাপাচারী তোমাদের কাছে কোন বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত না কর ...... (৪৯ঃ ৬)।
নবী (ﷺ) কিরূপে তার আমীরদের পর্যায়ক্রমে একজনের পর একজনকে পাঠাতেন, যেন তাদের কেউ ভুল করলে তাকে সুন্নতের দিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
৬৭৫২। মুহাম্মাদ ইবনে মুসান্না (রাহঃ) ......... মালিক ইবনে হুওয়ায়রিস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী (ﷺ) এর কাছে এলাম। আমাদের সকলেই সমবয়সী যুবক ছিলাম। আমরা বিশ রাত পর্যন্ত তাঁর কাছে অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি যখন অনুমান করতে পারলেন যে, আমরা আমাদের স্ত্রী-পরিজনের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েছি, কিংবা আসক্ত হয়ে পড়েছি। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, আমরা বাড়িতে কাদেরকে রেখে এসেছি। আমরা তাকে অবহিত করলাম। তিনি বললেনঃ তোমরা তোমাদের পরিজনের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের মাঝে অবস্থান কর, আর তাদেরকে (দ্বীন) শিক্ষা দিও। আর তাদের নির্দেশ দিও। তিনি (মালিক) কতিপয় বিষয়ের উল্লেখ করেছিলেন, যা আমি স্মরণ রেখেছি বা রাখতে পারিনি। (নবী (ﷺ) আরো বলেছিলেন) তোমরা আমাকে যেভাবে নামায আদায় করতে দেখেছ সেভাবে নামায আদায় কর। যখন নামাযের সময় উপস্থিত হয়, তখন যেন তোমাদের কোন একজন তোমাদের উদ্দেশ্যে আযান দেয়, আর তোমাদের মধ্যে যে বড় সে যেন তোমাদের ইমামতি করে।
كِتَابُ أَخْبَارِ الآحَادِ بَابُ مَا جَاءَ فِي إِجَازَةِ خَبَرِ الوَاحِدِ الصَّدُوقِ فِي الأَذَانِ وَالصَّلاَةِ وَالصَّوْمِ وَالفَرَائِضِ وَالأَحْكَامِ وَقَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى: {فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ} [التوبة: 122] ، «وَيُسَمَّى الرَّجُلُ طَائِفَةً لِقَوْلِهِ تَعَالَى» : {وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ المُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا} [الحجرات: 9] ، «فَلَوِ اقْتَتَلَ رَجُلاَنِ دَخَلَ فِي مَعْنَى الآيَةِ» ، وَقَوْلُهُ تَعَالَى: {إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا} ، «وَكَيْفَ بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُمَرَاءَهُ وَاحِدًا بَعْدَ وَاحِدٍ، فَإِنْ سَهَا أَحَدٌ مِنْهُمْ رُدَّ إِلَى السُّنَّةِ»
7246 - حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ المُثَنَّى، حَدَّثَنَا عَبْدُ الوَهَّابِ، حَدَّثَنَا أَيُّوبُ، عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ، حَدَّثَنَا مَالِكُ بْنُ الحُوَيْرِثِ، قَالَ: أَتَيْنَا النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ شَبَبَةٌ مُتَقَارِبُونَ، فَأَقَمْنَا عِنْدَهُ عِشْرِينَ لَيْلَةً، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفِيقًا، فَلَمَّا ظَنَّ أَنَّا قَدِ اشْتَهَيْنَا أَهْلَنَا - أَوْ قَدِ اشْتَقْنَا - سَأَلَنَا عَمَّنْ تَرَكْنَا بَعْدَنَا فَأَخْبَرْنَاهُ [ص:87]، قَالَ: «ارْجِعُوا إِلَى أَهْلِيكُمْ، فَأَقِيمُوا فِيهِمْ، وَعَلِّمُوهُمْ وَمُرُوهُمْ، - وَذَكَرَ أَشْيَاءَ أَحْفَظُهَا أَوْ لاَ أَحْفَظُهَا، - وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত মালিক ইবনুল হুওয়ায়রিছ রাযি. তাঁর কাছাকাছি বয়সের একদল যুবকসহ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে টানা বিশ দিন অবস্থান করেন। এ সময়ে তারা কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন। তাঁর সাহচর্যে থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাঁকে কেমন দেখেছেন, সে সম্পর্কে হযরত মালিক রাযি. বলেন-
وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ رَحِيمًا رَفِيقًا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও কোমল চরিত্রের)। তিনি ছিলেন রহমাতুল লিল-আলামীন। সমস্ত মাখলুকের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম দয়ামায়া। তাঁর মন ছিল অত্যন্ত কোমল। অন্যের দুঃখ তাঁকে পীড়া দিত। তাঁর কোনও কাজে কেউ যাতে কষ্ট না পায় সেদিকে তো লক্ষ রাখতেনই, সেইসঙ্গে কেউ অন্যের দ্বারা কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলে সর্বদা তার সে কষ্টও নিবারণের চেষ্টা করতেন। কুরআনে তাঁর দয়ামায়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে-
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ (128)
‘(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যে-কোনও কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।’ (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২৮)
হযরত মালিক রাযি. ও তাঁর সঙ্গীগণ ছিলেন যুবক। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অন্তরে বাড়ির প্রতি টান ছিল। একাধারে বিশ দিন বাইরে থাকায় বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠার কথা। কোমলপ্রাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা উপলব্ধি করতে পারলেন। তাই তাদের কাছে তাদের বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। বাড়িতে কে কে আছে তাও জেনে নিলেন। তিনি ভাবলেন এখন তাদের বাড়িতে যেতে দেওয়া উচিত। এর অতিরিক্ত থাকাটা তাদের পক্ষে কষ্টকর হবে। তবে তাদের সে যাওয়াটা যাতে কেবল মনের টানে পার্থিব যাওয়াই না হয়; বরং এর সঙ্গে দীনী চেতনা ও দীনী দায়িত্ব পালনের ইচ্ছাও সক্রিয় থাকে, সে লক্ষ্যে বললেন-
اِرْجِعُوْا إِلَى أَهْلِيْكُمْ، فَأَقِيمُوا فِيهِمْ، وَعَلِّمُوْهُمْ وَمُرُوهُمْ তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাও। তাদের মধ্যে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষাদান করো। তাদেরকে (দীনের উপর চলতে) আদেশ করো'। এর মধ্যে কয়েকটি হুকুম রয়েছে। এক তো হল তাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাওয়ার হুকুম। এ হুকুম দ্বারা তাদের পারিবারিক বন্ধনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার স্বভাবগত ব্যাকুলতার মূল্যায়ন করা হয়েছে। এমন নয় যে, আমার কাছে ফিরে এসেছ, এ অবস্থায় আবার পরিবার-পরিজনের কথা মনে করা কেন? ওসব ছেড়ে-ছুঁড়ে দিয়ে আমার এখানেই পড়ে থাকো! না, পরিবারব্যবস্থাকে খাটো করা, পারিবারিক জীবনযাপনের স্বভাবগত চাহিদাকে উপেক্ষা করা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের নবী তাঁর অনুসারীদেরকে পার্থিব সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাঁর দাসত্বের শেকল গলায় পরার আহ্বান জানান না। বরং প্রাকৃতিক চাহিদাজনিত সকল বন্ধনকে সুন্দর ও সুসংহত করার শিক্ষা দেন। ফলে তারা সেসকল বন্ধনের মাধুর্যে প্লাবিত হয়ে জীবনের সম্ভাবনাসমূহকে উৎকর্ষমণ্ডিত করে তোলার অনুপ্রেরণা পায়। এভাবে তারা বুঝতে পারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা কী অমূল্য ধন। এ অনুভূতিতে তারা তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা ও গোলামীর শেকল আপনিই আপন গলায় তুলে নেয়।
দ্বিতীয় হুকুম হল- তোমরা পরিবারের মধ্যেই অবস্থান করো। অর্থাৎ পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করো। উপার্জনের জন্য বাইরে যাবে। উপার্জন শেষে ঘরে ফিরে আসবে। বাইরে যাওয়ার আরও বিভিন্ন অজুহাত থাকতে পারে। কিন্তু শেষটায় আপন ঘরই হবে ফেরার জায়গা। অহেতুক বাইরে ঘোরাফেরা করবে না। বাইরের প্রয়োজন সমাধার পর অবশিষ্ট সবটা সময় পরিবারকেই দেবে এবং তাদের প্রতি তোমার যেসকল যিম্মাদারী ও দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা পালনে সচেষ্ট থাকবে।
তৃতীয় হুকুম হল- তাদেরকে শিক্ষাদান করবে। অর্থাৎ আমার এখানে থেকে দীনের যে শিক্ষালাভ করলে, তাদেরকে তা শেখাবে। এটা পরিবারের কর্তার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। যে উলামার সাহচর্যে থেকে দীনের শিক্ষালাভ করবে। তারপর বাড়িতে এসে স্ত্রী ও সন্তানদের তা শেখাবে। পরিবারের সদস্যদেরকে দীনের শিক্ষাদান করা পরিবারের কর্তার দীনী দায়িত্ব। এ দায়িত্বে তার অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই।
চতুর্থ হুকুম হল দীনের শিক্ষা অনুযায়ী তারা যাতে আমল করে, তাদেরকে সে আদেশ করা। অর্থাৎ তাদের দীনী তরবিয়াত করা। দীনের শিক্ষা দিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। শিক্ষা অনুযায়ী আমলের অনুশীলন করানোও জরুরি। ইসলামের শিক্ষা কেবল পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য নয়। বরং তার মূল উদ্দেশ্য জীবনগঠন। তাই শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের জীবনাচরণে যাতে তা প্রতিফলিত হয়ে ওঠে, তার তত্ত্বাবধানও করতে হবে।
ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে নামায সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নামাযের বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত নির্দেশনা দান করেছেন। বলে দিয়েছেন কোন নামায কখন পড়তে হবে, নামায পড়তে হবে জামাতের সঙ্গে, এর জন্য আযান দিতে হবে, একজন ইমামত করবে, তবে যে-কেউ নয়; সবচে' যে বেশি উপযুক্ত সে, সবাই সমান উপযুক্ত হলে বয়সে যে সবার বড় সে ইমাম হবে। তিনি এককথায় বলে দিয়েছেন- তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছ, সেভাবে নামায পড়বে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দয়া ও কোমলতা ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ গুণ। আমাদেরকেও এ গুণ অর্জন করতে হবে।
খ. পরিবারের প্রতি টান থাকা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এটা দোষের নয়। বরং এটা না থাকাই দোষের।
গ. মানুষের স্বভাবগত আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে।
ঘ. পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করাও ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
ঙ. পরিবারকে সময় দেওয়া চাই। বাইরে বেহুদা সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
চ. পরিবারের সদস্যদেরকে দীন শেখানো ও তাদের জীবনে দীনী শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
ছ. নামায যাতে সুন্নত মোতাবেক হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ رَحِيمًا رَفِيقًا (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও কোমল চরিত্রের)। তিনি ছিলেন রহমাতুল লিল-আলামীন। সমস্ত মাখলুকের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম দয়ামায়া। তাঁর মন ছিল অত্যন্ত কোমল। অন্যের দুঃখ তাঁকে পীড়া দিত। তাঁর কোনও কাজে কেউ যাতে কষ্ট না পায় সেদিকে তো লক্ষ রাখতেনই, সেইসঙ্গে কেউ অন্যের দ্বারা কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হলে সর্বদা তার সে কষ্টও নিবারণের চেষ্টা করতেন। কুরআনে তাঁর দয়ামায়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে-
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ (128)
‘(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যে-কোনও কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।’ (সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২৮)
হযরত মালিক রাযি. ও তাঁর সঙ্গীগণ ছিলেন যুবক। স্বাভাবিকভাবেই তাদের অন্তরে বাড়ির প্রতি টান ছিল। একাধারে বিশ দিন বাইরে থাকায় বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠার কথা। কোমলপ্রাণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা উপলব্ধি করতে পারলেন। তাই তাদের কাছে তাদের বাড়ির খোঁজখবর নিলেন। বাড়িতে কে কে আছে তাও জেনে নিলেন। তিনি ভাবলেন এখন তাদের বাড়িতে যেতে দেওয়া উচিত। এর অতিরিক্ত থাকাটা তাদের পক্ষে কষ্টকর হবে। তবে তাদের সে যাওয়াটা যাতে কেবল মনের টানে পার্থিব যাওয়াই না হয়; বরং এর সঙ্গে দীনী চেতনা ও দীনী দায়িত্ব পালনের ইচ্ছাও সক্রিয় থাকে, সে লক্ষ্যে বললেন-
اِرْجِعُوْا إِلَى أَهْلِيْكُمْ، فَأَقِيمُوا فِيهِمْ، وَعَلِّمُوْهُمْ وَمُرُوهُمْ তোমরা তোমাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাও। তাদের মধ্যে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষাদান করো। তাদেরকে (দীনের উপর চলতে) আদেশ করো'। এর মধ্যে কয়েকটি হুকুম রয়েছে। এক তো হল তাদের পরিবারবর্গের কাছে ফিরে যাওয়ার হুকুম। এ হুকুম দ্বারা তাদের পারিবারিক বন্ধনের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার স্বভাবগত ব্যাকুলতার মূল্যায়ন করা হয়েছে। এমন নয় যে, আমার কাছে ফিরে এসেছ, এ অবস্থায় আবার পরিবার-পরিজনের কথা মনে করা কেন? ওসব ছেড়ে-ছুঁড়ে দিয়ে আমার এখানেই পড়ে থাকো! না, পরিবারব্যবস্থাকে খাটো করা, পারিবারিক জীবনযাপনের স্বভাবগত চাহিদাকে উপেক্ষা করা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের নবী তাঁর অনুসারীদেরকে পার্থিব সকল বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাঁর দাসত্বের শেকল গলায় পরার আহ্বান জানান না। বরং প্রাকৃতিক চাহিদাজনিত সকল বন্ধনকে সুন্দর ও সুসংহত করার শিক্ষা দেন। ফলে তারা সেসকল বন্ধনের মাধুর্যে প্লাবিত হয়ে জীবনের সম্ভাবনাসমূহকে উৎকর্ষমণ্ডিত করে তোলার অনুপ্রেরণা পায়। এভাবে তারা বুঝতে পারে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা কী অমূল্য ধন। এ অনুভূতিতে তারা তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা ও গোলামীর শেকল আপনিই আপন গলায় তুলে নেয়।
দ্বিতীয় হুকুম হল- তোমরা পরিবারের মধ্যেই অবস্থান করো। অর্থাৎ পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করো। উপার্জনের জন্য বাইরে যাবে। উপার্জন শেষে ঘরে ফিরে আসবে। বাইরে যাওয়ার আরও বিভিন্ন অজুহাত থাকতে পারে। কিন্তু শেষটায় আপন ঘরই হবে ফেরার জায়গা। অহেতুক বাইরে ঘোরাফেরা করবে না। বাইরের প্রয়োজন সমাধার পর অবশিষ্ট সবটা সময় পরিবারকেই দেবে এবং তাদের প্রতি তোমার যেসকল যিম্মাদারী ও দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা পালনে সচেষ্ট থাকবে।
তৃতীয় হুকুম হল- তাদেরকে শিক্ষাদান করবে। অর্থাৎ আমার এখানে থেকে দীনের যে শিক্ষালাভ করলে, তাদেরকে তা শেখাবে। এটা পরিবারের কর্তার অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। যে উলামার সাহচর্যে থেকে দীনের শিক্ষালাভ করবে। তারপর বাড়িতে এসে স্ত্রী ও সন্তানদের তা শেখাবে। পরিবারের সদস্যদেরকে দীনের শিক্ষাদান করা পরিবারের কর্তার দীনী দায়িত্ব। এ দায়িত্বে তার অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই।
চতুর্থ হুকুম হল দীনের শিক্ষা অনুযায়ী তারা যাতে আমল করে, তাদেরকে সে আদেশ করা। অর্থাৎ তাদের দীনী তরবিয়াত করা। দীনের শিক্ষা দিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। শিক্ষা অনুযায়ী আমলের অনুশীলন করানোও জরুরি। ইসলামের শিক্ষা কেবল পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য নয়। বরং তার মূল উদ্দেশ্য জীবনগঠন। তাই শিক্ষাদানের পাশাপাশি তাদের জীবনাচরণে যাতে তা প্রতিফলিত হয়ে ওঠে, তার তত্ত্বাবধানও করতে হবে।
ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে নামায সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নামাযের বিষয়ে কিছুটা বিস্তারিত নির্দেশনা দান করেছেন। বলে দিয়েছেন কোন নামায কখন পড়তে হবে, নামায পড়তে হবে জামাতের সঙ্গে, এর জন্য আযান দিতে হবে, একজন ইমামত করবে, তবে যে-কেউ নয়; সবচে' যে বেশি উপযুক্ত সে, সবাই সমান উপযুক্ত হলে বয়সে যে সবার বড় সে ইমাম হবে। তিনি এককথায় বলে দিয়েছেন- তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখেছ, সেভাবে নামায পড়বে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দয়া ও কোমলতা ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ গুণ। আমাদেরকেও এ গুণ অর্জন করতে হবে।
খ. পরিবারের প্রতি টান থাকা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এটা দোষের নয়। বরং এটা না থাকাই দোষের।
গ. মানুষের স্বভাবগত আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে।
ঘ. পারিবারিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করাও ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
ঙ. পরিবারকে সময় দেওয়া চাই। বাইরে বেহুদা সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
চ. পরিবারের সদস্যদেরকে দীন শেখানো ও তাদের জীবনে দীনী শিক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
ছ. নামায যাতে সুন্নত মোতাবেক হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
