আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৭৯- আহকাম (রাষ্ট্রনীতি) অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৬৮৫
আন্তর্জাতিক নং: ৭১৭৩
৩০২৭. প্রশাসকের দাওয়াত কবুল করা।
উসমান (রাযিঃ) মুগীরা ইবনে শু'বা (রাযিঃ) এর গোলামের দাওয়াত কবুল করেছিলেন।
উসমান (রাযিঃ) মুগীরা ইবনে শু'বা (রাযিঃ) এর গোলামের দাওয়াত কবুল করেছিলেন।
৬৬৮৫। মুসাদ্দাদ (রাহঃ) ......... আবু মুসা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ বন্দীদের মুক্ত কর, আর দাওয়াতকারীর দাওয়াত কবুল কর।
بَابُ إِجَابَةِ الحَاكِمِ الدَّعْوَةَ وَقَدْ أَجَابَ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ عَبْدًا لِلْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ
7173 - حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، عَنْ سُفْيَانَ، حَدَّثَنِي مَنْصُورٌ، عَنْ أَبِي وَائِلٍ، عَنْ أَبِي مُوسَى، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «فُكُّوا العَانِيَ وَأَجِيبُوا الدَّاعِيَ»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
বন্দীদের মুক্তিদান করা সম্পর্কে
বন্দী বিভিন্ন রকম হতে পারে। এক তো সেই বন্দী, যে অমুসলিমদের হাতে আটক রয়েছে। তাকে অর্থের বিনিময়ে বা বন্দীমুক্তির বিনিময়ে কিংবা অন্য কোনও পন্থায় মুক্ত করে আনা একান্ত কর্তব্য। এটা মুসলিম রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যে-কোনও উপায়ে এ দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। এর জন্য জিহাদের প্রয়োজন হলেও রাষ্ট্র তা থেকে পিছপা হবে না। হযরত উমর রাযি. বলেন, কাফেরদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা আমার কাছে সমগ্র জাযীরাতুল আরব অপেক্ষাও বেশি প্রিয়।
আরেক হল দাস-দাসী। অর্থাৎ যেসকল যুদ্ধবন্দী মুসলমানদের নিকট দাস- দাসীরূপে অবস্থান করছে। তাদেরকে মুক্তিদান করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। ইসলাম নানা পন্থায় দাসমুক্তির কাজে উৎসাহ প্রদান করেছে।
তৃতীয় প্রকার বন্দী হল দেনার দায়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। দেনা পরিশোধ করতে অক্ষম হওয়ায় আদালত যে দেনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কারাদণ্ড দিয়েছে, সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কর্তব্য দেনা পরিশোধ করে তার মুক্তির ব্যবস্থা করা।
চতুর্থ প্রকার বন্দী হল জুলুম ও অবিচারের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। এরূপ বন্দীগণ মজলুম হওয়ায় তাদের মুক্তিলাভের জন্য চেষ্টা করা ঈমানের দাবি। এই সকল প্রকার বন্দীকেই মুক্ত করা এ হাদীছের আদেশের অন্তর্ভুক্ত। মৌলিকভাবে তো এটা রাষ্ট্ররই কর্তব্য। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
انَّ عَلَى الْمُسْلِمِينَ فِي فَيْئِهِمْ أَنْ يُفَادُوا أَسِيرَهُمْ وَيُؤَدُّوا عَنْ غَارِمِهِمْ
'মুসলিমদের কর্তব্য তাদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তাদের বন্দীদের মুক্ত করা এবং তাদের ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করা’।
(সুনানে সা'ঈদ ইবন মানসূর: ২৮২১)
রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন না করলে জনগণকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এটা তাদের ঈমানী কর্তব্য। এটা অনেক বড় ছাওয়াবেরও কাজ বটে। কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি জোর উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ (12) فَكُّ رَقَبَةٍ (13) أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ (14) يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ (15) أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ (16)
'তুমি কি জান সে ঘাঁটি কী? (তা হচ্ছে কারও) গর্দানকে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করা অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যদান করা কোনও এতিম আত্মীয়কে অথবা এমন কোনও মিসকীনকে, যে ধুলোমাটিতে গড়াগড়ি খায়’। (সূরা বালাদ, আয়াত ১২-১৬)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
أيما رجل أعتق امرأ مسلما، استنقذ الله بكل عضو منه عضوا منه من النار
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তা'আলা তার প্রত্যেক অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রত্যেক অঙ্গ জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবেন’।
(সহীহ বুখারী : ২৫১৭; সহীহ মুসলিম : ১৫০৯; জামে তিরমিযী: ১৫৪৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৪৮৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ২৫২২; সুনানে সা'ঈদ ইবন মানসূর: ২৪২১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১২৬৩২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৭২০; শুআবুল ঈমান: ৪০২৯)
যে ব্যক্তি বন্দীজীবন যাপন করে, তার কষ্ট দুঃসহ। বর্তমানকালে পৃথিবীর কারাগারসমূহে বন্দীদের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হয়, তাতে কোনও ঈমানদারের প্রাণ না কেঁদে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করছে। দুনিয়ার শক্তিমানেরা তাদের দুর্বল প্রতিপক্ষকে অন্যায়ভাবে কারাগারে শাস্তিভোগ করাচ্ছে। স্বৈরশাসকদের জুলুম- নিপীড়নের শিকার হয়ে কত অসহায় মানুষ কারাপ্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরছে। তাদের জন্য প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের অপরিহার্য করণীয় রয়েছে। যে-কোনও মূল্যে তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্ত করা মুসলিমদের ঈমানী দায়িত্ব। ঈমানী চেতনাসমৃদ্ধ কোনও ব্যক্তি তাদেরকে জালেম নিপীড়কদের হাতে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرب يَوْمِ الْقِيَامَةِ
'এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে (শত্রুর হাতে অসহায়ভাবে) পরিত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনকে সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন’।
দাওয়াত কবুল করা
এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের আরেকটি হক হচ্ছে দাওয়াত কবুল করা। এর আক্ষরিক অর্থ ডাকে সাড়া দেওয়া। ডাকে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক। আরবীতে এর দ্বারা সাধারণত অনুষ্ঠানের দাওয়াত বোঝায়। তবে কেউ যদি কাউকে কোনও প্রয়োজনে ডাকে, তা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ডাকা হোক বা অন্য কোনও সাহায্যের প্রয়োজনে ডাকা হোক, তবে যাকে ডাকা হয় তার কর্তব্য সে ডাকে সাড়া দেওয়া এবং নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করা। এটাও এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের হক, যেমন পেছনে একাধিক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
আরেক হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ডাকা অর্থাৎ দাওয়াত করা। হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ শব্দের সেই অর্থই গ্রহণ করেছেন। কেউ যদি কাউকে বৈধ দাওয়াতে অংশগ্রহণের অনুরোধ করে, তবে তা কবুল করা উচিত। এর দ্বারা পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয়। দুই মুমিনের মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এটা জান্নাত লাভের উপায়। জান্নাত লাভ করা মুমিনদের পরম লক্ষ্য।যে দাওয়াতগ্রহণ তা লাভের পক্ষে সহায়ক হয়, তা কবুল করতে কুণ্ঠাবোধ করা উচিত নয়। এ হাদীছে তো দাওয়ার কবুলকে মুমিন ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إذا دعي أحدكم إلى الوليمة فليأتها 'কাউকে যদি ওলীমার দাওয়াত দেওয়া হয়, তবে সে যেন তাতে আসে।[১২]
নির্দোষ দাওয়াত কবুল না করাটা অপরাধ। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ومن دعي إلى وليمة فلم يجب فقد عصى الله ورسوله 'যে ব্যক্তিকে ওলীমায় দাওয়াত দেওয়া হয় আর সে তা কবুল না করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল।[১৩]
অবশ্য দাওয়াত কবুল করা জরুরি কেবল তখনই, যখন তাতে আপত্তিকর কিছু না থাকে। যদি তাতে আপত্তিকর কিছু থাকে অথবা দাওয়াতটাই কোনও অবৈধ উপলক্ষ্যে হয়, তখন তা কবুল করা জরুরি নয়।।
ইদানীংকার অধিকাংশ দাওয়াতই এমন, যাতে যাওয়ার পরিবেশ থাকে না। সুন্নত দাওয়াতকেও নানারকম পাপাচারে পঙ্কিল করে ফেলা হয়েছে। ওলীমার দাওয়াত সুন্নত। কিন্তু আজকাল অধিকাংশ ওলীমার অনুষ্ঠান সহীহ পন্থায় হয় না।তাতে গানবাদ্য থাকে, পর্দার পরিবর্তে থাকে পর্দাহীনতার প্রতিযোগিতা, নারী-পুরুষ একই জায়গায় বসে খাওয়া-দাওয়া করা হয়, থাকে উপহারের প্রদর্শনী ও উপহার লেনদেনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা, এছাড়াও নানারকম অনুচিত উপসর্গ। দীনদার ব্যক্তির এ জাতীয় দাওয়াতে যাওয়ার কোনও উপায় থাকে না। তাদের বরং না যাওয়াই উচিত। হাঁ, যদি সেখানে গিয়ে আপত্তিকর বিষয়গুলো অপসারণ করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে ভিন্ন কথা। আগেও এরকম শর্ত দেওয়া যেতে পারে যে, অনুষ্ঠানে আপত্তিকর কিছু করা চলবে না। তারপর যাওয়ার পর যদি দেখা যায় যথাযথভাবে কথা রাখা হয়নি, তবে কোনওকিছুর পরওয়া না করে ফিরে আসবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ছবিযুক্ত পর্দা দেখে নিজ ঘরেই ঢোকা হতে বিরত থেকেছিলেন। একবার মেয়ে-জামাতা হযরত ফাতিমা রাযি. ও হযরত আলী রাযি.-এর বাড়ি থেকেও ফিরে এসেছিলেন। একবার হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. এক দাওয়াতে গিয়ে দেখতে পান দেওয়ালে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন অর্থের এ অপচয়, এ কারণে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। তাঁরা আমাদের আদর্শ। তাঁদের পথে চলাতেই সঠিক সমাজগঠন ও সমাজ সংস্কারে সফলতা নির্ভর করে।
সাম্প্রতিক দাওয়াতসমূহের আরও একটি বড় দোষ হচ্ছে গরীব-ধনীর ভেদাভেদ করা। অনেকেই গরীব আত্মীয় বা গরীব প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করে থাকে। তারা তাদের অনুষ্ঠানসমূহে অনাত্মীয় ধনী বন্ধু-বান্ধবকে তো দাওয়াত করে, কিন্তু গরীব আত্মীয় ও গরীব প্রতিবেশীর কথা মনে করে না। এ জাতীয় অনুষ্ঠান অতি নিকৃষ্ট। এর খানাদানায় বরকত থাকে না। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ- بئس الطعام طعام الوليمة يدعى إليها الأغنياء ويترك الفقراء ‘অতি নিকৃষ্ট খাবার সে ওলীমার খাবার, যাতে ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়, গরীবদের ত্যাগ করা হয়।[১৪]
সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই; বরং একদেহতুল্য, তখন গরীব-ধনী ভেদাভেদ করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। এ প্রভেদ একরকম বর্ণবাদ ও জাহিলিয়াত। আলোর ধর্ম ইসলামের অনুসারীদেরকে এরকম জাহিলী ভেদনীতি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. অমুসলিম রাষ্ট্রে বন্দী থাকা মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিককে মুক্ত করা এবং যে-কোনও স্থানে বিনা অপরাধে আটক ব্যক্তিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া চাই। এটা ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব। দাস-দাসীকে মুক্তিদান করাও অতি বড় ছাওয়াবের কাজ।
খ. দাওয়াত কবুল করা এবং অন্যের ডাকে সাড়া দেওয়াও একটি হক, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
বন্দী বিভিন্ন রকম হতে পারে। এক তো সেই বন্দী, যে অমুসলিমদের হাতে আটক রয়েছে। তাকে অর্থের বিনিময়ে বা বন্দীমুক্তির বিনিময়ে কিংবা অন্য কোনও পন্থায় মুক্ত করে আনা একান্ত কর্তব্য। এটা মুসলিম রাষ্ট্রের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যে-কোনও উপায়ে এ দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। এর জন্য জিহাদের প্রয়োজন হলেও রাষ্ট্র তা থেকে পিছপা হবে না। হযরত উমর রাযি. বলেন, কাফেরদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করা আমার কাছে সমগ্র জাযীরাতুল আরব অপেক্ষাও বেশি প্রিয়।
আরেক হল দাস-দাসী। অর্থাৎ যেসকল যুদ্ধবন্দী মুসলমানদের নিকট দাস- দাসীরূপে অবস্থান করছে। তাদেরকে মুক্তিদান করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। ইসলাম নানা পন্থায় দাসমুক্তির কাজে উৎসাহ প্রদান করেছে।
তৃতীয় প্রকার বন্দী হল দেনার দায়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। দেনা পরিশোধ করতে অক্ষম হওয়ায় আদালত যে দেনাগ্রস্ত ব্যক্তিকে কারাদণ্ড দিয়েছে, সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কর্তব্য দেনা পরিশোধ করে তার মুক্তির ব্যবস্থা করা।
চতুর্থ প্রকার বন্দী হল জুলুম ও অবিচারের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। এরূপ বন্দীগণ মজলুম হওয়ায় তাদের মুক্তিলাভের জন্য চেষ্টা করা ঈমানের দাবি। এই সকল প্রকার বন্দীকেই মুক্ত করা এ হাদীছের আদেশের অন্তর্ভুক্ত। মৌলিকভাবে তো এটা রাষ্ট্ররই কর্তব্য। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
انَّ عَلَى الْمُسْلِمِينَ فِي فَيْئِهِمْ أَنْ يُفَادُوا أَسِيرَهُمْ وَيُؤَدُّوا عَنْ غَارِمِهِمْ
'মুসলিমদের কর্তব্য তাদের রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তাদের বন্দীদের মুক্ত করা এবং তাদের ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ করা’।
(সুনানে সা'ঈদ ইবন মানসূর: ২৮২১)
রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন না করলে জনগণকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এটা তাদের ঈমানী কর্তব্য। এটা অনেক বড় ছাওয়াবেরও কাজ বটে। কুরআন ও হাদীছে এর প্রতি জোর উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ (12) فَكُّ رَقَبَةٍ (13) أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ (14) يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ (15) أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ (16)
'তুমি কি জান সে ঘাঁটি কী? (তা হচ্ছে কারও) গর্দানকে (দাসত্ব থেকে) মুক্ত করা অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যদান করা কোনও এতিম আত্মীয়কে অথবা এমন কোনও মিসকীনকে, যে ধুলোমাটিতে গড়াগড়ি খায়’। (সূরা বালাদ, আয়াত ১২-১৬)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে ইরশাদ করেন-
أيما رجل أعتق امرأ مسلما، استنقذ الله بكل عضو منه عضوا منه من النار
'যে ব্যক্তি কোনও মুসলিম ব্যক্তিকে মুক্তিদান করে, আল্লাহ তা'আলা তার প্রত্যেক অঙ্গের বিনিময়ে তার প্রত্যেক অঙ্গ জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবেন’।
(সহীহ বুখারী : ২৫১৭; সহীহ মুসলিম : ১৫০৯; জামে তিরমিযী: ১৫৪৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা : ৪৮৫৬; সুনানে ইবন মাজাহ : ২৫২২; সুনানে সা'ঈদ ইবন মানসূর: ২৪২১; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ১২৬৩২; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার : ৭২০; শুআবুল ঈমান: ৪০২৯)
যে ব্যক্তি বন্দীজীবন যাপন করে, তার কষ্ট দুঃসহ। বর্তমানকালে পৃথিবীর কারাগারসমূহে বন্দীদের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হয়, তাতে কোনও ঈমানদারের প্রাণ না কেঁদে পারে না। পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করছে। দুনিয়ার শক্তিমানেরা তাদের দুর্বল প্রতিপক্ষকে অন্যায়ভাবে কারাগারে শাস্তিভোগ করাচ্ছে। স্বৈরশাসকদের জুলুম- নিপীড়নের শিকার হয়ে কত অসহায় মানুষ কারাপ্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরছে। তাদের জন্য প্রকৃত মুমিন-মুসলিমদের অপরিহার্য করণীয় রয়েছে। যে-কোনও মূল্যে তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্ত করা মুসলিমদের ঈমানী দায়িত্ব। ঈমানী চেতনাসমৃদ্ধ কোনও ব্যক্তি তাদেরকে জালেম নিপীড়কদের হাতে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرب يَوْمِ الْقِيَامَةِ
'এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করবে না এবং তাকে (শত্রুর হাতে অসহায়ভাবে) পরিত্যাগ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনকে সমাধায় রত থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন সমাধা করতে থাকেন। যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমের কোনও একটি বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দেবেন’।
দাওয়াত কবুল করা
এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের আরেকটি হক হচ্ছে দাওয়াত কবুল করা। এর আক্ষরিক অর্থ ডাকে সাড়া দেওয়া। ডাকে সাড়া দেওয়ার বিষয়টি ব্যাপক। আরবীতে এর দ্বারা সাধারণত অনুষ্ঠানের দাওয়াত বোঝায়। তবে কেউ যদি কাউকে কোনও প্রয়োজনে ডাকে, তা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ডাকা হোক বা অন্য কোনও সাহায্যের প্রয়োজনে ডাকা হোক, তবে যাকে ডাকা হয় তার কর্তব্য সে ডাকে সাড়া দেওয়া এবং নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করা। এটাও এক মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের হক, যেমন পেছনে একাধিক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
আরেক হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ডাকা অর্থাৎ দাওয়াত করা। হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ শব্দের সেই অর্থই গ্রহণ করেছেন। কেউ যদি কাউকে বৈধ দাওয়াতে অংশগ্রহণের অনুরোধ করে, তবে তা কবুল করা উচিত। এর দ্বারা পরস্পরে মহব্বত সৃষ্টি হয়। দুই মুমিনের মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এটা জান্নাত লাভের উপায়। জান্নাত লাভ করা মুমিনদের পরম লক্ষ্য।যে দাওয়াতগ্রহণ তা লাভের পক্ষে সহায়ক হয়, তা কবুল করতে কুণ্ঠাবোধ করা উচিত নয়। এ হাদীছে তো দাওয়ার কবুলকে মুমিন ব্যক্তির হক বলা হয়েছে। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- إذا دعي أحدكم إلى الوليمة فليأتها 'কাউকে যদি ওলীমার দাওয়াত দেওয়া হয়, তবে সে যেন তাতে আসে।[১২]
নির্দোষ দাওয়াত কবুল না করাটা অপরাধ। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ومن دعي إلى وليمة فلم يجب فقد عصى الله ورسوله 'যে ব্যক্তিকে ওলীমায় দাওয়াত দেওয়া হয় আর সে তা কবুল না করে, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল।[১৩]
অবশ্য দাওয়াত কবুল করা জরুরি কেবল তখনই, যখন তাতে আপত্তিকর কিছু না থাকে। যদি তাতে আপত্তিকর কিছু থাকে অথবা দাওয়াতটাই কোনও অবৈধ উপলক্ষ্যে হয়, তখন তা কবুল করা জরুরি নয়।।
ইদানীংকার অধিকাংশ দাওয়াতই এমন, যাতে যাওয়ার পরিবেশ থাকে না। সুন্নত দাওয়াতকেও নানারকম পাপাচারে পঙ্কিল করে ফেলা হয়েছে। ওলীমার দাওয়াত সুন্নত। কিন্তু আজকাল অধিকাংশ ওলীমার অনুষ্ঠান সহীহ পন্থায় হয় না।তাতে গানবাদ্য থাকে, পর্দার পরিবর্তে থাকে পর্দাহীনতার প্রতিযোগিতা, নারী-পুরুষ একই জায়গায় বসে খাওয়া-দাওয়া করা হয়, থাকে উপহারের প্রদর্শনী ও উপহার লেনদেনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা, এছাড়াও নানারকম অনুচিত উপসর্গ। দীনদার ব্যক্তির এ জাতীয় দাওয়াতে যাওয়ার কোনও উপায় থাকে না। তাদের বরং না যাওয়াই উচিত। হাঁ, যদি সেখানে গিয়ে আপত্তিকর বিষয়গুলো অপসারণ করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে ভিন্ন কথা। আগেও এরকম শর্ত দেওয়া যেতে পারে যে, অনুষ্ঠানে আপত্তিকর কিছু করা চলবে না। তারপর যাওয়ার পর যদি দেখা যায় যথাযথভাবে কথা রাখা হয়নি, তবে কোনওকিছুর পরওয়া না করে ফিরে আসবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ছবিযুক্ত পর্দা দেখে নিজ ঘরেই ঢোকা হতে বিরত থেকেছিলেন। একবার মেয়ে-জামাতা হযরত ফাতিমা রাযি. ও হযরত আলী রাযি.-এর বাড়ি থেকেও ফিরে এসেছিলেন। একবার হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. এক দাওয়াতে গিয়ে দেখতে পান দেওয়ালে পর্দা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন অর্থের এ অপচয়, এ কারণে তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। তাঁরা আমাদের আদর্শ। তাঁদের পথে চলাতেই সঠিক সমাজগঠন ও সমাজ সংস্কারে সফলতা নির্ভর করে।
সাম্প্রতিক দাওয়াতসমূহের আরও একটি বড় দোষ হচ্ছে গরীব-ধনীর ভেদাভেদ করা। অনেকেই গরীব আত্মীয় বা গরীব প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করে থাকে। তারা তাদের অনুষ্ঠানসমূহে অনাত্মীয় ধনী বন্ধু-বান্ধবকে তো দাওয়াত করে, কিন্তু গরীব আত্মীয় ও গরীব প্রতিবেশীর কথা মনে করে না। এ জাতীয় অনুষ্ঠান অতি নিকৃষ্ট। এর খানাদানায় বরকত থাকে না। এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ- بئس الطعام طعام الوليمة يدعى إليها الأغنياء ويترك الفقراء ‘অতি নিকৃষ্ট খাবার সে ওলীমার খাবার, যাতে ধনীদের দাওয়াত দেওয়া হয়, গরীবদের ত্যাগ করা হয়।[১৪]
সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই; বরং একদেহতুল্য, তখন গরীব-ধনী ভেদাভেদ করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। এ প্রভেদ একরকম বর্ণবাদ ও জাহিলিয়াত। আলোর ধর্ম ইসলামের অনুসারীদেরকে এরকম জাহিলী ভেদনীতি থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. অমুসলিম রাষ্ট্রে বন্দী থাকা মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিককে মুক্ত করা এবং যে-কোনও স্থানে বিনা অপরাধে আটক ব্যক্তিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া চাই। এটা ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব। দাস-দাসীকে মুক্তিদান করাও অতি বড় ছাওয়াবের কাজ।
খ. দাওয়াত কবুল করা এবং অন্যের ডাকে সাড়া দেওয়াও একটি হক, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: