আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৯- আযান-ইকামতের অধ্যায়
৬৫২। মুআয ইবনে আসাদ (রাহঃ) ......... ইতবান ইবনে মালিক আনসারী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) (আমার ঘরে প্রবেশের) অনুমতি চাইলেন। আমি তাঁকে অনুমতি দিলাম। তিনি বললেনঃ তোমার ঘরের কোন জায়গাটি আমার নামায আদায়ের জন্য তুমি পছন্দ কর? আমি আমার পছন্দ মত একটি স্থান ইশারা করে দেখালাম। তিনি সেখানে নামাযের জন্য দাঁড়ালেন, আমরা তাঁর পিছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালাম। এরপর তিনি সালাম ফিরালেন এবং আমরা সালাম ফিরালাম।
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো। وعن عِتْبَانَ بن مالك – رضي الله عنه – وَهُوَ مِمَّن شَهِدَ بَدرًا، قَالَ: كنت أُصَلِّي لِقَوْمِي بَني سَالِم، وَكَانَ يَحُولُ بَيْنِي وبَيْنَهُمْ وَادٍ إِذَا جَاءتِ الأَمْطَار، فَيَشُقُّ عَلَيَّ اجْتِيَازُهُ قِبَلَ مَسْجِدِهم، فَجِئتُ رسولَ الله – صلى الله عليه وسلم – فقلت لَهُ: إنّي أَنْكَرْتُ بَصَرِي وَإنَّ الوَادِي الَّذِي بَيْنِي وبَيْنَ قَومِي يَسيلُ إِذَا جَاءتِ الأمْطَارُ فَيَشُقُّ عَلَيَّ اجْتِيَازُهُ فَوَدِدْتُ أنَّكَ تَأتِي فَتُصَلِّي في بَيْتِي مَكَانًا أتَّخِذُهُ مُصَلّى، فَقَالَ رَسُول الله – صلى الله عليه وسلم: «سَأفْعَلُ» فَغَدَا رسولُ الله – صلى الله عليه وسلم – وَأَبُو بكر – رضي الله عنه – بَعْدَ مَا اشْتَدَّ النَّهَارُ، وَاسْتَأذَنَ رَسُول الله – صلى الله عليه وسلم – فَأذِنْتُ لَهُ، فَلَمْ يَجْلِسْ حَتَّى قَالَ: «أيْنَ تُحِبُّ أَنْ أُصَلِّيَ مِنْ بَيْتِكَ؟» فَأشَرْتُ لَهُ إِلَى المَكَانِ الَّذِي أُحبُّ أَنْ يُصَلِّيَ فِيهِ، فَقَامَ رَسُول الله – صلى الله عليه وسلم – فَكَبَّرَ وَصَفَفْنَا وَرَاءَهُ فَصَلَّى رَكعَتَينِ ثُمَّ سَلَّمَ وَسَلَّمْنَا حِينَ سَلَّمَ فَحَبَسْتُهُ عَلَى خَزيرَةٍ تُصْنَعُ لَهُ، فَسَمِعَ أهلُ الدَّارِ أنَّ رَسُول الله – صلى الله عليه وسلم – في بَيْتِي فَثَابَ رِجالٌ مِنْهُمْ حَتَّى كَثُرَ الرِّجَالُ في البَيْتِ، فَقَالَ رَجُلٌ: مَا فَعَلَ مَالِكٌ لا أرَاهُ! فَقَالَ رَجُلٌ: ذلِكَ مُنَافِقٌ لا يُحِبُّ الله ورسولَهُ، فَقَالَ رَسُول الله – صلى الله عليه وسلم: «لا تَقُلْ ذلِكَ، ألاَ تَرَاهُ قَالَ: لا إلهَ إلاَّ الله يَبْتَغي بذَلِكَ وَجهَ الله تَعَالَى» فَقَالَ: اللهُ ورسُولُهُ أعْلَمُ أمَّا نَحْنُ فَوَاللهِ مَا نَرَى وُدَّهُ وَلاَ حَدِيثَهُ إلاَّ إِلَى المُنَافِقينَ! فَقَالَ رَسُول الله – صلى الله عليه وسلم: «فإنَّ الله قَدْ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إلهَ إلاَّ الله يَبْتَغِي بذَلِكَ وَجْهَ الله». হযরত ইতবান ইবনে মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, –তিনি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একজন– তিনি বলেন, আমি আমার গোত্র বনু সালিমের নামাযে ইমামত করতাম। যখন বৃষ্টি হতো, আমার ও তাদের মাঝখানে একটি উপত্যকা প্রতিবন্ধক হয়ে যেত। ফলে আমার পক্ষে তা অতিক্রম করে তাদের মসজিদে যাওয়া কঠিন হয়ে যেত। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললাম যে, আমার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেয়েছে। ওদিকে আমার ও আমার গোত্রের মাঝখানে যে উপত্যকাটি আছে সেটি বৃষ্টি আসলে প্লাবিত হয়ে যায়। ফলে আমার পক্ষে সেটি অতিক্রম করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আমার একান্ত কামনা, আপনি এসে আমার ঘরের একটি জায়গায় নামায পড়বেন, যে স্থানটিকে আমি মুসল্লা (নামাযের স্থান) বানিয়ে নেব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এটা করছি। পরদিন বেলা হবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবূ বকর রাযি. চলে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। আমি তাঁকে অনুমতি দিলাম। কিন্তু তিনি বসলেন না। বললেন, আমি তোমার ঘরের কোন জায়গায় নামায পড়ব বলে তুমি পসন্দ কর? আমি ইঙ্গিতে সে জায়গাটি দেখিয়ে দিলাম, যেখানে তাঁর নামায পড়া আমার পসন্দ ছিল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন। তিনি তাকবীর বললেন। আমরা তাঁর পেছনে কাতারবদ্ধ হলাম। তিনি দু' রাক'আত নামায পড়লেন। তারপর সালাম ফেরালেন। তিনি যখন সালাম ফেরালেন, আমরাও সালাম ফেরালাম। তারপর আমরা তাঁর জন্য তৈরি করা খাযীরা (এক প্রকার খাদ্য)–এর জন্য তাঁকে আটকালাম। ওদিকে মহল্লার লোকেরা শুনতে পেল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে। অমনি তারা ছুটে আসল। ফলে আমার ঘরে প্রচুর লোক জমা হয়ে গেল। তখন এক ব্যক্তি বলল, মালিক কোথায়, তাকে যে দেখছি না? অপর এক ব্যক্তি বলল, সে তো একটা মুনাফিক। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমনটা বলো না। তুমি দেখছ না সে বলে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই, যা দ্বারা সে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনা করে? লোকটি বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তবে আল্লাহর কসম! আমরা তো মুনাফিকদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও তাদের সঙ্গেই তাকে কথাবার্তা বলতে দেখি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই; যা দ্বারা সে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেন। হাদীসের ব্যাখ্যাঃ হযরত ইতবান ইবন মালিক রাযি. নিজ গোত্র বনূ সালিমের মসজিদের ইমাম ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শেষদিকে তিনি পরিপূর্ণ অন্ধই হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনকার কথা এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর বাড়ি থেকে মসজিদে আসতে একটি উপত্যকা পার হতে হতো। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢলে উপত্যকা ভরে যেত। ফলে তাঁর পক্ষে সেটি পার হয়ে মসজিদে আসা সম্ভব হতো না, যেমনটা তিনি এ হাদীছে বর্ণনা করেছেন। তিনি চাচ্ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাড়িতে এসে নির্দিষ্ট একটি স্থানে নামায পড়লে তিনি বরকতস্বরূপ সে স্থানটিকে নিজ নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করতেন। তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এর জন্য অনুরোধ করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেন। একদিন তিনি সূর্যোদয়ের পর বেলা চড়ে আসলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসেন। পরে হযরত উমর ফারূক রাযি.-ও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। দিনটি ছিল শনিবার। তিনি হযরত ইতবান রাযি.-এর দেখানো স্থানে সকলকে নিয়ে দু' রাক'আত নামায আদায় করেন। তারপর তাঁর সামনে খাযীরা পেশ করা হয়। খাযীরা হল আটার সঙ্গে চর্বি মিশিয়ে তৈরি করা এক প্রকার খাদ্য। তিনি তা খেয়ে নেন। ইত্যবসরে মহল্লায় তাঁর আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন জমা হয়ে যায়। হযরত মালিক ইবন দুখশুম রাযি. এ গোত্রেরই একজন সাহাবী। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তাঁকে দেখা না যাওয়ায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। কেউ একজন তাঁকে মুনাফিকও বলে বসে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেন যে, তিনি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্যই কালেমায়ে তায়্যিবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে থাকেন। এটা তাঁর মুমিন হওয়ার দলীল। এক বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে মন্তব্যকারীর প্রতিবাদ করেছিলেন যে, সে কি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি? ইবন ইসহাক রহ. তার মাগাযী গ্রন্থে এ কথাও বর্ণনা করেছেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মালিক ইবন দুখশুম ও মা'ন ইবন 'আদী রাযি.-কে মুনাফিকদের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ- মসজিদে যিরার ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা সেটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এটাও তাঁর খাঁটি মুমিন হওয়া ও মুনাফিকী থেকে মুক্ত থাকার প্রমাণ বহন করে। যারা তাঁকে মুনাফিক বলে মন্তব্য করেছিলেন তারা এর কারণ দেখিয়েছিলেন এই যে, তাঁকে মুনাফিকদের সঙ্গে উঠাবসা করতে দেখা যায়। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেখানো এ কারণটিকে তাঁর মুনাফিকীর দলীলরূপে গ্রহণ করেননি। সম্ভবত তাদের সঙ্গে তাঁর উঠাবসা করার বিশেষ কোনও কারণ ছিল। সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালেমায়ে তায়্যিবার ফযীলত বয়ান করেছেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এটা পাঠ করে, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এ ঘোষণা দান করে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেন। এ হারাম হওয়ার অর্থ ওই ব্যক্তির কবীরা গুনাহ না থাকলে জাহান্নামে আদৌ যাবে না। যদি কবীরা গুনাহ থাকে এবং আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করে দেন, তখনও সে জাহান্নামে যাবে না। আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা না করলে নির্দিষ্ট মেয়াদে শাস্তিভোগ করার পর সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। এ কালেমার কারণে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকতে হবে না। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কারও বিশেষ ওজর থাকলে সে মসজিদে না গিয়ে ফরয নামায নিজ ঘরেও আদায় করতে পারে। খ. তাবাররুকের ধারণা ইসলামবিরোধী নয়। তাবাররুক হিসেবেই হযরত ইতবান ইবন মালিক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায আদায়ের স্থানকে নিজের জন্য নামাযের স্থানরূপে গ্রহণ করেছিলেন। গ. কারও বাড়িতে বিশেষ কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির শুভাগমন হলে মহল্লার লোকজনের উচিত তার সঙ্গে দেখা করতে আসা এবং কিছুক্ষণ তার সাহচর্যে কাটানো। বাড়িওয়ালারও উচিত তাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া। ঘ. অকাট্য কারণ ছাড়া কালেমা পাঠকারী কোনও ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা উচিত নয়। কেননা দিলের খবর আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কেউ জানে না। ঙ. সঙ্গত কারণ ছাড়া কাফের-মুশরিক ও ফাসেক-ফাজেরদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা উচিত না। তাতে অন্যদের মনে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হতে দেওয়া সমীচীন নয়। চ. আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যে ব্যক্তি কালেমা পাঠ করে আর এ অবস্থায় মারা যায়, জাহান্নামের স্থায়ী শাস্তি তার জন্য নয়।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন