মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)
২. ঈমান ও ইসলামের বর্ণনা
হাদীস নং: ৬৩
আন্তর্জাতিক নং: ৮৫৪৪
(৯) পরিচ্ছেদঃ কালেমা শাহাদতদ্বয় উচ্চারণকারীর হুকুম, তাদেরকে হত্যা করা নিষেধ করে এবং যে এতদুভয় কালেমা উচ্চারণ করেই মুসলিম হয় এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করবে
(৬৩) তাঁর (আবূ হুরায়রা) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেন, আমাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা বলবে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এবং সালাত কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে (এগুলো করলে পর) তাদের রক্ত (জীবন) ও সম্পদ (আমাদের জন্য ) হারাম হয়ে যাবে এবং তাদের (সত্যিকার) হিসাব আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দায়িত্বে। (বুখারী ও মুসলিম)
(9) باب في حكم الاقرار بالشهادتين وانهما تعصمان قائلهما من القتل وبهما يكون مسلما ويدخل الجنة
(63) وعنه في أخرى قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أمرت أن أقاتل الناس حتى يقوقلوا لا اله الا الله محمد رسول الله ويقيموا الصلاة ويؤتوا الزكاة ثم قد
حرم علي دمائهم وأموالهم وحسابهم على الله عز وجل
حرم علي دمائهم وأموالهم وحسابهم على الله عز وجل
হাদীসের ব্যাখ্যা:
ইসলাম দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়। ইসলাম হলো আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূল বলে সাক্ষ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে দীন ও শরীআত নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করে নেওয়া। যে ব্যক্তি মুখে এটা স্বীকার করে নেয় সে-ই মুসলিম। যদি অন্তরে এর প্রতি বিশ্বাস না থাকে, সে মুনাফিক। তবে কার মনে বিশ্বাস আছে আর কার মনে বিশ্বাস নেই তা আল্লাহ তাআলা ছাড়া কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এ হিসেবে কাউকে মুনাফিক সাব্যস্ত করা সম্ভবও নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় কিছু সংখ্যক লোক মুনাফিক ছিল। তাঁকে ওহীর মাধ্যমে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল। তাই ইতিহাসে তারা মুনাফিকরূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু এখন যেহেতু ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ, তাই এখন বাস্তবিকপক্ষে কেউ মুনাফিক হলেও কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। দুনিয়ার বিচারে এখন মানুষ কেবল দু'প্রকার হয় মুসলিম নয়তো কাফের। সুতরাং বাহ্যিকভাবে যাকে মুসলিম মনে হবে, তাকে মুসলিমই গণ্য করতে হবে। আর বাহ্যিকভাবে যাকে কাফের মনে হবে, তাকে কাফেরই গণ্য করা হবে।
এমনিভাবে মুসলিম ব্যক্তির বাহ্যিক আমল ভালো হলে তাকে নেককার গণ্য করা হবে। তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ করা যাবে না। আবার বাহ্যিকভাবে পাপাচারে লিপ্ত থাকলে তাকে ফাসেক বলা হবে। মন ভালোর দোহাই দিয়ে তার পাপাচারকে উপেক্ষা করা হবে না। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে, কারা জান-মালের নিরাপত্তা পাবে এবং ইসলাম গ্রহণের পর কোনও কারণে কাউকে হত্যা করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে মৌলিক নির্দেশনা দান করেছেন। প্রথমে ইরশাদ করেন- মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাকে আদেশ করেছেন, যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না আবার জিযিয়াও দেবে না, তাদের সঙ্গে যেন আমি যুদ্ধ করি।
“আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই ও মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল' কথাটি ইসলামগ্রহণের বাণী। আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথাটি ঘোষণা করার দ্বারা অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সে মুসলিম বলে গণ্য হয়। এ কথা ঘোষণা করার অপরিহার্য দাবি হলো মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু নিয়ে এসেছেন তা সব সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং তিনি যে শরীআত পেশ করেছেন তা পালন করা। এ কারণেই কেবল এ ঘোষণার দ্বারাই জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয় না; বরং এর সঙ্গে নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াও শর্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের বিধান মানবে না, সরকার তাকে তা মানতে বাধ্য করবে। যদি অবিশ্বাস করে তবে তো মুরতাদই হয়ে যাবে। ফলে মুরতাদের শাস্তি হিসেবে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। আর যদি নামায ও যাকাত ফরয বলে বিশ্বাস করে কিন্তু পালন না করে, তবে মুরতাদ হবে না বটে, কিন্তু সরকার এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। যদি সংঘবদ্ধ কোনও দল নামায, যাকাত ইত্যাদি ফরয বিধান পালন করতে না চায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে, যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. যাকাত দিতে অস্বীকারকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
শরীআতের জরুরি বিধানসমূহ মেনে নেওয়া সহকারে ইসলামের ঘোষণা দিলে জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। সুতরাং হাদীছের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে-
(যখন তারা তা করবে তখন তারা নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা পাবে)। অর্থাৎ তারা যদি কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে এবং শরীআত মেনে নেয়, তবে তারা তাদের জান-মাল নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় তাদের রক্তপাত করা ও তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়।
যেসকল কারণে মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়
এমন কিছু অপরাধ আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তিও তাতে লিপ্ত হলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তার উপর মৃত্যুদন্ড আরোপিত হবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তবে ইসলামের হক (এর বিষয়টি) ব্যতিক্রম'। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে—কালেমায়ে শাহাদাতের 'হক'-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম উভয় বর্ণনার মর্ম একই। অর্থাৎ কেউ যদি কালেমায়ে শাহাদাত তথা ইসলামের হক নষ্ট করে, তবে তার জান ও মালের নিরাপত্তা থাকবে না। কালেমায়ে শাহাদাতের সে হক হলো তিনটি— ক. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা; খ. ব্যভিচার না করা। এবং গ. মুরতাদ না হওয়া। ইসলাম গ্রহণের পরে মুরতাদ হয়ে গেলে অথবা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে কিংবা কোনও বিবাহিত মুসলিম ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أمرْتُ أنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لا إله إلا الله، فإذا قَالُوْهَا عَصَمُوا مِن دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقَّهَا قِبْلَ: وَمَا حَقَّهَا؟ قَالَ: زنى بَعْدَ إِحْصَانِ، أَوْ كُفْرٌ بَعْدَ إِسلام أَوْ قَتْلُ نَفْسٍ فَيُقْتَلُ بِهِ
'আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা বলে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। যখন তারা এটা বলবে, আমার পক্ষ হতে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। তবে এ কালেমার হক-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম। জিজ্ঞেস করা হলো, এর হক কী? তিনি বললেন, বিবাহের পর ব্যভিচার, ইসলাম গ্রহণের পর কুফর এবং কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা। এ অপরাধের কারণে কতলের শাস্তি দেওয়া হবে।৩২৭
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يَحِلُّ دَمُ امْرِي مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لا إلهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ، إِلَّا بِإِحْدَى ثَلاثِ النفس بالنفس، وَالتَّيْبُ الزَّانِي، وَالْمَارِقُ مِنَ الدِّينِ التارِكُ لِلْجَمَاعَةِ
'যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, এমন মুসলিম ব্যক্তিকে তিনটি কারণের কোনও একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়- বিবাহিত ব্যভিচারকারী (-কে ব্যভিচারের কারণে), প্রাণের বদলে প্রাণ, দীন পরিত্যাগকারী এমন ব্যক্তি, যে মুসলমানদের জামাত পরিত্যাগ করেছে।৩২৮
এই যা বলা হলো, এর সম্পর্ক দুনিয়ার সঙ্গে। অর্থাৎ কেউ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলে এবং ইসলামী শরীআত মেনে নিলে সে তার জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। উপর তাদের বাহ্যিক উপরে বর্ণিত কারণসমূহ ছাড়া অন্য কোনও কারণে তাকে হত্যা করা যাবে না। সে কালেমা পড়েছে খাঁটি মনে না কপট মনে, তা দেখার প্রয়োজন নেই। তা দেখা বান্দার কাজ নয়। সে হিসাব নেবেন আল্লাহ। যেমন হাদীছটির শেষে বলা হয়েছে—(আর তাদের হিসাব আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত)। অর্থাৎ দুনিয়ায় তার বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ীই আচরণ করা হবে। তবে আখেরাতের বিষয়টা আলাদা। সে আখেরাতে মুক্তি পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করে তার ইখলাসের উপর। অর্থাৎ সে যদি খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার ইসলাম গৃহীত হবে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যদি তার অন্তরে মুনাফিকী থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার বাহ্যিক ইসলাম গৃহীত হবে না। ফলে সে মুক্তিও পাবে না। মোটকথা আখেরাতের হিসাব হবে অন্তরের অবস্থা অনুযায়ী। সে হিসাব নেওয়া আল্লাহরই কাজ।
হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় কালেমা পাঠের সঙ্গে শরীআতের বিধানাবলী মেনে নেওয়ার দ্বারা।
খ. বাহ্যিক অবস্থা দ্বারা কাউকে মুমিন-মুসলিম বলে মনে হলেই সে নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। অন্তরে ঈমান আছে কি নেই তা দেখা বান্দার কাজ নয়। বান্দার পক্ষে তা নির্ণয় করা সম্ভবও নয়।
গ. এমন কিছু অপরাধও আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তি যাতে লিপ্ত হলে তার প্রাণের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে অপরাধের শরীআতী শাস্তি হলো হত্যা করা।
৩২৭. আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩২২১
৩২৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৭৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৭৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪০২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪০৪৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৫২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৬৪৯২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৩
এমনিভাবে মুসলিম ব্যক্তির বাহ্যিক আমল ভালো হলে তাকে নেককার গণ্য করা হবে। তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ করা যাবে না। আবার বাহ্যিকভাবে পাপাচারে লিপ্ত থাকলে তাকে ফাসেক বলা হবে। মন ভালোর দোহাই দিয়ে তার পাপাচারকে উপেক্ষা করা হবে না। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে, কারা জান-মালের নিরাপত্তা পাবে এবং ইসলাম গ্রহণের পর কোনও কারণে কাউকে হত্যা করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে মৌলিক নির্দেশনা দান করেছেন। প্রথমে ইরশাদ করেন- মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাকে আদেশ করেছেন, যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না আবার জিযিয়াও দেবে না, তাদের সঙ্গে যেন আমি যুদ্ধ করি।
“আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই ও মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল' কথাটি ইসলামগ্রহণের বাণী। আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথাটি ঘোষণা করার দ্বারা অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সে মুসলিম বলে গণ্য হয়। এ কথা ঘোষণা করার অপরিহার্য দাবি হলো মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু নিয়ে এসেছেন তা সব সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং তিনি যে শরীআত পেশ করেছেন তা পালন করা। এ কারণেই কেবল এ ঘোষণার দ্বারাই জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয় না; বরং এর সঙ্গে নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াও শর্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের বিধান মানবে না, সরকার তাকে তা মানতে বাধ্য করবে। যদি অবিশ্বাস করে তবে তো মুরতাদই হয়ে যাবে। ফলে মুরতাদের শাস্তি হিসেবে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। আর যদি নামায ও যাকাত ফরয বলে বিশ্বাস করে কিন্তু পালন না করে, তবে মুরতাদ হবে না বটে, কিন্তু সরকার এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। যদি সংঘবদ্ধ কোনও দল নামায, যাকাত ইত্যাদি ফরয বিধান পালন করতে না চায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে, যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. যাকাত দিতে অস্বীকারকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
শরীআতের জরুরি বিধানসমূহ মেনে নেওয়া সহকারে ইসলামের ঘোষণা দিলে জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। সুতরাং হাদীছের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে-
(যখন তারা তা করবে তখন তারা নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা পাবে)। অর্থাৎ তারা যদি কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে এবং শরীআত মেনে নেয়, তবে তারা তাদের জান-মাল নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় তাদের রক্তপাত করা ও তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়।
যেসকল কারণে মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়
এমন কিছু অপরাধ আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তিও তাতে লিপ্ত হলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তার উপর মৃত্যুদন্ড আরোপিত হবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তবে ইসলামের হক (এর বিষয়টি) ব্যতিক্রম'। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে—কালেমায়ে শাহাদাতের 'হক'-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম উভয় বর্ণনার মর্ম একই। অর্থাৎ কেউ যদি কালেমায়ে শাহাদাত তথা ইসলামের হক নষ্ট করে, তবে তার জান ও মালের নিরাপত্তা থাকবে না। কালেমায়ে শাহাদাতের সে হক হলো তিনটি— ক. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা; খ. ব্যভিচার না করা। এবং গ. মুরতাদ না হওয়া। ইসলাম গ্রহণের পরে মুরতাদ হয়ে গেলে অথবা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে কিংবা কোনও বিবাহিত মুসলিম ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أمرْتُ أنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لا إله إلا الله، فإذا قَالُوْهَا عَصَمُوا مِن دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقَّهَا قِبْلَ: وَمَا حَقَّهَا؟ قَالَ: زنى بَعْدَ إِحْصَانِ، أَوْ كُفْرٌ بَعْدَ إِسلام أَوْ قَتْلُ نَفْسٍ فَيُقْتَلُ بِهِ
'আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা বলে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। যখন তারা এটা বলবে, আমার পক্ষ হতে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। তবে এ কালেমার হক-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম। জিজ্ঞেস করা হলো, এর হক কী? তিনি বললেন, বিবাহের পর ব্যভিচার, ইসলাম গ্রহণের পর কুফর এবং কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা। এ অপরাধের কারণে কতলের শাস্তি দেওয়া হবে।৩২৭
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يَحِلُّ دَمُ امْرِي مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لا إلهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ، إِلَّا بِإِحْدَى ثَلاثِ النفس بالنفس، وَالتَّيْبُ الزَّانِي، وَالْمَارِقُ مِنَ الدِّينِ التارِكُ لِلْجَمَاعَةِ
'যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, এমন মুসলিম ব্যক্তিকে তিনটি কারণের কোনও একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়- বিবাহিত ব্যভিচারকারী (-কে ব্যভিচারের কারণে), প্রাণের বদলে প্রাণ, দীন পরিত্যাগকারী এমন ব্যক্তি, যে মুসলমানদের জামাত পরিত্যাগ করেছে।৩২৮
এই যা বলা হলো, এর সম্পর্ক দুনিয়ার সঙ্গে। অর্থাৎ কেউ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলে এবং ইসলামী শরীআত মেনে নিলে সে তার জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। উপর তাদের বাহ্যিক উপরে বর্ণিত কারণসমূহ ছাড়া অন্য কোনও কারণে তাকে হত্যা করা যাবে না। সে কালেমা পড়েছে খাঁটি মনে না কপট মনে, তা দেখার প্রয়োজন নেই। তা দেখা বান্দার কাজ নয়। সে হিসাব নেবেন আল্লাহ। যেমন হাদীছটির শেষে বলা হয়েছে—(আর তাদের হিসাব আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত)। অর্থাৎ দুনিয়ায় তার বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ীই আচরণ করা হবে। তবে আখেরাতের বিষয়টা আলাদা। সে আখেরাতে মুক্তি পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করে তার ইখলাসের উপর। অর্থাৎ সে যদি খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার ইসলাম গৃহীত হবে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যদি তার অন্তরে মুনাফিকী থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার বাহ্যিক ইসলাম গৃহীত হবে না। ফলে সে মুক্তিও পাবে না। মোটকথা আখেরাতের হিসাব হবে অন্তরের অবস্থা অনুযায়ী। সে হিসাব নেওয়া আল্লাহরই কাজ।
হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় কালেমা পাঠের সঙ্গে শরীআতের বিধানাবলী মেনে নেওয়ার দ্বারা।
খ. বাহ্যিক অবস্থা দ্বারা কাউকে মুমিন-মুসলিম বলে মনে হলেই সে নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। অন্তরে ঈমান আছে কি নেই তা দেখা বান্দার কাজ নয়। বান্দার পক্ষে তা নির্ণয় করা সম্ভবও নয়।
গ. এমন কিছু অপরাধও আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তি যাতে লিপ্ত হলে তার প্রাণের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে অপরাধের শরীআতী শাস্তি হলো হত্যা করা।
৩২৭. আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩২২১
৩২৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৭৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৭৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪০২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪০৪৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৫২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৬৪৯২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৩
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
