মুসনাদে আহমদ- ইমাম আহমদ রহঃ (আল-ফাতহুর রব্বানী)
৪. ইলমের অধ্যায়
হাদীস নং: ২৩
আন্তর্জাতিক নং: ১২৭৯৬
ইলমের অধ্যায়
(৩) পরিচ্ছেদঃ ইল্ম শিক্ষা দানে উৎসাহ প্রদান এবং শিক্ষকের সম্মান প্রসঙ্গে
(২৩) আনাস ইবন মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণ (একদা) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ), আমরা যখন আপনার সান্নিধ্যে থাকি এবং আপনি আমাদের সাথে কথা-বার্তা বলেন (হাদীস বর্ণনা করেন), তখন আমাদের অন্তঃকরণ বিনম্র থাকে। (কিন্তু) আমরা যখন আপনার দরবার থেকে বের হয়ে যাই, তখন আমরা স্ত্রীলোক ও শিশু সন্তানদের সাথে (কথা-বার্তায়) বিভোর হয়ে যাই, আমরা এই করি, সেই করি (নানাবিধ কাজ-কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং অন্তরের সেই নম্রতা বিদূরিত হয়ে যায়)। তখন নবী করীম (ﷺ) বলেন, যদি তোমরা ঐ সময়ের ন্যায় (আমার সান্নিধ্যে থাকাকালীন সময়ের ন্যায়) সর্বদা থাকতে পারতে, তাহলে ফিরিশতাগণ তোমাদের সাথে মুসাফাহা করতেন, (তোমাদের সম্মানার্থে)।
كتاب العلم
(3) باب الحث على تعليم العلم واداب المعلم
(23) وعن أنس بن مالك رضى الله عنه أن أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم قالوا للنبي صلى الله عليه وسلم إنا إذا كنا عندك فحدثتنا رقت قلوبنا فإذا خرجنا من عندك عافنا (2) النساء والصبيان وفعلنا وفعلنا فقال النبي صلى الله عليه وسلم إن تلك الساعة لو تدومون عليها لصافحتكم الملائكة.
-[في مجالس العلم وادابها واداب المتعلم]-
-[في مجالس العلم وادابها واداب المتعلم]-
হাদীসের ব্যাখ্যা:
তুমি কেমন আছ, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত হানযালা রাযি. বললেন, হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে। তিনি কেন এ কথা বলেছিলেন, নিজেই তার ব্যাখ্যা দেন যে- আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে থাকি আর তিনি আমাদেরকে জান্নাত-জাহান্নামের কথা বলে উপদেশ দেন, তখন মনে হয় যেন নিজ চোখে তা দেখতে পাচ্ছি। তারপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে বের হয়ে আসি এবং স্ত্রী, সন্তানসন্ততি ও জমিজায়েদাদের ঝামেলায় লিপ্ত হই, তখন অনেক কিছুই ভুলে যাই।
এর সারকথা হল, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে থাকা অবস্থায় আমার ঈমানের যে অবস্থা থাকে, বাইরে সে অবস্থা থাকে না। অর্থাৎ যতক্ষণ তাঁর মজলিসে থাকি আর তিনি আমাদের সামনে জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা দেন, ততক্ষণ তো আখিরাতের ধ্যান ও ফিকিরে থাকি। সেই ফিকিরে অন্তরে দেখা দেয় জাহান্নামের তীব্র ভীতি এবং সঞ্চার হয় জান্নাত লাভের বিপুল উৎসাহ। এর ফলে তখন জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস ও ঈমানের অবস্থা এমন মজবুত থাকে, যেন জান্নাত-জাহান্নাম নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। তাঁর মজলিস থেকে চলে আসার পর মনের সে অবস্থা থাকে না। তাঁর মজলিস থেকে চলে আসার পর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও কাজকারবার নিয়ে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন মন এসব পার্থিব বিষয়ে নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে মজলিসের সব কথা মনে জাগ্রত থাকে না আর তাতে ঈমানের ওই হালতও থাকে না। জান্নাত-জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস থাকলেও তা যেন ঠিক চোখে দেখার মত পর্যায়ে থাকে না। ঈমানের এই যে দুই রকম অবস্থা, এটা কি মুনাফিকী? আমার বড় ভয়, মুনাফিক হয়ে গেলাম কি না!
প্রকৃতপক্ষে এটা মুনাফিকী নয়। কেননা মুনাফিকী তো বলা হয় মুখে নিজেকে মু'মিন বলে জাহির করা, কিন্তু আন্তরিকভাবে ঈমান না আনা; বরং অন্তরে কুফর পোষণ করা। তিনি তো এরকম ছিলেন না। তিনি একজন খাঁটি মু'মিন ছিলেন। ঈমানের উচ্চতর স্তরে ছিল তাঁর স্থান। যার ঈমান যত উঁচু, ঈমানের ব্যাপারে তার ভয়ও তত বেশি থাকে। মূলত সে ভয় থেকেই তিনি এ কথা বলেছিলেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করা দরকার ছিল। দুই জায়গায় তাঁর মনের অবস্থা যে দু'রকম হয়, তা যে মোটেই মুনাফিকী নয় এটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন ছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সে ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. হযরত হানযালা রাযি.-এর এ ব্যাখ্যা শুনে বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনেরও তো এই একই অবস্থা। কিন্তু তিনি এ কথা বললেন না যে, তবে কি আমিও মুনাফিক হয়ে গেছি? এ কথা না বলাটা দীন ও ঈমান সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের পরিপূর্ণতার পরিচায়ক। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ঈমানদার। আখিরাতের অবস্থা ও জান্নাত-জাহান্নামের দৃশ্য অন্যদের কাছে যদি নিজ চোখে দেখার মত হয়, তবে তাঁর কাছে সে দেখাটা হবে আরও বেশি স্পষ্ট এবং অধিকতর গভীর। তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিস থেকে আসার পর তিনি যখন ঘর-সংসারের কাজকর্ম করতেন ও পার্থিব বিষয়াবলিতে জড়িত হতেন, তখন মনের অবস্থা ওইরকম থাকত না, যেমনটা থাকত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে, যে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তবুও তিনি মুনাফিক হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন না। কারণ তিনি দুই জায়গার পার্থক্য বোঝেন।
এক হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নুরানী সাহচর্য, যেখানে ওহী নাযিল হয়, দীনের চর্চা হয়, আখিরাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যে মজলিস পার্থিব সব স্থূলতা থেকে মুক্ত, দুনিয়াবী কোনও মলিনতা যাকে স্পর্শ করে না, নফস ও শয়তানের সকল প্ররোচনা ও চাতুর্য যেখানে সম্পূর্ণ অচল এবং ঊর্ধ্বলোকের সফর ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রায় যে মজলিস সদা মুখর। কোনও মু'মিন যতক্ষণ সেখানে হাজির থাকবে, ততক্ষণ যে সে নূরের সাগরে হাবুডুবু খাবে ও পারলৌকিক আবহে অবগাহন করতে থাকবে-এই তো স্বাভাবিক।
আরেক হচ্ছে নববী মজলিসের বাইরের পরিমণ্ডল। নববী মজলিসের বাইরে পা রাখা মাত্রই ফিরে আসা হয় অন্য এক জগতে, যেখানে আছে ঘর-সংসারের ব্যবস্থাপনা, আছে রোজগারের দৌড়ঝাপ, মানুষের সঙ্গে নানামুখী সংশ্লিষ্টতা ও হাজারও রকমের ব্যতিব্যস্ততা। আর সবটার মধ্যে কেবলই স্থূলতা এবং কেবলই অন্ধকার। মানুষ যতক্ষণ এই পরিবেশে থাকবে, ততক্ষণ তার পক্ষে এর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা কখনওই সম্ভব নয়। আগুন-পানি ও মাটি-বাতাসের সৃষ্ট মানুষ এসবের প্রতি আকৃষ্ট হবেই। এর প্রত্যেকটির প্রতি আকর্ষণ তার স্বভাব-প্রকৃতিতেই নিহিত। স্বভাবগত সে আকর্ষণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা কখনওই সম্ভব নয় আর শরী'আত তা করতে বলেওনি। বরং আখিরাতের উৎকর্ষের লক্ষ্যেই স্বভাবগত চাহিদা নির্দিষ্ট মাত্রায় পূরণ করতে বলেছে এবং পূরণ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। পার্থিব বিষয়ে স্বভাবগত চাহিদা পূরণ করা হবে আবার এর স্পর্শ হতে মুক্ত থেকে কোনও ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে আখিরাতের ধ্যান-ফিকিরে ডুবে থাকবে, তা কী করে সম্ভব? সুতরাং দুই জায়গায় দু'রকম অবস্থা হবেই। আর সে পার্থক্য হওয়াটা আদৌ মুনাফিকী নয়। সাংসারিক প্রয়োজন ও পার্থিব কাজকারবার আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি শরী'আতের সীমারেখা রক্ষা করা হয় এবং ঈমানের কোনও দাবি উপেক্ষা করা না হয়, তবে সে তো সাক্ষাৎ ঈমান! তাতে আখিরাতের দৃশ্যাবলি নজরে না-ই আসুক এবং জান্নাত ও জাহান্নামের বিশ্বাস চোখে দেখার মত না-ই হোক।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এ হাকীকত ভালোভাবেই জানতেন। সে কারণেই দুই জায়গায় ঈমানের দুই অবস্থা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও মুনাফিক হয়ে যাওয়ার ধারণা ব্যক্ত করেননি। তবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সশরীরে বিদ্যমান, তাই নিজের পক্ষ থেকে ফয়সালা না দিয়ে হযরত হানযালা রাযি.-কে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়াই সমীচীন বোধ করলেন। সুতরাং তাঁরা দু'জন একত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে হযরত হানযালা রাযি. তাঁর মনের এ অবস্থা প্রকাশ করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই জায়গার পার্থক্য তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন এবং সে পার্থক্যের কারণে তিনি যে মুনাফিক হয়ে যাননি এ বিষয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সেই আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার কাছে থাকা অবস্থায় যেমন থাক, তোমরা যদি সে অবস্থায় এবং আল্লাহর যিকরের সাথে সর্বদা থাকতে, তবে ফিরিশতাগণ তোমাদের সঙ্গে মুসাফাহা করত তোমাদের বিছানায় এবং তোমাদের পথেঘাটে। অর্থাৎ যদি দুটি অবস্থা তোমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ বিদ্যমান থাকত, তবে ফিরিশতাগণ তোমাদেরকে এমন সম্মান করত যে, তোমাদের সঙ্গে তোমাদের বিছানায় এবং পথেঘাটে সর্বত্র মুসাফাহা করত।
সে দুই অবস্থার এক অবস্থা হল- জান্নাত ও জাহান্নামের মুশাহাদা। অর্থাৎ আখিরাতের এমন গভীর ধ্যান, যদ্দরুন জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্যাবলি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দ্বিতীয় অবস্থা হল আল্লাহ তা'আলার সার্বক্ষণিক স্মরণ ও যিকর। অর্থাৎ দুনিয়ায় যা-কিছু করা হবে, আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ রেখে করা হবে; বরং কেবল তাঁর জন্যই করা হবে। আর চোখ দিয়ে যা-কিছু দেখা হবে, তা অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত করবে এবং আল্লাহর জন্যই তা দেখা হবে। এমনকি অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা যে জান্নাত-জাহান্নাম দেখা হবে, সে দেখাও কেবল উপভোগ ও ভীতির জন্য নয়; বরং এজন্য দেখা হবে যে, তার একটি আল্লাহর রহমত এবং অন্যটি তাঁর গযবের স্থান। গযবের স্থান থেকে নাজাত পেয়ে যদি রহমতের স্থানে পৌঁছাঁ যায়, তবে সেখানে আল্লাহ তা'আলার সান্নিধ্য ও দীদার লাভ হবে।
যে ব্যক্তি যিকর ও মুশাহাদা তথা আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর অনুধ্যানের এ স্তরে উপনীত হতে পারে এবং সর্বক্ষণ এ অবস্থায় কাটাতে পারে, তার সব হালই সমান। মসজিদের শান্ত-সমাহিত নূরানী পরিবেশ ও বাজারের কোলাহলপূর্ণ এলোমেলো পরিমণ্ডল সর্বত্র তার ঈমান একইরকম থাকে। এরূপ ঈমানদারের ঈমানে ফারাক আসে না কোনও স্থানে। তার পক্ষে নামাযের মুসল্লাও যা, ঘুমানোর বিছানাও তা। তাই এমনকি বিছানায়ও তার সাথে ফিরিশতা মুসাফাহা করবে বৈ কি। বলাবাহুল্য, এতটা উচ্চতার ঈমান কেবল নবী- রাসূলগণেরই হতে পারে। সুতরাং জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমন ঘটে তাঁদের বিশ্রামস্থলেও। যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর সঙ্গে এক চাদরে শায়িত থাকেন, তখনও তাঁর আগমনে বাধা হয় না। কিন্তু উম্মতের ঈমান তো সে পর্যায়ের হতে পারে না, তা সে যত বড় ঈমানওয়ালাই হোক না কেন।
সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে হানযালা! কখনও এরকম এবং কখনও ওরকম। তিনি এ কথা তিনবার বললেন। অর্থাৎ যখন তুমি আমার মজলিসে থাক, তখন পার্থিব কোনওরকম সংশ্লিষ্টতা না থাকায় তোমার ঈমান তো এই মুশাহাদার স্তরেই থাকবে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম যেন নিজ চোখে দেখতে পাও। আর যখন বাইরের পরিবেশে থাক, তখন পার্থিব কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় ঈমানের সে অবস্থা থাকবে না। তাই বলে এটা মুনাফিকী নয়, যেমন তুমি ভাবছ। পার্থিব কাজকর্মে যতক্ষণ শরী'আতের অনুসারী হয়ে থাকবে, ততক্ষণ তুমি নিঃসন্দেহে মু'মিনই থাকবে এবং তখন মুশাহাদার ব্যাপারটা না থাকলেও শরী'আত মেনে চলার ভেতর দিয়ে তোমার রূহানী উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হতে থাকবে। ফলে ঈমানের যা মুখ্য উদ্দেশ্য, জাহান্নাম থেকে নাজাত ও জান্নাত লাভ, তা তোমার হাসিল হয়ে যাবে। আর জান্নাতে চূড়ান্ত পর্যায়ের মুশাহাদা তথা আল্লাহ তা'আলার দীদার লাভ হয়ে যাবে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মু'মিনের এই পরম কামনার বিষয় আমাদের দান করুন, আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. প্রত্যেক মু'মিনের উচিত নিজ ঈমান সম্পর্কে সতর্ক থাকা, পাছে কোনও কারণে ঈমানের কোনও ক্ষতি হয়ে যায়।
খ পার্থিব কাজকর্ম ও স্বভাবগত চাহিদা পূরণ করা ঈমানের পরিপন্থি কাজ নয়। বরং শরী'আতসম্মত পন্থায় তা পূরণ করা ঈমানেরই দাবি।
গ. কোনও মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তার অবস্থাদি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া উচিত, যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. হযরত হানযালা রাযি.-এর খোঁজখবর নিয়েছেন।
ঘ. মুসলিম ভাইয়ের কোনও সংকট সম্পর্কে জানতে পারলে তা কিভাবে মোচন করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা-ফিকির করা উচিত।
ঙ. কারও সামনে তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের দীনী জটিলতা প্রকাশ পেলে তার উচিত তাকে কোনও বিজ্ঞ লোকের সন্ধান দেওয়া কিংবা নিজেই তাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া।
চ. মুরুব্বীর উচিত তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির চিন্তা ও কাজে ভুল দেখতে পেলে তাকে তা বুঝিয়ে দেওয়া এবং মমতার সাথে তার ইসলাহ করা।
এর সারকথা হল, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে থাকা অবস্থায় আমার ঈমানের যে অবস্থা থাকে, বাইরে সে অবস্থা থাকে না। অর্থাৎ যতক্ষণ তাঁর মজলিসে থাকি আর তিনি আমাদের সামনে জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা দেন, ততক্ষণ তো আখিরাতের ধ্যান ও ফিকিরে থাকি। সেই ফিকিরে অন্তরে দেখা দেয় জাহান্নামের তীব্র ভীতি এবং সঞ্চার হয় জান্নাত লাভের বিপুল উৎসাহ। এর ফলে তখন জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস ও ঈমানের অবস্থা এমন মজবুত থাকে, যেন জান্নাত-জাহান্নাম নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি। তাঁর মজলিস থেকে চলে আসার পর মনের সে অবস্থা থাকে না। তাঁর মজলিস থেকে চলে আসার পর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও কাজকারবার নিয়ে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন মন এসব পার্থিব বিষয়ে নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে মজলিসের সব কথা মনে জাগ্রত থাকে না আর তাতে ঈমানের ওই হালতও থাকে না। জান্নাত-জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস থাকলেও তা যেন ঠিক চোখে দেখার মত পর্যায়ে থাকে না। ঈমানের এই যে দুই রকম অবস্থা, এটা কি মুনাফিকী? আমার বড় ভয়, মুনাফিক হয়ে গেলাম কি না!
প্রকৃতপক্ষে এটা মুনাফিকী নয়। কেননা মুনাফিকী তো বলা হয় মুখে নিজেকে মু'মিন বলে জাহির করা, কিন্তু আন্তরিকভাবে ঈমান না আনা; বরং অন্তরে কুফর পোষণ করা। তিনি তো এরকম ছিলেন না। তিনি একজন খাঁটি মু'মিন ছিলেন। ঈমানের উচ্চতর স্তরে ছিল তাঁর স্থান। যার ঈমান যত উঁচু, ঈমানের ব্যাপারে তার ভয়ও তত বেশি থাকে। মূলত সে ভয় থেকেই তিনি এ কথা বলেছিলেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করা দরকার ছিল। দুই জায়গায় তাঁর মনের অবস্থা যে দু'রকম হয়, তা যে মোটেই মুনাফিকী নয় এটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন ছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সে ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. হযরত হানযালা রাযি.-এর এ ব্যাখ্যা শুনে বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনেরও তো এই একই অবস্থা। কিন্তু তিনি এ কথা বললেন না যে, তবে কি আমিও মুনাফিক হয়ে গেছি? এ কথা না বলাটা দীন ও ঈমান সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের পরিপূর্ণতার পরিচায়ক। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ঈমানদার। আখিরাতের অবস্থা ও জান্নাত-জাহান্নামের দৃশ্য অন্যদের কাছে যদি নিজ চোখে দেখার মত হয়, তবে তাঁর কাছে সে দেখাটা হবে আরও বেশি স্পষ্ট এবং অধিকতর গভীর। তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিস থেকে আসার পর তিনি যখন ঘর-সংসারের কাজকর্ম করতেন ও পার্থিব বিষয়াবলিতে জড়িত হতেন, তখন মনের অবস্থা ওইরকম থাকত না, যেমনটা থাকত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে, যে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। তবুও তিনি মুনাফিক হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন না। কারণ তিনি দুই জায়গার পার্থক্য বোঝেন।
এক হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নুরানী সাহচর্য, যেখানে ওহী নাযিল হয়, দীনের চর্চা হয়, আখিরাতের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যে মজলিস পার্থিব সব স্থূলতা থেকে মুক্ত, দুনিয়াবী কোনও মলিনতা যাকে স্পর্শ করে না, নফস ও শয়তানের সকল প্ররোচনা ও চাতুর্য যেখানে সম্পূর্ণ অচল এবং ঊর্ধ্বলোকের সফর ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রায় যে মজলিস সদা মুখর। কোনও মু'মিন যতক্ষণ সেখানে হাজির থাকবে, ততক্ষণ যে সে নূরের সাগরে হাবুডুবু খাবে ও পারলৌকিক আবহে অবগাহন করতে থাকবে-এই তো স্বাভাবিক।
আরেক হচ্ছে নববী মজলিসের বাইরের পরিমণ্ডল। নববী মজলিসের বাইরে পা রাখা মাত্রই ফিরে আসা হয় অন্য এক জগতে, যেখানে আছে ঘর-সংসারের ব্যবস্থাপনা, আছে রোজগারের দৌড়ঝাপ, মানুষের সঙ্গে নানামুখী সংশ্লিষ্টতা ও হাজারও রকমের ব্যতিব্যস্ততা। আর সবটার মধ্যে কেবলই স্থূলতা এবং কেবলই অন্ধকার। মানুষ যতক্ষণ এই পরিবেশে থাকবে, ততক্ষণ তার পক্ষে এর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা কখনওই সম্ভব নয়। আগুন-পানি ও মাটি-বাতাসের সৃষ্ট মানুষ এসবের প্রতি আকৃষ্ট হবেই। এর প্রত্যেকটির প্রতি আকর্ষণ তার স্বভাব-প্রকৃতিতেই নিহিত। স্বভাবগত সে আকর্ষণকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা কখনওই সম্ভব নয় আর শরী'আত তা করতে বলেওনি। বরং আখিরাতের উৎকর্ষের লক্ষ্যেই স্বভাবগত চাহিদা নির্দিষ্ট মাত্রায় পূরণ করতে বলেছে এবং পূরণ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। পার্থিব বিষয়ে স্বভাবগত চাহিদা পূরণ করা হবে আবার এর স্পর্শ হতে মুক্ত থেকে কোনও ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে আখিরাতের ধ্যান-ফিকিরে ডুবে থাকবে, তা কী করে সম্ভব? সুতরাং দুই জায়গায় দু'রকম অবস্থা হবেই। আর সে পার্থক্য হওয়াটা আদৌ মুনাফিকী নয়। সাংসারিক প্রয়োজন ও পার্থিব কাজকারবার আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি শরী'আতের সীমারেখা রক্ষা করা হয় এবং ঈমানের কোনও দাবি উপেক্ষা করা না হয়, তবে সে তো সাক্ষাৎ ঈমান! তাতে আখিরাতের দৃশ্যাবলি নজরে না-ই আসুক এবং জান্নাত ও জাহান্নামের বিশ্বাস চোখে দেখার মত না-ই হোক।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এ হাকীকত ভালোভাবেই জানতেন। সে কারণেই দুই জায়গায় ঈমানের দুই অবস্থা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও মুনাফিক হয়ে যাওয়ার ধারণা ব্যক্ত করেননি। তবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সশরীরে বিদ্যমান, তাই নিজের পক্ষ থেকে ফয়সালা না দিয়ে হযরত হানযালা রাযি.-কে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়াই সমীচীন বোধ করলেন। সুতরাং তাঁরা দু'জন একত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে হযরত হানযালা রাযি. তাঁর মনের এ অবস্থা প্রকাশ করলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই জায়গার পার্থক্য তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন এবং সে পার্থক্যের কারণে তিনি যে মুনাফিক হয়ে যাননি এ বিষয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সেই আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার কাছে থাকা অবস্থায় যেমন থাক, তোমরা যদি সে অবস্থায় এবং আল্লাহর যিকরের সাথে সর্বদা থাকতে, তবে ফিরিশতাগণ তোমাদের সঙ্গে মুসাফাহা করত তোমাদের বিছানায় এবং তোমাদের পথেঘাটে। অর্থাৎ যদি দুটি অবস্থা তোমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ বিদ্যমান থাকত, তবে ফিরিশতাগণ তোমাদেরকে এমন সম্মান করত যে, তোমাদের সঙ্গে তোমাদের বিছানায় এবং পথেঘাটে সর্বত্র মুসাফাহা করত।
সে দুই অবস্থার এক অবস্থা হল- জান্নাত ও জাহান্নামের মুশাহাদা। অর্থাৎ আখিরাতের এমন গভীর ধ্যান, যদ্দরুন জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্যাবলি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দ্বিতীয় অবস্থা হল আল্লাহ তা'আলার সার্বক্ষণিক স্মরণ ও যিকর। অর্থাৎ দুনিয়ায় যা-কিছু করা হবে, আল্লাহ তা'আলাকে স্মরণ রেখে করা হবে; বরং কেবল তাঁর জন্যই করা হবে। আর চোখ দিয়ে যা-কিছু দেখা হবে, তা অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত করবে এবং আল্লাহর জন্যই তা দেখা হবে। এমনকি অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা যে জান্নাত-জাহান্নাম দেখা হবে, সে দেখাও কেবল উপভোগ ও ভীতির জন্য নয়; বরং এজন্য দেখা হবে যে, তার একটি আল্লাহর রহমত এবং অন্যটি তাঁর গযবের স্থান। গযবের স্থান থেকে নাজাত পেয়ে যদি রহমতের স্থানে পৌঁছাঁ যায়, তবে সেখানে আল্লাহ তা'আলার সান্নিধ্য ও দীদার লাভ হবে।
যে ব্যক্তি যিকর ও মুশাহাদা তথা আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর অনুধ্যানের এ স্তরে উপনীত হতে পারে এবং সর্বক্ষণ এ অবস্থায় কাটাতে পারে, তার সব হালই সমান। মসজিদের শান্ত-সমাহিত নূরানী পরিবেশ ও বাজারের কোলাহলপূর্ণ এলোমেলো পরিমণ্ডল সর্বত্র তার ঈমান একইরকম থাকে। এরূপ ঈমানদারের ঈমানে ফারাক আসে না কোনও স্থানে। তার পক্ষে নামাযের মুসল্লাও যা, ঘুমানোর বিছানাও তা। তাই এমনকি বিছানায়ও তার সাথে ফিরিশতা মুসাফাহা করবে বৈ কি। বলাবাহুল্য, এতটা উচ্চতার ঈমান কেবল নবী- রাসূলগণেরই হতে পারে। সুতরাং জিবরীল আলাইহিস সালামের আগমন ঘটে তাঁদের বিশ্রামস্থলেও। যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর সঙ্গে এক চাদরে শায়িত থাকেন, তখনও তাঁর আগমনে বাধা হয় না। কিন্তু উম্মতের ঈমান তো সে পর্যায়ের হতে পারে না, তা সে যত বড় ঈমানওয়ালাই হোক না কেন।
সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে হানযালা! কখনও এরকম এবং কখনও ওরকম। তিনি এ কথা তিনবার বললেন। অর্থাৎ যখন তুমি আমার মজলিসে থাক, তখন পার্থিব কোনওরকম সংশ্লিষ্টতা না থাকায় তোমার ঈমান তো এই মুশাহাদার স্তরেই থাকবে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম যেন নিজ চোখে দেখতে পাও। আর যখন বাইরের পরিবেশে থাক, তখন পার্থিব কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় ঈমানের সে অবস্থা থাকবে না। তাই বলে এটা মুনাফিকী নয়, যেমন তুমি ভাবছ। পার্থিব কাজকর্মে যতক্ষণ শরী'আতের অনুসারী হয়ে থাকবে, ততক্ষণ তুমি নিঃসন্দেহে মু'মিনই থাকবে এবং তখন মুশাহাদার ব্যাপারটা না থাকলেও শরী'আত মেনে চলার ভেতর দিয়ে তোমার রূহানী উন্নতি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হতে থাকবে। ফলে ঈমানের যা মুখ্য উদ্দেশ্য, জাহান্নাম থেকে নাজাত ও জান্নাত লাভ, তা তোমার হাসিল হয়ে যাবে। আর জান্নাতে চূড়ান্ত পর্যায়ের মুশাহাদা তথা আল্লাহ তা'আলার দীদার লাভ হয়ে যাবে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মু'মিনের এই পরম কামনার বিষয় আমাদের দান করুন, আমীন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. প্রত্যেক মু'মিনের উচিত নিজ ঈমান সম্পর্কে সতর্ক থাকা, পাছে কোনও কারণে ঈমানের কোনও ক্ষতি হয়ে যায়।
খ পার্থিব কাজকর্ম ও স্বভাবগত চাহিদা পূরণ করা ঈমানের পরিপন্থি কাজ নয়। বরং শরী'আতসম্মত পন্থায় তা পূরণ করা ঈমানেরই দাবি।
গ. কোনও মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তার অবস্থাদি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া উচিত, যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. হযরত হানযালা রাযি.-এর খোঁজখবর নিয়েছেন।
ঘ. মুসলিম ভাইয়ের কোনও সংকট সম্পর্কে জানতে পারলে তা কিভাবে মোচন করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা-ফিকির করা উচিত।
ঙ. কারও সামনে তার কোনও মুসলিম ভাইয়ের দীনী জটিলতা প্রকাশ পেলে তার উচিত তাকে কোনও বিজ্ঞ লোকের সন্ধান দেওয়া কিংবা নিজেই তাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া।
চ. মুরুব্বীর উচিত তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির চিন্তা ও কাজে ভুল দেখতে পেলে তাকে তা বুঝিয়ে দেওয়া এবং মমতার সাথে তার ইসলাহ করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)