আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৯- আযান-ইকামতের অধ্যায়
হাদীস নং: ৬৩১
আন্তর্জাতিক নং: ৬৬৪
৪৩১। কী পরিমাণ রোগ থাকা সত্ত্বেও জামাআতে শামিল হওয়া উচিত।
৬৩১। উমর ইবনে হাফস ইবনে গিয়াস (রাহঃ) ......... আসওয়াদ (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা আয়িশা (রাযিঃ) এর কাছে ছিলাম এবং নামাযের পাবন্দী ও উহার তা’যীম সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম। আয়েশা (রাযিঃ) বললেন, নবী (ﷺ) যখন অন্তিম রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন, তখন নামাযের সময় হলে আযান দেওয়া হল। তখন তিনি বললেন, আবু বকরকে লোকদের নিয়ে নামায আদায় করতে বল। তাঁকে বলা হল যে, আবু বকর (রাযিঃ) অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের লোক। তিনি যখন আপনার স্থানে দাঁড়াবেন তখন লোকদের নিয়ে নামায আদায় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবারো সে কথা বললেন এবং তারা আবারো তা-ই বললেন। তৃতীয়বারও তিনি সে কথা বললেন। তিনি আরো বললেনঃ তোমরা ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) এর সাথী মহিলাদের মত। আবু বকরকেই বল, যেন লোকদের নিয়ে নামায আদায় করে নেয়।
আবু বকর (রাযিঃ) এগিয়ে গিয়ে নামায শুরু করলেন। এদিকে নবী (ﷺ) নিজেকে একটু হালকাবোধ করলেন। দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, আমার চোখে এখনও স্পষ্ট ভাসছে। অসুস্থতার কারণে তাঁর দু’পা মাটির উপর দিয়ে হেঁচড়ে যাচ্ছিল। তখন আবু বকর (রাযিঃ) পেছনে সরে আসতে চাইলেন। নবী (ﷺ) তাঁকে স্বস্থানে থাকার জন্য ইঙ্গিত করলেন।
তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে একটু সামনে আনা হল, তিনি আবু বকর (রাযিঃ) এর পাশে বসলেন। আ’মাশ (রাযিঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হলঃ তাহলে নবী (ﷺ) ইমামতি করছিলেন। আবু বকর (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অনুসরণে নামায আদায় করছিলেন এবং লোকেরা আবু বকর (রাযিঃ) এর নামাযের অনুকরণ করছিল? আ’মাশ (রাযিঃ) মাথার ইশারায় বললেন, হ্যাঁ।
আবু দাউদ (রাহঃ) শু’বা (রাহঃ) সূত্রে আ’মাশ (রাযিঃ) থেকে হাদীসের কতকাংশ উল্লেখ করেছেন। আবু মুআবিয়া (রাহঃ) অতিরিক্ত বলেছেন, তিনি আবু বকর (রাযিঃ) এর বাঁ দিকে বসেছিলেন এবং আবু বকর (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন।
আবু বকর (রাযিঃ) এগিয়ে গিয়ে নামায শুরু করলেন। এদিকে নবী (ﷺ) নিজেকে একটু হালকাবোধ করলেন। দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন। আয়িশা (রাযিঃ) বলেন, আমার চোখে এখনও স্পষ্ট ভাসছে। অসুস্থতার কারণে তাঁর দু’পা মাটির উপর দিয়ে হেঁচড়ে যাচ্ছিল। তখন আবু বকর (রাযিঃ) পেছনে সরে আসতে চাইলেন। নবী (ﷺ) তাঁকে স্বস্থানে থাকার জন্য ইঙ্গিত করলেন।
তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে একটু সামনে আনা হল, তিনি আবু বকর (রাযিঃ) এর পাশে বসলেন। আ’মাশ (রাযিঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হলঃ তাহলে নবী (ﷺ) ইমামতি করছিলেন। আবু বকর (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর অনুসরণে নামায আদায় করছিলেন এবং লোকেরা আবু বকর (রাযিঃ) এর নামাযের অনুকরণ করছিল? আ’মাশ (রাযিঃ) মাথার ইশারায় বললেন, হ্যাঁ।
আবু দাউদ (রাহঃ) শু’বা (রাহঃ) সূত্রে আ’মাশ (রাযিঃ) থেকে হাদীসের কতকাংশ উল্লেখ করেছেন। আবু মুআবিয়া (রাহঃ) অতিরিক্ত বলেছেন, তিনি আবু বকর (রাযিঃ) এর বাঁ দিকে বসেছিলেন এবং আবু বকর (রাযিঃ) দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন।
باب حَدِّ الْمَرِيضِ أَنْ يَشْهَدَ الْجَمَاعَةَ
664 - حَدَّثَنَا عُمَرُ بْنُ حَفْصِ بْنِ غِيَاثٍ، قَالَ: حَدَّثَنِي أَبِي، قَالَ: حَدَّثَنَا الأَعْمَشُ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنِ الأَسْوَدِ، قَالَ: كُنَّا عِنْدَ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، فَذَكَرْنَا المُوَاظَبَةَ عَلَى الصَّلاَةِ وَالتَّعْظِيمَ لَهَا، قَالَتْ: لَمَّا مَرِضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَضَهُ الَّذِي مَاتَ فِيهِ [ص:134]، فَحَضَرَتِ الصَّلاَةُ، فَأُذِّنَ فَقَالَ: «مُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ» فَقِيلَ لَهُ: إِنَّ أَبَا بَكْرٍ رَجُلٌ أَسِيفٌ إِذَا قَامَ فِي مَقَامِكَ لَمْ يَسْتَطِعْ أَنْ يُصَلِّيَ بِالنَّاسِ، وَأَعَادَ فَأَعَادُوا لَهُ، فَأَعَادَ الثَّالِثَةَ، فَقَالَ: «إِنَّكُنَّ صَوَاحِبُ يُوسُفَ مُرُوا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ» ، فَخَرَجَ أَبُو بَكْرٍ فَصَلَّى فَوَجَدَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ نَفْسِهِ خِفَّةً، فَخَرَجَ يُهَادَى بَيْنَ رَجُلَيْنِ، كَأَنِّي أَنْظُرُ رِجْلَيْهِ تَخُطَّانِ مِنَ الوَجَعِ، فَأَرَادَ أَبُو بَكْرٍ أَنْ يَتَأَخَّرَ، فَأَوْمَأَ إِلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ مَكَانَكَ، ثُمَّ أُتِيَ بِهِ حَتَّى جَلَسَ إِلَى جَنْبِهِ، قِيلَ لِلْأَعْمَشِ: وَكَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي وَأَبُوبَكْرٍ يُصَلِّي بِصَلاَتِهِ، وَالنَّاسُ يُصَلُّونَ بِصَلاَةِ أَبِي بَكْرٍ، فَقَالَ: بِرَأْسِهِ نَعَمْ رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ، عَنْ شُعْبَةَ، عَنِ الأَعْمَشِ بَعْضَهُ، وَزَادَ أَبُو مُعَاوِيَةَ جَلَسَ عَنْ يَسَارِ أَبِي بَكْرٍ، فَكَانَ أَبُو بَكْرٍ يُصَلِّي قَائِمًا
হাদীসের ব্যাখ্যা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের আগের বৃহস্পতিবার ইশার সময় খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর পক্ষে মসজিদে গিয়ে ইমামত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তিনি ঘরের লোকদের হুকুম দিলেন, যেন তারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে ইমামত করতে বলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মন ছিল অত্যন্ত নরম। কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতকালে তাঁর কান্না চলে আসত। কান্নার বেগ বেশি হলে স্বাভাবিক গতিতে তিলাওয়াত করা সম্ভব হয় না। ইমামত করার সময় এরূপ অবস্থা হলে সাবলীলভাবে কুরআন পাঠ করা কঠিন হয়ে যায়। আবার সময়টা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতাকালীন। এ কারণে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, এমনিতেও উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থানে দাঁড়িয়ে ইমামত করতে তাঁর অনেক বেশি চাপবোধ হওয়ার কথা। সেদিকে ইঙ্গিত করে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. বলেন যে, আপনার স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি নামায পড়লে কান্নার কারণে মানুষকে কিরাআত, তাকবীর ইত্যাদি শোনাতে পারবেন না। অর্থাৎ কান্না অবস্থায় তাঁর উচ্চারণ জড়িয়ে যাবে। আওয়াজও উঁচু হবে না। ফলে মুক্তাদীগণ তা শুনতে পাবে না।
কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ওজর গ্রাহ্য করলেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সবচে' বেশি প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন আলামত-ইঙ্গিত দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর একান্ত কামনা ছিল তাঁর ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই যেন প্রথম খলীফা হিসেবে মনোনীত হন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নামাযের ইমামরূপে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা এ কামনা পূরণে সহায়ক ছিল। অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করলে তার দিকে কিছু লোকের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা ছিল। হয়তো এটাকে তারা তার খলীফারূপে মনোনয়নের প্রতি ইঙ্গিত মনে করত। সে আশঙ্কার পথ বন্ধ করার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে দিয়েই ইমামত করানোর প্রয়োজন ছিল। তাই সব ওজর প্রত্যাখ্যান করে তিনি বারবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কেই ইমামত করার হুকুম দিতে বললেন।
সেমতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্তরূপে নামাযের ইমামত করলেন। এটা ছিল বৃহস্পতিবার ইশার নামায। এরপর থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত টানা ১৭ ওয়াক্ত নামাযে তিনি ইমামত করেন। ওফাতের পর যখন খলীফা নিয়োগের পালা আসে, তখন হযরত উমর ফারূক রাযি, হযরত আলী রাযি. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ নামাযের এই ইমামতকে তাঁর বৃহত্তর ইমামত অর্থাৎ খেলাফতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পক্ষে একটি বড় শক্তিরূপে অবলম্বন করে নিয়েছিলেন।
যাহোক, এস্থলে এ হাদীছের মূল বিষয় হল কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তিলাওয়াতকালে খুব কাঁদতেন। এটা প্রকৃত মুমিনদের শান। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
"আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হিদায়াত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে সঠিক পথে আনার কেউ নেই।
কুরআন পড়ে দেহমন বিগলিত হওয়া মহান লোকদের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। মদীনা মুনাউওয়ারায় হিজরতের আগে তিনি মক্কা ছেড়ে পরিব্রাজকরূপে ভূপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানো ও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লে ইবনুদ্দাগিনাহ নামক মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাড়ির আঙিনায় একটি ইবাদতখানা বানিয়ে সেখানে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকর-তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। তিনি যখন বিগলিত মনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকতেন, তখন আশপাশের নারী-পুরুষ সকলে ঘর থেকে বের হয়ে আসত এবং তাঁর নিকট জড়ো হয়ে কুরআন শ্রবণে মগ্ন হয়ে পড়ত। কুরায়শ নেতৃবর্গ এটাকে অনেক বড় ঝুঁকিরূপে দেখছিল। তারা ভাবছিল, এভাবে চলতে থাকলে মক্কার সকল নারী-পুরুষ নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম কবুল করে নেবে। সুতরাং তাদের চাপে পড়ে ইবনুদ্দাগিনাহ তার দেওয়া নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। পরিশেষে হিজরতের পালা আসে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ প্রমাণ করে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় সাহাবী।
খ. প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা পসন্দের ব্যক্তি।
গ. ‘ইলম ও আমলে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই ইমামরূপে মনোনীত করা উচিত।
ঘ. কুরআন পাঠকালে সম্ভব হলে ক্রন্দন করা উচিত। অন্ততপক্ষে ক্রন্দনের ভাব তো অবলম্বন করা চাই-ই।
কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ওজর গ্রাহ্য করলেন না। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাঁর সবচে' বেশি প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন আলামত-ইঙ্গিত দ্বারা বোঝা যায়, তাঁর একান্ত কামনা ছিল তাঁর ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই যেন প্রথম খলীফা হিসেবে মনোনীত হন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নামাযের ইমামরূপে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা এ কামনা পূরণে সহায়ক ছিল। অন্য কেউ এ দায়িত্ব পালন করলে তার দিকে কিছু লোকের ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা ছিল। হয়তো এটাকে তারা তার খলীফারূপে মনোনয়নের প্রতি ইঙ্গিত মনে করত। সে আশঙ্কার পথ বন্ধ করার জন্য হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে দিয়েই ইমামত করানোর প্রয়োজন ছিল। তাই সব ওজর প্রত্যাখ্যান করে তিনি বারবার হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কেই ইমামত করার হুকুম দিতে বললেন।
সেমতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্তরূপে নামাযের ইমামত করলেন। এটা ছিল বৃহস্পতিবার ইশার নামায। এরপর থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত টানা ১৭ ওয়াক্ত নামাযে তিনি ইমামত করেন। ওফাতের পর যখন খলীফা নিয়োগের পালা আসে, তখন হযরত উমর ফারূক রাযি, হযরত আলী রাযি. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ নামাযের এই ইমামতকে তাঁর বৃহত্তর ইমামত অর্থাৎ খেলাফতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পক্ষে একটি বড় শক্তিরূপে অবলম্বন করে নিয়েছিলেন।
যাহোক, এস্থলে এ হাদীছের মূল বিষয় হল কুরআন তিলাওয়াতকালে ক্রন্দন করা। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তিলাওয়াতকালে খুব কাঁদতেন। এটা প্রকৃত মুমিনদের শান। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ ذَلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ
"আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটা আল্লাহর হিদায়াত, যার মাধ্যমে তিনি যাকে চান সঠিক পথে নিয়ে আসেন আর আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন, তাকে সঠিক পথে আনার কেউ নেই।
কুরআন পড়ে দেহমন বিগলিত হওয়া মহান লোকদের মধ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। মদীনা মুনাউওয়ারায় হিজরতের আগে তিনি মক্কা ছেড়ে পরিব্রাজকরূপে ভূপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়ানো ও আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লে ইবনুদ্দাগিনাহ নামক মক্কার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এ সময় তিনি বাড়ির আঙিনায় একটি ইবাদতখানা বানিয়ে সেখানে ইবাদত-বন্দেগী ও যিকর-তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। তিনি যখন বিগলিত মনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকতেন, তখন আশপাশের নারী-পুরুষ সকলে ঘর থেকে বের হয়ে আসত এবং তাঁর নিকট জড়ো হয়ে কুরআন শ্রবণে মগ্ন হয়ে পড়ত। কুরায়শ নেতৃবর্গ এটাকে অনেক বড় ঝুঁকিরূপে দেখছিল। তারা ভাবছিল, এভাবে চলতে থাকলে মক্কার সকল নারী-পুরুষ নিজ ধর্ম ছেড়ে ইসলাম কবুল করে নেবে। সুতরাং তাদের চাপে পড়ে ইবনুদ্দাগিনাহ তার দেওয়া নিরাপত্তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। পরিশেষে হিজরতের পালা আসে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ প্রমাণ করে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় সাহাবী।
খ. প্রথম খলীফা হিসেবে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-ই ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা পসন্দের ব্যক্তি।
গ. ‘ইলম ও আমলে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই ইমামরূপে মনোনীত করা উচিত।
ঘ. কুরআন পাঠকালে সম্ভব হলে ক্রন্দন করা উচিত। অন্ততপক্ষে ক্রন্দনের ভাব তো অবলম্বন করা চাই-ই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
