আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৯- শপথ ও মান্নতের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৬৩৮
২৭৫১. নবী (ﷺ) এর শপথ কিরূপ ছিল?
৬১৮৩। উমর ইবনে হাফস (রাহঃ) ......... আবু যর গিফারী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা আমি নবী (ﷺ) এর নিকট গেলাম। তখন তিনি কাবাগৃহের ছায়ায় বসে বলছিলেনঃ কাবা গৃহের রবের কসম! তারা ক্ষতিগ্রস্ত। কাবা গৃহের রবের কসম! তারা ক্ষতিগ্রস্ত। আমি বললাম, আমার অবস্থা কি? আমার মাঝে কি কিছু (ক্রটি) পরিলক্ষিত হয়েছে? তিনি বলছিলেন, এমন অবস্থায় আমি তার কাছে বসে পড়লাম। আমি তাকে থামাতে পারলাম না। যতক্ষণের জন্য আল্লাহ চাইলেন আমি চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। এরপর আমি আরয করলাম, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান! ঐ সমস্ত লোক কারা? ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ এরা হল ঐ সকল লোক যারা অধিক সম্পদের অধিকারী। তবে হ্যাঁ, ঐ সমস্ত লোক স্বতন্ত্র যারা এরূপ, এরূপ ও এরূপ (ক্ষেত্রে খরচ করে থাকে)।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছটিতে সম্পদশালীদের দুর্দশার কথা বলা হয়েছে– (কিয়ামতের দিন হবে অভাবগ্রস্ত, তবে যে তার সম্পদ এভাবে এভাবে ও এভাবে বিলায়)। অর্থাৎ দুনিয়ায় যাদের অর্থ-সম্পদ বেশি, কিয়ামতের দিন তাদের ছাওয়াবের পরিমাণ হবে কম। কারণ তারা অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করতে ব্যতিব্যস্ত থাকায় ইবাদত-বন্দেগীর বেশি সুযোগ পায়নি। আবার উপার্জন যদি হালাল পথে না হয়ে থাকে, তবে তাতে তো গুনাহের পরিমাণই বাড়তে থেকেছে। সেইসঙ্গে যদি যাকাতও আদায় না করে এবং মালের অন্যান্য হক আদায়ে অবহেলা করে থাকে, তাতেও পাপের পাল্লা ভারী হয়েছে। একদিকে নেক আমল করেছে কম, অন্যদিকে নানারকম গুনাহে লিপ্ত থেকেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আখিরাতে এ শ্রেণীর লোক ছাওয়াব ও পুণ্যে অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকবে। তারা গরীবদের অনেক পেছনে থাকবে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছেন ধনীদের সাধারণ অবস্থা অনুযায়ী। কিছু কিছু ধনী ব্যতিক্রমও আছে। তাই তিনি বলেন, “তবে যে তার সম্পদ এভাবে এভাবে ও এভাবে বিলায়।“ অর্থাৎ ডানে, বামে, পেছনে সবদিকে বিলায়। তার কথা আলাদা। সে ছাওয়াবের দিক থেকে অভাবগ্রস্ত হবে না। বরং বলা যায় এরকম অনেক ধনী আখিরাতে গরীবদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও এর প্রমাণ মেলে। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
أن فقراء المهاجرين أتوا رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقالوا: ذهب أهل الدثور بالدرجات العلى، والنعيم المقيم، فقال: «وما ذاك؟» قالوا: يصلون كما نصلي، ويصومون كما نصوم، ويتصدقون ولا نتصدق، ويعتقون ولا نعتق، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «أفلا أعلمكم شيئا تدركون به من سبقكم وتسبقون به من بعدكم؟ ولا يكون أحد أفضل منكم إلا من صنع مثل ما صنعتم» قالوا: بلى، يا رسول الله قال: «تسبحون، وتكبرون، وتحمدون، دبر كل صلاة ثلاثا وثلاثين مرة» قال أبو صالح: فرجع فقراء المهاجرين إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقالوا: سمع إخواننا أهل الأموال بما فعلنا، ففعلوا مثله، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء
“গরীব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ধনীগণ তো উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি'আমত নিয়ে গেল। তিনি বললেন, সে কী? তারা বললেন, তারা নামায পড়ে যেমন আমরা পড়ি, তারা রোযা রাখে যেমন আমরা রাখি, কিন্তু তারা দান-সদাকা করে, আমরা তা করতে পারি না, তারা গোলাম আযাদ করে, আমরা তাও করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন কোনও আমল শিখিয়ে দেব, যা দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রবর্তীদের ধরে ফেলবে এবং তোমাদের পরবর্তীদের থেকে অগ্রগামী থাকবে আর তোমাদের অনুরূপ আমল যারা করবে তারা ছাড়া অন্য কেউ তোমাদের চেয়ে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে না? তারা বললেন, অবশ্যই শিখিয়ে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। পরে গরীব মুহাজিরগণ আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসলেন এবং বললেন, আমাদের সম্পদশালী ভাইয়েরা আমরা যা করি তা শুনে ফেলেছে। এখন তারাও আমাদের মত আমল শুরু করে দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান দিয়ে থাকেন।

الاكثرون - এর দ্বারা সাধারণভাবে যদিও ধনীকে বোঝায়, কিন্তু যারা ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অন্যদের উপর, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। আখিরাতে তারাও সাধারণজনদের তুলনায় পেছনে থাকবে। তবে তারা যদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির হক আদায় করতে পারে, নিজ ক্ষমতা ও যোগ্যতা দ্বারা সৃষ্টির সেবা করে, কারও প্রতি ক্ষমতাবলে জুলুম না করে এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী যথাযথভাবে চালিয়ে যায়, তাদের কথা আলাদা। তাই দেখা যায় বিভিন্ন হাদীছে ন্যায়পরায়ণ শাসকদের প্রভূত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য এ কথাও সত্য, সম্পদশালী ও ক্ষমতাওয়ালাদের অধিকাংশই দীনদারীতে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। তারা ক্ষমতা ও সম্পদের মোহে আখিরাত ভুলে যায়। এর প্রতিযোগিতায় পড়ে শরী'আত পালনে উদাসীন হয়ে পড়ে। এর ব্যতিক্রম খুব কমই।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. হাদীছটি দ্বারা যুহদের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

খ. গরীব দীনদার মুসলিমদের অবহেলা করতে নেই। তারাই প্রকৃত ধনী। তারা সম্পদশালীদের আগে জান্নাতে যাবে।

গ. যার অর্থ-সম্পদ আছে তার কর্তব্য তা থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করা।

ঘ. সম্পদশালীদের নিজ সম্পদের কারণে ভীত থাকা উচিত। কারণ এ হাদীছ জানাচ্ছে আখিরাতে তারাই হবে গরীব, যদি না সম্পদের হক আদায় করা হয়।

ঙ. প্রত্যেক সম্পদশালীর এ কারণেও ভীত থাকা উচিত যে, তার দ্বারা তার সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক যথাযথ আদায় হচ্ছে কি না। হাদীছে তো তা আদায়কারী ধনীদের সংখ্যা খুব কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ বুখারী - হাদীস নং ৬১৮৩ | মুসলিম বাংলা