আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৮- তাকদির সংশ্লিষ্ট অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৬১৯
৩৪৭৮. (মহান আল্লাহর বাণীঃ) বলুন, আমাদের জন্য আল্লাহ যা নির্দিষ্ট করেছেন তা ছাড়া আমাদের কিছুই হবে না। كَتَبَ - নির্দিষ্ট করেছেন।
মুজাহিদ (রাহঃ) বলেছেন, بِفَاتِنِينَ - যারা পথভ্রষ্ট হয়, হ্যাঁ যার সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা লিখে দিয়েছেন যে, সে জাহান্নামে যাবে।
قَدَّرَ فَهَدَى- দুর্ভাগ্য এবং সৌভাগ্য নির্দিষ্ট করেছেন। জন্তুকে চারণভূমি পর্যন্ত পৌঁছানো।
৬১৬৬। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম হানযালী (রাহঃ) ......... আয়েশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে প্লেগরোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেনঃ এটা হচ্ছে আল্লাহর এক প্রকার আযাব। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তার ওপরই প্রেরণ করেন। আল্লাহ তা'আলা এটা মুসলমানের জন্য রহমতে পরিণত করেছেন। প্লেগাক্রান্ত শহরে কোন বান্দা যদি ধৈর্যধারণ করে, এ বিশ্বাস নিয়ে সেখানেই অবস্থান করে ও তা থেকে বের না হয় যে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য যা ভাগ্যে লিখেছেন তা ব্যতীত কিছুই তাকে স্পর্শ করবে না, তাহলে সে শহীদের সাওয়াব লাভ করবে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

'তাউন' প্লেগরোগকেও বলে আবার অন্য যে-কোনও মহামারিকেও বলে, যেমন কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি। এ হাদীছে তা'ঊন দ্বারা বিশেষভাবে প্লেগরোগও বোঝানো হতে পারে, আবার অন্যান্য যে-কোনও মহামারিও। এতে আক্রান্ত হয়ে যেহেতু গণহারে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তাই আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. জানতে চাইলেন, এ রোগ কেন দেখা দেয়? তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানালেন, আগে এ রোগ ছিল আল্লাহ তা'আলার এক আযাব, যা কাফির-পাপাচারীদের উপর পাঠানো হত। মানুষ যখন ব্যাপকভাবে পাপাচারে লিপ্ত হত, তখন এ আযাব দিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেওয়া হত। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর খাস দয়ায় এই উম্মতের জন্যে এরকম রোগ-ব্যাধিকে রহমত বানিয়ে দিয়েছেন। ফলে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। তবে শর্ত হল, তাকে বিশ্বাস রাখতে হবে আল্লাহ তা'আলা তার তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন, ঘটবে কেবল তাই। যদি এ রোগে তার মৃত্যু লেখা হয়ে থাকে, তবে কোনও উপায়ই সে এ থেকে মুক্তি পাবে না। আর যদি এতে তার মৃত্যু লেখা না হয়, তবে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও এতে তার মৃত্যু ঘটবে না। সেইসংগে ছওয়াবের আশায় ধৈর্যসহকারে আপন জায়গায় অবস্থান করতে হবে। নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও পালাবে না। তো যেহেতু মু'মিন ব্যক্তি তা'উনের বিনিময়ে আখিরাতে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে, সে কারণে তার পক্ষে এ রোগকে রহমত বলা হয়েছে। এক হাদীছে আছে-

الطاعونُ شَهَادَةٌ لِكُلِّ مُسْلِمٍ

‘তাউন প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে শাহাদাত।
অন্য এক হাদীছে আছে-

الْمَطْعُونُ شَهِيدٌ

'তাউনে আক্রান্ত ব্যক্তি শহীদ'

পক্ষান্তরে কাফিরের জন্য এটা আযাব। সে মৃত্যুর আগে দুনিয়াতেই এ আযাব ভোগ করে। আখিরাতের আযাব তো রয়েছেই। এ উম্মতের মধ্যে যারা গুনাহগার অর্থাৎ যারা কবীরা গুনাহে লিপ্ত থাকে, তাদের জন্যও কি প্লেগ রোগ রহমত এবং এতে মৃত্যু হলে কি তারাও শহীদের মর্যাদা পাবে? এ ব্যাপারে দু'রকম মতই আছে। কারও মতে তারা শহীদের মর্যাদা পাবে না এবং কারও মতে পাবে। তবে এ ব্যাপারে সঠিক কথা এই যে, ফাসিক ব্যক্তি প্লেগে আক্রান্ত হয়ে সবর অবলম্বন করলে সে এর বিনিময়ে ছওয়াবের অধিকারী হবে এবং তার গুনাহও মাফ হবে, হয়তো শহীদ বলেও গণ্য হবে, তবে পূর্ণাঙ্গ মু'মিনের মত সমপর্যায়ের শহীদ সে গণ্য হবে না। শহীদী মর্যাদা লাভের জন্যে একটি শর্ত বলা হয়েছে, ছওয়াব লাভের আশায় ধৈর্যসহকারে নিজ শহরে অবস্থান করতে হবে। যে এলাকায় প্লেগ দেখা দেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘উলামায়ে কিরামের মতে মৃত্যুভয়ে সে এলাকা থেকে পালানো জায়েয নয় কেননা ঘটবে তো তাই, যা তাকদীরে আছে। তাকদীরে যা আছে তা থেকে বাঁচার সাধ্য কারও নেই। পালাতে গেলে তাকদীর থেকে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা হবে মাত্র। এরকম চেষ্টা তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়। তাই এটা জায়েয নয়। এরূপ পলায়ন জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নতুল্য, যা নাজায়েয ও কঠিন গুনাহ। এক হাদীছে আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إذا سمعتم بالطاعون في أرض فلا تَدْخُلُوهَا، وَإِذا وقع بأرض و أنتم بها فلا تخرُجُوا مِنْهَا.

'যখন কোনও এলাকায় তা'ঊন দেখা দিয়েছে বলে জানতে পার, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর তুমি যেখানে অবস্থান করছ, সেখানে তা'উন দেখা দিলে সেখান থেকে পলায়ন করো না।
মহামারি-কবলিত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে এ কারণে যে, এর ফলে তাকদীরে বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশংকা থাকে। মূলত ঘটবে তো তাই, যা তাকদীরে আছে। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার পর প্লেগে আক্রান্ত হলে তার মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, এখানে প্রবেশ করার কারণেই সে প্লেগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রবেশ না করলে আক্রান্ত হত না। এটা তাকদীরে বিশ্বাসের পরিপন্থী। এ কারণেই সতর্কতাস্বরূপ মহামারি-কবলিত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাছাড়া তাকদীরে বিশ্বাসের সংগে সংগে বান্দাকে সতর্ক জীবনযাপনেরও হুকুম দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বান্দা বিশ্বাস তো রাখবে এই যে, তাকদীরে যা আছে কেবল তাই হবে, তবে দুনিয়া যেহেতু আসবাব-উপকরণের স্থান, তাই যেসকল আসবাব-উপকরণের সংগে নিরাপত্তার সম্পর্ক, তা অবলম্বন করবে আর যা-কিছু দ্বারা শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা থাকে, তা থেকে দূরে থাকবে। এ প্রসঙ্গে হযরত ‘উমর ফারূক রাযি.- এর ফিলিস্তীন সফরের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

হিজরী ১৮ সালে হযরত উমর ফারূক রাযি. ফিলিস্তীন এলাকায় সফরের উদ্দেশ্যে বের হন। তিনি যখন 'সারগ' নামক স্থানে পৌঁছান, তখন ওই এলাকার মুসলিম সেনাপতিগণ তাঁর সংগে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে জানান যে, সমগ্র শাম এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। তখন তিনি প্রথমদিকের মুহাজিরগণকে ডাকালেন এবং তাদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের করণীয় কী? আমরা কি সামনে অগ্রসর হব, না মদীনায় ফিরে যাব? কেউ কেউ বললেন, আমরা যেহেতু একটা উদ্দেশ্যে বের হয়েছি, তখন আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত হবে না। আবার অনেকে বললেন, ইতোমধ্যে কত সাহাবী মারা গেছেন, আপনার সংগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবশিষ্ট সাহাবীগণ রয়েছেন। আমাদের মত, আপনি মদীনায় ফিরে যান। মহামারির ভেতর ঢুকবেন না। এভাবে মতভেদ দেখা দিলে তিনি আনসারগণকে ডাকালেন। তাদের মধ্যেও মুহাজিরদের মত মতভিন্নতা দেখা দিল। শেষে তিনি প্রবীণ কুরায়শ মুহাজিরগণকে ডাকলেন। তারা সবাই একমত হয়ে বললেন, আপনি মহামারি-কবলিত এলাকার দিকে অগ্রসর হবেন না। আপনি লোকজন নিয়ে মদীনায় ফিরে যান। তখন হযরত 'উমর ফারুক রাখি ঘোষণা দিলেন, ঠিক আছে আমি মদীনায় ফিরে যাচ্ছি। এ কথা শুনে ফিলিস্তীন এলাকার প্রধান সেনাপতি বিখ্যাত সাহাবী 'উবাইদা ইবনুল জাররাহ রাযি. বললেন, তাকদীর থেকে পলায়ন? হযরত ফারূক রাযি. বললেন, আহা আবূ উবাইদা, এ কথা যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ হযরত আবূ বলত! আমরা তাকদীর থেকে তাকদীরের দিকেই ফিরে যাচ্ছি। আচ্ছা আপনি বলুন তো, একটি উপত্যকার দুই প্রান্ত আছে, যার একপ্রান্ত খরাকবলিত, অন্য প্রান্ত সবুজ- শ্যামল। আপনি আপনার উটগুলোকে কোন প্রান্তে চড়াবেন? যদি খরাকবলিত প্রান্তে চড়ান, তা যেমন তাকদীর অনুযায়ী হবে, তেমনি সবুজ-শ্যামল প্রান্তে চড়ালেও কি তা তাকদীর অনুযায়ী হবে না? ঠিক এ সময় সুবিখ্যাত ও বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুর রহমান ইবন 'আওফ রাযি. এসে উপস্থিত হলেন। সব শুনে তিনি বললেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা আছে। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা যখন কোনও এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবর পাও, তখন সেই এলাকায় গমন করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করছ, সেখানে মহামারি দেখা দিলে পালানোর উদ্দেশ্যে সেখান থেকে বের হয়ে যেও না। এ হাদীছ শুনে হযরত উমর ফারূক রাযি. আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করলেন, তারপর মদীনার উদ্দেশ্যে ফিরে চললেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারাও সবরের ফযীলত জানা গেল।

খ. এ উম্মতের উপর আল্লাহ তা'আলা যে কত বড় দয়াবান, এ হাদীছ দ্বারা তা উপলব্ধি করা যায়। অন্যসব জাতির জন্য যে তা'উন ছিল আযাব, এ উম্মতের পক্ষে তাকে কেমন রহমতে পরিণত করলেন!

গ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া গেল যে, রোগ-ব্যাধি ও বালা-মসিবতকে অকল্যাণ মনে করা উচিত নয়। এর মধ্যেও বান্দার পক্ষে বিশেষ বিশেষ কল্যাণ নিহিত থাকে। সবর অবলম্বন করলে সে কল্যাণ লাভ করা যায়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন