আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৮- তাকদির সংশ্লিষ্ট অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৬১১
৩৪৭১. নিস্পাপ সে-ই আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন।
عَاصِمٌ অর্থ প্রতিরোধকারী। মুজাহিদ (রাহঃ) বলেন, سُدًا عَنِ الْحَقِّ গোমরাহীতে মত্ত হওয়া, دَسَّاهَا তাকে গোমরাহ করেছে।
عَاصِمٌ অর্থ প্রতিরোধকারী। মুজাহিদ (রাহঃ) বলেন, سُدًا عَنِ الْحَقِّ গোমরাহীতে মত্ত হওয়া, دَسَّاهَا তাকে গোমরাহ করেছে।
৬১৫৮। আবদান (রাহঃ) ......... আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যেকোন লোককেই খলীফা বানানো হয় তার জন্য দুটি গুপ্তচর থাকে। একটা তো তাকে সৎকর্মের আদেশ করে এবং এর প্রতি তাকে উৎসাহিত করে। আরেকটা তাকে মন্দ কর্মের আদেশ করে এবং এর প্রতি তাকে প্ররোচিত করে। আর নিস্পাপ সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা রক্ষা করেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
بطَانةٌ এর অর্থ অন্তরঙ্গ বন্ধু; বিশেষ বন্ধু, যার সঙ্গে গোপন পরামর্শ করা হয়। রাজা-বাদশা ও শাসকদের বেলায় শব্দটি এমন ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা হয়, যে গোপনে বা নির্জনে শাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং গুপ্ত বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলে আর শাসকও তাকে বিশ্বাস করে এবং তার মতামত গ্রহণ করে। এ হিসেবে মন্ত্রী, ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ও একান্ত সচিবদের জন্যও শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। তাছাড়া এমন কিছু লোকও থাকে, যারা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জুটে যায়। তারা তাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। এক পর্যায়ে এমন আস্থাভাজন হয়ে যায়, যখন তারা তাদের সঙ্গে একাকী দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ পায়। তখন তারা যাই বলে, ক্ষমতাসীনগণ তাই বিশ্বাস করে। তারা যে পরামর্শই দেয়, তাই গ্রহণ করে। এদের জন্যও بطَانةٌ শব্দটি প্রযোজ্য।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলা যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন অথবা যে-কাউকে খলীফা বানিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই দু'জন بطَانةٌ (বিতানা) থেকেছে। অর্থাৎ এমন কেউ থেকেছে, যে একান্তভাবে তার সঙ্গে থেকে তাকে পরামর্শ দিয়েছে এবং বিশেষ বিশেষ কাজের প্রতি তাকে উৎসাহ দিয়েছে। হাদীছটিতে বলা হয়েছে, এরূপ উৎসাহদাতা সঙ্গী হয় দু'জন। দু'জন বলে নির্দিষ্ট দু'জন হওয়াই জরুরি নয়; তার বেশিও হতে পারে। বোঝানো উদ্দেশ্য নবী-রাসূল, রাজা-বাদশা ও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দু'শ্রেণির লোক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। কেন তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে? তাদের কাজ কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সম্পর্কে বলেন-
بطانةٌ تَأْمُرُهُ بِالْمَعْرُوفِ وَتَحُضهُ عَلَيْهِ (এক সঙ্গী তাকে ভালো কাজের আদেশ করে ও তার প্রতি উৎসাহদান করে)। অর্থাৎ এক সঙ্গীর কাজ হল শরী'আত যে কাজ পসন্দ করে এবং যে কাজ উত্তম বলে স্বীকৃতি দেয় সে কাজের অনুপ্রেরণা দেওয়া। যেমন ন্যায়বিচার করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণকে শরী'আত মোতাবেক পরিচালনা করা। বলাবাহুল্য, এরা উত্তম সঙ্গী। মানুষের উচিত নিজের জন্য এরকম সঙ্গীই নির্বাচন করা এবং তাদের পরামর্শকে মূল্যায়ন করা।
وَبَطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالشَّرِّ وَتَحُضهُ عَلَيْه (আরেক সঙ্গী তাকে মন্দ কাজের আদেশ করে ও তাতে উৎসাহ দেয়)। বলাবাহুল্য, এরূপ সঙ্গী নেহাৎ মন্দ। এদের ব্যাপারে সকলেরই সতর্ক থাকা উচিত। বেশিরভাগ এ শ্রেণির লোক যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পাশে ঘোরাঘুরি করে এবং তাদেরকে নানা কুপরামর্শ দেয়। তোষামুদে হওয়ায় ক্ষমতাসীন লোকেরা তাদের খুব পসন্দও করে। অসৎ ক্ষমতাধরেরা তাদের উস্কানিতে অধিকতর অসৎকর্মে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অনেক সময় সরল প্রকৃতির সৎলোকও তাদের কুপরামর্শে বিপথগামী হয়ে যায়। খুব বেশি সতর্ক না থাকলে সেইসঙ্গে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে সাহায্যপ্রাপ্ত না হলে এদের থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَالْمَعْصُوْمُ مَنْ عَصَمَ اللهُ (নিরাপদ থাকে কেবল সেই, যাকে আল্লাহ নিরাপদ রাখেন)। নবী-রাসূলগণ মা‘সূম ছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে সর্বপ্রকার অন্যায়-অনুচিত কাজ থেকে নিরাপদ রাখতেন। ফলে কোনও অসৎসঙ্গী তাদেরকে প্ররোচিত করতে সক্ষম হতো না। অন্যদের ক্ষেত্রে যেহেতু আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই, তাই তাদের আত্মরক্ষার জন্য বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলার শরণাপন্ন হওয়া খুব জরুরি। যে ব্যক্তি খাঁটিমনে আল্লাহর সাহায্য চায়, আল্লাহ তাকে অবশ্যই সাহায্য করেন এবং কুসঙ্গীর কুপরামর্শ থেকে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেন।
প্রকাশ থাকে যে, ভালো-মন্দ এ সঙ্গী যেমন মানুষ হতে পারে, তেমনি হতে পারে ফিরিশতা ও জিন্নও। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান-
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَقَدْ وُكِّلَ بِهِ قَرِينهُ مِنَ الْجِنِّ، وَقَرِينهُ مِنَ الْمَلَائِكَةِ، قَالُوْا: وَإِيَّاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ : وَإِيَّايَ ، وَلَكِنَّ اللهَ أَعَانَنِي عَلَيْهِ فَلَا يَأْمُرُنِي إِلَّا بِحَقِّ
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে কোনও জিন্ন সঙ্গী ও কোনও ফিরিশতা সঙ্গী নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সঙ্গেও কি? তিনি বললেন, আমার সঙ্গেও। তবে আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার (অর্থাৎ জিন্ন সঙ্গীর) বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমাকে কেবল ন্যায় কাজেরই আদেশ করে থাকে। (মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৪৮; সুনানে দারিমী ২৭৭৬; সহীহ মুসলিম: ২৮১৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ৬৫৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ১০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬৪১৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫২২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪২১১)
এখানে 'জিন্ন' দ্বারা দুষ্টু জিন্ন বোঝানো হয়েছে। সব দুষ্টু জিন্নকেই শয়তান বলে। শয়তানেরা ইবলীসের অনুচর। তাদের কাজ হল মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করা। কাজেই দুষ্টু জিন্ন বা শয়তান মানুষকে সর্বদা কুপরামর্শ দেয় ও মন্দ কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়। অন্যদিকে ফিরিশতা মানুষকে সৎকর্মের অনুপ্রেরণা দেয়। যার আকল-বুদ্ধি সুস্থ ও দীনের আলোয় আলোকিত, সে তো শয়তানের অনুপ্রেরণা উপেক্ষা করে ফিরিশতার অনুপ্রেরণাই গ্রহণ করে। ফলে তার অন্তর সৎকাজের দিকে ধাবিত হয়। অপরদিকে যে ব্যক্তি মনের খেয়াল-খুশি ও ইন্দ্রিয় চাহিদার বশীভূত হয়ে নিজ আকল-বুদ্ধি নষ্ট করে ফেলেছে, সে ফিরিশতার পরিবর্তে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যায়। ফলে তার অন্তর অসৎকাজের দিকে ধাবিত হয়। সুতরাং মনের খেয়াল-খুশির অনুগামী হয়ে নিজের উপর শয়তানের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া কিছুতেই সুবুদ্ধির কাজ নয়। নিজেকে খেয়াল-খুশির অনুগমন থেকে রক্ষার জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ও মুজাহাদা। এ সাধনায় লিপ্ত হলে নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ তা'আলার সাহায্য পাওয়া যায়। তাঁর সাহায্য লাভ হলে শয়তানের সব প্ররোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন খুব সহজেই তার থেকে আত্মরক্ষা করে সৎকর্মে লিপ্ত থাকা সম্ভব হয়।
মানুষের মধ্যে যারা কুপরামর্শ দেয়, তারাও এক রকম শয়তান। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا
এবং (তারা যেমন আমার নবীর সাথে শত্রুতা করছে) এভাবেই আমি (পূর্ববর্তী) প্রত্যেক নবীর জন্য কোনও না কোনও শত্রুর জন্ম দিয়েছি অর্থাৎ মানব ও জিন্নদের মধ্যকার শয়তানদেরকে, যারা ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে চমৎকার চমৎকার কথা শেখায়। (সূরা আন'আম (৬), আয়াত ১১২)
কাজেই মানুষের মধ্যে যারা শয়তান কিসিমের লোক, তাদের ব্যাপারে সকল ক্ষমতাসীনের সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য। তার প্রথম কর্তব্য ক্ষমতাকে আল্লাহর আমানত মনে করে আল্লাহভীতির সঙ্গে তা পরিচালনা করা। তারপর মন্ত্রীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল নিয়োগের বেলায় লক্ষ রাখা যাতে তারা সৎ ও আল্লাহভীরু লোক হয়, কিছুতেই মন্দ সঙ্গী ও মন্দ পরামর্শক না হয়। তারপর এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যাতে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ তাদের ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে না পারে। যারা তাদের আশেপাশে থাকে, তাদের বেলায়ও সচেতন থাকা উচিত যাতে কোনওক্রমেই মন্দ পরামর্শ দ্বারা তাকে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করানোর সুযোগ না পায়। কুরআন মাজীদের সর্বশেষ সূরা- সূরা নাসও আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়। তাতে মানবমনে প্ররোচনা দানকারী সকল জিন্ন ও মানুষের অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা'আলার আশ্রয় চাওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবীগণ আল্লাহ তা'আলার প্রেরিত পুরুষ। তাঁরা মা'সূম ও নিষ্পাপ। কেউ সাধনা করে নবী হতে পারে না।
খ. জিন্ন বা শয়তান মন্দ প্ররোচনা দিয়ে নবীদের কোনও ক্ষতি করতে পারত না।
গ. জনগণের শাসনক্ষমতা মূলত আল্লাহ তা'আলারই দান। তাই এটা আল্লাহর আমানত। তাঁর হুকুম অনুযায়ীই এটা পরিচালনা করা উচিত।
ঘ. শাসনকর্তার উচিত সৎ মন্ত্রী ও সৎ অনুচরের সুপরামর্শ গ্রহণ করা।
ঙ. প্রত্যেক ক্ষমতাসীনকে মনে রাখতে হবে যে, তার অনুচর ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোকও থাকে। নিজেদের মতলব অনুযায়ী পরামর্শ ও মতামত দেওয়াই তাদের কাজ। সুতরাং তাদের প্রতিটি পরামর্শ ও মতামতে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখাতে হবে।
চ. আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন, কেবল সেই কাছের লোকজনের দুরভিসন্ধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে আল্লাহ তা'আলার শরণাপন্ন হওয়া ও তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া একান্ত কর্তব্য।
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তা'আলা যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন অথবা যে-কাউকে খলীফা বানিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই দু'জন بطَانةٌ (বিতানা) থেকেছে। অর্থাৎ এমন কেউ থেকেছে, যে একান্তভাবে তার সঙ্গে থেকে তাকে পরামর্শ দিয়েছে এবং বিশেষ বিশেষ কাজের প্রতি তাকে উৎসাহ দিয়েছে। হাদীছটিতে বলা হয়েছে, এরূপ উৎসাহদাতা সঙ্গী হয় দু'জন। দু'জন বলে নির্দিষ্ট দু'জন হওয়াই জরুরি নয়; তার বেশিও হতে পারে। বোঝানো উদ্দেশ্য নবী-রাসূল, রাজা-বাদশা ও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দু'শ্রেণির লোক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। কেন তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে? তাদের কাজ কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সম্পর্কে বলেন-
بطانةٌ تَأْمُرُهُ بِالْمَعْرُوفِ وَتَحُضهُ عَلَيْهِ (এক সঙ্গী তাকে ভালো কাজের আদেশ করে ও তার প্রতি উৎসাহদান করে)। অর্থাৎ এক সঙ্গীর কাজ হল শরী'আত যে কাজ পসন্দ করে এবং যে কাজ উত্তম বলে স্বীকৃতি দেয় সে কাজের অনুপ্রেরণা দেওয়া। যেমন ন্যায়বিচার করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণকে শরী'আত মোতাবেক পরিচালনা করা। বলাবাহুল্য, এরা উত্তম সঙ্গী। মানুষের উচিত নিজের জন্য এরকম সঙ্গীই নির্বাচন করা এবং তাদের পরামর্শকে মূল্যায়ন করা।
وَبَطَانَةٌ تَأْمُرُهُ بِالشَّرِّ وَتَحُضهُ عَلَيْه (আরেক সঙ্গী তাকে মন্দ কাজের আদেশ করে ও তাতে উৎসাহ দেয়)। বলাবাহুল্য, এরূপ সঙ্গী নেহাৎ মন্দ। এদের ব্যাপারে সকলেরই সতর্ক থাকা উচিত। বেশিরভাগ এ শ্রেণির লোক যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পাশে ঘোরাঘুরি করে এবং তাদেরকে নানা কুপরামর্শ দেয়। তোষামুদে হওয়ায় ক্ষমতাসীন লোকেরা তাদের খুব পসন্দও করে। অসৎ ক্ষমতাধরেরা তাদের উস্কানিতে অধিকতর অসৎকর্মে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অনেক সময় সরল প্রকৃতির সৎলোকও তাদের কুপরামর্শে বিপথগামী হয়ে যায়। খুব বেশি সতর্ক না থাকলে সেইসঙ্গে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে সাহায্যপ্রাপ্ত না হলে এদের থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَالْمَعْصُوْمُ مَنْ عَصَمَ اللهُ (নিরাপদ থাকে কেবল সেই, যাকে আল্লাহ নিরাপদ রাখেন)। নবী-রাসূলগণ মা‘সূম ছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে সর্বপ্রকার অন্যায়-অনুচিত কাজ থেকে নিরাপদ রাখতেন। ফলে কোনও অসৎসঙ্গী তাদেরকে প্ররোচিত করতে সক্ষম হতো না। অন্যদের ক্ষেত্রে যেহেতু আল্লাহ তা'আলার তরফ থেকে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই, তাই তাদের আত্মরক্ষার জন্য বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি আল্লাহ তা'আলার শরণাপন্ন হওয়া খুব জরুরি। যে ব্যক্তি খাঁটিমনে আল্লাহর সাহায্য চায়, আল্লাহ তাকে অবশ্যই সাহায্য করেন এবং কুসঙ্গীর কুপরামর্শ থেকে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেন।
প্রকাশ থাকে যে, ভালো-মন্দ এ সঙ্গী যেমন মানুষ হতে পারে, তেমনি হতে পারে ফিরিশতা ও জিন্নও। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান-
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَقَدْ وُكِّلَ بِهِ قَرِينهُ مِنَ الْجِنِّ، وَقَرِينهُ مِنَ الْمَلَائِكَةِ، قَالُوْا: وَإِيَّاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ؟ قَالَ : وَإِيَّايَ ، وَلَكِنَّ اللهَ أَعَانَنِي عَلَيْهِ فَلَا يَأْمُرُنِي إِلَّا بِحَقِّ
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে কোনও জিন্ন সঙ্গী ও কোনও ফিরিশতা সঙ্গী নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সঙ্গেও কি? তিনি বললেন, আমার সঙ্গেও। তবে আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার (অর্থাৎ জিন্ন সঙ্গীর) বিরুদ্ধে সাহায্য করেছেন। ফলে সে আমাকে কেবল ন্যায় কাজেরই আদেশ করে থাকে। (মুসনাদে আহমাদ: ৩৬৪৮; সুনানে দারিমী ২৭৭৬; সহীহ মুসলিম: ২৮১৪; সহীহ ইবনে খুযায়মা : ৬৫৮; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার ১০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬৪১৮; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৫২২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪২১১)
এখানে 'জিন্ন' দ্বারা দুষ্টু জিন্ন বোঝানো হয়েছে। সব দুষ্টু জিন্নকেই শয়তান বলে। শয়তানেরা ইবলীসের অনুচর। তাদের কাজ হল মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করা। কাজেই দুষ্টু জিন্ন বা শয়তান মানুষকে সর্বদা কুপরামর্শ দেয় ও মন্দ কাজের অনুপ্রেরণা যোগায়। অন্যদিকে ফিরিশতা মানুষকে সৎকর্মের অনুপ্রেরণা দেয়। যার আকল-বুদ্ধি সুস্থ ও দীনের আলোয় আলোকিত, সে তো শয়তানের অনুপ্রেরণা উপেক্ষা করে ফিরিশতার অনুপ্রেরণাই গ্রহণ করে। ফলে তার অন্তর সৎকাজের দিকে ধাবিত হয়। অপরদিকে যে ব্যক্তি মনের খেয়াল-খুশি ও ইন্দ্রিয় চাহিদার বশীভূত হয়ে নিজ আকল-বুদ্ধি নষ্ট করে ফেলেছে, সে ফিরিশতার পরিবর্তে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে যায়। ফলে তার অন্তর অসৎকাজের দিকে ধাবিত হয়। সুতরাং মনের খেয়াল-খুশির অনুগামী হয়ে নিজের উপর শয়তানের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া কিছুতেই সুবুদ্ধির কাজ নয়। নিজেকে খেয়াল-খুশির অনুগমন থেকে রক্ষার জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ও মুজাহাদা। এ সাধনায় লিপ্ত হলে নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ তা'আলার সাহায্য পাওয়া যায়। তাঁর সাহায্য লাভ হলে শয়তানের সব প্ররোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন খুব সহজেই তার থেকে আত্মরক্ষা করে সৎকর্মে লিপ্ত থাকা সম্ভব হয়।
মানুষের মধ্যে যারা কুপরামর্শ দেয়, তারাও এক রকম শয়তান। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে-
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا
এবং (তারা যেমন আমার নবীর সাথে শত্রুতা করছে) এভাবেই আমি (পূর্ববর্তী) প্রত্যেক নবীর জন্য কোনও না কোনও শত্রুর জন্ম দিয়েছি অর্থাৎ মানব ও জিন্নদের মধ্যকার শয়তানদেরকে, যারা ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে চমৎকার চমৎকার কথা শেখায়। (সূরা আন'আম (৬), আয়াত ১১২)
কাজেই মানুষের মধ্যে যারা শয়তান কিসিমের লোক, তাদের ব্যাপারে সকল ক্ষমতাসীনের সতর্ক থাকা একান্ত কর্তব্য। তার প্রথম কর্তব্য ক্ষমতাকে আল্লাহর আমানত মনে করে আল্লাহভীতির সঙ্গে তা পরিচালনা করা। তারপর মন্ত্রীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল নিয়োগের বেলায় লক্ষ রাখা যাতে তারা সৎ ও আল্লাহভীরু লোক হয়, কিছুতেই মন্দ সঙ্গী ও মন্দ পরামর্শক না হয়। তারপর এদিকেও লক্ষ রাখা জরুরি যাতে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গ তাদের ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে না পারে। যারা তাদের আশেপাশে থাকে, তাদের বেলায়ও সচেতন থাকা উচিত যাতে কোনওক্রমেই মন্দ পরামর্শ দ্বারা তাকে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করানোর সুযোগ না পায়। কুরআন মাজীদের সর্বশেষ সূরা- সূরা নাসও আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়। তাতে মানবমনে প্ররোচনা দানকারী সকল জিন্ন ও মানুষের অনিষ্ট হতে আল্লাহ তা'আলার আশ্রয় চাওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. নবীগণ আল্লাহ তা'আলার প্রেরিত পুরুষ। তাঁরা মা'সূম ও নিষ্পাপ। কেউ সাধনা করে নবী হতে পারে না।
খ. জিন্ন বা শয়তান মন্দ প্ররোচনা দিয়ে নবীদের কোনও ক্ষতি করতে পারত না।
গ. জনগণের শাসনক্ষমতা মূলত আল্লাহ তা'আলারই দান। তাই এটা আল্লাহর আমানত। তাঁর হুকুম অনুযায়ীই এটা পরিচালনা করা উচিত।
ঘ. শাসনকর্তার উচিত সৎ মন্ত্রী ও সৎ অনুচরের সুপরামর্শ গ্রহণ করা।
ঙ. প্রত্যেক ক্ষমতাসীনকে মনে রাখতে হবে যে, তার অনুচর ও ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী লোকও থাকে। নিজেদের মতলব অনুযায়ী পরামর্শ ও মতামত দেওয়াই তাদের কাজ। সুতরাং তাদের প্রতিটি পরামর্শ ও মতামতে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখাতে হবে।
চ. আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন, কেবল সেই কাছের লোকজনের দুরভিসন্ধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। তাই এ বিষয়ে আল্লাহ তা'আলার শরণাপন্ন হওয়া ও তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া একান্ত কর্তব্য।


বর্ণনাকারী: