আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৮- তাকদির সংশ্লিষ্ট অধ্যায়
৬১৫২। আবদান (রাহঃ) ......... আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন তার সঙ্গে ছিল একটি লাঠি। যা দিয়ে তিনি মাটি খুঁড়ছিলেন। তিনি তখন বললেনঃ তোমাদের মাঝে এমন কোন ব্যক্তি নেই যার ঠিকানা জাহান্নামে বা জান্নাতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। লোকদের ভিতর থেকে এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তা হলে (এর উপর) নির্ভর করব না? তিনি বললেনঃ না, বরং আমল কর। কেননা, প্রত্যেকের জন্য আমল সহজ (যার জন্য তাকে সৃষ্টি) করা হয়েছে। এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেনঃ فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى (সূরা আল লাইলঃ ৫)
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
বাকী'উল গারকাদ হল মদীনা মুনাউওয়ারার বিখ্যাত কবরস্থান। একে আল-বাকী' এবং জান্নাতুল বাকী'-ও বলা হয়। এ কবরস্থানে একদিন এক মায়্যিতকে দাফন করা হল। দাফন শেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন। উপস্থিত সাহাবীগণও তাঁর পাশে বসলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তিত ছিলেন। চিন্তিত অবস্থায় তিনি হাতে লাঠি দিয়ে মাটি খোঁচাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে তিনি বললেন- مَا مِنكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا وَقَدْ كُتِبَ مَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ وَمَقْعَدُهُ مِنَ الْجَنَّةِ (তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার স্থান জাহান্নামে ও জান্নাতে লিখে রাখা হয়নি)। অর্থাৎ লাওহে মাহফূযে তোমাদের প্রত্যেকেরই পরিণাম লেখা হয়ে গেছে কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে, তা নির্ধারিত হয়ে আছে। এটা হল তাকদীর বা ভাগ্যলিখন। বাহ্যত এ কথাটি শরী'আতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শরী'আতের বিধানাবলি তো এজন্যই দেওয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তি সে বিধান পালন করবে সে জান্নাত লাভ করবে আর যে ব্যক্তি তা পালন করবে না সে জাহান্নামে যাবে। এর দ্বারা বোঝা যায় মানুষের আমল অনুযায়ী ফয়সালা হবে কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে। অথচ এ হাদীছটিতে বলা হয়েছে কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে তা আগেই নির্ধারিত হয়ে আছে। তাই যদি হয়, তবে শরী'আত কেন? আমলেরই বা কী ফায়দা? এ প্রশ্ন সাহাবায়ে কেরামের মনেও দেখা দিল। তাই তারা বললেন- يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَفَلَا نَتَّكِلُ عَلَى كِتَابِنَا؟ (ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাহলে আমরা কি আমাদের সেই লেখার উপর নির্ভর করব না)? অর্থাৎ তাকদীরে যার যেমন পরিণাম লেখা আছে তেমনই তো হবে। যার সম্পর্কে লেখা আছে যে সে জাহান্নামে যাবে, হাজার ভালো আমল করলেও সে জাহান্নামেই যাবে। আর যার সম্পর্কে লেখা আছে সে জান্নাতে যাবে, সে যত মন্দ কাজই করুক না কেন, সে অবশ্যই জান্নাতবাসীই হবে। এ অবস্থায় আমল করে কী লাভ? তারচে' আমরা সেই লেখার উপর ভরসা করে থাকি না কেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- اِعْمَلُوْا؛ فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ (তোমরা আমল করতে থাকো। কারণ প্রত্যেকের জন্য তা সহজ করে দেওয়া হয়, যেজন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে)। অর্থাৎ কার জন্য জান্নাত নির্ধারিত আছে আর কার জন্য জাহান্নাম, তা তো কারও জানা নেই। এটা গায়েবী বিষয়। একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই জানেন। তবে তোমাদের তো স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। তোমরা জড়পদার্থের মতো নও। তোমরা চাইলে ভালো আমলও করতে পার, মন্দ আমলও করতে পার। আর আমল একটা বাহ্যিক ও বর্তমান অবস্থা, যা পরিণাম ও শেষ অবস্থার আলামতস্বরূপ। যার ভালো আমল করার তাওফীক হয়, তার সম্পর্কে আশা থাকে যে তার পরিণামও ভালো হবে। পরিণাম ভালো বলেই তার জন্য সৎকর্ম করা সহজ করে দেওয়া হয়েছে। সহজ করে দেওয়ার অর্থ আমলের সুযোগ করে দেওয়া এবং তা করার ইচ্ছা ও আগ্রহ দান করা। অপরদিকে যার দিন কাটে মন্দ আমলের ভেতর, তার সম্পর্কে আশঙ্কা থাকে যে তার পরিণামও বুঝি মন্দই হবে। পরিণাম মন্দ বলেই তার জন্য অসৎকর্ম সহজ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে সে অবাধে অসৎকর্ম করতে পারে এবং তা করার ইচ্ছা ও আগ্রহ সে বোধ করে। বলাবাহুল্য, সৎ ও অসৎকর্ম করাটা একটা বাহ্যিক কারণ। আখেরে হবে তো তাই, যা আল্লাহ তা'আলার সিদ্ধান্ত। বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী ফলাফল দিতে তিনি বাধ্য নন। সারকথা বান্দা হিসেবে মানুষের কাজ নিজ ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালন করে যাওয়া। গায়েবী বিষয়ে মাথা ঘামানো তার কাজ নয়। লাওহে মাহফুযের লিখন একটি গায়েবী বিষয়। এর উপর বিশ্বাস থাকা জরুরি। কিন্তু সেই জল্পনা-কল্পনায় আমলে গাফলাতি করার অবকাশ নেই। তার যখন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে, তখন সে শক্তিকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। তাকে এ শক্তি আল্লাহ তা'আলা অহেতুক দেননি। সে যাতে এ শক্তির ব্যবহার দ্বারা সৎকর্ম করে ও অসৎকর্ম থেকে বেঁচে থাকে, সেজন্যই তাকে এটা দেওয়া হয়েছে। কাজেই এ শক্তির সৎব্যবহার করলে আখিরাতে সে পুরস্কৃত হবে বলে আশা থাকে। সৎকর্মের নির্দেশ সেজন্যই। ভাগ্যলিখন বা তাকদীরে বিশ্বাসের হাকীকত মনে রাখতে হবে, মানুষ জড়পদার্থের মতো নয়। তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে। সে তার প্রাকৃতিক বিষয়, যেমন কে কখন জন্ম নেবে, গায়ের রং ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেমন হবে, বুদ্ধি-বিবেচনা ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলি কি রকম হবে, আয়ু, জীবিকা ইত্যাদির পরিমাণ কী হবে ইত্যাদিতে তো সম্পূর্ণই ইচ্ছারহিত। অর্থাৎ এসব বিষয়ে নিজ ইচ্ছায় তার কিছুই করার থাকে না। বরং তার এসব বিষয় সরাসরি আল্লাহ তা'আলার ফয়সালা অনুসারে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মানুষ বিলকুল নিরুপায় এবং সরাসরি নিয়তিচালিত। পক্ষান্তরে মানুষের কার্যাবলি, যা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে, তাতে মানুষ জড় পদার্থের মতো সম্পূর্ণ বাধ্য ও ইচ্ছারহিতও নয় এবং নিরঙ্কুশ স্বাধীনও নয়। জড় পদার্থের মতো যে নয়; বরং কিছু না কিছু কর্মস্বাধীনতা তার আছে, এটা বোঝার জন্য বিশেষ বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার পড়ে না। কোনও মানুষই নিজেকে জড় পদার্থের মতো মনে করে না। কেউ নিজেকে অন্যের হাতের পুতুল বলে ভাবতে পারে না; বরং এরূপ ভাবাকে প্রত্যেকেই নিজের পক্ষে অবমাননাকর ও গালিস্বরূপ মনে করে। তা কেন মনে করে? এ জন্যই তো যে, আপন চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মে সে নিজেকে স্বাধীন সত্তা বলেই বিশ্বাস করে। সুতরাং মানুষের কর্মস্বাধীনতার বিষয়টা এতটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়, যা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তবে সে স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। এক পর্যায়ে অদৃষ্টের কাছে হার মানতেই হয় এবং এটাও এক অনস্বীকার্য সত্য। প্রত্যেকেরই জীবনে এর বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। মনে কত কিছু করার সাধ জাগে। তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টাও চালানো হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায় চেষ্টাই সার, সাধ আর পূরণ হয় না। আবার অনেক কিছুকেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভেবে এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেজন্য সবরকম তদবির করা হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে সব তদবির ব্যর্থ হয় এবং তাকদীরের কাছেই হার মানতে হয়। সুতরাং মানুষ নিরঙ্কুশ স্বাধীনও নয়। বস্তুত নিরঙ্কুশ স্বাধীন হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। কেননা তার অর্থ দাঁড়ায় তার উপর আল্লাহ তা'আলার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। কোনও সৃষ্টির উপর শ্রষ্টার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকা সম্ভব কি? আল্লাহ তা'আলা সর্বশক্তিমান। তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। তাঁর জ্ঞান যেমন সর্বব্যাপী, কুদরতও তেমনি সর্বব্যাপী। তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার সাধ্য নেই কারও। জগৎসংসারের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ সম্পর্কে এটাই তাওহীদী আকীদার শিক্ষা। সুতরাং আপন কর্মে এক পর্যায়ের স্বাধীনতা থাকার পরও মানুষ আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা-এখতিয়ারের অধীন। অর্থাৎ স্বাধীনতা ও অপারগতা- এ দুইয়ের মাঝখানে তার অবস্থান। বিষয়টাকে হযরত আলী রাযি. এভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, তুমি চাইলে এক পা তুলে অন্য পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পার, কিন্তু দু'টো পা'ই তুলে রেখে যদি দাঁড়াতে চাও, তা পারবে না কিছুতেই। ব্যস এটাই হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা ও বাধ্যবাধকতা। সে পূর্ণ স্বাধীনও নয়। এবং পূর্ণ নিরুপায়ও নয়। যেসব বিষয় উপায়-উপকরণের সাথে যুক্ত, তাতে নজর দিলে এ কথা আরও বেশি পরিস্ফুট হয়। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় চাষাবাদ করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, ওষুধ খাওয়া ইত্যাদি কাজসমূহ মানুষের ইচ্ছাধীন। এগুলো উপায়-উপকরণ। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ফসল জন্মানো, জীবিকা অর্জন করা ও আরোগ্য লাভ করা। এগুলো সেই উপায়-উপকরণের ফল। সেই উপায় অবলম্বনে মানুষ স্বাধীন হলেও এই ফললাভে সে আদৌ স্বাধীন নয়। এতে তার কোনও এখতিয়ারই নেই। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাধীন। তিনি চাইলে এ ফল দিতেও পারেন, চাইলে নাও দিতে পারেন। যদিও ইহজগতে তাঁর রীতি হল উপায় অবলম্বন করলে ফল দিয়ে দেওয়া। তাঁর ঘোষণা রয়েছে- وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى (39) وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى 'আর এই যে, মানুষ নিজের প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কোনও কিছুর (বিনিময় লাভের) হকদার হয় না। এবং এই যে, তার চেষ্টা অচিরেই দেখা যাবে’। (সূরা নাজম, আয়াত ৩৯-৪০) এ কারণেই উপায়-অবলম্বন জরুরি। বেকার বসে থাকা ইসলামের শিক্ষা নয়, বৈধ পন্থায় তাতে লিপ্ত থাকাই সে ক্ষমতা যথার্থ মূল্যায়ন এবং এটাই কাম্য। তবে ফলাফলের বিষয়টা যেহেতু আল্লাহর হাতে, তাই তাঁর হাতেই তা ছেড়ে রাখা চাই। তা নিয়ে মাথা ঘামানো বোকামি। মাথা ঘামিয়ে কিছু লাভ হবে না, তাতে অশান্তি-অস্থিরতাই বাড়ে। সারকথা চেষ্টা-চরিত্রে বান্দা স্বাধীন, কিন্তু ফলপ্রাপ্তিতে সে স্বাধীন নয়, তা সম্পূর্ণ আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাধীন। দেখা যাচ্ছে আপন কাজে মানুষের কিছু না কিছু স্বাধীনতা আছে। এই স্বাধীনতার কারণেই তার উপর বিধি-বিধান আরোপ করা হয়েছে। তাকে শরী'আত দেওয়া হয়েছে। সে চাইলে নিজ ইচ্ছা প্রয়োগের সাথে শরী'আত পালনও করতে পারে এবং চাইলে পালন নাও করতে পারে। পালন করলে সে জান্নাত লাভ করবে আর পালন না করলে জাহান্নামে যাবে। ইচ্ছার এ স্বাধীনতার কারণেই সে পুরস্কার ও শাস্তি তথা জান্নাত ও জাহান্নামের উপযুক্ত হবে। এই হচ্ছে তাকদীর ও নিয়তি সম্পর্কে মোটামুটি কথা। এর বেশি গভীরে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। মূলত এ এক অন্তহীন রহস্য। আল্লাহ তা'আলার অসীম জ্ঞান ও অপার কুদরতের সাথে এর সম্পর্ক। সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধির মানুষের পক্ষে এর কুলকিনারা পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বেশি গভীরে না গিয়ে এই সরল ও সাদামাটা ধারণার উপরই ক্ষান্ত থাকা উচিত। কুরআন মাজীদে তাকদীর সম্পর্কে এরূপ সহজ-সরল ধারণাই আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কবরস্থানে গেলে মানুষের মন নরম হয়। তাই এটা নসীহতের উপযুক্ত স্থান। এখানে কিছু না কিছু নসীহত করা উচিত। খ. তাকদীরে বিশ্বাস রাখা জরুরি। তবে এর উপর নির্ভর করে আমল ছেড়ে দেওয়া নির্বুদ্ধিতা। গ. নেক আমলের সুযোগ লাভ হওয়া একটি ভালো লক্ষণ। তাই সে সুযোগকে যথাসাধ্য কাজে লাগানো উচিত। ঘ. অসৎকর্ম করতে থাকাটা অশুভ পরিণামের আলামত। তাই এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা এবং দ্রুত তাওবা করে নিজেকে সংশোধন করে ফেলা একান্ত জরুরি।

তাহকীক:
তাহকীক নিষ্প্রয়োজন