আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৫৪৭
৩৪৬২. জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা।
৬১০৪। মুসাদ্দাদ (রাহঃ) ......... উসামা ইবনে যায়দ (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম, (এরপর দেখতে পেলাম যে) তথায় যারা প্রবেশ করেছে তারা অধিকাংশই নিঃস্ব। আর ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আব্দ্ধ অবস্থায় রয়েছে। আর জাহান্নামীদের জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দেওয়া হয়েছে। এরপর আমি জাহান্নামের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন (দেখতে পেলাম যে) এখানে প্রবেশ কারীদের অধিকাংশই হচ্ছে নারী।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছের আলোচনা মৌলিকভাবে দু'টি বিষয়ে- ক. বেশিরভাগ জান্নাতবাসীর গরীবশ্রেণীভুক্ত হওয়া এবং খ. বেশিরভাগ জাহান্নামীর নারীদের মধ্য থেকে হওয়া।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- قمت على باب الجنة (আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম)। তিনি জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হয়তো মি'রাজের সফরে অথবা স্বপ্নযোগে। একবার সূর্যগ্রহণের নামায অবস্থায়ও তাঁর সামনে জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছিল। যেভাবেই হোক তাঁকে জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয়, যাতে তিনি উম্মতকে সে ব্যাপারে অবহিত করেন আর এভাবে নিজে দেখা জান্নাতের মনোরম দৃশ্য বর্ণনা করে তাদেরকে তার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন এবং জাহান্নামের বীভৎস আযাবের কথা বর্ণনা করে তাদেরকে তা থেকে আত্মরক্ষার প্রেরণা যোগান।
তিনি জান্নাতের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন- فاذا عامة من دخلها المساكين (দেখি কি তাতে প্রবেশকারী অধিকাংশ লোকই গরীব-মিসকীন)। এর মানে গরীবমাত্রই জান্নাতে যাবে এমন নয়। বস্তুত এর দ্বারা এমন গরীব বোঝানো উদ্দেশ্য, যারা প্রকৃত দীনদার অর্থাৎ ওই গরীব, যে ধনীর প্রতি হাসাদ করে না, নিজ গরীবি হালের উপর সবর করে ও সন্তুষ্ট থাকে এবং গরীবি অবস্থাকে সে এ হিসেবে এক নিআমতও মনে করে যে, অর্থ সম্পদ কম বলে আশা করা যায় আখেরাতের হিসাবও আসান হবে। সেইসঙ্গে সে তার অভাব-অনটনকে শরীআতের অনুসরণ থেকে পিছিয়ে থাকার অজুহাত বানায় না; বরং অর্থবিত্তের বহুবিধ ফ্যাসাদ থেকে মুক্ত থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পূর্ণোদ্যমে শরীআতের বিধানাবলি পালনে যত্নবান থাকে। এ শ্রেণীর গরীব যেহেতু দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা ও ভোগ-বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত থাকে, সেইসঙ্গে ধনী ও প্রভাবশালী মহল দ্বারা নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয় এবং তা সত্ত্বেও সবরের সীমানা লঙ্ঘন করে না, তাই এর প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জান্নাতের অনন্ত অফুরন্ত নিআমত দান করবেন।
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধনীদের কোন্ অবস্থায় দেখেছিলেন সে সম্পর্কে জানান- واصحاب الجد محبوسون (আর বিত্তবানদের আটকে রাখা হয়েছে)। অর্থাৎ তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে হিসাব নিকাশের জন্য। এর দ্বারা ওই সকল ধনীকে বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করেনি। হয়তো ঠিকভাবে যাকাত আদায় করেনি, ক্ষুধার্তকে অন্নদান করেনি কিংবা অন্যান্য যেসকল ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা খরচ করা জরুরি ছিল সেসব ক্ষেত্রে খরচ করেনি। এ কারণেই তাদেরকে অর্থ-সম্পদের হিসাব দিতে হবে আর সেজন্যই তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে যেসকল ধনী আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করে এবং যাকাতসহ মালের অন্যান্য হক আদায় করে তাদেরকে আটকে রাখা হবে না। তারা সহজেই জান্নাতে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এরকম ধনীর সংখ্যা বড় কম। মানুষের স্বভাবই হল যত বেশি ধন-সম্পদ অর্জিত হয়, ততই অহংকারী ও অবাধ্য-স্পর্ধিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ তাআলা বলেন (كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى (6) أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى (7 'বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য অবাধ্যতা করে, যখন সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখে।২৬২
তাছাড়া সম্পদ বৃদ্ধির সাথে অন্তরে লোভ ও কৃপণতাও বাড়তে থাকে। ফলে এক তো কৃপণতার কারণে যথাযথভাবে যাকাতও আদায় করে না এবং মালের অন্যান্য হকও আদায় করতে পারে না। দ্বিতীয়ত লোভের বশবর্তীতে হালাল হারাম নির্বিচারে সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করে। কাজেই তাদেরকে আয়েরও হিসাব দিতে হবে এবং ব্যয়েরও। এক হাদীছে আছে, বান্দা পাঁচটি বিষয়ের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আপন জায়গা থেকে সরতে পারবে না। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- সে কোন পথে সম্পদ অর্জন করেছিল, আরেকটি হচ্ছে সে কোন্ কোন্ খাতে তা ব্যয় করেছিল। সুতরাং যতবেশি সম্পদ এ হিসাবও ততবেশি কঠিনই হবে। ফলে দীর্ঘ সময় তাদেরকে আটকা পড়ে থাকতে হবে। আর এ অবকাশে গরীবগণ জান্নাতে চলে যাবে।
কেউ কেউ বলেন, ধনীদেরকে আটকে রাখা হবে তাদের আগে গরীবদেরকে জান্নাতে যেতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যেমন এক হাদীছে আছে يدخل الفقراء الجنة قبل الأغنياء بخمسمائة عام نصف يوم 'গরীবগণ ধনীদের পাঁচশ বছর আগে জান্নাতে যাবে, যা (আখেরাতের হিসেবে) আধা দিন পরিমাণ।২৬৩
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন غير أن أصحاب النار قد أمر بهم إلى النار (অবশ্য যারা জাহান্নামী তাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়ে দেওয়া হয়েছে)। অর্থাৎ যারা ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারেনি বেঈমান অবস্থায়ই মারা গেছে তাদের না আছে হিসাব-নিকাশ না আছে আমলের ওজন করার কোনও ব্যাপার। কাজেই তাদেরকে আটকে রাখার কোনও প্রয়োজন হবে না। বিনা হিসাবেই জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহান্নামের যে দৃশ্য দেখেছিলেন তার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন (আমি জাহান্নামের দরজায় দাঁড়ালাম, দেখি কি তাতে প্রবেশকারীদের অধিকাংশই নারী)। এটা প্রথম অবস্থা হিসেবে। অর্থাৎ প্রথমদিকে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি থাকবে। পরে যারা ঈমান নিয়ে মারা যাবে, ঈমানের বদৌলতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। ফলে তারা জান্নাতে চলে যাবে। তখন জান্নাতে পুরুষ ও নারী উভয়ের সংখ্যাই বেশি হয়ে যাবে। তাদের প্রথমদিকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ এমনকিছু দোষ, যা সাধারণত তাদের মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা দান-সদাকা করো, কেননা তোমরাই জাহান্নামে বেশি যাবে। তখন সাধারণ স্তরের এক নারী প্রশ্ন করল, তা কী কারণে? তিনি বললেন تكثرن اللعن، وتكفرن العشير 'তোমরা বেশি বেশি লানত কর এবং স্বামীর অকৃতজ্ঞতা কর।২৬৪
অন্যান্য পাপ নারী-পুরুষ উভয়ই সাধারণত সমানই করে। কিন্তু লানত করার পাপ তুলনামূলক নারীদের মধ্যে বেশি। আর স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা তো তাদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ কারণেই প্রথমদিকে জাহান্নামে তাদের সংখ্যা বেশি হবে।
হাদীছটির এরকম ব্যাখ্যাও করা যায় যে, জাহান্নামে তাদের সংখ্যা বেশি হওয়ার অর্থ পুরুষদের তুলনায় বেশি হওয়া নয়; বরং নারীদের মধ্যেই যারা জাহান্নামে যাবে তাদের একদলের তুলনায় অন্যদলের সংখ্যা বেশি বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তাদের অনেককেই বিভিন্ন কারণে জাহান্নামে যেতে হবে বটে, কিন্তু লা'নত করা ও স্বামীর অবাধ্যতা করার অপরাধে যারা জাহান্নামে যাবে তাদের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি হবে।
উল্লেখ্য স্বামীর অবাধ্যতা করা যেমন পাপ, তেমনি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি জুলুম-নির্যাতন করাও পাপ বৈকি। অনেক স্বামীই এ পাপ করে থাকে। এর থেকে তাদের বিরত হওয়া উচিত। অন্যথায় এ কারণে তাদেরকেও আখেরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকেই জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি হয়ে আছে।
খ. এ হাদীছ দ্বারা আরও জানা যায়, দীনদার গরীবগণ ধনীদের আগে জান্নাতে যাবে। সুতরাং গরীব দেখে কাউকে হেলা করতে নেই।
গ. আল্লাহ তাআলা যাদেরকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তাদের অবশ্যকর্তব্য তার হক আদায় করা, অন্যথায় আখেরাতে কঠিন হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন হতে হবে।
ঘ. এমন কিছু পাপ আছে, যা সাধারণত মহিলারাই বেশি করে থাকে। তাদের উচিত সেগুলো ছেড়ে দেওয়া, যাতে সেসব পাপের কারণে জাহান্নামে যেতে না হয়। তারা যাতে সেসব পাপ ছাড়তে পারে, পুরুষের উচিত সে ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করা।
২৬২. সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ৬-৭
২৬৩. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৫৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১২২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৮২৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩৪৩৯২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৭৬; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৭৬০৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৮৯৭
২৬৪. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৫৬৯; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১০৪৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩২৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩১০৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৭৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৯
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- قمت على باب الجنة (আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়ালাম)। তিনি জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হয়তো মি'রাজের সফরে অথবা স্বপ্নযোগে। একবার সূর্যগ্রহণের নামায অবস্থায়ও তাঁর সামনে জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছিল। যেভাবেই হোক তাঁকে জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হয়, যাতে তিনি উম্মতকে সে ব্যাপারে অবহিত করেন আর এভাবে নিজে দেখা জান্নাতের মনোরম দৃশ্য বর্ণনা করে তাদেরকে তার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন এবং জাহান্নামের বীভৎস আযাবের কথা বর্ণনা করে তাদেরকে তা থেকে আত্মরক্ষার প্রেরণা যোগান।
তিনি জান্নাতের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন- فاذا عامة من دخلها المساكين (দেখি কি তাতে প্রবেশকারী অধিকাংশ লোকই গরীব-মিসকীন)। এর মানে গরীবমাত্রই জান্নাতে যাবে এমন নয়। বস্তুত এর দ্বারা এমন গরীব বোঝানো উদ্দেশ্য, যারা প্রকৃত দীনদার অর্থাৎ ওই গরীব, যে ধনীর প্রতি হাসাদ করে না, নিজ গরীবি হালের উপর সবর করে ও সন্তুষ্ট থাকে এবং গরীবি অবস্থাকে সে এ হিসেবে এক নিআমতও মনে করে যে, অর্থ সম্পদ কম বলে আশা করা যায় আখেরাতের হিসাবও আসান হবে। সেইসঙ্গে সে তার অভাব-অনটনকে শরীআতের অনুসরণ থেকে পিছিয়ে থাকার অজুহাত বানায় না; বরং অর্থবিত্তের বহুবিধ ফ্যাসাদ থেকে মুক্ত থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পূর্ণোদ্যমে শরীআতের বিধানাবলি পালনে যত্নবান থাকে। এ শ্রেণীর গরীব যেহেতু দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা ও ভোগ-বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত থাকে, সেইসঙ্গে ধনী ও প্রভাবশালী মহল দ্বারা নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয় এবং তা সত্ত্বেও সবরের সীমানা লঙ্ঘন করে না, তাই এর প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে জান্নাতের অনন্ত অফুরন্ত নিআমত দান করবেন।
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধনীদের কোন্ অবস্থায় দেখেছিলেন সে সম্পর্কে জানান- واصحاب الجد محبوسون (আর বিত্তবানদের আটকে রাখা হয়েছে)। অর্থাৎ তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে হিসাব নিকাশের জন্য। এর দ্বারা ওই সকল ধনীকে বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করেনি। হয়তো ঠিকভাবে যাকাত আদায় করেনি, ক্ষুধার্তকে অন্নদান করেনি কিংবা অন্যান্য যেসকল ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা খরচ করা জরুরি ছিল সেসব ক্ষেত্রে খরচ করেনি। এ কারণেই তাদেরকে অর্থ-সম্পদের হিসাব দিতে হবে আর সেজন্যই তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে যেসকল ধনী আল্লাহ তা'আলার হক আদায় করে এবং যাকাতসহ মালের অন্যান্য হক আদায় করে তাদেরকে আটকে রাখা হবে না। তারা সহজেই জান্নাতে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এরকম ধনীর সংখ্যা বড় কম। মানুষের স্বভাবই হল যত বেশি ধন-সম্পদ অর্জিত হয়, ততই অহংকারী ও অবাধ্য-স্পর্ধিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ তাআলা বলেন (كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى (6) أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى (7 'বস্তুত মানুষ প্রকাশ্য অবাধ্যতা করে, যখন সে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেখে।২৬২
তাছাড়া সম্পদ বৃদ্ধির সাথে অন্তরে লোভ ও কৃপণতাও বাড়তে থাকে। ফলে এক তো কৃপণতার কারণে যথাযথভাবে যাকাতও আদায় করে না এবং মালের অন্যান্য হকও আদায় করতে পারে না। দ্বিতীয়ত লোভের বশবর্তীতে হালাল হারাম নির্বিচারে সম্পদ অর্জনের চেষ্টা করে। কাজেই তাদেরকে আয়েরও হিসাব দিতে হবে এবং ব্যয়েরও। এক হাদীছে আছে, বান্দা পাঁচটি বিষয়ের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আপন জায়গা থেকে সরতে পারবে না। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- সে কোন পথে সম্পদ অর্জন করেছিল, আরেকটি হচ্ছে সে কোন্ কোন্ খাতে তা ব্যয় করেছিল। সুতরাং যতবেশি সম্পদ এ হিসাবও ততবেশি কঠিনই হবে। ফলে দীর্ঘ সময় তাদেরকে আটকা পড়ে থাকতে হবে। আর এ অবকাশে গরীবগণ জান্নাতে চলে যাবে।
কেউ কেউ বলেন, ধনীদেরকে আটকে রাখা হবে তাদের আগে গরীবদেরকে জান্নাতে যেতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যেমন এক হাদীছে আছে يدخل الفقراء الجنة قبل الأغنياء بخمسمائة عام نصف يوم 'গরীবগণ ধনীদের পাঁচশ বছর আগে জান্নাতে যাবে, যা (আখেরাতের হিসেবে) আধা দিন পরিমাণ।২৬৩
অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন غير أن أصحاب النار قد أمر بهم إلى النار (অবশ্য যারা জাহান্নামী তাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়ে দেওয়া হয়েছে)। অর্থাৎ যারা ঈমান নিয়ে কবরে যেতে পারেনি বেঈমান অবস্থায়ই মারা গেছে তাদের না আছে হিসাব-নিকাশ না আছে আমলের ওজন করার কোনও ব্যাপার। কাজেই তাদেরকে আটকে রাখার কোনও প্রয়োজন হবে না। বিনা হিসাবেই জাহান্নামে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাহান্নামের যে দৃশ্য দেখেছিলেন তার বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন (আমি জাহান্নামের দরজায় দাঁড়ালাম, দেখি কি তাতে প্রবেশকারীদের অধিকাংশই নারী)। এটা প্রথম অবস্থা হিসেবে। অর্থাৎ প্রথমদিকে জাহান্নামে নারীদের সংখ্যা বেশি থাকবে। পরে যারা ঈমান নিয়ে মারা যাবে, ঈমানের বদৌলতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। ফলে তারা জান্নাতে চলে যাবে। তখন জান্নাতে পুরুষ ও নারী উভয়ের সংখ্যাই বেশি হয়ে যাবে। তাদের প্রথমদিকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ এমনকিছু দোষ, যা সাধারণত তাদের মধ্যেই বেশি পাওয়া যায়। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা দান-সদাকা করো, কেননা তোমরাই জাহান্নামে বেশি যাবে। তখন সাধারণ স্তরের এক নারী প্রশ্ন করল, তা কী কারণে? তিনি বললেন تكثرن اللعن، وتكفرن العشير 'তোমরা বেশি বেশি লানত কর এবং স্বামীর অকৃতজ্ঞতা কর।২৬৪
অন্যান্য পাপ নারী-পুরুষ উভয়ই সাধারণত সমানই করে। কিন্তু লানত করার পাপ তুলনামূলক নারীদের মধ্যে বেশি। আর স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞতা তো তাদেরই মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ কারণেই প্রথমদিকে জাহান্নামে তাদের সংখ্যা বেশি হবে।
হাদীছটির এরকম ব্যাখ্যাও করা যায় যে, জাহান্নামে তাদের সংখ্যা বেশি হওয়ার অর্থ পুরুষদের তুলনায় বেশি হওয়া নয়; বরং নারীদের মধ্যেই যারা জাহান্নামে যাবে তাদের একদলের তুলনায় অন্যদলের সংখ্যা বেশি বোঝানো উদ্দেশ্য। অর্থাৎ তাদের অনেককেই বিভিন্ন কারণে জাহান্নামে যেতে হবে বটে, কিন্তু লা'নত করা ও স্বামীর অবাধ্যতা করার অপরাধে যারা জাহান্নামে যাবে তাদের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি হবে।
উল্লেখ্য স্বামীর অবাধ্যতা করা যেমন পাপ, তেমনি স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি জুলুম-নির্যাতন করাও পাপ বৈকি। অনেক স্বামীই এ পাপ করে থাকে। এর থেকে তাদের বিরত হওয়া উচিত। অন্যথায় এ কারণে তাদেরকেও আখেরাতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকেই জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায়, জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি হয়ে আছে।
খ. এ হাদীছ দ্বারা আরও জানা যায়, দীনদার গরীবগণ ধনীদের আগে জান্নাতে যাবে। সুতরাং গরীব দেখে কাউকে হেলা করতে নেই।
গ. আল্লাহ তাআলা যাদেরকে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তাদের অবশ্যকর্তব্য তার হক আদায় করা, অন্যথায় আখেরাতে কঠিন হিসাব-নিকাশের সম্মুখীন হতে হবে।
ঘ. এমন কিছু পাপ আছে, যা সাধারণত মহিলারাই বেশি করে থাকে। তাদের উচিত সেগুলো ছেড়ে দেওয়া, যাতে সেসব পাপের কারণে জাহান্নামে যেতে না হয়। তারা যাতে সেসব পাপ ছাড়তে পারে, পুরুষের উচিত সে ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা করা।
২৬২. সূরা আলাক (৯৬), আয়াত ৬-৭
২৬৩. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩৫৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪১২২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৯৮২৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, হাদীছ নং ৩৪৩৯২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৭৬; তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হাদীছ নং ৭৬০৫; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৮৯৭
২৬৪. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৪০০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৫৬৯; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১০৪৭; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩২৩; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩১০৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৪৭৪; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২৯
