আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৯২
৩৪৪৪. সগীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
৬০৪৮। আবুল ওয়ালীদ (রাহঃ) ......... আনাস (রাযিঃ) বলেনঃ তোমরা এমন সব কাজ করে থাক, যা তোমাদের চোখে চুল থেকেও সূক্ষ্ম দেখায়। কিন্তু নবী (ﷺ) এর যমানায় আমরা এগুলোকে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম।
আবু আব্দুল্লাহ বুখারী (রাহঃ) বলেন, الْمُهْلِكَاتِ অর্থাৎ “ধ্বংসাত্মক”।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হযরত আনাস রাযি. একজন দীর্ঘজীবী সাহাবী ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরও প্রায় নব্বই বছর জীবিত ছিলেন। এ সময়কালের ভেতর মানুষের দীনী অবস্থার কী পরিবর্তন ঘটেছে, তা লক্ষ করেছেন। তিনি একজন সাহাবী । সব সাহাবীই নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার শতভাগ অনুসরণের চেষ্টা করতেন। তাঁদের যারা সাহচর্য পেয়েছিলেন, তারাও তাঁদের মত দীনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের চেষ্টা করতেন। কিন্তু কালক্রমে মানুষের মধ্যে শৈথিল্য দেখা দিতে থাকে। এমনকি নামায আদায়ের ক্ষেত্রেও তারা অবহেলা শুরু করে দেয়। আগে যেমন জামাতের পাবন্দী ছিল, লোকে সেরকম পাবন্দী আর করে না। যতটুকু করে তাও মুস্তাহাব ওয়াক্তে নয়, দেরি করে পড়ে। তাদের গাফলাতি লক্ষ করে একবার তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- দীনের যে রূপ নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় আমরা দেখেছি, এখন আর তা দেখতে পাচ্ছি না। সে রকমেরই এক আক্ষেপ এ হাদীছে লক্ষ করা যায়। তিনি বলেন, তোমরা এমন এমন কাজ কর, যা তোমাদের চোখে চুলের চেয়েও চিকন। অর্থাৎ শরী'আতবিরোধী কাজ কর, যে কাজ করলে পাপ হয়। কিন্তু তোমরা সে পাপকে তুচ্ছ মনে কর। তা যে পাপ, তাতে আল্লাহ তা'আলা নারাজ হন এবং পরকালে সেজন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে, তার প্রতি কোনও ভ্রুক্ষেপ কর না। অথচ আমরা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সেসব কাজকে ধ্বংসাত্মক গণ্য করতাম। মনে করতাম তা করলে ধ্বংস হয়ে যাব। পাপে লিপ্ত হওয়া

তো নিজেকে ধ্বংস করাই। যে-কোনও পাপই আল্লাহর অবাধ্যতা। মহামহিম আল্লাহর অবাধ্যতা কতই না সাংঘাতিক ব্যাপার। তাকে তুচ্ছ মনে করা যায় কিভাবে? তাই তো এক বর্ণনায় আছে-

لا تنظر إلى صغر الخطية والكر إلى من عضيت '

গুনাহের ক্ষুদ্রতার দিকে লক্ষ করো না, লক্ষ করো তুমি কার অবাধ্যতা করছ।

একবার আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে লক্ষ্য করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

يَا عَائِشَهُ إِيَّاكِ وتخرَاتِ الذُّنوبِ فَإِن لَهَا مِنَ اللهِ طالبًا

“হে আয়েশা! সাবধান! যেসব গুনাহ তুচ্ছ মনে করা হয়, তা থেকেও বিরত থেকো। কারণ সেসবের ব্যাপারেও আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুসন্ধানকারী (ফিরিশতা) আছে।

কোনও গুনাহকে তুচ্ছ মনে করা মু'মিনের কাজ নয়
আসলে কোনও গুনাহকেই তুচ্ছ মনে করা যায় না। গুনাহই তো আখিরাতে জাহান্নামের আগুন হয়ে জ্বালাবে। আগুন আগুনই, তা বড় হোক বা ছোট। অনেক সময় তুচ্ছ একটুখানি আগুনেই গোটা একটা এলাকা পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। তাই সামান্য আগুনকেও কেউ অবহেলার চোখে দেখে না। তেমনি গুনাহকেও অবহেলার চোখে দেখা উচিত নয়। ছোট গুনাহকে অবহেলার চোখে দেখলে বাস্তবে তা ছোট থাকে না, যেমন সামান্য আগুনকে অবহেলা করলে তা সামান্য থাকে না। বিশেষত গুনাহ যখন আল্লাহর অবাধ্যতা, আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা, সে বিবেচনায় কোনও অবস্থায়ই তাকে ক্ষুদ্র ভাবা যেতে পারে না। গুনাহকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে করা মু'মিনের শান নয়। গুনাহকে অবহেলা করা ফাসেক ফাজের ব্যক্তির কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-

«إن المؤمن يرى ذنوبه كأنه في أصل جبل يخاف أن يقع عليه، وإن الفاجر يرى ذنوبه مثل ذباب مر على أنفه فذبه عنه»

'মুমিন ব্যক্তি তার পাপসমূহকে এমন মনে করে, যেন সে কোনও পাহাড়ের পাদদেশে আছে। আর তার ভয় নাজানি পাহাড়টি তার উপর পতিত হয় (আর তার নিচে পিষ্ট হয়ে সে মারা যায়)। অপরদিকে ফাসেক ব্যক্তি গুনাহকে মনে করে যেন একটা। মাছি তার নাকের উপর পড়ল, আর সে সেটি তার থেকে তাড়িয়ে দিল।

হযরত সাহল ইবন সা'দ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা ওই সকল গুনাহ থেকে বেঁচে থাক, যাকে তুচ্ছ মনে করা হয়। কেননা এ সকল গুনাহের দৃষ্টান্ত এরকম, যেমন একদল লোক কোনও উপত্যকার মাঝখানে অবস্থান নিল। তারপর তাদের কেউ একখণ্ড কাঠ নিয়ে আসল, আরেকজন আরেকখণ্ড কাঠ নিয়ে আসল। এভাবে অনেক কাঠ জমা হয়ে গেল। তারপর তা জ্বালাল এবং তা দ্বারা তারা তাদের খাবার রান্না করল। তুচ্ছ গুনাহসমূহ এ রকমই। কোনও ব্যক্তিকে সেসব গুনাহের কারণে ধরা হলে তা তাকে ধ্বংস করে দেবে।

এ হাদীছ দ্বারা বোঝানো হচ্ছে, অনেকগুলো ছোট ছোট কাষ্ঠখণ্ড দ্বারা আগুন জ্বালিয়ে যেমন কোনও খাদ্য সেদ্ধ করে ফেলা যায়, তেমনি অনেকগুলো ছোট ছোট গুনাহের দ্বারাও মানুষ জাহান্নামে পুড়ে দগ্ধ হওয়ার উপযুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং ছোট গুনাহকে বাস্তবিকপক্ষে ছোট মনে করার কোনও সুযোগ নেই।

ইব্‌ন বাত্তাল রহ. বলেন, ছোট গুনাহ যখন অনেক হয়ে যায়, তখন তা বড় গুনাহে পরিণত হয়। অর্থাৎ একটি সগীরা গুনাহ বার বার করার দ্বারা কবীরা গুনাহের পর্যায়ে চলে যায়। সুতরাং কেউ যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, কিন্তু সগীরা গুনাহ বেশি বেশি করতে থাকে, তবে অবসম্ভব নয় সেই সগীরা গুনাহসমূহই তার ধ্বংসের কারণ হয়ে যাবে।

হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী রাযি. বলেন, কোনও ব্যক্তি নেককাজ করে এবং তার উপর ভরসা করে। অন্যদিকে সে ছোট ছোট গুনাহের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে থাকে। তারপর সে যখন আল্লাহর সংগে সাক্ষাত করে, তখন সেই সগীরা গুনাহসমূহ দ্বারা সে থাকে পরিবেষ্টিত (যা তাকে ধ্বংস করে দেয়)। অপরদিকে কোনও ব্যক্তি বড় বড় গুনাহ করে আর তার ভয়ে সর্বদা ভীত থাকে। এ অবস্থায় যখন সে আল্লাহর সংগে সাক্ষাত করবে, তখন সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে।

বস্তুত সাহাবায়ে কিরামের সকলেই গুনাহমাত্রকেই ধ্বংসাত্মক মনে করতেন। সগীরা বলে কোনও গুনাহকে তারা অবহেলা করতেন না। কিন্তু আজ আমাদের কী অবস্থা?

কবীরা গুনাহও করে যাচ্ছি অবলীলায়! সগীরা গুনাহের তো কোনও পরওয়াই করছি না। যেন তা কোনও গুনাহই নয়! কোনও গুনাহের ব্যাপারে যেই শুনি সেটি সগীরা, অমনি ধরে নিই তা করলে কোনও অসুবিধা নেই। ব্যস নির্দ্বিধায় করে যাই। আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সগীরা বলে কোনও গুনাহকেই অবহেলা করা যায় না।

খ. সগীরা গুনাহকেও ধ্বংসকর মনে করা সাহাবায়ে কিরামের শান। মু'মিন মাত্রেরই এ গুণ অর্জন করা উচিত।

গ. সগীরা গুনাহকে তুচ্ছ মনে করা ফাসেক ব্যক্তির কাজ। এর থেকে বিরত থাকা উচিত ।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন