আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৯০
৩৪৪২. মানুষ যেন নিজের চেয়ে নিন্মস্তর ব্যক্তির দিকে তাকায় আর নিজের চেয়ে উচ্চস্তর ব্যক্তির দিকে যেন না তাকায়।
৬০৪৬। ইসমাঈল (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের কারো দৃষ্টি যদি এমন ব্যক্তির উপর নিপতিত হয়, যাকে সম্পদে ও দৈহিক গঠনে বেশী মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তবে সে যেন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যে তার চেয়ে হীন অবস্থায় রয়েছে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটির সম্পর্ক দুনিয়াবী বিষয়ের সঙ্গে। অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, চেহারা-সুরত, গায়ের রং ইত্যাদি সকল কিছুতে নিয়ম শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, যারা উপরে আছে বলে মনে হয় তাদের দিকে না তাকিয়ে যারা নিচে আছে তাদের দিকে তাকাতে হবে। কেন এ নীতি অবলম্বন করতে হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
فهو اجدر أن لا تزدروا نعمة الله عليكم
(এটাই তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে তুচ্ছ মনে না করার পক্ষে বেশি সহায়ক)।
কেননা কোনও ব্যক্তি যখন তারচে' বেশি ধনী, বেশি ক্ষমতাবান, বেশি প্রভাবশালী, বেশি স্বাস্থ্যবান বা বেশি রূপবান ব্যক্তিদের দিকে তাকাবে, তখন নিজেকে এসব দিক থেকে তাদেরচে' ছোট মনে হবে। নিজের যা আছে তা তার কাছে অল্প মনে হবে। ফলে তার নিজের মনেও ওইসব লোকের মত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগবে এবং তাদের মত না হওয়ার কারণে তার আক্ষেপবোধ হবে। এর দ্বারা প্রকারান্তরে আল্লাহ তা'আলা তাকে যা দিয়েছেন তার অমর্যাদা করা হয়। এভাবে আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতকে তুচ্ছ গণ্য করা হয়। আল্লাহর দেওয়া যে কোনও নি'আমতকে তুচ্ছ গণ্য করা সে নি'আমতের অকৃতজ্ঞতাই বটে। এভাবে উপরের দিকে তাকানোর দ্বারা বান্দা আল্লাহ তা'আলার নাশোকর ও অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। অকৃতজ্ঞ বান্দা আল্লাহর পসন্দ নয়।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজের তুলনায় নিচের লোকদের দিকে তাকায়, তার কাছে আল্লাহ তা'আলা তাকে যা-কিছু দিয়েছেন তা অনেক বড় ও অনেক মূল্যবান মনে হয়। এটা অন্তরে কৃতজ্ঞতাবোধ সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক। আল্লাহ তা'আলা কৃতজ্ঞ বান্দাদের পসন্দ করেন। এ নীতি পার্থিব জীবনে সুখী হওয়ারও চাবিকাঠি। কেননা যে ব্যক্তি শুধু উপরের লোকদের দিকে তাকায়, সে সর্বদা অন্তর্জালায় ভোগে। এক রকম হীনম্মন্যতাবোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। অপরদিকে যে ব্যক্তি তার নিচের লোকদের দিকে তাকায়, তার দৃষ্টিতে তার নিজের অবস্থা যথেষ্ট ভালো মনে হয়। ফলে সে তাতে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকে। এভাবে সে একজন সুখী মানুষরূপে ইহজীবন কাটাতে পারে।
জনৈক বুযুর্গ বলেন, আমি ধনী লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতে থাকলাম। আমি দেখলাম তাদের প্রশস্ত বাড়ি, দামি বাহন ও চমৎকার আসবাব-উপকরণ, যার কিছুই আমার কাছে নেই। এর ফলে আমি বড় দুঃখের ভেতর দিন কাটাচ্ছিলাম। শেষে আমি গরীবদের সাহচর্য গ্রহণ করলাম। এতে করে আমি সে দুঃখ কাটিয়ে উঠি এবং মনে সুখ অনুভব করি। সুতরাং এক হাদীছে হুকুম দেওয়া হয়েছে
أقلوا الدخول على الأغنياء فإنه أجدر ألا تزدروا نعمة الله عز وجل
'তোমরা ধনীদের কাছে আসা-যাওয়া কমাও। এটা আল্লাহর নি'আমতকে তুচ্ছ গণ্য না করার পক্ষে বেশি সহায়ক।
কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى
“তুমি পার্থিব জীবনের ওই চাকচিক্যের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ো না, যা আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন শ্রেণীকে মজা লোটার জন্য দিয়ে রেখেছি, তা দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। বস্তুত তোমার রব্বের রিযিক সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী।"
এ নীতি মানুষের চারিত্রিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখে। যে ব্যক্তি তারচে' ভালো অবস্থাসম্পন্ন লোকদের দিকে তাকাতে অভ্যস্ত, তার অন্তরে পরশ্রীকাতরতা ও লোভ লালসা বাড়তে থাকে। এর থেকে আরও নানা চারিত্রিক দোষ জন্ম নেয়। সে হয়ে যায় কৃপণ, লোভী, স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। অন্যদিকে নিচের লোকদের দিকে তাকানোই যার অভ্যাস, সে এসব দোষ থেকে মুক্ত থাকে। উদারতা, বদান্যতা, সহমর্মিতা, পরার্থপরতা প্রভৃতি সদগুণে সে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
দীনের ক্ষেত্রে নিজের চেয়ে অগ্রগামীদের দিকে তাকানো
বলাবাহুল্য, এ নীতি দুনিয়াবী বিষয়ে প্রযোজ্য, দীনী বিষয়ে নয়। দীনী বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে নিয়ম এর বিপরীত। সে ক্ষেত্রে কর্তব্য নিজের চেয়ে অগ্রগামী ব্যক্তির দিকে লক্ষ করা, নিজের চেয়ে নিচের ব্যক্তির দিকে নয়। এ ক্ষেত্রে নিচের দিকে লক্ষ করলে অন্তরে আত্মমুগ্ধতা জন্মায় এবং আমলে অধঃপতন আসে। কেননা তখন মনে হয় আমার আমল তো যথেষ্ট ভালো। এই ভালোত্বের বোধ গাফলাত ও উদাসীনতা জন্ম দেয়। ফলে আস্তে আস্তে আমল ছুটতে শুরু করে। তাই দীনী বিষয়ে নিচের দিকে নয়; বরং উপরের দিকে লক্ষ করা জরুরি। হাদীছ আমাদেরকে সে শিক্ষাই দেয়। যেমন এক হাদীছে আছে
خصلتان من كانتا فيه كتبه الله شاكرا صابرا، ومن لم تكونا فيه لم يكتبه الله شاكرا ولا صابرا، من نظر في دينه إلى من هو فوقه فاقتدى به، ونظر في دنياه إلى من هو دونه فحمد الله على ما فضله به عليه كتبه الله شاكرا و صابرا، ومن نظر في دينه إلى من هو دونه، ونظر في دنياه إلى من هو فوقه فأسف على ما فاته منه لم يكتبه الله شاكرا ولا صابرا
“দুটি গুণ এমন, যা কারও মধ্যে থাকলে আল্লাহ তা'আলা শাকির (কৃতজ্ঞ) ও সাবির (ধৈর্যশীল) হিসেবে তার নাম লিখে দেন। যার মধ্যে গুণদুটি থাকে না, শাকির ও সাবিররূপে তার নাম লেখা হয় না। যে ব্যক্তি তার দীনদারীর ক্ষেত্রে তার উপরের লোকের দিকে তাকায় ও তার অনুসরণ করে, আর দুনিয়ার ব্যাপারে তার নিচের লোকদের দিকে তাকায় এবং আল্লাহ তা'আলা তাকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায় করে, আল্লাহ তা'আলা সাবির ও শাকির হিসেবে তার নাম লেখেন। অপরদিকে যে ব্যক্তি দীনদারীর ক্ষেত্রে তারচে' নিচের লোকদের দিকে তাকায় আর দুনিয়াদারীর ব্যাপারে তাকায় তারচে' উপরের লোকের দিকে, ফলে সে যা পায়নি সেজন্য আক্ষেপ করে, আল্লাহ তা'আলা শাকির ও সাবিররূপে তার নাম লেখেন না।"
ইমাম ইবন বাত্তাল রহ., আলোচ্য হাদীছটি সম্পর্কে বলেন, এ হাদীছটি সর্বপ্রকার কল্যাণের ধারক। কেননা কোনও ব্যক্তি ইবাদত-বন্দেগীতে যে স্তরের সাধকই হোক না কেন, সে লক্ষ করলে কাউকে না কাউকে তারচে' উপরে পাবেই। কাজেই সে যখনই কাউকে তার উপরে দেখতে পাবে, তখন যদি সে তার স্তরে পৌঁছতে সচেষ্ট থাকে, তবে সে অব্যাহতভাবে তার রব্বের নৈকট্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। আবার পার্থিব দিক থেকে সে যতই গরীব ও অবহেলিত থাকুক, সে যদি চারদিকে লক্ষ করে তবে তারচে'ও আরও নিম্ন অবস্থার কাউকে না কাউকে পাবে। এ অবস্থায় সে নিজেকে তার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝতে পারবে আল্লাহ তা'আলা তাকে কত কত নি'আমত দান করেছেন। এতে করে তার শোকর আদায়ের অনুপ্রেরণা জাগবে।
বস্তুত হাদীছটি সকল রোগের দাওয়াই। কেননা প্রত্যেকেরই কখনও না কখনও তারচে' ভালো অবস্থাসম্পন্ন লোক নজরে আসে। ফলে তার অন্তরে হাসাদ সৃষ্টির যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় সে যদি তারচে' নিচের লোকের দিকে লক্ষ করে, তবে সে হাসাদের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যাবে এবং নিজের যা আছে সেজন্য শোকরগুযার হতে পারবে।
লক্ষণীয়: নিজের চেয়ে নিম্নাবস্থার লোকের দিকে লক্ষ করতে বলা হয়েছে নিজ নি'আমতের মূল্য অনুধাবন করার জন্য। অনেক লোক এমনও আছে, যারা নিজের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের লোক দেখলে নিজেকে তারচে' বড় মনে করে এবং তাকে ছোট করে দেখে। এটা অহংকার। কাজেই দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করতে হবে। নিচের দিকে তাকানোর উদ্দেশ্য হতে হবে নিজ প্রাপ্তির জন্য অন্তরে সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত করা, অন্যের উপর গৌরব করা নয়। মনে রাখতে হবে আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিটি নি'আমতের দাবি হল আল্লাহ তা'আলার কাছে শোকরগুযার হয়ে থাকা। কোনও নি'আমতকে অহমিকার কারণ বানানো সেই নি'আমতের অমর্যাদা করা ও অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের নামান্তর।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াবী দিক থেকে যাকে যে অবস্থায় রেখেছেন, সে অবস্থাকে হীন মনে করতে নেই। বরং তার মূল্যায়ন করা ও তাতে সন্তুষ্ট থাকা চাই।
খ. নিজের চেয়ে ভালো অবস্থাসম্পন্ন লোকের দিকে তাকানোর দ্বারা অন্তরে লোভ লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও হিনম্মন্যতাবোধ জন্ম নেয়। তাই এর থেকে বিরত উচিত।
গ. নিজের চেয়ে নিম্নাবস্থার লোকের দিকে তাকালে নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্টি ও অন্তরে কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেয়। তাই অবস্থাসম্পন্ন নয়; বরং সর্বদা দুরবস্থার লোকদের দিকেই তাকানো চাই।
فهو اجدر أن لا تزدروا نعمة الله عليكم
(এটাই তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে তুচ্ছ মনে না করার পক্ষে বেশি সহায়ক)।
কেননা কোনও ব্যক্তি যখন তারচে' বেশি ধনী, বেশি ক্ষমতাবান, বেশি প্রভাবশালী, বেশি স্বাস্থ্যবান বা বেশি রূপবান ব্যক্তিদের দিকে তাকাবে, তখন নিজেকে এসব দিক থেকে তাদেরচে' ছোট মনে হবে। নিজের যা আছে তা তার কাছে অল্প মনে হবে। ফলে তার নিজের মনেও ওইসব লোকের মত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগবে এবং তাদের মত না হওয়ার কারণে তার আক্ষেপবোধ হবে। এর দ্বারা প্রকারান্তরে আল্লাহ তা'আলা তাকে যা দিয়েছেন তার অমর্যাদা করা হয়। এভাবে আল্লাহপ্রদত্ত নি'আমতকে তুচ্ছ গণ্য করা হয়। আল্লাহর দেওয়া যে কোনও নি'আমতকে তুচ্ছ গণ্য করা সে নি'আমতের অকৃতজ্ঞতাই বটে। এভাবে উপরের দিকে তাকানোর দ্বারা বান্দা আল্লাহ তা'আলার নাশোকর ও অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। অকৃতজ্ঞ বান্দা আল্লাহর পসন্দ নয়।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজের তুলনায় নিচের লোকদের দিকে তাকায়, তার কাছে আল্লাহ তা'আলা তাকে যা-কিছু দিয়েছেন তা অনেক বড় ও অনেক মূল্যবান মনে হয়। এটা অন্তরে কৃতজ্ঞতাবোধ সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক। আল্লাহ তা'আলা কৃতজ্ঞ বান্দাদের পসন্দ করেন। এ নীতি পার্থিব জীবনে সুখী হওয়ারও চাবিকাঠি। কেননা যে ব্যক্তি শুধু উপরের লোকদের দিকে তাকায়, সে সর্বদা অন্তর্জালায় ভোগে। এক রকম হীনম্মন্যতাবোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। অপরদিকে যে ব্যক্তি তার নিচের লোকদের দিকে তাকায়, তার দৃষ্টিতে তার নিজের অবস্থা যথেষ্ট ভালো মনে হয়। ফলে সে তাতে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকে। এভাবে সে একজন সুখী মানুষরূপে ইহজীবন কাটাতে পারে।
জনৈক বুযুর্গ বলেন, আমি ধনী লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতে থাকলাম। আমি দেখলাম তাদের প্রশস্ত বাড়ি, দামি বাহন ও চমৎকার আসবাব-উপকরণ, যার কিছুই আমার কাছে নেই। এর ফলে আমি বড় দুঃখের ভেতর দিন কাটাচ্ছিলাম। শেষে আমি গরীবদের সাহচর্য গ্রহণ করলাম। এতে করে আমি সে দুঃখ কাটিয়ে উঠি এবং মনে সুখ অনুভব করি। সুতরাং এক হাদীছে হুকুম দেওয়া হয়েছে
أقلوا الدخول على الأغنياء فإنه أجدر ألا تزدروا نعمة الله عز وجل
'তোমরা ধনীদের কাছে আসা-যাওয়া কমাও। এটা আল্লাহর নি'আমতকে তুচ্ছ গণ্য না করার পক্ষে বেশি সহায়ক।
কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى
“তুমি পার্থিব জীবনের ওই চাকচিক্যের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ো না, যা আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন শ্রেণীকে মজা লোটার জন্য দিয়ে রেখেছি, তা দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। বস্তুত তোমার রব্বের রিযিক সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী।"
এ নীতি মানুষের চারিত্রিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখে। যে ব্যক্তি তারচে' ভালো অবস্থাসম্পন্ন লোকদের দিকে তাকাতে অভ্যস্ত, তার অন্তরে পরশ্রীকাতরতা ও লোভ লালসা বাড়তে থাকে। এর থেকে আরও নানা চারিত্রিক দোষ জন্ম নেয়। সে হয়ে যায় কৃপণ, লোভী, স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির। অন্যদিকে নিচের লোকদের দিকে তাকানোই যার অভ্যাস, সে এসব দোষ থেকে মুক্ত থাকে। উদারতা, বদান্যতা, সহমর্মিতা, পরার্থপরতা প্রভৃতি সদগুণে সে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
দীনের ক্ষেত্রে নিজের চেয়ে অগ্রগামীদের দিকে তাকানো
বলাবাহুল্য, এ নীতি দুনিয়াবী বিষয়ে প্রযোজ্য, দীনী বিষয়ে নয়। দীনী বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে নিয়ম এর বিপরীত। সে ক্ষেত্রে কর্তব্য নিজের চেয়ে অগ্রগামী ব্যক্তির দিকে লক্ষ করা, নিজের চেয়ে নিচের ব্যক্তির দিকে নয়। এ ক্ষেত্রে নিচের দিকে লক্ষ করলে অন্তরে আত্মমুগ্ধতা জন্মায় এবং আমলে অধঃপতন আসে। কেননা তখন মনে হয় আমার আমল তো যথেষ্ট ভালো। এই ভালোত্বের বোধ গাফলাত ও উদাসীনতা জন্ম দেয়। ফলে আস্তে আস্তে আমল ছুটতে শুরু করে। তাই দীনী বিষয়ে নিচের দিকে নয়; বরং উপরের দিকে লক্ষ করা জরুরি। হাদীছ আমাদেরকে সে শিক্ষাই দেয়। যেমন এক হাদীছে আছে
خصلتان من كانتا فيه كتبه الله شاكرا صابرا، ومن لم تكونا فيه لم يكتبه الله شاكرا ولا صابرا، من نظر في دينه إلى من هو فوقه فاقتدى به، ونظر في دنياه إلى من هو دونه فحمد الله على ما فضله به عليه كتبه الله شاكرا و صابرا، ومن نظر في دينه إلى من هو دونه، ونظر في دنياه إلى من هو فوقه فأسف على ما فاته منه لم يكتبه الله شاكرا ولا صابرا
“দুটি গুণ এমন, যা কারও মধ্যে থাকলে আল্লাহ তা'আলা শাকির (কৃতজ্ঞ) ও সাবির (ধৈর্যশীল) হিসেবে তার নাম লিখে দেন। যার মধ্যে গুণদুটি থাকে না, শাকির ও সাবিররূপে তার নাম লেখা হয় না। যে ব্যক্তি তার দীনদারীর ক্ষেত্রে তার উপরের লোকের দিকে তাকায় ও তার অনুসরণ করে, আর দুনিয়ার ব্যাপারে তার নিচের লোকদের দিকে তাকায় এবং আল্লাহ তা'আলা তাকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায় করে, আল্লাহ তা'আলা সাবির ও শাকির হিসেবে তার নাম লেখেন। অপরদিকে যে ব্যক্তি দীনদারীর ক্ষেত্রে তারচে' নিচের লোকদের দিকে তাকায় আর দুনিয়াদারীর ব্যাপারে তাকায় তারচে' উপরের লোকের দিকে, ফলে সে যা পায়নি সেজন্য আক্ষেপ করে, আল্লাহ তা'আলা শাকির ও সাবিররূপে তার নাম লেখেন না।"
ইমাম ইবন বাত্তাল রহ., আলোচ্য হাদীছটি সম্পর্কে বলেন, এ হাদীছটি সর্বপ্রকার কল্যাণের ধারক। কেননা কোনও ব্যক্তি ইবাদত-বন্দেগীতে যে স্তরের সাধকই হোক না কেন, সে লক্ষ করলে কাউকে না কাউকে তারচে' উপরে পাবেই। কাজেই সে যখনই কাউকে তার উপরে দেখতে পাবে, তখন যদি সে তার স্তরে পৌঁছতে সচেষ্ট থাকে, তবে সে অব্যাহতভাবে তার রব্বের নৈকট্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। আবার পার্থিব দিক থেকে সে যতই গরীব ও অবহেলিত থাকুক, সে যদি চারদিকে লক্ষ করে তবে তারচে'ও আরও নিম্ন অবস্থার কাউকে না কাউকে পাবে। এ অবস্থায় সে নিজেকে তার সঙ্গে তুলনা করলে বুঝতে পারবে আল্লাহ তা'আলা তাকে কত কত নি'আমত দান করেছেন। এতে করে তার শোকর আদায়ের অনুপ্রেরণা জাগবে।
বস্তুত হাদীছটি সকল রোগের দাওয়াই। কেননা প্রত্যেকেরই কখনও না কখনও তারচে' ভালো অবস্থাসম্পন্ন লোক নজরে আসে। ফলে তার অন্তরে হাসাদ সৃষ্টির যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় সে যদি তারচে' নিচের লোকের দিকে লক্ষ করে, তবে সে হাসাদের শিকার হওয়া থেকে বেঁচে যাবে এবং নিজের যা আছে সেজন্য শোকরগুযার হতে পারবে।
লক্ষণীয়: নিজের চেয়ে নিম্নাবস্থার লোকের দিকে লক্ষ করতে বলা হয়েছে নিজ নি'আমতের মূল্য অনুধাবন করার জন্য। অনেক লোক এমনও আছে, যারা নিজের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের লোক দেখলে নিজেকে তারচে' বড় মনে করে এবং তাকে ছোট করে দেখে। এটা অহংকার। কাজেই দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করতে হবে। নিচের দিকে তাকানোর উদ্দেশ্য হতে হবে নিজ প্রাপ্তির জন্য অন্তরে সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত করা, অন্যের উপর গৌরব করা নয়। মনে রাখতে হবে আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিটি নি'আমতের দাবি হল আল্লাহ তা'আলার কাছে শোকরগুযার হয়ে থাকা। কোনও নি'আমতকে অহমিকার কারণ বানানো সেই নি'আমতের অমর্যাদা করা ও অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের নামান্তর।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াবী দিক থেকে যাকে যে অবস্থায় রেখেছেন, সে অবস্থাকে হীন মনে করতে নেই। বরং তার মূল্যায়ন করা ও তাতে সন্তুষ্ট থাকা চাই।
খ. নিজের চেয়ে ভালো অবস্থাসম্পন্ন লোকের দিকে তাকানোর দ্বারা অন্তরে লোভ লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও হিনম্মন্যতাবোধ জন্ম নেয়। তাই এর থেকে বিরত উচিত।
গ. নিজের চেয়ে নিম্নাবস্থার লোকের দিকে তাকালে নিজের যা আছে তাতে সন্তুষ্টি ও অন্তরে কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নেয়। তাই অবস্থাসম্পন্ন নয়; বরং সর্বদা দুরবস্থার লোকদের দিকেই তাকানো চাই।
