আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৮৭
৩৪৪০. প্রবৃত্তি দ্বারা জাহান্নামকে বেষ্টন করা হয়েছে।
৬০৪৩। ইসমাঈল (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ জাহান্নাম প্রবৃত্তি-কামনা (শরীআতের নিষিদ্ধ বিষয়াবলি) দিয়ে বেষ্টিত। আর জান্নাত বেষ্টিত দুঃখ-কষ্টকর বিষয় দিয়ে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি শব্দের দিক থেকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু এর অর্থ অনেক ব্যাপক। এর বিষয়বস্তু হল- মনের লোভলালসা ও খেয়ালখুশি পূরণের নিন্দা এবং তার বিরুদ্ধে চলার প্রতি উৎসাহদান। এ হাদীছটি আরেকটু বিস্তারিতরূপে বিভিন্ন হাদীছগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তাতে আছেঃ-

لما خلق الله الجنة والنار أرسل جبريل إلى الجنة، فقال: أنظر إليها، قال: فرجع، فقال و عزتك لا يسمع بها أحد إلا دخلها، فأمر بها فحفت بالمكاره، فقال: ارجع إليها فرجع، فقال و عزتك لقد خفت أن لا يدخلها أحد قال: إذهب إلى النار فانظر إليها، فرجع فقال: وعزتك لا يسمع بها أحد فيدخلها فأمر بها فحفت بالشهوات، فقال: ارجع إليها، فرجع فقال: وعزتك لقد خشيت أن لا ينجو منها أحدا

“আল্লাহ তা'আলা জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করার পর হযরত জিবরীল আ.-কে বললেন, জান্নাতে যাও এবং তা দেখে আস। তিনি জান্নাত দেখে এসে বললেন, আপনার মহিমার শপথ! যে-কেউ এর সম্পর্কে শুনবে সে অবশ্যই এতে প্রবেশ করবে। তারপর আল্লাহর হুকুমে কষ্টকর বিষয়াবলি দ্বারা জান্নাত বেষ্টন করে দেওয়া হল। তারপর তিনি জিবরীল আলাইহিস সালামকে বললেন, আবার সেখানে যাও। তিনি গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন, আপনার মহিমার শপথ! আমার ভয় হয় যে, তাতে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না!
তারপর আল্লাহ বললেন, জাহান্নামে যাও এবং তা দেখে আস। তিনি দেখে এ বললেন, আপনার মহিমার শপথ! জাহান্নাম সম্পর্কে যে-কেউ শুনবে আর সে তাতে প্রবেশ করবে- এমন কখনও হবে না। তারপর আল্লাহর আদেশে লোভনীয় বিষয়াবলি দ্বারা জাহান্নামকে বেষ্টন করে দেওয়া হল। তারপর তিনি জিবরীল আলাই সালামকে বললেন, আবার যাও। তিনি গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন, আপনার মহিমার শপথ! আমার আশঙ্কা, জাহান্নাম থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না।মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৮৩৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫৬০; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩৭৬৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ১৪৩৫
مكاره অর্থ কষ্টকর বিষয়। এ হাদীছে এর দ্বারা শরী'আতের আদেশসমূহ বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামায ওয়াক্তমত পড়া, মালের যাকাত দেওয়া, সভ্যকথা বলা, হারাম খাওয়া থেকে বেঁচে থাকা, অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করা, মিথ্যা পরিহার করা ইত্যাদি। এসব বিধিবিধানকে ‘মাকারিহ' বা কষ্টকর কাজ বলা হয়েছে এজন্য যে, এসব পালন করতে শারীরিক ও মানসিক কিছু না কিছু কষ্ট হয়ই। কেউ কোনও বিপদে পড়লে শরী'আতের হুকুম হল সবর করা। কিন্তু সবর করা একদম সহজ কাজ নয়। সবর করতে মনের উপর অনেক চাপ পড়ে। সে চাপ সহ্য করা অনেক কঠিন। কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে শরী'আতের হুকুম হল তাকে আল্লাহর ফয়সালা মনে করে মেনে নেওয়া। কিন্তু তা মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়। শরী'আতের সকল বিধানই এরকম কষ্টকর। সেই কষ্টকর বিধানাবলি দ্বারা জান্নাতকে ঘিরে রাখা হয়েছে।
মনে করুন, এক মনোরোম উদ্যান। তার মধ্যে আছে সবরকম শান্তির ব্যবস্থা। কিন্তু সেটি প্রাচীর বেষ্টিত। ভেতরে ঢুকতে হলে সেই প্রাচীর অতিক্রম করতে হবে। তবে সে প্রাচীর অতিক্রম করা অনেক কঠিন। কিন্তু যত কঠিনই হোক না কেন, যে ব্যক্তি সে উদ্যানে প্রবেশ করতে চাবে তাকে এ কঠিন কাজটি করতেই হবে। অন্যথায় তার সেখানে ঢোকা হবে না। অনুরূপ শরী'আতের বিধানাবলি যেন জান্নাতের প্রাচীর, যা দ্বারা জান্নাতকে ঘিরে রাখা হয়েছে। জান্নাতের ভেতর আছে অনন্ত অকল্পনীয় সুখশান্তির ব্যবস্থা। যে ব্যক্তি সেই জান্নাতে যাওয়ার আশা রাখে, তাকে 'শরীআত' নামক প্রাচীর অতিক্রম করতেই হবে। অর্থাৎ শরী'আতের বিধানাবলি অনুসরণ করতে হবে, তা যতই কঠিন মনে হোক না কেন। কঠিন মনে করে যদি কেউ পিছিয়ে থাকে এবং শরী'আতের বিধানাবলি পালন না করেই মারা যায়, তবে তার পক্ষে জান্নাতে প্রবেশ সম্ভব হবে না, যেহেতু সে শরী'আত নামক প্রাচীর অতিক্রম করেনি।
شهوات -এর অর্থ লোভনীয় ও আনন্দদায়ক বিষয়াবলি। এর দ্বারা শরী'আতের নিষিদ্ধ বিষয়াবলি বোঝানো উদ্দেশ্য। শরী'আত যা-কিছু করতে নিষেধ করেছে, তার প্রত্যেকটিই আপাতমধুর ও লোভনীয়। তাতে মন খুব আকৃষ্ট হয় এবং করতে মজা লাগে। যেমন, মদপান করা, সুদ ও ঘুষ খাওয়া, গীবত করা, নর-নারী অবাধ মেলামেশা করা, গানবাদ্য করা ও শোনা ইত্যাদি।
জাহান্নাম এক ভয়ংকর অগ্নিকুণ্ড। এসব নিষিদ্ধ বিষয় তার প্রাচীরস্বরূপ। আল্লাহ তা'আলা জাহান্নামকে এসব নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রাচীর দ্বারা ঘিরে রেখেছেন, যাতে বান্দা জাহান্নামে পড়ে না যায়। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় রহমত।
প্রশ্ন দাঁড়ায়, বান্দাকে জান্নাতে নেওয়া ও জাহান্নাম থেকে বাঁচানো যদি কাম্য হয়,তবে যেসব বিষয় জান্নাতে যাওয়ার উপায় তাকে কেন কষ্টকর বানিয়েছেন, যা করতে মন সহজে আগ্রহী হয় না? আবার যেসব বিষয় জাহান্নামে যাওয়ার কারণ, তাকে কেন লোভনীয় বানিয়েছেন, যার প্রতি মন শুধু আকৃষ্ট হয়?
উত্তর : এরূপ করা হয়েছে বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য। জান্নাত ও জাহান্নাম হচ্ছে বান্দার কাজের বদলাস্বরূপ। জান্নাত ভালো কাজের বদলা ও পুরস্কার, জাহান্নাম মন্দ কাজের বদলা ও শাস্তি। আল্লাহ তা'আলা ভালো কাজসমূহকে কষ্টকর ও মন্দ কাজসমূহকে লোভনীয় করেছেন এই পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যে, বান্দা জান্নাতের স্থায়ী আনন্দ-সুখ লাভের আশায় দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী আনন্দ ও সুখ পরিহার করে এবং কষ্টকর কাজসমূহকেই বেছে নেয়, নাকি জান্নাতের আশা বিসর্জন দিয়ে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দ-আহ্লাদে মাতোয়ারা হয় ও কষ্টকর কাজসমূহ পরিহার করে চলে।
বলাবাহুল্য, বিনা পরীক্ষা ও বিনা কষ্টশ্রমে কখনও উৎকৃষ্ট কিছু লাভ করা যায় না। কাজেই জান্নাতের মত শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার ও অনন্ত সুখের নি'আমত লাভ করতে হলে কষ্টসাধ্য এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তো হতেই হবে। মন সহজে প্রস্তুত হতে চাবে না। কষ্ট দেখে পিছিয়ে থাকতে চাবে। কিন্তু মন যতই পিছিয়ে থাকতে চাক তার সাথে সংগ্রাম করতে হবে। মনের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে এবং এ জিহাদে জিততেই হবে। কেননা মনের বিরুদ্ধে এ জিহাদে হেরে গেলে মন লোভনীয় কাজসমূহের দিকে টেনে নেবে এবং হারাম ও অবৈধ কাজে লিপ্ত করবে, যার পরিণাম হবে জাহান্নামবাস। সেই কঠিন পরিণতি থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে মনের বিরুদ্ধে জিহাদে জয়ী হওয়া এবং যত কষ্টকরই মনে হোক না কেন, সর্বাবস্থায় শরী'আতের বিধানাবলি পালনে অটল-অবিচল থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, জান্নাতে যাওয়ার কাজসমূহ তথা শরী'আতের বিধানাবলি কষ্টকর হলেও তা এমন কঠিন নয় যে, বান্দার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয় বা পালন করতে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট হয় । কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا “আল্লাহ তা'আলা কারও প্রতি তার সাধ্যের বাইরে বিধান আরোপ করেন না।” সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৬
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেঃ-

وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ

“তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।” সূরা হজ্জ, আয়াত ৭৮
শরী'আতের বিধানাবলি পালনে যতটুকু কষ্ট হয় তা অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ের। এটাও বান্দার প্রতি আল্লাহ তা'আলার এক বিরাট মেহেরবানী যে, জান্নাতের মত বিশাল নি'আমত বান্দার সামান্য একটু কষ্টের বিনিময়েই তিনি দান করতে চাচ্ছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জাহান্নাম থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে, তা যতই লোভনীয় এবং তার প্রতি মন যতই আকৃষ্ট হোক না কেন।

খ. জান্নাতলাভের আশায় আমাদেরকে অবশ্যই শরী'আতের আদেশসমূহ পালন করে যেতে হবে, তাতে সে আদেশসমূহ পালন করা যতই কষ্টকর হোক এবং মন তা করতে যতই অনাগ্রহী হোক।

গ. শরী'আতের আদিষ্ট বিষয় পালন করা ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে দূরে থাকা— এ দু'টি মনের ইচ্ছা ও চাহিদার বিপরীত কাজ। তাই এর জন্য সদাসর্বদা মনের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন