আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৭৫
৩৪৩৫. যবানের হেফাযত করা।
৬০৩১। আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে নয়তো নীরব থাকে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। উত্তম চরিত্রের সবকিছুই এর মধ্যে এসে গেছে। এতে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের উপর আমল করলে মোটামুটিভাবে বান্দার হক সম্পর্কিত সবকিছুই পালন হয়ে যায়। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনওটি কাজের হুকুমদানের আগে আল্লাহ ও শেষদিবসে বিশ্বাসের বরাত দিয়েছেন। অর্থাৎ যার এ বিশ্বাস আছে তার এ বিষয়তিনটি পালনে যত্নবান থাকা একান্ত কর্তব্য।

ঈমানের মূল স্তম্ভ সাতটি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস, তাকদীরে বিশ্বাস এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপর বিশ্বাস। এ হাদীছে তার মধ্যে মাত্র দু'টি অর্থাৎ আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ এ দু'টির উপর যার বিশ্বাস আছে, বাকি পাঁচটিতে বিশ্বাস আপনা-আপনিই তার উপর অবধারিত হয়ে যায়। শরীআতের যাবতীয় বিধানের ভিত্তি মূলত এ দু'টি বিশ্বাসের উপরই। কেননা যার আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে এবং আখেরাতের হিসাব-নিকাশেরও ভয় আছে, সেই তো শরীআত মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবে। এরূপ বিশ্বাস থাকলেই সে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলের শিক্ষার দ্বারস্থ হবে। নবী-রাসূলের শিক্ষার উৎস আসমানী কিতাব, যা তাঁরা ফিরিশতাদের মাধ্যমে লাভ করে থাকেন। সুতরাং বিশ্বাসীগণ আসমানী কিতাব ও ফিরিশতাদের উপরও ঈমান রাখবে। আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস থাকলে তাতে বর্ণিত কোনওকিছুর উপরই অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। ফলে তাকদীর ও পুনরুত্থানে বিশ্বাসও অবধারিত হয়ে যায়। ব্যস এভাবে আল্লাহ ও শেষদিবসের বিশ্বাস অন্যসবকিছুর বিশ্বাসকেও অবধারিত করে।

যাহোক এ হাদীছে বলা হয়েছে-

من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فلا يؤذ جاره

(যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার কর্তব্য প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়া)। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখার উদ্দেশ্য তো দুনিয়ায় তাঁর আনুগত্য করে আখেরাতে তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করা। তাঁর নৈকট্যের স্থান হলো জান্নাত। সেখানে রয়েছে সম্মানজনক জীবনের যাবতীয় উপকরণ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে জানাচ্ছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করে জান্নাতের সম্মানজনক জীবনের অধিকারী হতে চায়, তার কর্তব্য তার নিকটবর্তী বাসিন্দা বা প্রতিবেশীকে কোনওরূপ কষ্ট না দেওয়া। সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যাতে প্রতিবেশীর জান, মাল ও ইজ্জতের কোনওরকম ক্ষতি তার দ্বারা না হয়ে যায়। এমনিভাবে কোনও কথা ও কোনও কাজ দ্বারা যাতে সে কষ্ট না পায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। সেদিকে লক্ষ রাখার জন্য প্রতিবেশীর কাছেই খোঁজ নেওয়া কর্তব্য যে, তার দ্বারা তারা কোনও প্রকারে কষ্ট পাচ্ছে কি না। বরং খোঁজখবর না রাখাও এক প্রকার কষ্টদানই বটে। অনেকে এমনও আছে, যারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না; তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে এবং তাদের দরজা প্রতিবেশীদের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। এ আচরণ ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এরূপ প্রতিবেশী সম্পর্কে হাদীছে সতর্কবাণী আছে-

كم من جار متعلق بجاره يوم القيامة يقول: يا رب، هذا أغلق بابه دوني، فمنع معروفه

“এমন কত প্রতিবেশী আছে, কিয়ামতের দিন যার প্রতিবেশী তাকে ধরে রাখবে আর বলবে, হে আল্লাহ! এই ব্যক্তি আমার জন্য তার দরজা বন্ধ করে রাখত। সে তার সৌজন্য হতে আমাকে বঞ্চিত রাখত।৩৮

আল্লাহ না করুন, কারও প্রতিবেশী যদি কষ্টদায়ী হয় এবং তাকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে, তবে সে ক্ষেত্রে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত। প্রতিবেশীর উৎপাতে ধৈর্যধারণ করা অনেক বড় নেকীর কাজ। তাতে আল্লাহ তাআলা খুশি হন। এক হাদীছে আছে, আল্লাহ তাআলা তিন ব্যক্তিকে ভালোবাসেন। তাদের মধ্যে একজন হলো ওই ব্যক্তি—

رجل له جار سوء يؤذيه، فيصبر على أذاه حتى يكفيه الله، إما بحياة وإما بموت

'যার কোনও মন্দ প্রতিবেশী আছে, যে তাকে কষ্ট দেয়, আর সে ব্যক্তি তার উৎপীড়নে ধৈর্যধারণ করে, যতদিন না আল্লাহ তাকে তার থেকে মুক্তি দেন, হয়তো তাকে জীবিত রেখেই কিংবা তাকে মৃত্যু দিয়ে।৩৯

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليكرم ضيفه (যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার কর্তব্য অতিথির প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা)। অতিথি গরীব-ধনী, আত্মীয়-অনাত্মীয় যেই হোক না কেন তাকে খুশিমনে গ্রহণ করা চাই। এমন কোনও আচরণ তার সঙ্গে করা যাবে না, যা অতিথির পক্ষে মর্যাদাকর নয়। সুতরাং মেজবানের কর্তব্য তার সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাত করা, নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তার জন্য ভালো মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা, সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে ভালো জায়গায় থাকতে দেওয়া, তার ওযূ-গোসলের প্রতি লক্ষ রাখা, তাকে সঙ্গ দেওয়া, বিদায়কালে তাকে এগিয়ে দেওয়া, সম্ভব হলে তার পথখরচা দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার প্রতি সম্মানজনক আচরণের একটি হলো অতিথি যেখানে বসবে, নিজে তার চেয়ে একটু নিচে বসা।

হাদীছে বলা হয়েছে-

من كان يؤمن بالله واليوم الآخر فليقل خيرا او ليسكت

(যে আল্লাহ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার কর্তব্য ভালো কথা বলা, নয়তো চুপ থাকা)। অর্থাৎ বলবে কেবল সেই কথাই, যা ভালো হয়। বোঝা যাচ্ছে চুপ থাকাটাই আসল। কথা বলার অনুমতি আছে তখনই, যখন কথাটা ভালো হয়। ভালো কথা মানে এমন কথা, যাতে কোনও গুনাহ নেই বরং ছাওয়াব আছে। যেমন সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজে নিষেধ করা, ভালো পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

'মানুষের বহু গোপন কথায় কোনও কল্যাণ নেই। তবে কোনও ব্যক্তি দান সদাকা বা কোনও সৎকাজের কিংবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার আদেশ করলে, সেটা ভিন্ন কথা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এরূপ করবে, আমি তাকে মহাপ্রতিদান দেব।৪০

যে কথায় ছাওয়াবও নেই গুনাহও নেই, এরকম প্রয়োজনীয় দুনিয়াবী কথা বলারও অনুমতি আছে। কিন্তু যে কথার কোনও প্রয়োজন নেই, তা বাহ্যত বৈধ হলেও সে কথা পরিহার করা উচিত। কেননা তাতে অন্ততপক্ষে সময় তো নষ্ট হয়। অহেতুক সময় নষ্ট করাও ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। এক হাদীছে ইরশাদ-

من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه

'অহেতুক সবকিছু পরিহার করা কোনও ব্যক্তির ইসলামের সুষ্ঠুতার পরিচায়ক।৪১
অর্থাৎ এর দ্বারা বোঝা যায় সে একজন ভালো মুসলিম, সে নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলামের উপর আছে।

বলা হয়েছে, যদি ভালো কিছু বলার না থাকে তাহলে চুপ থাকবে। অর্থাৎ চুপ থাকাটা হতে হবে ইচ্ছাকৃত, অক্ষমতার কারণে নয়। যেমন এক ব্যক্তি বোবা, সে কথাই বলতে পারে না অথবা বাকশক্তি আছে বটে, কিন্তু কোনওকিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস রাখে না, তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে আছে, এরূপ চুপ থাকাটা কোনও ছাওয়াবের কাজ নয়। চুপ থাকা ছাওয়াবের কাজ হবে তখনই, যখন তা ইচ্ছাকৃত হয়। যেমন চাইলে সে কোনও শক্ত ও রূঢ় কথা বলতে পারে, তা সত্ত্বেও বলছে না, এ ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা একটি ছাওয়াবের কাজরূপে গণ্য হবে। একবার এক সাহাবী আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে পৌঁছাবে। উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একের পর এক বিভিন্ন আমলের কথা বলতে থাকেন। সবশেষে ইরশাদ করেন-

فإن لم تطق ذلك، فكف لسانك إلا من خير

‘যদি তাও না পার, তবে ভালো কথা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তোমার জিহ্বা সংযত রাখবে।৪২
অপর এক হাদীছে ইরশাদ من صمت نجا “যে ব্যক্তি নীরবতা অবলম্বন করল সে মুক্তি পেল।"

আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে চুপ থাকাটা গুনাহের কাজও বটে। যেমন কারও সামনে কেউ অন্যায় কিছু বলছে, কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে তার প্রতিবাদ করছে না, এটা অন্যায়কে সমর্থন করারই নামান্তর। এরূপ চুপ থাকা নিঃসন্দেহে একটি গুনাহের কাজ। তাই বলা হয়, যে ব্যক্তি সত্য বলার স্থানে চুপ করে থাকে সে এক বোবা শয়তান। (অবশ্য এটি হাদীছ নয়)।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে বিশ্বাস করে তার কর্তব্য প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা।

খ. অতিথির সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা ঈমানের দাবি।

গ. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য নিজ জিহ্বা সংযত রাখা। হয় ভালো কথা বলবে, নয়তো চুপ থাকবে।

ঘ. অন্যায় ও অনুচিত কথা বলা হতে বিরত থাকাও একটি সৎকর্ম

৩৮. বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ১১১

৩৯. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৮৫০; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯১০২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৬৩৭

৪০. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১৪

৪১. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৩১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৭৬; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ২২৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮৮৬; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬৩২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১৩২

৪২. বুখারী, আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৯; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৭৪; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৭৪৩; সুনানু দারা কুতনী, হাদীছ নং ২০৫৫; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২১৩১৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৫৮০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৪১৯

৪৩. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৫০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৪৮১; সুনানুদ্ দারিমী, হাদীছ নং ২৭৫৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১১৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪৬২৯
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
সহীহ বুখারী - হাদীস নং ৬০৩১ | মুসলিম বাংলা