আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৫২
৩৪২৯. নবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণের জীবন যাপন কিরূপ ছিল এবং তাঁরা দুনিয়া থেকে কী অবস্থায় বিদায় নিলেন।
৬০০৮। আবু নুআইম (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলতেনঃ আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, আমি ক্ষুধার জ্বালায় আমার পেটকে মাটিতে রেখে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম। আর কোন সময় ক্ষুধার জ্বালায় আমার পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে নবী (ﷺ) ও সাহাবীগণের বের হওয়ার পথে বসে থাকলাম। অতঃপর আবু বকর (রাযিঃ) যেতে লাগলে আমি কুরআনের একটা আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি তাহলে আমাকে পরিতৃপ্ত করে কিছু খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন, কিছু করলেন না। কিছুক্ষণ পর উমর (রাযিঃ) যাচ্ছিলেন। আমি তাকে কুরআনের একটি আয়াত সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম। এ সময়ও আমি প্রশ্ন করলাম এ উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমার কোন ব্যবস্থা করলেন না।
তার পরক্ষণে আবুল কাসিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন এবং আমার মধ্যকার অস্থিরতা বিরাজমান এবং আমার চেহারার অবস্থা থেকে তিনি তা আচ করতে পারলেন। তারপর বললেনঃ হে আবু হির! আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাযির আছি। তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে চল। এ বলে তিনি চললেন, আমিও তার অনুসরণ করলাম। তিনি ঘরে ঢূকবার অনুমতি চাইলেন এবং আমাকেও ঢুকবার অনুমতি দিলেন। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পেয়ালার মধ্যে কিছু পরিমাণ দুধ পেলেন। তিনি বললেন, এ দুধ কোথা থেকে এসেছে? তাঁরা বললেন, এটা আপনাকে অমুক পুরুষ অথবা অমুক মহিলা হাদিয়া দিয়েছে। তখন তিনি বললেন, হে আবু হির! আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তুমি সুফফাবাসীদের কাছে গিয়ে তাদেরকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। রাবী বলেনঃ –সুফফাবাসীরা ইসলামের মেহমান ছিলেন। তাদের কোন পরিবার ছিল না এবং তাদের কোন সম্পদ ছিল না এবং তাদের কারো উপর নির্ভরশীল হওয়ারও সুযোগ ছিল না। যখন কোন সাদ্কা আসত তখন তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি এর থেকে কিছুই গ্রহণ করতেন না। আর যখন কোন হাদিয়া আসত, তখন তার কিছু অংশ তাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং এর থেকে নিজেও কিছু রাখতেন। এর মধ্যে তাদেরকে শরীক করতেন– এ আদেশ শুনে আমার মনে কিছুটা হতাশা এলো। মনে মনে ভাবলাম যে, এ সামান্য দুধ দ্বারা সুফফাবাসীদের কি হবে? এ সামান্য দুধ আমার জন্যই যথেষ্ট হতো। এটা পান করে আমি শরীরে কিছুটা শক্তি পেতাম।
এরপর যখন তাঁরা এসে গেলেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, আমিই যেন তা তাঁদেরকে দেই, আমার আর আশা রইল না যে, এ দুধ থেকে আমি কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ না মেনে কোন উপায় নেই। তাই তাঁদের কাছে গিয়ে তাদেরকে ডেকে আনলাম। তারা এসে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তাঁরা এসে ঘরে আসন গ্রহণ করলেন। তিনি বললেনঃ হে আবু হির! আমি বললাম, আমি হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ তুমি পেয়ালাটি নাও আর তাদেরকে দাও। আমি পেয়ালা নিয়ে একজনকে দিলাম। তিনি তা পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম। তিনিও পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমন কি আমি এরূপে দিতে দিতে নবী (ﷺ) পর্যন্ত পৌছলাম। তাঁরা সবাই তৃপ্ত হয়েছিলেন।
তারপর নবী (ﷺ) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আর বললেনঃ হে আবু হির! আমি বললাম, আমি হাযির, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ এখন তো আমি আর তুমি আছি। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ঠিক বলছেন। তিনি বললেনঃ এখন তুমি বসে পান কর। তখন আমি বসে কিছু পান করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি আরও পান কর। আমি আরও পান করলাম। তিনি বারবার আমাকে পান করার নির্দেশ দিতে লাগলেন। এমন কি আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, আর না। যে সত্তা আপনাকে সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, তার কসম! (আমার পেটে) আর পান করার মত জায়গা আমি পাচ্ছি না। তিনি বললেনঃ তাহলে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাঁকে দিয়ে দিলাম। তিনি আলহামদুলিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলে বাকীটা পান করলেন।
তার পরক্ষণে আবুল কাসিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন এবং আমার মধ্যকার অস্থিরতা বিরাজমান এবং আমার চেহারার অবস্থা থেকে তিনি তা আচ করতে পারলেন। তারপর বললেনঃ হে আবু হির! আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাযির আছি। তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে চল। এ বলে তিনি চললেন, আমিও তার অনুসরণ করলাম। তিনি ঘরে ঢূকবার অনুমতি চাইলেন এবং আমাকেও ঢুকবার অনুমতি দিলেন। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পেয়ালার মধ্যে কিছু পরিমাণ দুধ পেলেন। তিনি বললেন, এ দুধ কোথা থেকে এসেছে? তাঁরা বললেন, এটা আপনাকে অমুক পুরুষ অথবা অমুক মহিলা হাদিয়া দিয়েছে। তখন তিনি বললেন, হে আবু হির! আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তুমি সুফফাবাসীদের কাছে গিয়ে তাদেরকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। রাবী বলেনঃ –সুফফাবাসীরা ইসলামের মেহমান ছিলেন। তাদের কোন পরিবার ছিল না এবং তাদের কোন সম্পদ ছিল না এবং তাদের কারো উপর নির্ভরশীল হওয়ারও সুযোগ ছিল না। যখন কোন সাদ্কা আসত তখন তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি এর থেকে কিছুই গ্রহণ করতেন না। আর যখন কোন হাদিয়া আসত, তখন তার কিছু অংশ তাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং এর থেকে নিজেও কিছু রাখতেন। এর মধ্যে তাদেরকে শরীক করতেন– এ আদেশ শুনে আমার মনে কিছুটা হতাশা এলো। মনে মনে ভাবলাম যে, এ সামান্য দুধ দ্বারা সুফফাবাসীদের কি হবে? এ সামান্য দুধ আমার জন্যই যথেষ্ট হতো। এটা পান করে আমি শরীরে কিছুটা শক্তি পেতাম।
এরপর যখন তাঁরা এসে গেলেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, আমিই যেন তা তাঁদেরকে দেই, আমার আর আশা রইল না যে, এ দুধ থেকে আমি কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ না মেনে কোন উপায় নেই। তাই তাঁদের কাছে গিয়ে তাদেরকে ডেকে আনলাম। তারা এসে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তাঁরা এসে ঘরে আসন গ্রহণ করলেন। তিনি বললেনঃ হে আবু হির! আমি বললাম, আমি হাযির ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ তুমি পেয়ালাটি নাও আর তাদেরকে দাও। আমি পেয়ালা নিয়ে একজনকে দিলাম। তিনি তা পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম। তিনিও পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমন কি আমি এরূপে দিতে দিতে নবী (ﷺ) পর্যন্ত পৌছলাম। তাঁরা সবাই তৃপ্ত হয়েছিলেন।
তারপর নবী (ﷺ) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আর বললেনঃ হে আবু হির! আমি বললাম, আমি হাযির, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ এখন তো আমি আর তুমি আছি। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ঠিক বলছেন। তিনি বললেনঃ এখন তুমি বসে পান কর। তখন আমি বসে কিছু পান করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি আরও পান কর। আমি আরও পান করলাম। তিনি বারবার আমাকে পান করার নির্দেশ দিতে লাগলেন। এমন কি আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, আর না। যে সত্তা আপনাকে সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, তার কসম! (আমার পেটে) আর পান করার মত জায়গা আমি পাচ্ছি না। তিনি বললেনঃ তাহলে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাঁকে দিয়ে দিলাম। তিনি আলহামদুলিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলে বাকীটা পান করলেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. নিজের অবস্থা বর্ণনা করছেন যে, কী রকম অনাহারের ভেতর দিয়ে তাঁর দিন যাচ্ছিল। ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে খালি বুকে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতেন। কষ্ট লাঘবের জন্য পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন। এরকম মাঝেমধ্যেই হতো।
নিজ জীবনের এ অবস্থা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষের কাছে কষ্টের কথা বলে বেড়ানো নয়, বরং মানুষকে ঈমানী চেতনার সঙ্গে পরিচিত করা। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা কিভাবে দীন ও ঈমান ধরে রেখেছেন, কী কঠিন মুজাহাদার মধ্যে ইসলামের শুরু দিনগুলো কেটেছে, তা জানতে পারলে মানুষ দীন ও ঈমানের মূল্য বুঝবে, তাদের আখিরাতমুখিতা বাড়বে, দুনিয়ার আসক্তি ও অর্থবিত্তের মোহ থেকে তারা বাঁচতে পারবে।
মানুষের সামনে কেবল কষ্টের কথা প্রকাশ করাই নয়; বরং সে কষ্টের ভেতর তাদের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিল, কিভাবে তিনি তাদের সকলকে একত্রে নিয়ে চলতেন, কিভাবে তাঁদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ঐক্য সম্প্রীতির চেতনা সঞ্চার করতেন, তার সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করাও উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বিশেষ একটি দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
(একদিন আমি মানুষের চলাচলপথে বসে থাকলাম)। অর্থাৎ লোকে যে পথ দিয়ে মসজিদে আসা-যাওয়া করত, সেই পথে বসে থাকলাম। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর অবস্থা দেখে হয়তো লোকে তাঁর ক্ষুধার কষ্টের কথা বুঝতে পারবে।
সাহাবীগণ তো সহজে মানুষের কাছে কিছু চাইতেন না। অন্যের কাছে হাত পাতা তাঁদের অভ্যাস ছিল না। অথচ অনাহারের যে কঠিন কষ্ট তাঁদের ভোগ করতে হচ্ছিল, এরকম অবস্থায় অন্যের কাছে হাত পাতা নাজায়েয় নয়। তবে তা নাজায়েয না হলেও তারা এক উচ্চতর আদর্শের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। দীন ও ঈমানের এক পৰিত্ৰ জীবনবোধ তারা পালন করছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিতে কোনও অবস্থায়ই মাখলুকের কাছে সরাসরি কিছু চাওয়া সে জীবনবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ওদিকে ছিল দুর্বিষহ ক্ষুধার যন্ত্রণা। তাই প্রয়োজন পুরণের তাগিদে তিনি পরোক্ষ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। মানুষের যাতায়াতপথে বসে থাকলেন। হয়তো লোকে দেখে বুঝবে।
কখনও তিনি এমনও করতেন যে, কাছে যাকে পেতেন তাকে কুরআন মাজীদের কোনও আয়াত জিজ্ঞেস করতেন। হয়তো সে তাঁর আওয়াজ শুনে অনাহারের কারণ বুঝতে পারবে।
এদিন লোক আসা-যাওয়া করল ঠিকই, কিন্তু কেউ তার অবস্থা আঁচ করতে পারল না। একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সেখান দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি তাঁর অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলেন। সাহাবীদের কাছে সে হাসিও এক খাবার বটে। প্রাণের খোরাক। এমন প্রাণজুড়ানো হাসি কে কবে কোথায় দেখেছে? সেইসঙ্গে যদি হয় মধুর সম্ভাষণও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(হে আবু হিরর)। আবু হুরায়রা রাযি. প্রিয় সম্ভাষণে হয়ে গেলেন আবু হিরর, যেমন তিনি আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে ডাক দিতেন 'আয়েশু'। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হয়তো স্নেহের সে স্পর্শে আনন্দে ভাসছিলেন। তিনি সাড়া দিলেন-
(লাব্বায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ)। আমি হাজির ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাজির: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সঙ্গে চলতে বললেন। তিনি তাঁর পেছনে পেছনে চললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন। ভেতরে একটা পেয়ালায় কিছু দুধ দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন কেউ তা হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়েছে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন। তা নিজে খেতেন, অন্যদেরও খাওয়াতেন। সদাকা হলে তা খেতেন না, উপযুক্ত লোককে খাওয়াতেন।
কিছুটা খাদ্য যখন পাওয়া গেল, তখন তিনি সকলকে নিয়ে তা ভাগাভাগি করে খেতে চাইলেন। তিনি হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.কে হুকুম দিলেন যেন সুফ্ফায় অবস্থিত সাহাবীদের ডেকে আনেন। সুফ্ফার সে সাহাবীগণ কারা? হযরত আবু হুরায়রা রাযি. তাঁদের পরিচয় দিচ্ছেন-
(সুফ্ফাবাসীগণ ছিলেন ইসলামের অতিথি। তাদের কোনও পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ ছিল না এবং আশ্রয় নেওয়ার মত কোনও লোক তাদের ছিল না)। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. নিজেও তাঁদের একজন ছিলেন। সুফফা হল মসজিদে নববী-সংলগ্ন চতুর। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, বাহির থেকে কেউ মদীনায় আসলে আর মদীনায় তার পরিচিত কেউ থাকলে সে তার পরিচিত সেই ব্যক্তির মেহমান হয়ে যেত। আর পরিচিত কেউ না থাকলে সে সুফফায় অবস্থিত সাহাবীদের সঙ্গী হয়ে যেত। এ সাহাবীগণ মসজিদেই ঘুমাতেন। রাত হলে তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করতেন। তিনি স্থানীয় সাহাবীদেরকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী যে যত জনকে পারে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলতেন। তিনি হুকুম দিতেন-
যার কাছে দুজনের খাবার আছে সে তৃতীয় একজনকে নিয়ে যাক। যার কাছে চারজনের খাবার আছে, সে পঞ্চম বা ষষ্ঠ একজনকে নিয়ে যাক।
তারপর যারা অবশিষ্ট থাকত তাদেরকে তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সংখ্যা কখনও দশজন, কখনও তার কম বা বেশি হতো। এ হাদীছে আবু হুরায়রা রাযি. জানাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও সদাকা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যখন হাদিয়া আসত, তা তাদের কাছেও পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে গ্রহণ করতেন আর তাদেরকে তাতে শরীক করতেন।
যাহোক, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সুফ্ফার সাহাবীদের ডাকতে বললেন, তখন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.এর মনের অবস্থা কী হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর এ কথা আমাকে অখুশি করল। আমি (মনে মনে) বললাম, এতটুকু দুধে সুফফাবাসীদের কী হবে? আমিই তো এ দুধ পান করে শক্তি অর্জনের বেশি হকদার ছিলাম। তারপর তারা যখন আসবে, তখন তিনি আমাকেই (পরিবেশনের) হুকুম দেবেন। আমি তাদেরকে তা দিতে থাকব আর সম্ভবত এ দুখ থেকে আমার ভাগে কিছুই পড়বে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন না করেও আমার কোনও উপায় ছিল না। অগত্যা তিনি তাদের ডেকে আনলেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন-
(তারা চলে আসল এবং প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তারা ঘরে জায়গা নিয়ে বসে পড়ল)। বোঝা গেল কাউকে নিজ বাড়িতে আসার সংবাদ পাঠালেও তাদের আসার পর ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চাওয়া উচিত। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ জায়েয নয়।
যারা এসেছিলেন, এ বর্ণনায় তাদের সংখ্যা বলা হয়নি। অন্য কোনও বর্ণনা থেকে তা জানা যায় না। সুফফায় সাহাবীদের সংখ্যা সব সময় একরকম থাকত না। কখন ৪০ জন থাকত, কখনও এর বেশি, কখনও কম। যখন কোনও যুদ্ধভিযানে চলে যেতেন, তখন সুফফায় অবশিষ্ট সাহাবী খুব কমই থাকত।
সুফফার সর্বমোট সাহাবী কতজন তাও নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। বিভিন্নজন বিভিন্ন সংখ্যা বলেছেন। ইমাম আবু নুআয়ম রহ. 'আল-হিলয়া গ্রন্থে বলেছেন, তাদের সংখ্যা ছিল একশ'র কাছাকাছি। ইমাম সাহরাওয়ার্দী রহ. "আওয়ারিফুল মাআরিফ" গ্রন্থে তাদের সংখ্যা বলেছেন চারশ।
সকলে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রাকে তাদের মধ্যে দুধ পরিবেশন করতে বললেন। তিনি বলেন, আমি পেয়ালা নিয়ে একেকজনকে দিতে থাকলাম। প্রত্যেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করছিল, তারপর পেয়ালা আমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমি অন্যজনকে তা দিচ্ছিলাম। সেও পরিতৃপ্ত হায় পান করে আমার হাতে পেয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলাম।
এর দ্বারা বোঝা গেল খাদ্য পরিবেশনকারী যখন পেয়ালায় করে অতিথিদের একজনের পর একজনকে খাদ্য বা পানীয় দেবে, তখন প্রত্যেকে খাওয়ার পর পেয়ালাটি পরিবেশনকারীর হাতে ফিরিয়ে দেবে। পরিবেশনকারীই তা পরবর্তীজনকে দেবে। অতিথি নিজে দেবে না। পরিবেশনকারীও তা দেওয়ার ভার অতিথির উপর ছাড়বে না।
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. অতিধিদের দুধ পান করানো শেষ হওয়ার পর পেয়ালাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে রাখলেন। তিনি বলেন-
(তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন)। অর্থাৎ তিনি যেন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর মনের কথা পড়তে পেরেছিলেন। মুচকি হাসি দিয়ে তিনি তার জবাব দিয়ে দেন। যেন বোঝাচ্ছিলেন, হে আবূ হুরায়রা! তুমি তো ভাবছিলে সকলকে পান করানোর পর পেয়ালায় অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না আর তোমার ভাগে কিছুই পড়বে না; তোমাকে অভুক্তই থাকতে হবে। এখন দেখলে তো, সবাই পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করার পরও কেমন থেকে গেল?
মুচকি হাসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, এখন বাকি আছি আমি আর তুমি। তিনি বললেন, ঠিকই বলেছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! অর্থাৎ আপনি আর আমিই বাকি আছি। অন্য সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(বসো, পান করো)। বোঝা গেল পানাহারকালে বসা সুন্নত। এছাড়া অন্যান্য হাদীছ দ্বারাও এরকম শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বসে বসে পান করলেন। একবার পান করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরও পান কর। এভাবে একের পর এক তিনি পান করতে বলছিলেন আর আবু হুরায়রা রাযি. পান করে যাচ্ছিলেন। সবশেষে বললেন-
যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম। পান করার জন্য (আমার পেটে আর খালি জায়গা পাচ্ছি না। অর্থাৎ তিনি দুধপান করে সম্পূর্ণ পেট ভরে ফেলেছেন, আর তা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশেই। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, অন্যান্য হাদীছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ পেট ভরে খেতে নিষেধ করেছেন? এর কী জবাব?
জবাব হল, সব সময় পেট ভরে খাওয়া উচিত নয়। সম্পূর্ণ পেট ভরে পানাহারে অভ্যস্ত হওয়ার দ্বারা পানাহার সামগ্রীর প্রতি লোভ-লালসা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এতে শরীরে আলস্য দেখা দেয়। অতিরিক্ত খাওয়ার পর ইবাদত-বন্দেগী ও কাজকর্মের প্রতি উদ্যম-উদ্দীপনা থাকে না। তাই পানাহারের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হল পেটের তিন ভাগের একভাগ পরিমাণ খাওয়ার জন্য, একভাগ পানি পান করার জন্য, আর একভাগ রাখবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য, যেমনটা বিভিন্ন হাদীছে এসেছে। কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম হলে তাতে দোষ নেই, বিশেষত তাতে যদি কোনও দীনী ফায়দাও থাকে। হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর এই পেট ভরে দুধ পান করাটা নিতান্তই ব্যতিক্রম ঘটনা। তিনি এটা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে। তিনি এর দ্বারা তাঁর সামনে নিজ মু'জিযার মহিমা পরিস্ফুট করতে চাচ্ছিলেন।
সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহপ্রদত্ত বরকতের জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকর আদায় করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে অবশিষ্ট দুধ নিজে পান করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল মু'জিযা সত্য। সামান্য একটু দুধে কিভাবে এত সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হয়ে গেল।
খ. ক্ষুধার কষ্টের কথা প্রকাশ করা ভালো নয়। কষ্ট অসহ্য হয়ে গেলে তখনও মুখে কিছু না বলে অন্য কোনও পন্থায় বা ভাবভঙ্গি দ্বারা তা বোঝানো চাই।
গ. বসে বসে পানাহার করা সুন্নত।
ঘ. পানাহারের আগে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত।
ঙ. যে-কোনও নি'আমত লাভের পর আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করা চাই।
চ. কারও ঘরে প্রবেশর আগে অবশ্যই অনুমতি গ্রহণ করতে হবে।
ছ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন, হাদিয়ার খাবার খেতেন। এবং তাতে অন্যদেরও শরীক রাখতেন। এটা সুন্নত।
ছ. অল্প খাদ্যও নিজে একা ভোগ না করে অন্যদের নিয়ে খাওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ।
জ. অভাব-অনটন ও অনাহারের কষ্ট যত বেশিই হোক না কেন, তথাপি শরী'আতের আদেশ অবশ্যই মান্য করতে হবে, যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাযি. ক্ষুধার অসহ্য কষ্ট সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ মান্য করেছেন।
ঞ. অধীনস্থদের যে-কোনও কষ্টে তাদের প্রতি সহমর্মী আচরণ ও তাদের কষ্ট লাঘবের সর্বাত্মক চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
নিজ জীবনের এ অবস্থা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষের কাছে কষ্টের কথা বলে বেড়ানো নয়, বরং মানুষকে ঈমানী চেতনার সঙ্গে পরিচিত করা। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা কিভাবে দীন ও ঈমান ধরে রেখেছেন, কী কঠিন মুজাহাদার মধ্যে ইসলামের শুরু দিনগুলো কেটেছে, তা জানতে পারলে মানুষ দীন ও ঈমানের মূল্য বুঝবে, তাদের আখিরাতমুখিতা বাড়বে, দুনিয়ার আসক্তি ও অর্থবিত্তের মোহ থেকে তারা বাঁচতে পারবে।
মানুষের সামনে কেবল কষ্টের কথা প্রকাশ করাই নয়; বরং সে কষ্টের ভেতর তাদের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিল, কিভাবে তিনি তাদের সকলকে একত্রে নিয়ে চলতেন, কিভাবে তাঁদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ঐক্য সম্প্রীতির চেতনা সঞ্চার করতেন, তার সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করাও উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বিশেষ একটি দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
(একদিন আমি মানুষের চলাচলপথে বসে থাকলাম)। অর্থাৎ লোকে যে পথ দিয়ে মসজিদে আসা-যাওয়া করত, সেই পথে বসে থাকলাম। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর অবস্থা দেখে হয়তো লোকে তাঁর ক্ষুধার কষ্টের কথা বুঝতে পারবে।
সাহাবীগণ তো সহজে মানুষের কাছে কিছু চাইতেন না। অন্যের কাছে হাত পাতা তাঁদের অভ্যাস ছিল না। অথচ অনাহারের যে কঠিন কষ্ট তাঁদের ভোগ করতে হচ্ছিল, এরকম অবস্থায় অন্যের কাছে হাত পাতা নাজায়েয় নয়। তবে তা নাজায়েয না হলেও তারা এক উচ্চতর আদর্শের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। দীন ও ঈমানের এক পৰিত্ৰ জীবনবোধ তারা পালন করছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিতে কোনও অবস্থায়ই মাখলুকের কাছে সরাসরি কিছু চাওয়া সে জীবনবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ওদিকে ছিল দুর্বিষহ ক্ষুধার যন্ত্রণা। তাই প্রয়োজন পুরণের তাগিদে তিনি পরোক্ষ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। মানুষের যাতায়াতপথে বসে থাকলেন। হয়তো লোকে দেখে বুঝবে।
কখনও তিনি এমনও করতেন যে, কাছে যাকে পেতেন তাকে কুরআন মাজীদের কোনও আয়াত জিজ্ঞেস করতেন। হয়তো সে তাঁর আওয়াজ শুনে অনাহারের কারণ বুঝতে পারবে।
এদিন লোক আসা-যাওয়া করল ঠিকই, কিন্তু কেউ তার অবস্থা আঁচ করতে পারল না। একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সেখান দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি তাঁর অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলেন। সাহাবীদের কাছে সে হাসিও এক খাবার বটে। প্রাণের খোরাক। এমন প্রাণজুড়ানো হাসি কে কবে কোথায় দেখেছে? সেইসঙ্গে যদি হয় মধুর সম্ভাষণও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(হে আবু হিরর)। আবু হুরায়রা রাযি. প্রিয় সম্ভাষণে হয়ে গেলেন আবু হিরর, যেমন তিনি আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে ডাক দিতেন 'আয়েশু'। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হয়তো স্নেহের সে স্পর্শে আনন্দে ভাসছিলেন। তিনি সাড়া দিলেন-
(লাব্বায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ)। আমি হাজির ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাজির: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সঙ্গে চলতে বললেন। তিনি তাঁর পেছনে পেছনে চললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন। ভেতরে একটা পেয়ালায় কিছু দুধ দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন কেউ তা হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়েছে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন। তা নিজে খেতেন, অন্যদেরও খাওয়াতেন। সদাকা হলে তা খেতেন না, উপযুক্ত লোককে খাওয়াতেন।
কিছুটা খাদ্য যখন পাওয়া গেল, তখন তিনি সকলকে নিয়ে তা ভাগাভাগি করে খেতে চাইলেন। তিনি হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.কে হুকুম দিলেন যেন সুফ্ফায় অবস্থিত সাহাবীদের ডেকে আনেন। সুফ্ফার সে সাহাবীগণ কারা? হযরত আবু হুরায়রা রাযি. তাঁদের পরিচয় দিচ্ছেন-
(সুফ্ফাবাসীগণ ছিলেন ইসলামের অতিথি। তাদের কোনও পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ ছিল না এবং আশ্রয় নেওয়ার মত কোনও লোক তাদের ছিল না)। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. নিজেও তাঁদের একজন ছিলেন। সুফফা হল মসজিদে নববী-সংলগ্ন চতুর। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, বাহির থেকে কেউ মদীনায় আসলে আর মদীনায় তার পরিচিত কেউ থাকলে সে তার পরিচিত সেই ব্যক্তির মেহমান হয়ে যেত। আর পরিচিত কেউ না থাকলে সে সুফফায় অবস্থিত সাহাবীদের সঙ্গী হয়ে যেত। এ সাহাবীগণ মসজিদেই ঘুমাতেন। রাত হলে তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করতেন। তিনি স্থানীয় সাহাবীদেরকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী যে যত জনকে পারে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলতেন। তিনি হুকুম দিতেন-
যার কাছে দুজনের খাবার আছে সে তৃতীয় একজনকে নিয়ে যাক। যার কাছে চারজনের খাবার আছে, সে পঞ্চম বা ষষ্ঠ একজনকে নিয়ে যাক।
তারপর যারা অবশিষ্ট থাকত তাদেরকে তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সংখ্যা কখনও দশজন, কখনও তার কম বা বেশি হতো। এ হাদীছে আবু হুরায়রা রাযি. জানাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও সদাকা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যখন হাদিয়া আসত, তা তাদের কাছেও পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে গ্রহণ করতেন আর তাদেরকে তাতে শরীক করতেন।
যাহোক, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সুফ্ফার সাহাবীদের ডাকতে বললেন, তখন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.এর মনের অবস্থা কী হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর এ কথা আমাকে অখুশি করল। আমি (মনে মনে) বললাম, এতটুকু দুধে সুফফাবাসীদের কী হবে? আমিই তো এ দুধ পান করে শক্তি অর্জনের বেশি হকদার ছিলাম। তারপর তারা যখন আসবে, তখন তিনি আমাকেই (পরিবেশনের) হুকুম দেবেন। আমি তাদেরকে তা দিতে থাকব আর সম্ভবত এ দুখ থেকে আমার ভাগে কিছুই পড়বে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন না করেও আমার কোনও উপায় ছিল না। অগত্যা তিনি তাদের ডেকে আনলেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন-
(তারা চলে আসল এবং প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তারা ঘরে জায়গা নিয়ে বসে পড়ল)। বোঝা গেল কাউকে নিজ বাড়িতে আসার সংবাদ পাঠালেও তাদের আসার পর ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চাওয়া উচিত। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ জায়েয নয়।
যারা এসেছিলেন, এ বর্ণনায় তাদের সংখ্যা বলা হয়নি। অন্য কোনও বর্ণনা থেকে তা জানা যায় না। সুফফায় সাহাবীদের সংখ্যা সব সময় একরকম থাকত না। কখন ৪০ জন থাকত, কখনও এর বেশি, কখনও কম। যখন কোনও যুদ্ধভিযানে চলে যেতেন, তখন সুফফায় অবশিষ্ট সাহাবী খুব কমই থাকত।
সুফফার সর্বমোট সাহাবী কতজন তাও নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। বিভিন্নজন বিভিন্ন সংখ্যা বলেছেন। ইমাম আবু নুআয়ম রহ. 'আল-হিলয়া গ্রন্থে বলেছেন, তাদের সংখ্যা ছিল একশ'র কাছাকাছি। ইমাম সাহরাওয়ার্দী রহ. "আওয়ারিফুল মাআরিফ" গ্রন্থে তাদের সংখ্যা বলেছেন চারশ।
সকলে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রাকে তাদের মধ্যে দুধ পরিবেশন করতে বললেন। তিনি বলেন, আমি পেয়ালা নিয়ে একেকজনকে দিতে থাকলাম। প্রত্যেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করছিল, তারপর পেয়ালা আমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমি অন্যজনকে তা দিচ্ছিলাম। সেও পরিতৃপ্ত হায় পান করে আমার হাতে পেয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলাম।
এর দ্বারা বোঝা গেল খাদ্য পরিবেশনকারী যখন পেয়ালায় করে অতিথিদের একজনের পর একজনকে খাদ্য বা পানীয় দেবে, তখন প্রত্যেকে খাওয়ার পর পেয়ালাটি পরিবেশনকারীর হাতে ফিরিয়ে দেবে। পরিবেশনকারীই তা পরবর্তীজনকে দেবে। অতিথি নিজে দেবে না। পরিবেশনকারীও তা দেওয়ার ভার অতিথির উপর ছাড়বে না।
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. অতিধিদের দুধ পান করানো শেষ হওয়ার পর পেয়ালাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে রাখলেন। তিনি বলেন-
(তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন)। অর্থাৎ তিনি যেন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর মনের কথা পড়তে পেরেছিলেন। মুচকি হাসি দিয়ে তিনি তার জবাব দিয়ে দেন। যেন বোঝাচ্ছিলেন, হে আবূ হুরায়রা! তুমি তো ভাবছিলে সকলকে পান করানোর পর পেয়ালায় অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না আর তোমার ভাগে কিছুই পড়বে না; তোমাকে অভুক্তই থাকতে হবে। এখন দেখলে তো, সবাই পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করার পরও কেমন থেকে গেল?
মুচকি হাসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, এখন বাকি আছি আমি আর তুমি। তিনি বললেন, ঠিকই বলেছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! অর্থাৎ আপনি আর আমিই বাকি আছি। অন্য সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(বসো, পান করো)। বোঝা গেল পানাহারকালে বসা সুন্নত। এছাড়া অন্যান্য হাদীছ দ্বারাও এরকম শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বসে বসে পান করলেন। একবার পান করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরও পান কর। এভাবে একের পর এক তিনি পান করতে বলছিলেন আর আবু হুরায়রা রাযি. পান করে যাচ্ছিলেন। সবশেষে বললেন-
যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম। পান করার জন্য (আমার পেটে আর খালি জায়গা পাচ্ছি না। অর্থাৎ তিনি দুধপান করে সম্পূর্ণ পেট ভরে ফেলেছেন, আর তা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশেই। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, অন্যান্য হাদীছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ পেট ভরে খেতে নিষেধ করেছেন? এর কী জবাব?
জবাব হল, সব সময় পেট ভরে খাওয়া উচিত নয়। সম্পূর্ণ পেট ভরে পানাহারে অভ্যস্ত হওয়ার দ্বারা পানাহার সামগ্রীর প্রতি লোভ-লালসা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এতে শরীরে আলস্য দেখা দেয়। অতিরিক্ত খাওয়ার পর ইবাদত-বন্দেগী ও কাজকর্মের প্রতি উদ্যম-উদ্দীপনা থাকে না। তাই পানাহারের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হল পেটের তিন ভাগের একভাগ পরিমাণ খাওয়ার জন্য, একভাগ পানি পান করার জন্য, আর একভাগ রাখবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য, যেমনটা বিভিন্ন হাদীছে এসেছে। কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম হলে তাতে দোষ নেই, বিশেষত তাতে যদি কোনও দীনী ফায়দাও থাকে। হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর এই পেট ভরে দুধ পান করাটা নিতান্তই ব্যতিক্রম ঘটনা। তিনি এটা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে। তিনি এর দ্বারা তাঁর সামনে নিজ মু'জিযার মহিমা পরিস্ফুট করতে চাচ্ছিলেন।
সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহপ্রদত্ত বরকতের জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকর আদায় করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে অবশিষ্ট দুধ নিজে পান করলেন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল মু'জিযা সত্য। সামান্য একটু দুধে কিভাবে এত সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হয়ে গেল।
খ. ক্ষুধার কষ্টের কথা প্রকাশ করা ভালো নয়। কষ্ট অসহ্য হয়ে গেলে তখনও মুখে কিছু না বলে অন্য কোনও পন্থায় বা ভাবভঙ্গি দ্বারা তা বোঝানো চাই।
গ. বসে বসে পানাহার করা সুন্নত।
ঘ. পানাহারের আগে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত।
ঙ. যে-কোনও নি'আমত লাভের পর আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করা চাই।
চ. কারও ঘরে প্রবেশর আগে অবশ্যই অনুমতি গ্রহণ করতে হবে।
ছ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন, হাদিয়ার খাবার খেতেন। এবং তাতে অন্যদেরও শরীক রাখতেন। এটা সুন্নত।
ছ. অল্প খাদ্যও নিজে একা ভোগ না করে অন্যদের নিয়ে খাওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ।
জ. অভাব-অনটন ও অনাহারের কষ্ট যত বেশিই হোক না কেন, তথাপি শরী'আতের আদেশ অবশ্যই মান্য করতে হবে, যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাযি. ক্ষুধার অসহ্য কষ্ট সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ মান্য করেছেন।
ঞ. অধীনস্থদের যে-কোনও কষ্টে তাদের প্রতি সহমর্মী আচরণ ও তাদের কষ্ট লাঘবের সর্বাত্মক চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
