আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৪৬
৩৪২৭. প্রকৃত ঐশ্বর্য হলো অন্তরের ঐশ্বর্য।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ তারা কি ধারণা করছে যে, আমি তাদেরকে যেসব ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি দান করেছি ....... করে যাচ্ছে পর্যন্ত।
৬০০২। আহমদ ইবনে ইউনুস (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ বৈষয়িক প্রাচুর্য ঐশ্বর্য নয়, বরং প্রকৃত ঐশ্বর্য হল অন্তরের ঐশ্বর্য।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

মানুষ স্বভাবগতভাবেই ঐশ্বর্য ভালোবাসে। সাধারণত মনে করা হয় টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদ দ্বারাই সে ঐশ্বর্য অর্জিত হয়। তাই প্রচেষ্টা থাকে কীভাবে কত বেশি ধন-সম্পদ অর্জন করা যায়। এর জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সে প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী থাকার লক্ষ্যে অনেক সময়ই হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধের পার্থক্য উপেক্ষা করা হয়। এভাবে ব্যক্তিচরিত্র ধ্বংস হয়। মনের মধ্যে জন্ম নেয় লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-অহমিকাসহ নানা চারিত্রিক ব্যাধি। সে ব্যাধির ছোবলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়। ব্যক্তির নিজেরও শান্তি নষ্ট হয় এবং আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের বৃহত্তর অঙ্গনে পারস্পরিক শত্রুতার সৃষ্টি হয়। এতদসত্ত্বেও যে ঐশ্বর্য অর্জনের লক্ষ্যে এতসব ক্ষতি মেনে নেওয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তা আদৌ অর্জিত হয় না। অর্জিত যা হয়, তা কেবলই টাকা-পয়সা, জমি-জায়েদাদ ও অন্যান্য আসবাবসামগ্রী। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَيْسَ الْغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ (সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা ঐশ্বর্য হয় না)। الْعَرَض -এর অর্থ ওই মালামাল, যা দ্বারা মানুষ কোনও না কোনওভাবে উপকৃত হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে বলেছেন, প্রকৃত ঐশ্বর্য সম্পদের প্রাচুর্য নয়। সম্পদ বেশি হলেই কেউ সত্যিকারের ধনী হয়ে যায় না। কেননা এমন বহু লোক আছে, আল্লাহ তা'আলা প্রচুর ধন-সম্পদ দেওয়া সত্ত্বেও যারা সন্তুষ্ট হতে পারে না। কোনও কিছুতেই তাদের সম্পদের চাহিদা মেটে না। তাদের অন্তরে সীমাহীন লোভ সক্রিয় থাকে। যত সম্পদ হয়, ততোই তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে। সে চাহিদা পূরণের জন্য সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করে। হালাল-হারামের কোনও তোয়াক্কা করে না। এরূপ লোককে ধনী বলা যায় কি? কোনও কিছুতেই যার লোভ মেটে না, সে তো ফকীরই বটে। এক বর্ণনায় আছে, হযরত আবূ যার্র রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ যার্র! তুমি কি মনে কর সম্পদ বেশি হওয়াটাই ঐশ্বর্য? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি মনে কর সম্পদ অল্প হওয়াটাই দারিদ্র্য? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাই তো। তিনি বললেন-
إنما الغنى غنى القلب ، والفقر فقر القلب
অন্তরের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য, আর মনের দারিদ্র্যই প্রকৃত দারিদ্র্য।(সহীহ ইবন হিব্বান : ৬৮৫; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১১৭৮৫; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়‍্যীন: ২০২০; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান : ৯৮৬১)

হাদীছটির দ্বিতীয় বাক্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত ঐশ্বর্যের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- إِنَّمَا الْغِنَى غِنَى الْقَلْبِ (অন্তরের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য)। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি যত বেশি অর্থ-সম্পদেরই মালিক হোক না কেন, অন্তরে যদি ঐশ্বর্য না থাকে, তবে তাকে প্রকৃত ধনী বলা যায় না। অপরদিকে কারও মালিকানায় খুব বেশি সম্পদ না থাকলেও মনে যদি ঐশ্বর্য থাকে, তবে সে-ই সত্যিকারের ধনী। কেননা কারও মনে ঐশ্বর্য থাকলে আল্লাহ তা'আলা যতটুকু সম্পদই দেন তাতে সে সন্তুষ্ট থাকে। সে অপ্রয়োজনে আরও বেশি সম্পদের প্রতি লালায়িত হয় না। সম্পদ বাড়ানোর মোহ তাকে অন্ধ করে না; যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। দেখলে মনে হয়ে তার কোনও অভাব নেই। পক্ষান্তরে মনে ঐশ্বর্য না থাকলে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাকে যতই দেওয়া হোক না কেন সে কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। তার লোভ-লালসা কোনও মাত্রায় গিয়ে প্রশমিত হয় না। মনের ক্ষুধা মেটানোর তাড়নায় সে অবিরাম দৌড়ঝাঁপ করতে থাকে। কোনও একটা প্রচেষ্টা বিফল হলে তার শোক-দুঃখের কোনও অন্ত থাকে না। মনে হয় যেন তার কিছুই নেই, একদম দেউলিয়া। সুতরাং বোঝা গেল মনের দিক থেকে যে ধনী, সে-ই আসল ধনী। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, মনের ঐশ্বর্য কীভাবে লাভ হয়? হাঁ, এটা লাভ হয় আল্লাহ তা'আলার ফয়সালায় সন্তুষ্টির দ্বারা, তিনি যা দিয়েছেন তাতে খুশি থাকার দ্বারা। [সুতরাং এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে- وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ ، تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ ‘আল্লাহ তোমার জন্য যা বণ্টন করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট হও, তাহলে সকল মানুষের মধ্যে তুমি হবে সর্বাধিক ঐশ্বর্যশালী।]( জামে তিরমিযী, হাদীছ ২৩০৫) মুমিনকে এ কথা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলার কাছে যা আছে, তা-ই তার জন্য উত্তম ও স্থায়ী। তিনিই প্রকৃত দাতা। তিনি যাকে যে পরিমাণ ইচ্ছা করেন, দান করে থাকেন। তিনি যাকে যা দিতে চান তাতে কেউ বাধা দিতে পারে না। আর তিনি দিতে না চাইলে কেউ কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং সর্বদা মাখলুক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহ তা'আলারই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। এরই দ্বারা অন্তর ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত এ ঐশ্বর্যেরই অধিকারী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى
এবং তোমাকে নিঃস্ব পেয়েছিলেন, অতঃপর (তোমাকে) ঐশ্বর্যশালী বানিয়ে দিলেন।(সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ৮)
এর দ্বারা মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ের ঐশ্বর্যই বোঝানো হয়েছে। কেননা এ আয়াত তাঁর মক্কী জীবনে অবতীর্ণ হয়েছে। আর সকলেরই জানা তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সম্পদের মোহে পড়া বাঞ্ছনীয় নয়। হৃদয়ে ঐশ্বর্য আনাই কাম্য।

খ. আল্লাহ তা'আলা যাকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকার দ্বারাই হৃদয়ের ঐশ্বর্য লাভ হয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন