আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪৪৪
৩৪২৬. নবী (ﷺ) এর বাণীঃ আমার জন্য উহুদ সোনা হোক; আমি তা কামনা করি না।
৬০০০। হাসান ইবনে রবী (রাহঃ) ......... যায়দ ইবনে ওয়াহব (রাহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আবু যর (রাযিঃ) বলেন, একবার আমি নবী (ﷺ) এর সঙ্গে মদীনার কংকরময় প্রান্তরে হেঁটে চলছিলাম। ইতিমধ্যে উহুদ আমাদের সামনে এল। তখন তিনি বললেনঃ হে আবু যর! আমি বললাম, লাব্বাইকা, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেনঃ আমার নিকট এ উহুদ পরিমাণ সোনা হোক, আর তা ঋণ পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে রেখে দেওয়া ব্যতীত একটি দীনারও তা থেকে আমার কাছে জমা থাকুক আর এ অবস্থায় তিন দিন অতিবাহিত হোক তা আমাকে আনন্দিত করবে না। তবে যদি আমি তা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এভাবে তাকে ডান দিকে, বাম দিকে ও পেছনের দিকে বিতরণ করে দেই তা স্বতস্ত্র। এরপর তিনি চললেন। কিছুক্ষণ পর আবার বললেনঃ জেনে রেখো, প্রাচুর্যের অধিকারীরাই কিয়ামতের দিন স্বল্পাধিকারী হবে। অবশ্য যারা এভাবে, এভাবে, এভাবে (যথাক্রমে) ডানে, বামে ও পেছনে ব্যয় করবে, তারা এর ব্যতিক্রম। কিন্তু এরকম লোক অতি অল্পই।
তারপর আমাকে বললেনঃ তুমি এখানে থাক। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করো। অতঃপর তিনি রাতের অন্ধকারে চলে গেলেন। এমনকি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপর আমি একটা উচ্চ শব্দ শুনলাম। এতে আমি শংকিত হয়ে পড়লাম যে, সম্ভবত তিনি কোন শক্রর সম্মুখীন হয়েছেন। এজন্য আমি তার কাছেই যেতে চাইলাম। কিন্তু তখনই আমার স্মরণ হলো যে, তিনি আমাকে বলে গিয়েছেন যে, আমি না আসা পর্যন্ত তুমি আর কোথাও যেয়ো না। তাই আমি সেদিকে আর গেলাম না।
ইতিমধ্যে তিনি ফিরে এলেন। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একটা শব্দ শুনে তো শংকিত হয়ে পড়েছিলাম। বাকী ঘটনা বর্ণনা করলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি শব্দ শুনেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ইনি জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম)। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, আপনার উম্মতের কেউ যদি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তবে সে জান্নাতে দাখিল হবে। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, যদি সে যিনা করে এবং যদি সে চুরি করে। তিনি বললেন, যদিও সে যিনা করে এবং যদিও সে চুরি করে।
তারপর আমাকে বললেনঃ তুমি এখানে থাক। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করো। অতঃপর তিনি রাতের অন্ধকারে চলে গেলেন। এমনকি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপর আমি একটা উচ্চ শব্দ শুনলাম। এতে আমি শংকিত হয়ে পড়লাম যে, সম্ভবত তিনি কোন শক্রর সম্মুখীন হয়েছেন। এজন্য আমি তার কাছেই যেতে চাইলাম। কিন্তু তখনই আমার স্মরণ হলো যে, তিনি আমাকে বলে গিয়েছেন যে, আমি না আসা পর্যন্ত তুমি আর কোথাও যেয়ো না। তাই আমি সেদিকে আর গেলাম না।
ইতিমধ্যে তিনি ফিরে এলেন। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একটা শব্দ শুনে তো শংকিত হয়ে পড়েছিলাম। বাকী ঘটনা বর্ণনা করলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি শব্দ শুনেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ইনি জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম)। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, আপনার উম্মতের কেউ যদি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তবে সে জান্নাতে দাখিল হবে। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, যদি সে যিনা করে এবং যদি সে চুরি করে। তিনি বললেন, যদিও সে যিনা করে এবং যদিও সে চুরি করে।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
“হাররা” বলা হয় কালো পাথরবহুল ভূমিকে। মদীনা মুনাওয়ারার বিভিন্ন দিকে কয়েকটি হাররা বা পাথুরে ভূমি ছিল। উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল সর্বাপেক্ষা বড় হাররা। সেটির নাম 'হাররা ওয়াকিম। উহুদ পাহাড় উত্তর দিকে অবস্থিত। এ হাদীছে বর্ণিত হাররা কোনটি, স্পষ্টভাবে তার উল্লেখ না থাকলেও সেটি হাররা ওয়াকিম ছিল বলে ধারণা করা যায়, যেহেতু হাদীছটিতে বলা হয়েছে l (আমাদের সামনে উহুদ পাহাড় পড়ল)। এক বর্ণনায় আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যার রাযি.-কে বলেছিলেন, হে আবু যার, উহুদ পাহাড় দেখতে পাচ্ছ?
হাদীছটিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুহদ (বিষয়বিমুখতা)-এর বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। উহুদ মদীনা মুনাউওয়ারার সবচে' বড় পাহাড়। এত বড় পাহাড় সোনায় পরিণত হলে কী বিপুল সম্পদ হয় তা কি কল্পনা করা সম্ভব? কারও কাছে সামান্য কিছু সম্পদ জমা হয়ে গেলে সে তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করে। কমে যাওয়ার ভয়ে তা থেকে কাউকে কিছু দিতে চায় না। যার যত হয় সে ততো বেশি চায়। কোনও গরীবের হাতে হঠাৎ কিছু টাকা-পয়সা চলে আসলে সে প্রথমেই তা দ্বারা ভালো একটি বাড়ি তৈরির চিন্তা করে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলছেন। তিনি গরীব হালে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর ছিল ছোট্ট কুটির। দিনের পর দিন তাঁর চুলায় আগুন জ্বলত না। কোনওরকম খেজুর ও পানি খেয়ে ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাতেন। তা সত্ত্বেও তিনি বলছেন এত বড় উহুদ পাহাড় পুরোটা সোনা হয়ে গেলেও তিনি তার সবটা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। ডানে, বামে, পেছনে (কোনও কোনও বর্ণনায় সম্মুখ দিকের কথাও আছে) সবদিকে তা দু'হাতে বিলাতে থাকতেন। তিন দিনের মধ্যে সব লুটিয়ে দিতেন। এক দীনার পরিমাণও নিজের কাছে রাখতেন না। হাঁ, দেনা পরিশোধের জন্য সামান্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ছাড়া। এক বর্ণনায় একদিনের কথাও আছে। তার মানে সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে তা বিলানোর চেষ্টা করতেন। তিন দিনের বেশি কিছুতেই পার হতে দিতেন না। এটা তাঁর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্মোহ চরিত্রের প্রমাণ বহন করে। দুনিয়ার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না। সঞ্চয়ের পক্ষপাতী ছিলেন না। সম্পদ যত বেশিই হোক না কেন, তা বিলাতেই পসন্দ করতেন। কিছু রেখে কিছু খরচ করা তাঁর ধাতে ছিল না।
তিনি বলেন- (কেবল ওই সামান্য কিছু ছাড়া, যা আমি আমার ঋণ পরিশোধের জন্য রাখব)। অর্থাৎ দেনা পরিশোধের সময় হলে তখন যাতে তা পরিশোধ করতে পারি অথবা পাওনাদার যদি হাজির না থাকে আর এখনই তার পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব না হয়, তবে সে ফিরে আসার পর যাতে তা পরিশোধ করতে পারি সেজন্য দেনা পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করে রাখব। এর দ্বারা দেনা পরিশোধের গুরুত্ব বোঝা যায়।
দান-খয়রাত করা নফল ইবাদত। কিন্তু দেনা পরিশোধ করা ফরয। তাই দেনা পরিশোধ না করে সবটা সম্পদ দান করে দেওয়া ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টাকা-পয়সা জমা করে রাখতে পসন্দ করতেন না। কিন্তু এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে, দেনা পরিশোধ করা যায় এ পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলছেন। কেননা এটা বান্দার হক। জীবদ্দশায় আদায় না করে গেলে আখিরাতে নিজের ছাওয়াব দিয়ে তা আদায় করতে হবে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الدَّيْنَ يُقْضَى مِنْ صَاحِبِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا مَاتَ وَلَمْ يَقْضِهِ
“কিয়ামতের দিন দেনাদারের কাছ থেকে দেনা আদায় করিয়ে দেওয়া হবে, যদি সে তা আদায় না করে মারা যায়।'
এক ব্যক্তি দেনাদার অবস্থা মারা গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ভাইকে বলেছিলেন-
إِن أَخَاكَ مُحْتَبَس بِدَيْنِهِ، فَاقْضِ عَنْهُ
'তোমার ভাই তার দেনার দায়ে আটক আছে। তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দাও।'
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, মায়্যিত দেনাদার হলে তার দেনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা পড়াতেন না। কাজেই দেনাদার ব্যক্তির উচিত সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেনা পরিশোধের চেষ্টা করা, যাতে দেনার দায় নিয়ে কবরে যেতে না হয়।
হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল এমনিতে কারও কাছে অর্থ-সম্পদ থাকা দোষের নয়। দোষের হয় তখনই, যখন তা আল্লাহর পথে খরচ করা না হয়। কেউ যদি আল্লাহর জন্য আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অর্থ-সম্পদ বিতরণে অভ্যস্ত থাকে, তবে এ অবস্থায় তার হাতে উহুদ পাহাড় পরিমাণ টাকা-পয়সা থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই। তবে এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, টাকা-পয়সার আকর্ষণ বড় কঠিন। সে আকর্ষণ উপেক্ষা করে মানুষের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়।
হাদীছটিতে তারপর বলা হয়েছে– (তারপর তিনি এগিয়ে চললেন। তারপর বললেন, কিয়ামতের দিন সম্পদশালীরাই হবে অভাবগ্রস্ত, তবে যে তার সম্পদ এভাবে এভাবে ও এভাবে বিলায়)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরের কথাগুলো বলার পর হযরত আবু যার রাযি.-কে নিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলতে থাকলেন। এ অবস্থায় তাকে বললেন, কিয়ামতের দিন সম্পদশালীরাই হবে অভাবগ্রস্ত। অর্থাৎ দুনিয়ায় যাদের অর্থ-সম্পদ বেশি, কিয়ামতের দিন তাদের ছাওয়াবের পরিমাণ হবে কম। কারণ তারা অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করতে ব্যতিব্যস্ত থাকায় ইবাদত-বন্দেগীর বেশি সুযোগ পায়নি। আবার উপার্জন যদি হালাল পথে না হয়ে থাকে, তবে তাতে তো গুনাহের পরিমাণই বাড়তে থেকেছে। সেইসঙ্গে যদি যাকাতও আদায় না করে এবং মালের অন্যান্য হক আদায়ে অবহেলা করে থাকে, তাতেও পাপের পাল্লা ভারী হয়েছে। একদিকে নেক আমল করেছে কম, অন্যদিকে নানারকম গুনাহে লিপ্ত থেকেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আখিরাতে এ শ্রেণীর লোক ছাওয়াব ও পুণ্যে অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকবে। তারা গরীবদের অনেক পেছনে থাকবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছেন ধনীদের সাধারণ অবস্থা অনুযায়ী। কিছু কিছু ধনী ব্যতিক্রমও আছে। তাই তিনি বলেন, “তবে যে তার সম্পদ এভাবে এভাবে ও এভাবে বিলায়।“ অর্থাৎ ডানে, বামে, পেছনে সবদিকে বিলায়। তার কথা আলাদা। সে ছাওয়াবের দিক থেকে অভাবগ্রস্ত হবে না। বরং বলা যায় এরকম অনেক ধনী আখিরাতে গরীবদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও এর প্রমাণ মেলে। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
أن فقراء المهاجرين أتوا رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقالوا: ذهب أهل الدثور بالدرجات العلى، والنعيم المقيم، فقال: «وما ذاك؟» قالوا: يصلون كما نصلي، ويصومون كما نصوم، ويتصدقون ولا نتصدق، ويعتقون ولا نعتق، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «أفلا أعلمكم شيئا تدركون به من سبقكم وتسبقون به من بعدكم؟ ولا يكون أحد أفضل منكم إلا من صنع مثل ما صنعتم» قالوا: بلى، يا رسول الله قال: «تسبحون، وتكبرون، وتحمدون، دبر كل صلاة ثلاثا وثلاثين مرة» قال أبو صالح: فرجع فقراء المهاجرين إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقالوا: سمع إخواننا أهل الأموال بما فعلنا، ففعلوا مثله، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء»
“গরীব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ধনীগণ তো উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি'আমত নিয়ে গেল। তিনি বললেন, সে কী? তারা বললেন, তারা নামায পড়ে যেমন আমরা পড়ি, তারা রোযা রাখে যেমন আমরা রাখি, কিন্তু তারা দান-সদাকা করে, আমরা তা করতে পারি না, তারা গোলাম আযাদ করে, আমরা তাও করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন কোনও আমল শিখিয়ে দেব, যা দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রবর্তীদের ধরে ফেলবে এবং তোমাদের পরবর্তীদের থেকে অগ্রগামী থাকবে আর তোমাদের অনুরূপ আমল যারা করবে তারা ছাড়া অন্য কেউ তোমাদের চেয়ে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে না? তারা বললেন, অবশ্যই শিখিয়ে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। পরে গরীব মুহাজিরগণ আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসলেন এবং বললেন, আমাদের সম্পদশালী ভাইয়েরা আমরা যা করি তা শুনে ফেলেছে। এখন তারাও আমাদের মত আমল শুরু করে দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান দিয়ে থাকেন।
ان الاكثرين هم الاقلون - এর দ্বারা সাধারণভাবে যদিও ধনী ও গরীবকে বোঝায়, কিন্তু যারা ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অন্যদের উপর, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। আখিরাতে তারাও সাধারণজনদের তুলনায় পেছনে থাকবে। তবে তারা যদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির হক আদায় করতে পারে, নিজ ক্ষমতা ও যোগ্যতা দ্বারা সৃষ্টির সেবা করে, কারও প্রতি ক্ষমতাবলে জুলুম না করে এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী যথাযথভাবে চালিয়ে যায়, তাদের কথা আলাদা। তাই দেখা যায় বিভিন্ন হাদীছে ন্যায়পরায়ণ শাসকদের প্রভূত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য এ কথাও সত্য, সম্পদশালী ও ক্ষমতাওয়ালাদের অধিকাংশই দীনদারীতে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। তারা ক্ষমতা ও সম্পদের মোহে আখিরাত ভুলে যায়। এর প্রতিযোগিতায় পড়ে শরী'আত পালনে উদাসীন হয়ে পড়ে। এর ব্যতিক্রম খুব কমই। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তী বাক্যে বলেন- (অথচ এরকম লোক বড় কম)। অর্থাৎ যারা তাদের অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে ব্যয় করে, তারা অপচয়-অপব্যয় করে না, তা দ্বারা সমাজে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তারে ভূমিকা রাখে না, আখিরাতে তারা গরীবদের থেকে পিছিয়ে থাকবে না। কিন্তু এরূপ লোকের সংখ্যা অনেক কম।
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও কিছুদূর সামনে গিয়ে হযরত আবূ যার রাযি.-কে এক জায়গায় বসিয়ে দিলেন এবং হুকুম দিলেন আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখান থেকে সরবে না। এই বলে তিনি সামনে এগোতে থাকলেন। তিনি চোখের আড়াল হতেই হযরত আবূ যার রাযি. একটা বিকট আওয়াজ শুনলেন। তাঁর ভয় হল কোনও শত্রু নয় তো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও বিপদে পড়লেন কিনা? তিনি তাঁর সাহায্যার্থে ছুটে যেতে চাইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ে গেল তাঁকে এখান থেকে সরতে নিষেধ করা হয়েছে। অগত্যা তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসলে তিনি নিজ উদ্বেগের কথা তাঁকে জানালেন। তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, কোনও শত্রুর ব্যাপার নয়; বরং হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসেছিলেন এবং তিনি তাঁর উম্মতকে এক বিরাট সুসংবাদ শুনিয়েছেন। সুসংবাদটি হল- (আপনার উম্মতের মধ্যে যে-কেউ এ অবস্থায় মারা যাবে যে, সে আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না, সে জান্নাতে, প্রবেশ করবে)। এর দ্বারা সাধারণভাবে বোঝা যাচ্ছে যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক না করা অবস্থায় মারা যাবে, তাকে জাহান্নামে যেতে হবে না: সে সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। সন্দেহ নেই অনেক বড় সুসংবাদ। এ সুসংবাদ যে-কোনও মুমিন-মুসলিমকে আপ্লুত করবে। কিন্তু এর উপর প্রশ্নও ওঠে। কেননা কোনও কোনও হাদীছে কোনও কোনও গুনাহ সম্পর্কে স্পষ্টই বলা হয়েছে তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে জাহান্নামে যেতে হবে। সে জান্নাতে যেতে পারবে না। যেমন এক হাদীছে আছে-
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِع
"আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।"
অপর এক হাদীছে আছে-
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنَّانٌ، وَلَا عَاق، وَلَا مُدْمِنُ خَمْرٍ
"দান করার পর যে ব্যক্তি খোঁটা দেয়, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং মদ পানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।"
এরকম আরও বহু হাদীছ আছে, যা প্রমাণ করে কোনও কোনও কবীরা গুনাহের কারণে মুমিনদেরকেও জাহান্নামে যেতে হবে। তারা জান্নাতে যেতে পারবে না। হযরত আবু যার রাযি.-এর তা জানা ছিল। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন- (যদিও সে ব্যভিচার করে এবং যদিও সে চুরি করে)? অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি যদি তাওহীদের অবস্থায় মারা যায় এবং সে শিরকে লিপ্ত না হয়ে থাকে, কিন্তু সে ব্যভিচার বা চুরির মত মহাপাপ করে থাকে, তবুও কি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-(যদিও সে ব্যভিচার করে, যদিও সে চুরি করে)। অর্থাৎ এরূপ মহাপাপ করা সত্ত্বেও সে জান্নাতে যাবে। আর এ উভয় কথার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা শিরকে লিপ্ত না থাকা অবস্থায় মারা গেলে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে তার অর্থ তার যদি কোনও কবীরা গুনাহ না থাকে তবে শুরুতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর কবীরা গুনাহ থাকলে প্রথমে জাহান্নামে তার নির্দিষ্ট শাস্তি ভোগ করবে এবং শাস্তির মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর সে জান্নাতে যাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. হাদীছটি দ্বারা যুহদের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
খ. গরীব দীনদার মুসলিমদের অবহেলা করতে নেই। তারাই প্রকৃত ধনী। তারা সম্পদশালীদের আগে জান্নাতে যাবে।
গ. যার অর্থ-সম্পদ আছে তার কর্তব্য তা থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করা।
ঘ. সম্পদশালীদের নিজ সম্পদের কারণে ভীত থাকা উচিত। কারণ এ হাদীছ জানাচ্ছে আখিরাতে তারাই হবে গরীব, যদি না সম্পদের হক আদায় করা হয়।
ঙ. প্রত্যেক সম্পদশালীর এ কারণেও ভীত থাকা উচিত যে, তার দ্বারা তার সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক যথাযথ আদায় হচ্ছে কি না। হাদীছে তো তা আদায়কারী ধনীদের সংখ্যা খুব কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চ. এ হাদীছ দ্বারা ঋণ পরিশোধের গুরুত্বও উপলব্ধি করা যায়। এ গুরুত্বের কারণেই নিজের কাছে অর্থ-সম্পদ জমা করে রাখা অপসন্দ হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণ পরিশোধ করা যায় এ পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলেছেন।
ছ. তাওহীদ আঁকড়ে ধরা চাই। এটাই আখিরাতে মুক্তিলাভের আসল উপায়।
জ. সদা সর্বদা সতর্ক থাকা উচিত যাতে কোনওক্রমেই শিরকে জড়িয়ে পড়া না হয়। কেননা শিরককারী জান্নাতে যেতে পারবে না।
ঝ. কিছুতেই কবীরা গুনাহ করা উচিত নয়। কখনও হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে ফেলা চাই। অন্যথায় জাহান্নামের শাস্তিভোগের আশঙ্কা রয়েছে।
হাদীছটিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুহদ (বিষয়বিমুখতা)-এর বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। উহুদ মদীনা মুনাউওয়ারার সবচে' বড় পাহাড়। এত বড় পাহাড় সোনায় পরিণত হলে কী বিপুল সম্পদ হয় তা কি কল্পনা করা সম্ভব? কারও কাছে সামান্য কিছু সম্পদ জমা হয়ে গেলে সে তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করে। কমে যাওয়ার ভয়ে তা থেকে কাউকে কিছু দিতে চায় না। যার যত হয় সে ততো বেশি চায়। কোনও গরীবের হাতে হঠাৎ কিছু টাকা-পয়সা চলে আসলে সে প্রথমেই তা দ্বারা ভালো একটি বাড়ি তৈরির চিন্তা করে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলছেন। তিনি গরীব হালে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁর ছিল ছোট্ট কুটির। দিনের পর দিন তাঁর চুলায় আগুন জ্বলত না। কোনওরকম খেজুর ও পানি খেয়ে ক্ষুধা ও পিপাসা মেটাতেন। তা সত্ত্বেও তিনি বলছেন এত বড় উহুদ পাহাড় পুরোটা সোনা হয়ে গেলেও তিনি তার সবটা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। ডানে, বামে, পেছনে (কোনও কোনও বর্ণনায় সম্মুখ দিকের কথাও আছে) সবদিকে তা দু'হাতে বিলাতে থাকতেন। তিন দিনের মধ্যে সব লুটিয়ে দিতেন। এক দীনার পরিমাণও নিজের কাছে রাখতেন না। হাঁ, দেনা পরিশোধের জন্য সামান্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ছাড়া। এক বর্ণনায় একদিনের কথাও আছে। তার মানে সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যে তা বিলানোর চেষ্টা করতেন। তিন দিনের বেশি কিছুতেই পার হতে দিতেন না। এটা তাঁর সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্মোহ চরিত্রের প্রমাণ বহন করে। দুনিয়ার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না। সঞ্চয়ের পক্ষপাতী ছিলেন না। সম্পদ যত বেশিই হোক না কেন, তা বিলাতেই পসন্দ করতেন। কিছু রেখে কিছু খরচ করা তাঁর ধাতে ছিল না।
তিনি বলেন- (কেবল ওই সামান্য কিছু ছাড়া, যা আমি আমার ঋণ পরিশোধের জন্য রাখব)। অর্থাৎ দেনা পরিশোধের সময় হলে তখন যাতে তা পরিশোধ করতে পারি অথবা পাওনাদার যদি হাজির না থাকে আর এখনই তার পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব না হয়, তবে সে ফিরে আসার পর যাতে তা পরিশোধ করতে পারি সেজন্য দেনা পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করে রাখব। এর দ্বারা দেনা পরিশোধের গুরুত্ব বোঝা যায়।
দান-খয়রাত করা নফল ইবাদত। কিন্তু দেনা পরিশোধ করা ফরয। তাই দেনা পরিশোধ না করে সবটা সম্পদ দান করে দেওয়া ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টাকা-পয়সা জমা করে রাখতে পসন্দ করতেন না। কিন্তু এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে, দেনা পরিশোধ করা যায় এ পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলছেন। কেননা এটা বান্দার হক। জীবদ্দশায় আদায় না করে গেলে আখিরাতে নিজের ছাওয়াব দিয়ে তা আদায় করতে হবে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ الدَّيْنَ يُقْضَى مِنْ صَاحِبِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا مَاتَ وَلَمْ يَقْضِهِ
“কিয়ামতের দিন দেনাদারের কাছ থেকে দেনা আদায় করিয়ে দেওয়া হবে, যদি সে তা আদায় না করে মারা যায়।'
এক ব্যক্তি দেনাদার অবস্থা মারা গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ভাইকে বলেছিলেন-
إِن أَخَاكَ مُحْتَبَس بِدَيْنِهِ، فَاقْضِ عَنْهُ
'তোমার ভাই তার দেনার দায়ে আটক আছে। তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দাও।'
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, মায়্যিত দেনাদার হলে তার দেনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জানাযা পড়াতেন না। কাজেই দেনাদার ব্যক্তির উচিত সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেনা পরিশোধের চেষ্টা করা, যাতে দেনার দায় নিয়ে কবরে যেতে না হয়।
হাদীছটি দ্বারা বোঝা গেল এমনিতে কারও কাছে অর্থ-সম্পদ থাকা দোষের নয়। দোষের হয় তখনই, যখন তা আল্লাহর পথে খরচ করা না হয়। কেউ যদি আল্লাহর জন্য আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অর্থ-সম্পদ বিতরণে অভ্যস্ত থাকে, তবে এ অবস্থায় তার হাতে উহুদ পাহাড় পরিমাণ টাকা-পয়সা থাকলেও কোনও ক্ষতি নেই। তবে এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, টাকা-পয়সার আকর্ষণ বড় কঠিন। সে আকর্ষণ উপেক্ষা করে মানুষের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়।
হাদীছটিতে তারপর বলা হয়েছে– (তারপর তিনি এগিয়ে চললেন। তারপর বললেন, কিয়ামতের দিন সম্পদশালীরাই হবে অভাবগ্রস্ত, তবে যে তার সম্পদ এভাবে এভাবে ও এভাবে বিলায়)। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরের কথাগুলো বলার পর হযরত আবু যার রাযি.-কে নিয়ে আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলতে থাকলেন। এ অবস্থায় তাকে বললেন, কিয়ামতের দিন সম্পদশালীরাই হবে অভাবগ্রস্ত। অর্থাৎ দুনিয়ায় যাদের অর্থ-সম্পদ বেশি, কিয়ামতের দিন তাদের ছাওয়াবের পরিমাণ হবে কম। কারণ তারা অর্থ-সম্পদ সঞ্চয় করতে ব্যতিব্যস্ত থাকায় ইবাদত-বন্দেগীর বেশি সুযোগ পায়নি। আবার উপার্জন যদি হালাল পথে না হয়ে থাকে, তবে তাতে তো গুনাহের পরিমাণই বাড়তে থেকেছে। সেইসঙ্গে যদি যাকাতও আদায় না করে এবং মালের অন্যান্য হক আদায়ে অবহেলা করে থাকে, তাতেও পাপের পাল্লা ভারী হয়েছে। একদিকে নেক আমল করেছে কম, অন্যদিকে নানারকম গুনাহে লিপ্ত থেকেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আখিরাতে এ শ্রেণীর লোক ছাওয়াব ও পুণ্যে অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকবে। তারা গরীবদের অনেক পেছনে থাকবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছেন ধনীদের সাধারণ অবস্থা অনুযায়ী। কিছু কিছু ধনী ব্যতিক্রমও আছে। তাই তিনি বলেন, “তবে যে তার সম্পদ এভাবে এভাবে ও এভাবে বিলায়।“ অর্থাৎ ডানে, বামে, পেছনে সবদিকে বিলায়। তার কথা আলাদা। সে ছাওয়াবের দিক থেকে অভাবগ্রস্ত হবে না। বরং বলা যায় এরকম অনেক ধনী আখিরাতে গরীবদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। কোনও কোনও হাদীছ দ্বারাও এর প্রমাণ মেলে। হযরত আবূ যার রাযি. থেকে বর্ণিত আছে-
أن فقراء المهاجرين أتوا رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقالوا: ذهب أهل الدثور بالدرجات العلى، والنعيم المقيم، فقال: «وما ذاك؟» قالوا: يصلون كما نصلي، ويصومون كما نصوم، ويتصدقون ولا نتصدق، ويعتقون ولا نعتق، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «أفلا أعلمكم شيئا تدركون به من سبقكم وتسبقون به من بعدكم؟ ولا يكون أحد أفضل منكم إلا من صنع مثل ما صنعتم» قالوا: بلى، يا رسول الله قال: «تسبحون، وتكبرون، وتحمدون، دبر كل صلاة ثلاثا وثلاثين مرة» قال أبو صالح: فرجع فقراء المهاجرين إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم، فقالوا: سمع إخواننا أهل الأموال بما فعلنا، ففعلوا مثله، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء»
“গরীব মুহাজিরগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, ধনীগণ তো উচ্চমর্যাদা ও স্থায়ী নি'আমত নিয়ে গেল। তিনি বললেন, সে কী? তারা বললেন, তারা নামায পড়ে যেমন আমরা পড়ি, তারা রোযা রাখে যেমন আমরা রাখি, কিন্তু তারা দান-সদাকা করে, আমরা তা করতে পারি না, তারা গোলাম আযাদ করে, আমরা তাও করতে পারি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন কোনও আমল শিখিয়ে দেব, যা দ্বারা তোমরা তোমাদের অগ্রবর্তীদের ধরে ফেলবে এবং তোমাদের পরবর্তীদের থেকে অগ্রগামী থাকবে আর তোমাদের অনুরূপ আমল যারা করবে তারা ছাড়া অন্য কেউ তোমাদের চেয়ে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পারবে না? তারা বললেন, অবশ্যই শিখিয়ে দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, তোমরা প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৩ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। পরে গরীব মুহাজিরগণ আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসলেন এবং বললেন, আমাদের সম্পদশালী ভাইয়েরা আমরা যা করি তা শুনে ফেলেছে। এখন তারাও আমাদের মত আমল শুরু করে দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা আল্লাহ তা'আলার অনুগ্রহ, তিনি যাকে চান দিয়ে থাকেন।
ان الاكثرين هم الاقلون - এর দ্বারা সাধারণভাবে যদিও ধনী ও গরীবকে বোঝায়, কিন্তু যারা ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অন্যদের উপর, তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। আখিরাতে তারাও সাধারণজনদের তুলনায় পেছনে থাকবে। তবে তারা যদি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির হক আদায় করতে পারে, নিজ ক্ষমতা ও যোগ্যতা দ্বারা সৃষ্টির সেবা করে, কারও প্রতি ক্ষমতাবলে জুলুম না করে এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী যথাযথভাবে চালিয়ে যায়, তাদের কথা আলাদা। তাই দেখা যায় বিভিন্ন হাদীছে ন্যায়পরায়ণ শাসকদের প্রভূত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য এ কথাও সত্য, সম্পদশালী ও ক্ষমতাওয়ালাদের অধিকাংশই দীনদারীতে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে। তারা ক্ষমতা ও সম্পদের মোহে আখিরাত ভুলে যায়। এর প্রতিযোগিতায় পড়ে শরী'আত পালনে উদাসীন হয়ে পড়ে। এর ব্যতিক্রম খুব কমই। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরবর্তী বাক্যে বলেন- (অথচ এরকম লোক বড় কম)। অর্থাৎ যারা তাদের অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে ব্যয় করে, তারা অপচয়-অপব্যয় করে না, তা দ্বারা সমাজে ফিতনা-ফাসাদ বিস্তারে ভূমিকা রাখে না, আখিরাতে তারা গরীবদের থেকে পিছিয়ে থাকবে না। কিন্তু এরূপ লোকের সংখ্যা অনেক কম।
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও কিছুদূর সামনে গিয়ে হযরত আবূ যার রাযি.-কে এক জায়গায় বসিয়ে দিলেন এবং হুকুম দিলেন আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত এখান থেকে সরবে না। এই বলে তিনি সামনে এগোতে থাকলেন। তিনি চোখের আড়াল হতেই হযরত আবূ যার রাযি. একটা বিকট আওয়াজ শুনলেন। তাঁর ভয় হল কোনও শত্রু নয় তো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও বিপদে পড়লেন কিনা? তিনি তাঁর সাহায্যার্থে ছুটে যেতে চাইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ে গেল তাঁকে এখান থেকে সরতে নিষেধ করা হয়েছে। অগত্যা তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসলে তিনি নিজ উদ্বেগের কথা তাঁকে জানালেন। তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, কোনও শত্রুর ব্যাপার নয়; বরং হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম এসেছিলেন এবং তিনি তাঁর উম্মতকে এক বিরাট সুসংবাদ শুনিয়েছেন। সুসংবাদটি হল- (আপনার উম্মতের মধ্যে যে-কেউ এ অবস্থায় মারা যাবে যে, সে আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করে না, সে জান্নাতে, প্রবেশ করবে)। এর দ্বারা সাধারণভাবে বোঝা যাচ্ছে যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক না করা অবস্থায় মারা যাবে, তাকে জাহান্নামে যেতে হবে না: সে সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। সন্দেহ নেই অনেক বড় সুসংবাদ। এ সুসংবাদ যে-কোনও মুমিন-মুসলিমকে আপ্লুত করবে। কিন্তু এর উপর প্রশ্নও ওঠে। কেননা কোনও কোনও হাদীছে কোনও কোনও গুনাহ সম্পর্কে স্পষ্টই বলা হয়েছে তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে জাহান্নামে যেতে হবে। সে জান্নাতে যেতে পারবে না। যেমন এক হাদীছে আছে-
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِع
"আত্মীয়তা ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।"
অপর এক হাদীছে আছে-
لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنَّانٌ، وَلَا عَاق، وَلَا مُدْمِنُ خَمْرٍ
"দান করার পর যে ব্যক্তি খোঁটা দেয়, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান এবং মদ পানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।"
এরকম আরও বহু হাদীছ আছে, যা প্রমাণ করে কোনও কোনও কবীরা গুনাহের কারণে মুমিনদেরকেও জাহান্নামে যেতে হবে। তারা জান্নাতে যেতে পারবে না। হযরত আবু যার রাযি.-এর তা জানা ছিল। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন- (যদিও সে ব্যভিচার করে এবং যদিও সে চুরি করে)? অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি যদি তাওহীদের অবস্থায় মারা যায় এবং সে শিরকে লিপ্ত না হয়ে থাকে, কিন্তু সে ব্যভিচার বা চুরির মত মহাপাপ করে থাকে, তবুও কি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-(যদিও সে ব্যভিচার করে, যদিও সে চুরি করে)। অর্থাৎ এরূপ মহাপাপ করা সত্ত্বেও সে জান্নাতে যাবে। আর এ উভয় কথার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কেননা শিরকে লিপ্ত না থাকা অবস্থায় মারা গেলে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে তার অর্থ তার যদি কোনও কবীরা গুনাহ না থাকে তবে শুরুতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর কবীরা গুনাহ থাকলে প্রথমে জাহান্নামে তার নির্দিষ্ট শাস্তি ভোগ করবে এবং শাস্তির মেয়াদ পূরণ হওয়ার পর সে জান্নাতে যাবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. হাদীছটি দ্বারা যুহদের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
খ. গরীব দীনদার মুসলিমদের অবহেলা করতে নেই। তারাই প্রকৃত ধনী। তারা সম্পদশালীদের আগে জান্নাতে যাবে।
গ. যার অর্থ-সম্পদ আছে তার কর্তব্য তা থেকে আল্লাহর পথে অকৃপণভাবে খরচ করা।
ঘ. সম্পদশালীদের নিজ সম্পদের কারণে ভীত থাকা উচিত। কারণ এ হাদীছ জানাচ্ছে আখিরাতে তারাই হবে গরীব, যদি না সম্পদের হক আদায় করা হয়।
ঙ. প্রত্যেক সম্পদশালীর এ কারণেও ভীত থাকা উচিত যে, তার দ্বারা তার সম্পদ থেকে আল্লাহ ও বান্দার হক যথাযথ আদায় হচ্ছে কি না। হাদীছে তো তা আদায়কারী ধনীদের সংখ্যা খুব কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চ. এ হাদীছ দ্বারা ঋণ পরিশোধের গুরুত্বও উপলব্ধি করা যায়। এ গুরুত্বের কারণেই নিজের কাছে অর্থ-সম্পদ জমা করে রাখা অপসন্দ হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণ পরিশোধ করা যায় এ পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে রেখে দেওয়ার কথা বলেছেন।
ছ. তাওহীদ আঁকড়ে ধরা চাই। এটাই আখিরাতে মুক্তিলাভের আসল উপায়।
জ. সদা সর্বদা সতর্ক থাকা উচিত যাতে কোনওক্রমেই শিরকে জড়িয়ে পড়া না হয়। কেননা শিরককারী জান্নাতে যেতে পারবে না।
ঝ. কিছুতেই কবীরা গুনাহ করা উচিত নয়। কখনও হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে ফেলা চাই। অন্যথায় জাহান্নামের শাস্তিভোগের আশঙ্কা রয়েছে।


বর্ণনাকারী: