আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

ওহীর সূচনা অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং:
১. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি কিভাবে ওহী শুরু হয়েছিল
৬। আবুল ইয়ামান হাকাম ইবনে নাফি' (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হরব তাকে বলেছেন, বাদশাহ হিরাকল একবার তাঁর কাছে লোক পাঠালেন। তিনি কুরাইশদের কাফেলায় তখন ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ায় ছিলেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু সুফিয়ান ও কুরাইশদের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্ধিবদ্ধ ছিলেন। আবু সুফিয়ান তার সঙ্গীদের সহ হিরাকলের কাছে এলেন এবং তখন হিরাকল জেরুযালেমে অবস্থান করছিলেন। হিরাকল তাদেরকে তাঁর দরবারে ডাকলেন। তার পাশে তখন রোমের নেত্রীস্থানীয় ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিল। এরপর তাদের কাছে ডেকে নিলেন এবং দোভাষীকে ডাকলেন।তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করে তোমাদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে তাঁর সবচেয়ে নিকটাত্মীয় কে? আবু সুফিয়ান বললেন, আমি বললাম, বংশের দিক দিয়ে আমিই তাঁর নিকটাত্মীয়। তিনি বললেন, তাঁকে আমার খুব কাছে নিয়ে এস এবং তাঁর সঙ্গীদেরও কাছে এনে পেছনে বসিয়ে দাও।
এরপর তাঁর দোভাষীকে বললেন, তাদের বলে দাও, আমি এর কাছে সে ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করবো, সে যদি আমার কাছে মিথ্যা বলে, তবে সাথে সাথে তোমরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রকাশ করবে। আবু সুফিয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে-এ লজ্জা যদি আমার না থাকত, তবে অবশ্যই আমি তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম। এরপর তিনি তাঁর সম্পর্কে আমাকে প্রথম যে প্রশ্ন
করেন তা হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে তাঁর বংশমর্যাদা কেমন? আমি বললাম, তিনি আমাদের মধ্যে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে এর আগে আর কখনো কি কেউ একথা বলেছে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাঁর বাপ-দাদাদের মধ্যে কি কেউ বাদশাহ ছিলেন? আমি বললাম, না। তিনি বললেন,সম্ভ্রান্ত লোকেরা তার অনুসরণ করে নাকি সাধারণ লোকেরা ? আমি বললাম, সাধারণ লোকেরা। তিনি বললেন, তারা কি সংখ্যায় বাড়ছে, না কমছে? আমি বললাম, তারা বেড়েই চলেছে। তিনি বললেন, তাঁর দ্বীন গ্রহণ করার পর কেউ কি নারায হয়ে তা পরিত্যাগ করে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, নবূয়তের দাবীর আগে তোমরা কি কখনো তাঁকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তিনি কি চুক্তি ভঙ্গ করেন? আমি বললাম, না। তবে আমরা তাঁর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তিতে আব্দ্ধ আছি। জানিনা, এর মধ্যে তিনি কি করবেন।আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথাটুকু ছাড়া নিজের পক্ষ থেকে আর কোন কথা সংযোজনের সুযোগই আমি পাইনি। তিনি বললেন, তোমরা কি তাঁর সাথে কখনো যুদ্ধ করেছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাঁর সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধ কেমন হয়েছে? আমি বললাম, তাঁর ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল কুয়ার বালতির ন্যায়। কখনো তাঁর পক্ষে যায়, আবার কখনো আমাদের পক্ষে আসে। তিনি বললেন, তিনি তোমাদের কিসের আদেশ দেন? আমি বললাম, তিনি বলেনঃ তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুর শরীক করো না এবং তোমাদের বাপ-দাদার ভ্রান্ত মতবাদ ত্যাগ কর। আর তিনি আমাদের নামায আদায় করার, সত্য কথা বলার, নিষ্কলুষ থাকার এবং আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ দেন।
তারপর তিনি দোভাষীকে বললেন, তুমি তাকে বল, আমি তোমার কাছে তাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তুমি তার জওয়াবে উল্লেখ করেছ যে, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশের। প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণকে তাঁদের কওমের উচ্চ বংশেই প্রেরণ করা হয়ে থাকে। তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, এ কথা তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে আর কেউ বলেছে কিনা? তুমি বলেছ, না। তাই আমি বলছি যে, আগে যদি কেউ এ কথা বলে থাকত, তবে অবশ্যই আমি বলতে পারতাম, এ এমন ব্যক্তি, যে তাঁর পূর্বসূরীর কথারই অনুসরণ করছে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে কোন বাদশাহ ছিলেন কি না? তুমি তার জবাবে বলেছ, না। তাই আমি বলছি যে, তাঁর পূর্বপুরুষের মধ্যে যদি কোন বাদশাহ থাকতেন, তবে আমি বলতাম, ইনি এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর বাপ-দাদার বাদশাহী ফিরে পেতে চান।আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি- এর আগে কখনো তোমরা তাঁকে মিথ্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছ কি না? তুমি বলেছ, না। এতে আমি বুঝলাম, এমনটি হতে পারে না যে, কেউ মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা ত্যাগ করবে অথচ আল্লাহ র ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলবে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, শরীফ লোক তাঁর অনুসরণ করে, না সাধারণ লোক? তুমি বলেছ, সাধারণ লোকই তাঁর অনুসরণ করে। আর বাস্তবেও এরাই হন রাসূলগণের অনুসারী। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তারা সংখ্যায় বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছ বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ঈমানে পূর্ণতা লাভ করা পর্যন্ত এ রকমই হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তাঁরা দ্বীনে দাখিল হওয়ার পর নারায হয়ে কেউ কি তা ত্যাগ করে? তুমি বলেছ, না। ঈমানের স্নিগ্ধতা অন্তরের সাথে মিশে গেলে ঈমান এরূপই হয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি চুক্তি ভঙ্গ করেন কি না? তুমি বলেছ, না। প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণ এরূপই, চুক্তি ভঙ্গ করেন না।আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি তিনি তোমাদের কিসের নির্দেশ দেন। তুমি বলেছ, তিনি তোমাদের এক আল্লাহর ইবাদত করা ও তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করার নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদের নিষেধ করেন মূর্তিপূজা করতে আর তোমাদের আদেশ করেন নামায আদায় করতে, সত্য কথা বলতে ও কলুষমুক্ত থাকতে। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে শীঘ্রই তিনি আমার এ দু পায়ের নীচের জায়গার মালিক হবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তাঁর আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্যে থেকে হবেন, এ কথা ভাবিনি। যদি জানতাম, আমি তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারব, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য আমি যে কোন কষ্ট স্বীকার করতাম। আর আমি যদি তাঁর কাছে থাকতাম তবে অবশ্যই তাঁর দুখানা পা ধুয়ে দিতাম।
এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সেই পত্রখানি আনতে বললেন, যা তিনি দিহয়াতুল কালবীর মাধ্যমে বসরার শাসকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তা পাঠ করলেন। তাতে লেখা ছিলঃ বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম (দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে)। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল মুহাম্মাদএর পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরাকল এর প্রতি। --শান্তি (বর্ষিত হোক) তার প্রতি, যে হিদায়াতের অনুসরণ করে। তারপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, নিরাপদে থাকবেন। আল্লাহ্ আপনাকে দ্বিগুণ পুরষ্কার দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তবে সব প্রজার পাপই আপনার উপর বর্তাবে। হে আহলে কিতাব! এস সে কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা আল্লাহ্ ব্যতীত আর কারো ইবাদত না করি, কোন কিছুকেই তাঁর শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ্ ব্যতীত রব রূপে গ্রহণ না করি। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলো, তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম (৩:৬৪)।
আবু সুফিয়ান বলেন, হিরাকল যখন তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন এবং পত্র পাঠও শেষ করলেন, তখন সেখানে শোরগোল পড়ে গেল, চিৎকার ও হৈ-হল্লা তুঙ্গে উঠল এবং আমাদের বের করে দেওয়া হল। আমাদের বের করে দিলে আমি আমার সঙ্গীদের বললাম, আবু কাবশার ছেলের বিষয়তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনু আসফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে। তখন থেকে আমি বিশ্বাস করতে লাগলাম, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে আল্লাহ্ তাআলা আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দান করলেন।
ইবনে নাতূর ছিলেন জেরুযালেমের শাসনকর্তা এবং হিরাকলের বন্ধু ও সিরিয়ার খৃষ্টানদের পাদ্রী। তিনি বলেন, হিরাকল যখন জেরুযালেম আসেন, তখন একদিন তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তাঁর একজন বিশিষ্ট সহচর বলল, আমরা আপনার চেহারা আজ বিবর্ণ দেখতে পাচ্ছি, ইবনে নাতূর বলেন, হিরাকল ছিলেন জ্যোতিষী, জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর দক্ষতা ছিল। তারা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদের বললেন, আজ রাতে আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, খতনাকারীদের বাদশাহ আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান যুগে কোন্ জাতি খতনা করে? তারা বলল, ইয়াহুদী ছাড়া কেউ খতনা করে না। কিন্তু তাদের ব্যাপার যেন আপনাকে মোটেই চিন্তিত না করে। আপনার রাজ্যের শহরগুলোতে লিখে পাঠান, তারা যেন সেখানকার সকল ইয়াহুদীকে হত্যা করে ফেলে। তারা যখন এ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত ছিল, তখন হিরাকলের কাছে এক ব্যক্তিকে উপস্থিত করা হল, যাকে গাসসানের শাসনকর্তা পাঠিয়েছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সম্পর্কে খবর দিচ্ছিল। হিরাকল তার কাছ থেকে খবর জেনে নিয়ে বললেন, তোমরা একে নিয়ে গিয়ে দেখ, তার খতনা হয়েছে কি-না। তারা তাকে নিয়ে দেখে এসে সংবাদ দিল, তার খতনা হয়েছে।
হিরাকল তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। সে জওয়াব দিল, তারা খতনা করে। তারপর হিরাকল তাদের বললেন, ইনি [রাসূলুল্লাহ (ﷺ)] এ উম্মতের বাদশাহ। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। এরপর হিরাকল রোমে তাঁর বন্ধুর কাছে লিখলেন। তিনি জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষ ছিলেন। পরে হিরাকল হিমস চলে গেলেন। হিমসে থাকতেই তাঁর কাছে তাঁর বন্ধুর চিঠি এলো, যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর আবির্ভাব এবং তিনিই যে প্রকৃত নবী, এ ব্যাপারে হিরাকলের মতকে সমর্থন করছিল। তারপর হিরাকল তাঁর হিমসের প্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ডাকলেন এবং প্রাসাদের সব দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। দরজা বন্ধ করা হল। তারপর তিনি সামনে এসে বললেন, হে রোমবাসী! তোমরা কি কল্যাণ, হিদায়ত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর বায়আত গ্রহণ কর। এ কথা শুনে তারা জংলী গাধার মত উর্ধ্বশ্বাসে দরজার দিকে ছুটল, কিন্তু তারা তা বন্ধ অবস্থায় পেল। হিরাকল যখন তাদের অনীহা লক্ষ্য করলেন এবং তাদের ঈমান থেকে নিরাশ হয়ে গেলেন, তখন বললেন, ওদের আমার কাছে ফিরিয়ে আন। তিনি বললেন, আমি একটু আগে যে কথা বলেছি, তা দিয়ে তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপর কতটুকু অটল, কেবল তার পরীক্ষা করেছিলাম। এখন আমি তা দেখে নিলাম। একথা শুনে তারা তাঁকে সিজদা করল এবং তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হল। এই ছিল হিরাকল এর শেষ অবস্থা।

আবু আব্দুল্লাহ বুখারী (রাহঃ) বলেন, সালেহ ইবনে কায়সান (রাহঃ), ইউনুস (রাহঃ) ও মা'মার (রাহঃ) এ হাদীস যুহরী (রাহঃ) থেকে রিওয়ায়েত করেছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

শিরোনামের সাথে অত্র হাদীসের বাহ্যিক কোন সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তবে তরজুমাতুল বাব প্রমাণ করার লক্ষ্যে মুহাদ্দিসগণ পরিচ্ছেদ শিরোনামের ও হাদীসের মধ্যকার কয়েকটি সামঞ্জস্যের দিক উল্লেখ করেছেন।
১. কতিপয় মুহাদ্দিসের মতে, ওহীর সূচনার সাথে হিরাক্লিয়াসের ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে। তা হল, উক্ত ঘটনায় ওহীর প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা রয়েছে। ওহী নাযিলের প্রাথমিক অবস্থায় কি কি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন অত্র হাদীসে তারই উল্লেখ রয়েছে।

২. সূচনালগ্নে ইসলাম অপরিচিত ছিল। তাই চতুর্দিক থেকে বিরোধিতা করা হচ্ছিল। তখন যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, ধাপে ধাপে তাদেরকে নানা প্রকারের নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। শুধু ইসলামের আকর্ষণ ও সভ্যতাই সাহাবায়ে কেরামের পদযুগল কঠিন মুসীবতেও অনড় অবিচল রেখেছিল। মোটকথা এখানে ইবতিদা যারা ওহীর শুরু অবস্থা উদ্দেশ্য নয়, বরং ইবতিদায়ে যামানী তথা ওহীর কালগত সূচনার ধরন বুঝানো উদ্দেশ্য।

৩. পরিচ্ছেদ শিরোনাম ও হাদীসের মাঝে আরেকটি সামঞ্জস্য হচ্ছে হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসনীয় গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো হিরাক্লিয়াসের প্রশ্নের জবাবে সামনে এসেছে।

অতএব ওহীর সূচনা উক্ত গুণাবলীর উপরই হয়েছে। সুতরাং এতে ইৰতিদায়ে শানী তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদাগত সূচনা' বাস্তবায়িত হয়েছে। এ সামঞ্জস্যের উপর ভিত্তি করে হাদীসখানা অত্র বাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

শাইখুল হিন্দ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর মতে বাবের সাথে হাদীসের সম্পর্ক হচ্ছে- অত্র বাবের উদ্দেশ্য ওহীর মাহাত্ম্য ও মর্যাদা বর্ণনা করা। আর হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উঁচুমানের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সম্মান মর্যাদার বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভ করা যায়। সুতরাং ওহী প্রাপকের মাহাত্ম্য ও মর্যাদার মাধ্যমে ওহীর মর্যাদাগত গুরুত্ব ও আযমত এমনিতেই প্রকাশিত হয়ে যায়।

আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের পূর্বে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ প্রয়োজন মনে করছি, যেগুলোর মাধ্যমে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস বাদশার পরিচয় পাওয়া যাবে এবং তিনি, আবূ সুফিয়ান ও দিহইয়া কালবী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাইতুল মুকাদ্দাসে একত্রিত হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। তা ছাড়া অত্র হাদীসে যে ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হবে, যাতে করে হাদীসের বিষয়বস্তু বুঝা সহজ হবে।

১. যে সময় নবীকুল শিরোমণি সরোয়ারে কায়েনাত খাতামুল আম্বিয়া রাসূলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নশ্বর পৃথিবীতে আগমন করেন, (৮ বা ৯ রবীউল আওয়াল ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ রোজ সোমবার) সে সময় সারা দুনিয়ায় দুটি বড় রাষ্ট্রশক্তি ছিল। তার একটি হল রোম রোম সম্রাটকে বলা হত 'কাইসার'। তার নাম ছিল হিরাক্লিয়াস। আরেকটি ছিল পারস্য, যেটির বর্তমান নাম ইরান। পারস্য সম্রাটকে বলা হত 'কিসৱা'। রোমবাসী ছিল আহলে কিতাব বা খ্রিস্টান। আর পারস্যবাসীরা ছিল অগ্নিপূজক। দীর্ঘদিন থেকে এদুটি সাম্রাজ্যের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল।

মক্কাবাসীর নিকট রোম ও পারস্যের যুদ্ধের সংবাদ পৌঁছত। সে সময় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত প্রাপ্ত হন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়ত দাবী ও ইসলামী আন্দোলন মক্কাবাসীর মনে রোম ও পারস্যের যুদ্ধের খবর নেয়ার এক বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করে।

২. মক্কার মুশরিকরা পারস্যের অগ্নিপূজকদেরকে ধর্মের দিক দিয়ে নিজেদের খুব কাছের মানুষ মনে করত। আর রোমের খ্রিস্টানরা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে মুসলমানদের কাছের লোক বলে বিবেচিত হত। এ কারণে পারস্যের বিজয়ের খবর আসলে মুশরিকরা খুশি হত। কেননা পারস্যের বিজয় সংবাদে মক্কার মুশরিকরা মনে করত পারস্যবাসী অগ্নিপূজকরা যেমন আহলে কিতাব খ্রিস্টান রোমবাসীর উপর বিজয়ী হয়েছে, তেমন তওহীদবাদী ইসলামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারাও বিজয়ী হবে। তারা তখন নানা ধরনের স্বপ্ন দেখত।

পক্ষান্তরে আহলে কিতাব রোমকদের পরাজয়ের সংবাদ শুনলে মুসলমানদের খারাপ লাগত। মুসলমানদের এ দুঃখ ভারাক্রান্ত অবস্থায় কাফির ও মুশরিকরা আনন্দ পেত। আর শেষে ৬১৪ খ্রিস্টাব্দে যখন চন্দ্রমাসের হিসেবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স ৪৫ বছর এবং নবুওয়তের পাঁচবছর অতিবাহিত হয়, তখন খসরু পারভেজের শাসন আমলে পারস্যবাসী রোমকে বিরাট আকারে পরাজিত করে। ফলে শাম, মিসর ও এশিয়া সবকয়টি রাজ্য রোমসম্রাটের হাতছাড়া হয়ে যায়। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ইরানী সৈনারা কুস্তনতুনিয়ায় (কনস্ট্যান্টিনোপল) আশ্রয় নিতে বাধ্য করে এবং রোম সম্রাট এক ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। বড় বড় পাদ্রী নিহত অথবা বন্দী হয়। বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে খ্রিস্টানদের কথিত পবিত্র ক্রুশ ইরানীরা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। রোম সম্রাটের ক্ষমতা সমূলে ধ্বংস হয়। বাহ্যত রোমের জন্য পারস্যের একচ্ছত্র শাসন থেকে বের হওয়ার কোন উপায় অবশিষ্ট থাকল না। এ অবস্থায় মক্কার মুশরিকরা অত্যধিক উৎফুল্ল হয়। তারা লম্বা লম্বা আশা পোষণ করতে শুরু করে। এমনকি কোন কোন মুশরিক আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কে বলল, আজ আমাদের ইরানী ভাইরা তোমাদের রোম ভাইদেরকে পরাজিত করেছে। আগামীতে আমরাও তোমাদেরকে তেমনিভাবে পরাজিত করব। তখনই কুরআন কারীম বাহ্যিক উপকরণের সম্পূর্ণ বিপরীত ঘোষণা করে দিল।

الم غلبت الروم في أذى الأرض وهم من بعد عليهم سيغلبون في يضع سنين، (روم) "

আলিফ-লাম-মীম। রোমানরা পরাজিত হয়েছে নিকটবর্তী এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর অতিসত্ত্বর বিজয়ী হবে কয়েক বছরের মধ্যে।”

৩. কুরআনের উক্ত ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ভিত্তি করে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কতিপয় মুশরিকের সাথে শর্ত করলেন, যদি এত বছরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী না হয়, তাহলে আমি তোমাদেরকে একশ উট দেব। অন্যথায় তোমরা আমাকে সেই পরিমাণ উট দেবে (এরূপ বাজি ধরা তখনও হারাম হয়নি)।
এদিকে চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছে আর ওদিকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস সকল নৈরাশ্যপূর্ণ অবস্থা থেকে উত্তরে আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা করে নিজের বিলুপ্ত রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ও ক্ষমতার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাতে লাগলেন। মান্নত করলেন, যদি আল্লাহ তা'য়ালা পারস্যের উপর আমাকে বিজয় দান করেন, তা হলে আমি হেমস (সিরিয়ার প্রসিদ্ধ শহর) থেকে পায়ে হেঁটে ঈলিয়ায় (বাইতুল মুকাদ্দাস) পৌছব (বাইতুল মুকাদ্দাস তাদের কেবলা ছিল, যেমন আমাদের জন্যে বাইতুল্লাহ্)।

৪. রোমের বিজয় এবং পারস্যের পরাজয়

কুরআন কারীমের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ঠিক নয় বছর পর দ্বিতীয় হিজরীতে বদরের যুদ্ধে যখন কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হন, ঠিক একই সময় আহলে কিতাব রোমক খ্রিস্টানরা অগ্নিপূজারী মুশরিক পারসিকদের উপর বিজয় লাভ করে। এই খবর শুনে সকলে আরো অধিক আনন্দিত হলেন। রোমানদের বিজয় সংবাদ শুনে এবং পারসিকদের পরাজয়ের গ্লানির সাথে মুশরিকদের অপদস্থতা-লাঞ্ছনা আরও বেড়ে যায়
বাহ্যিক উপায় উপকরণের বিপরীতে কুরমান করীমের এ আশ্চর্যপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব দেখে অনেক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। আর আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু শর্ত অনুযায়ী মুশরিকদের কাছ থেকে একশ উট আদায় করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সেগুলো সদকা করে দেন।

৫. দিহইয়া কালবী রাযি. আবূ সুফিয়ান ও হিরাক্লিয়াসের সম্মিলন

বদর যুদ্ধে যদিও মুসলমানদের বিরাট বিজয় ও সফলতা অর্জিত হয়েছে, এতদসত্ত্বেও যুদ্ধের ধারাক্রম অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় হিজরীতে বদর, তৃতীয় হিজরীতে উৎপ, চতুর্থ হিজরীতে বদরে সুগরা (ছোট বদর), পঞ্চাম হিজরীতে খন্দক (একে আহযাব যুদ্ধও বলা হয়) এ বছরই সংঘটিত ধনী মুস্তালিক যুদ্ধ (যাকে মুরাইসী যুদ্ধও বলা হয়) প্রভৃতি যুদ্ধের কারণে একদিকে মুসলমানদের সফর করা এবং বহির্বিশ্বে বিভিন্ন দেশের শাসক সম্রাটনের নিকট ইসলাম পৌঁছানো এক রকম অসম্ভব ছিল। অন্যদিকে মক্কার কুরাইশদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসার কেন্দ্র ছিল সিরিয়া। মদীনার নিকট দিয়ে তাদের সিরিয়ায় যাতায়াত করতে হত। এ কারণে সিরিয়ায় কুরাইশনের ব্যবসা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর ষষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার সন্ধি হলে পুনরায় সিরিয়ার সাথে কুরাইশদের ব্যবসা পূর্ববৎ চালু হয়।

৬. হুদাইবিয়ার সন্ধির মোটামুটি ঘটনা হল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লান একটি স্বপ্ন দেখে ষষ্ঠ হিজরীতে ফিলকান মাসে দেড় হাজার সাহাবীকে সাথে নিয়ে উমরা করার উদ্দেশ্যে মঞ্চাভিমুখে রওয়ানা হন। মক্কা মুকাররমার নিকটবর্তী হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উটনী বসে পড়ে। কোন ভাবেই সেটিকে উঠানো যাচ্ছিল না। ওখানে অনেক ঘটনা ঘটার পর মক্কার কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । এর নিকট উপস্থিত হয় এবং সন্ধিনামা লেখার সিদ্ধান্ত হয়। সন্ধির শর্তাবলী বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের বিপক্ষে ছিল। ফলে মুসলমানগণ তলোয়ারের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার লোকদের হঠকারিতা সত্ত্বেও তাদের মতামত মনযুর করে নেন এবং সঙ্গিনামা তৈরী হয়। সঙ্গির শর্তসমূহের একটি শর্ত ছিল, দশ বছর মুসলমান ও কুরাইশদের মাঝে কোন প্রকার যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হবে না।

হুদাইবিয়ার সন্ধির সুবাদে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হওয়ার দরুণ কুরাইশদের পক্ষে নিরাপদে নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য করার এবং মুসলমানদের জন্যে বহির্বিশ্বসহ আরব উপদ্বীপের সর্বত্র ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার সুযোগ আসে। যুদ্ধের কারণে এতদিন কুরাইশদের সিরিয়কেন্দ্রিক যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আবূ সুফিয়ানের নেতৃত্বে তা পুনরায় শুরু হয়। সেমতে ত্রিশজনের এক কাফেলা সঙ্গে করে তিনি সিরিয়ায় পৌঁছেন। এদিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুযোগ পেয়ে রোম, পারস্য, হাবশা, সিরিয়া ও ইয়ামানের সম্রাটদেরকে ইসলামের দাওয়াত-সম্বলিত পত্র লিখে পাঠালেন।

৭. হুদাইবিয়ার সন্ধির পর ষষ্ঠ হিজরীর শেষের দিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ইসলামের প্রতি আহবান জানিয়ে একখানা পত্র লিখেন। সাহাবী দেহইয়া কালবী রাদিয়াল্লাহ আনছ এ পত্র বয়ে নিয়ে যান। তিনি ৭ম হিজরীর মুহাররাম মাসের শুরুতে এ পত্র নিয়ে রোম সম্রাটের দরবারে পৌঁছেন।

৮. দেহইয়া কালবী রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন পত্র নিয়ে পৌঁছেন। পারস্যের পরাজয় হলে তিনি রোম সম্রাট হামস থেকে পায়ে হেঁটে তার মান্নত পুরা করার লক্ষ্যে বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছেছিলেন। দেহইয়া রাদিয়াল্লাহ আনছ বসবার আমীরের মাধ্যমে হিরাক্লিয়াসের নিকট পত্রখানা পৌঁছান। পর পেয়ে রোম সম্রাট এই মর্মে আদেশ করলেন, আলোচিত নবীর নিকটতম আত্মীয়দের কেউ এখানে থাকলে তাকে ডেকে পাঠাও। আবু সুফিয়ান ও তাঁর সঙ্গীদের ডাকা হল। আবু সুফিয় হিরাক্লিয়াসের মাঝে যে কথাবার্তা হয়েছে তার বিবরণ হাদীসেই রয়েছে।

রোম সম্রাটের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি ও সম্রাটের তদন্ত:

হিজরী ৬ সালে মক্কার মুশরিকদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সন্ধি স্থাপিত হয়। হিজরতের পর থেকে সন্ধিস্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকে। অধিকাংশ সময় নবী কারীম সাল্লা 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে চতুর্দিকে ইসলাম প্রচারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যায়নি। হিজরী ৬ষ্ঠ সালে তিনি প্রায় দেড় হাজার সাহাবীসহ উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু মুশরিকগণ তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি হুদায়বিয়া নামক স্থানে শিবির ফেলতে বাধ্য হন। সেখানে অনেক আলাপ-আলোচনার পর কুরায়শদের সংগে তাঁর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থাপিত হয়। এ চুক্তির ফলে পূর্ণোদ্যমে দা'ওয়াতী কার্যক্রম চালানোর সুযোগ হয়। অভ্যন্তরীণ প্রচার-প্রচারণার বাইরেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের কাছে দা'ওয়াতীপত্র প্রেরণ করতে থাকেন। এরকম একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল রোমের বাদশার কাছেও। পত্রবাহক ছিলেন হযরত দিহয়া কালবী রাযি.।

তখনকার রোমের বাদশা ছিলেন হিরাল (হেরাক্লিয়াস)। উপাধি কায়সার/কাইযার। রোমের প্রত্যেক বাদশাকেই কাইযার বলা হত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি যখন তার হাতে পৌঁছায়, তখন তিনি ঈলিয়া (বায়তুল মুকাদ্দাস) অবস্থান করছিলেন।

হিরাকল অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। চিঠি পাওয়ার পর চটজলদি কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না। তিনি চাইলেন পত্রপ্রেরক (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন। তারপর ভালোভাবে জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তাঁর সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রদান আরবের কোনও লোকের পক্ষেই সম্ভব। সে লোক যদি মক্কার হয়, বিশেষত তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেউ হয়, তবে আরও ভালো। এমন কোনও লোক পাওয়া যায় কিনা, তিনি খোঁজ নিতে বললেন।

ঘটনাক্রমে আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলা এ সময় ফিলিস্তীনে অবস্থান করছিল।

তারাও যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত থাকায় এতদিন ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগ দিতে পারেনি।
যাহোক হিরাকলের লোকজন আবূ সুফয়ানের বাণিজ্য কাফেলার সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা তাদেরকে রাজদরবারে নিয়ে হাজির করল। কাফেলার প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার পর জানা গেল আবূ সুফয়ানই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ। উভয়ে একই কুরায়শ বংশের লোক ও মক্কার বাসিন্দা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা ভালো ধারণা তিনিই দিতে পারবেন। কাজেই কথোপকথনের জন্য কাফেলার লোকদের মধ্যে হিরাকল তাকেই নির্বাচন করলেন।

রোম সম্রাটের দরবারে আবূ সুফয়ান:

সম্রাটের পারিষদবর্গের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন দরবারে উপস্থিত। আবূ সুফয়ানকে তাদের সামনে বসানো হল। তার সঙ্গীদের বসানো হল তার পেছনে। এটা ছিল হিরাকলের সতর্কতা। যাতে তারা পরস্পর ইশারা-ইঙ্গিতে ভাবের লেনদেন করতে না পারে।
হিরাকল তাকে নবী কারীম 'সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম' সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। আবূ সুফয়ান তার প্রত্যেকটির সঠিক উত্তর দান করেন। একটি প্রশ্নেরও উত্তরে কোনও অসত্যকথা বলেননি। রাজনৈতিক কুটকৌশলের দিকে লক্ষ করলে এ ক্ষেত্রে তার মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কথা ছিল। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার শত্রু। তাঁকে দমন করার জন্য এ যাবতকাল অনেক শক্তি ক্ষয় করেছেন। কিন্তু তাতে সফলতা লাভ করতে পারেননি। এবার সফলতা লাভের একটা বড় সুযোগ হাতে এসে গেছে। রোমসম্রাট বলে কথা!! তখনকার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি। তাকে যদি খেপিয়ে দেওয়া যায়, তবে মদীনায় হামলা চালিয়ে নিমিষেই সবকিছু চুরমার করে দিতে পারে। ইসলামের মূলোৎপাটন করার এ এক সুবর্ণ সুযোগ। কোনও বুদ্ধিমান ব্যক্তি শত্রু দমনের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে না। আবূ সুফয়ানেরও তা করার কথা নয়। কিন্তু সেজন্য যে কিছু মিথ্যাকথা বলতে হয়! সমস্যা এখানেই। আবূ সুফয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! লজ্জাই বাধ সেধেছে। আমি মিথ্যা বলি- এ কথা দেশময় প্রচার হয়ে যাবে। সেই লজ্জা! নয়তো আমি অবশ্যই তাঁর সম্পর্কে মিথ্যাকথা বলতাম।

এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। আবূ সুফয়ান তখনও কাফের এবং ইসলামের ঘোরশত্রু। তা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যা বলাকে নিজের পক্ষে লজ্জাস্কর মনে করেছেন। লোকে জানবে তিনি মিথ্যা বলেন, এটাকে নিজের পক্ষে অপমানকর মনে করেছেন। বিশেষত তিনি একজন জননেতা। লোকে জানবে তাদের নেতা মিথ্যা বলে।
সেই লজ্জায় তিনি মিথ্যা বলা হতে বিরত থেকেছেন। আজ আমাদের কী অবস্থা!
কথায় কথায় মিথ্যা বলি। তা জনসম্মুখে প্রকাশ্যেই বলি। ছোটদের সামনে বলি, বড়দের সামনেও বলি। আপন-পর সকলের সামনেই বলি।

সংক্ষিপ্ত নববী শিক্ষার ভেতর পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ছবি:

যাহোক হিরাকল আবূ সুফয়ানকে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিলেন। আমরা তার বিস্তারিত বিবরণের দিকে যাচ্ছি না। এখানে কেবল এতটুকু উল্লেখ্য যে, হিরাকল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের কী আদেশ করেন (অর্থাৎ কী শিক্ষা দেন)? আবূ সুফয়ান উত্তর দিলেন, তিনি বলে থাকেন- তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোনওকিছুকে শরীক করো না। তোমাদের বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিত্যাগ কর। আর তিনি আমাদেরকে সালাত, সিদক (সততা ও সত্যবাদিতা), আফাফ (সংযম ও শুচিতা) ও আত্মীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেন।

লক্ষ করলে বোঝা যায় এর ভেতর সংক্ষেপে ইসলামের মূল শিক্ষাসমূহ এসে গেছে। ইসলামের সর্বপ্রধান শিক্ষা ‘আকীদা-বিশ্বাস। আকীদা-বিশ্বাসের ভেতর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাওহীদ। অর্থাৎ আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা এবং তাঁর সংগে কাউকে শরীক না করা। এ হাদীছে প্রথমে সেই শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে। বলা যেতে পারে এটা 'আকীদা বিষয়ক একটি শিরোনাম। আখিরাত, রিসালাত, তাকদীর প্রভৃতি বিষয়ক বিশ্বাসও এর অন্তর্ভুক্ত। মু'মিন হওয়ার জন্য তার সবগুলোতেই বিশ্বাস রাখা জরুরি। তবে সবার আগে যেহেতু তাওহীদ, তাই শিরোনাম হিসেবে এখানে তাওহীদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।

বাপ-দাদাগণ যা বলে তা পরিহার করতে বলে মূলত শিরক পরিহারের কথাই বলা হয়েছে। আরবে যুগ-যুগ ধরে মূর্তিপূজা চলে আসছিল। পরের প্রজন্ম আগের প্রজন্মকে দেখে দেখে সেটাকেই সত্যধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। এর বিপরীত কোনও কথা তারা মানতে রাজি ছিল না। সাধারণভাবে সর্বত্র এটাই মানুষের চরিত্র। বাপ-দাদাদের যা করতে দেখে আসে তা করতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়, তার বিপরীত কিছু মানতে রাজি হয় না। আরব মুশরিকগণও তা মানছিল না। তাদের বড় অভিযোগ ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন তাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কথা বলেন। আবূ সুফয়ান হয়তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষাটিকে অভিযোগ হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি নিজেও বাপ-দাদার পথকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে নতুন পথে চলছেন, অন্যদেরও সে পথে চালাতে চাচ্ছেন। এভাবে বাপ-দাদাকে গোমরাহ সাব্যস্ত করা ও যুগ-যুগ ধরে চলে আসা ধর্মমতকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করা কি কোনও সমর্থনযোগ্য কাজ? এটা কি চরম অন্যায় ও গর্হিত কাজ নয়? এজন্যই আমরা তার নতুন ধর্ম সমর্থন করতে পারছি না। সম্ভবত এই বলে তিনি হেরাক্লিয়াসকেও নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে চাচ্ছিলেন। কারণ হেরাক্লিয়াস ও তার জাতিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের রেখে যাওয়া সত্যধর্মের বিপরীতে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা ভ্রান্ত রীতি-নীতি অনুসরণ করছিল আর তাকেই প্রকৃত খৃষ্টধর্ম বলে বিশ্বাস করছিল। কিন্তু আবূ সুফয়ানের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। কেননা তার মুখ থেকে যাবতীয় তথ্য শোনার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সত্য নবী এবং তিনিই সেই প্রতিশ্রুত শেষ পয়গম্বর, যাঁর সম্পর্কে আগের সমস্ত নবী-রাসূল ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। এ কারণে হেরাক্লিয়াস নিজেও ঈমান আনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখন পারিষদবর্গ ও যাজক-পুরোহিতদের স্পষ্ট বিরোধিতা লক্ষ করলেন এবং তার পরিণতিতে সিংহাসন হারানোরও আশংকা বোধ করলেন, তখন ভ্রান্ত জানা সত্ত্বেও প্রচলিত খৃষ্ট ধর্মমতেই অবিচল থাকলেন। ক্ষমতার মোহে পড়লে মানুষ এভাবেই সত্যবিমুখ হয়ে থাকে এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার স্বার্থে আখিরাতের চিরস্থায়ী সফলতা বিসর্জন দেয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন