আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪১৬
৩৪১৫. নবী (ﷺ) এর বাণীঃ দুনিয়াতে তুমি একজন মুসাফির অথবা পথযাত্রীর মত থাক।
৫৯৭৪। আলী ইবনে আব্দুল্লাহ (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা আমার উভয় কাঁধ ধরে বললেনঃ তুমি এ দুনিয়াতে একজন মুসাফির অথবা পথযাত্রীর মত থাক। আর ইবনে উমর (রাযিঃ) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার অবকাশে পীড়িত অবস্থার জন্য সঞ্চয় করে রেখো। আর জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিও।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
১. হাদীসটি একটি বিখ্যাত হাদীস। আমাদের অনেকেরই তা মুখস্থ আছে। অন্তত এর সরল ভাব ও মর্ম তো প্রায় সকলেরই জানা আছে। হাদীসের ইমামগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এই মোবারক হাদীসটি সংকলন করেছেন।
উপরের হাদীসে দুটো অংশ আছে : প্রথমটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী। আর দ্বিতীয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর বাণী। হাদীস-শাস্ত্রের পরিভাষা-অনুসারে প্রথমটিকে বলা হবে ‘মারফূ‚’ বর্ণনা। অর্থাৎ যে বর্ণনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, কর্ম, সম্মতি কিংবা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে।
আর দ্বিতীয় অংশটি, যাতে ইবনে ওমর রা.-এর বাণী উল্লেখিত হয়েছে, তাকে বলা হবে, ‘মাওকূফ’। অর্থাৎ যে বর্ণনা সাহাবী পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় কোনো সাহাবীর কথা, কাজ বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে। সাধারণভাবে ‘মাওকূফ’ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এ শব্দের অন্য ব্যবহারও আছে, তবে তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
আমাদের হাদীসের ইমামগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এত সতর্ক ছিলেন যে, বর্ণনায় মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্যও খুব যত্নের সাথে পরীক্ষা করতেন। তাদের নীতি এই ছিল যে, বর্ণনাটি উপর থেকে যেভাবে আসছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। যা উপর থেকে সাহাবীর বাণী হিসেবে বর্ণিত হয়ে এসেছে তাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। প্রত্যেক বর্ণনা আপনরূপে থাকতে হবে। এরপর সেই বর্ণনার বিষয়বস্তুর সূত্র-সন্ধান, অর্থাৎ সাহাবী এই কথাটি কোত্থেকে বলেছেন- তা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। সাহাবী যখন বলেছেন তা তো আল্লাহর রাসূলের কথাই হবে, কিংবা কথাটি তো খুব সুন্দর কথা, ধর্মীয় কথা, কাজেই একে আল্লাহর রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করে দেওয়া যায়- এজাতীয় চিন্তা তাদের কাছে শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা হিসেবে গণ্য ছিল। আর তাই মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্য না করা ছিল তাঁদের দৃষ্টিতে অনেক বড় শাস্ত্রীয় দোষ।
সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রেই যখন এই কথা তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য। বস্তুত দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণের এরকম সচেতনতা ও সতর্কতার কারণেই দ্বীন সংরক্ষিত থেকেছে এবং তা আমাদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে।
হাদীস শরীফের প্রথম অংশ
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
কাঁধে হাত দেওয়া স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করে। উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে তা অধিকতর ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবীকে আন্তরিকতার সাথে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা মুমিন-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। প্রিয় সাহাবীকে সম্বোধন করলেও এ শিক্ষা সকল মুমিনের জন্য- ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
ভিনদেশী বা পথিকজনের মতো হওয়ার অর্থ কী? হাদীসের ভাষ্যকারগণ এর ব্যাখ্যায় যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-
পৃথিবীর এই ঘর মানুষের স্থায়ী ঘর নয়। এখানে সে ক্ষণস্থায়ী, তাকে তার স্থায়ী ঘরে ফিরে যেতে হবে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এই মহাসত্য স্মরণ রাখা তার কর্তব্য। এই সত্য স্মরণ রাখার যে প্রভাব তার চিন্তা ও কর্মে পড়বে তা নিম্নরূপ :
এক. মুমিন কিছুতেই দুনিয়ার ব্যাপারে মোহগ্রস্ত হবে না এবং দুনিয়াকেই তার স্থায়ী আবাস হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তাই আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সবকিছু থেকে সে নিজেকে যত্নের সাথে দূরে সরিয়ে রাখবে।
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় একথাটি এভাবে লিখেছেন-
مَعْنَى الْحَدِيثِ : لَا تَرْكَنْ إِلَى الدّنْيَا وَلَا تَتّخِذْهَا وَطَنًا، وَلَا تُحَدِّثْ نَفْسَكَ بِالْبَقَاءِ فِيهَا، وَلَا تَتَعَلّقْ مِنْهَا بِمَا لَا يَتَعَلّقُ بِهِ الْغَرِيبُ فِي غَيْرِ وَطَنِهِ.
দুই. দুনিয়ায় তার আগমনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে। মানুষ তো দুনিয়াতে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার জন্য আসেনি। সে এসেছে আল্লাহর বান্দা হয়ে, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য। দুনিয়ার জীবনে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব পালন করে তাকে তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে উপরের কথাটি এভাবে বলেছেন-
...فَالْمَرْءُ فِي الدّنْيَا كَعَبْدٍ أَرْسَلَهُ سَيِّدُهُ فِي حَاجَةٍ إِلَى غَيْرِ بَلَدِهِ، فَشَأْنُهُ أَنْ يُبَادِرَ بِفِعْلِ مَا أُرْسِلَ فِيهِ، ثُمّ يَعُودَ إِلَى وَطَنِهِ، وَلَا يَتَعَلّقُ بِشَيْءٍ غَيْرِ مَا هُوَ فِيهِ.
তিন. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলবে না। সর্বদা তা স্মৃতিতে জাগ্রত রাখবে। আখিরাতকে চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে। দুনিয়ার জীবনকে সে গ্রহণ করবে আখিরাতের জীবনের প্রস্তুতির সুযোগ ও অবসর হিসেবে।
ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে কথাটি এভাবে বলেছেন-
وَقَالَ غَيْرُهُ : الْمُرَادُ أَنْ يُنَزِّلَ الْمُؤْمِنُ نَفْسَهُ فِي الدّنْيَا مَنْزِلَةَ الْغَرِيبِ، فَلَا يَعْلَقُ قَلْبَهُ بِشَيْءٍ مِنْ بَلَدِ الْغُرْبَةِ، بَلْ قَلْبُهُ مُتَعَلِّقٌ بِوَطَنِهِ الّذِي يَرْجِعُ إِلَيْهِ، وَيَجْعَلُ إِقَامَتَهُ فِي الدّنْيَا لِيَقْضِيَ حَاجَتَهُ وَجِهَازَهُ لِلرّجُوعِ إِلَى وَطَنِهِ، وَهَذَا شَأْنُ الْغَرِيبِ، أَوْ يَكُونُ كَالْمُسَافِرِ لَا يَسْتَقِرّ فِي مَكَانٍ بِعَيْنِهِ، بَلْ هُوَ دَائِمُ السّيْرِ إِلَى بَلَدِ الْإِقَامَةِ.
এককথায় এ হাদীসটি হচ্ছে মানব-জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শেষ গন্তব্য, দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ ও ক্ষণস্থায়িত্ব এবং এইসকল কিছুর আলোকে দুনিয়াতে মুমিনের জীবন যাপনের পন্থা সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ হাদীসে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার কথা বলা হয়নি। তা স্বাভাবিকও নয়, মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। হাদীস শরীফে দুনিয়ার বিষয়ে মোহগ্রস্ত না হওয়ার, হারাম ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার, পার্থিব বৈধ কাজকর্মে সীমাতিরিক্ত মগ্ন না হওয়ার এবং আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে শরীয়তের শিক্ষা ও বিধানের আলোকে জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরও বিভিন্ন স্তর হতে পারে। উপরোক্ত হাদীস শরীফেও তাকওয়ার একাধিক স্তরের দিকে ইশারা আছে। ‘ভীনদেশী’ ও ‘পথিক মুসাফিরের’ মধ্যকার পার্থক্যটুকু হচ্ছে এই দুই স্তরের মধ্যকার পার্থক্য। উভয়ের লক্ষ্য ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য অভিন্ন হলেও পর্যায়গত কিছু পার্থক্যও আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিল এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-
مَا لِي وَلِلدّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدّنْيَا إِلاّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمّ رَاحَ وَتَرَكَهَا.
দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে ঐ সওয়ারের মতো যে এক বৃক্ষের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে এরপর তা ছেড়ে চলে গিয়েছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৩৭৭
সাহাবায়ে কেরামের জীবনযাত্রা সাধারণভাবে ‘ভীনদেশী’ কিংবা ‘পথিক মুসাফির’- এই দুই পর্যায়ের কোনো এক পর্যায়েরই ছিল।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর নসীহত
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাঁর প্রিয় সাহাবীকে উপদেশ দিয়েছেন তেমনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্টদের নসীহত করেছেন। দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর নসীহত ও কল্যাণকামিতার ধারা অব্যাহত থাকা উচিত।
ইবনে ওমর রা.-এর উপদেশের মর্মবাণীও হচ্ছে, দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহ হওয়া এবং পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ করা।
إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ.
‘সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা কোরো না, আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কোরো না।’ অর্থাৎ পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ কর আর আখিরাতের সঞ্চয় যথাসম্ভব দ্রুত অর্জন কর।
পার্থিব আয়-উপার্জন ইত্যাদির ক্ষেত্রে লম্বা লম্বা প্রত্যাশা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ সত্যের উপলব্ধি খুবই কার্যকর যে, দুনিয়ার জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। যে কোনো সময় মৃত্যু এসে হাজির হয়ে যেতে পারে। কাজেই পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশার জালে জড়িয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। অতএব পার্থিব ক্ষেত্রে ঝামেলা কমিয়ে আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করাই বাঞ্ছনীয়।
কবি বলেন-
نسير إلي الآجال في كل لحظة+ وأيامنا تطوى وهن مراحل
ولم أر مثل الموت حقا كأنه+ إذا ما تخطته الأماني باطل
وما أقبح التفريط في زمن الصبا+فكيف به والشيب للرأس شاعل
ترحل من الدينا بزاد من التقى+ فعمرك أيام وهن قلائل
অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই ‘নির্ধারিত সময়’-এর দিকে। জীবনের প্রতিটি দিন এই অগস্ত্যযাত্রারই একেকটি মঞ্জিল, যা একে একে পিছিয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর মতো এমন অবধারিত সত্য আর দেখিনি, যা পার্থিব আশা-আকাক্সক্ষার ভীড়ে এমনই বিস্মৃত যে, তা যেন একেবারেই মিথ্যে।
জীবনের প্রভাতে শৈশবকালেও তো সময়ের অপচয় অগ্রহণযোগ্য, তাহলে প্রৌঢ়ত্বে যখন মাথার চুলে পাক ধরে- তখন তা কেমন?
কাজেই বন্ধু! সাবধান হও! পৃথিবী থেকে যখন যাবে, যেন তাকওয়ার সম্বল নিয়ে যেতে পার- সেই চিন্তা কর। পার্থিব জীবন তো অল্প কটি দিনই মাত্র।
আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উদ্যমী ও তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ইবনে ওমর রা. বলেছেন-
وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.
অর্থাৎ ভালো কাজের ক্ষেত্রে অলসতা না করে বর্তমানকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ একে তো জীবন ক্ষণস্থায়ী; যে কোনো সময় মৃত্যুর ডাক এসে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত জীবনের সময়টুকুও নির্ঝঞ্ঝাট-সক্ষমতার মধ্যে কাটবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই জীবন-যৌবন এবং সুস্থতা ও সক্ষমতার বিদ্যমান সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার কাম্য। যেন দিন শেষে অতীত সময়ের অপচয়ের জন্য আফসোস করতে না হয়।
اغتنم في الفراغ فضل ركوع+ عسى أن يكون موتك بغتة
كم صحيح مات من غير سقم+ ذهبت نفسه الصحيحة فلتة
অর্থাৎ অবসর সময়ে যদি একটি রুকুও বেশি করতে পার তাতে অবহেলা করো না/কে জানে, হঠাৎ কখন মৃত্যু এসে পড়ে/কত সুস্থ লোক রোগ-ব্যাধি ছাড়াই মারা গেছে/তার নিরোগ প্রাণ অকস্মাৎ উড়ে গেছে।
স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে সচেতন করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصِّحّةُ وَالفَرَاغُ.
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার ব্যাপারে বহু মানুষ লোকসান-গ্রস্ত : সুস্থতা ও অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে নসীহত করে বলেছেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচ বিষয়ের আগে গনীমত মনে করো : তোমার যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতা আসার আগে, তোমার সচ্ছলতাকে অসচ্ছলতা আসার আগে, তোমার অবসরকে ব্যস্ততা আসার আগে, আর তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার আগে। -আলমুসতাদরাক, হাকেম, হাদীস ৭৮৪৬
কাজেই কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সৎকর্মে মশগুল থাকার মাধ্যমে বিদ্যমান সময়-সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক নিয়ত এবং সৎ ও উপযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই মানুষের জীবন সাফল্যমণ্ডিত হয়। কবি বলেন-
إنا لنفرح بالأيام نقطعها+ وكل يوم مضى يدني من الأجل
فاعمل لنفسك قبل الموت مجتهدا+ فإنما الربح والخسران في العمل
আমাদের দিন কাটছে তাই আমরা আনন্দে মেতে উঠি/অথচ চলে যাওয়া প্রতিটি দিন আমাদের নিকটবর্তী করছে সেই নির্ধারিত সময়ের/মৃত্যু আসার আগেই নিজের কল্যাণে কর্ম-প্রয়াসে মগ্ন হও/দিন শেষে লাভ-লোকসান তো কর্মেরই নিরিখে।
مضى أمسك الماضي شهيدا معدِّلا+ واعقبه يوم عليك جديد
فإن كنت بالأمس اقترفت إساءة+ فثن بإحسان وأنت حميد
فيومك إن اعتبته عاد نفعه+ عليك وماضي الأمس ليس يعود
ولا ترجئ فعل الخير يوما إلى غدٍ+ لعل غدًا يأتي وأنت فقيد.
অর্থাৎ তোমার বিগত দিনটি ভালো-মন্দের সাক্ষী হয়ে চলে গেছে/এখন তার জায়গায় এসেছে একটি নতুন দিন। গতকাল যদি ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে আজ ভালো কাজের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ কর/যে দিন গেছে তা তো আর কিছুতেই আসবে না, তবে আজকের এই দিনটাকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তাহলে এর সুফল অবশ্যই পাবে/কাজেই আজ যে ভালো কাজ সম্ভব তা আগামীকালের জন্য রেখে দিও না/এমনও তো হতে পারে যে, আগামী কাল আসবে কিন্তু তুমি থাকবে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
২. এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে দুনিয়ায় অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এক মহান শিক্ষক। তাঁর শিক্ষার্থী সাহাবীগণকে বেজায় ভালোবাসতেন। যে ভালোবাসার পরিচয় মেলে এ শিক্ষাদানকালে সাহাবীর প্রতি তাঁর আচরণের ভেতরেও। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর দু'কাঁধ ধরেন, যাতে তিনি তাঁর শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন এবং অন্যসব লিপ্ততা থেকে বিমুখ হয়ে পরিপূর্ণরূপে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করেন। দু'কাঁধ ধরে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ভেতর শিক্ষার বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তারও ইঙ্গিত বহন করে। বলাবাহুল্য, এরূপ আচরণ এমন কারও সঙ্গেই করা হয়ে থাকে, যার প্রতি অন্তরে ভরপুর স্নেহ-মমতা বিরাজ করে। এমন গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি কাউকে শিক্ষা দেওয়া হয় তা সে শিক্ষার্থীর মনে গভীর রেখাপাত করে, ফলে সে তা কখনও ভুলতে পারে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বললেন- كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيْبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ (তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক)। غَرِيْب মানে প্রবাসী, বিদেশে বসবাসকারী। যে ব্যক্তি বিদেশে বসবাস করে সে ওই দেশকে কখনও তার নিজের দেশ মনে করে না। একদিন এ দেশ ছেড়ে তাকে তার নিজের দেশে চলে যেতে হবে, এ কথাটি মাথায় রেখেই সে সব কাজ করে। সে যা-কিছু উপার্জন করে তা ওই দেশে খরচ করে ফেলে না; বরং নিজ দেশে পাঠায়, যাতে নিজ দেশের ঘরবাড়ি আবাদ হয় এবং ফিরে আসার পর সুখে-শান্তিতে সেখানে বসবাস করতে পারে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বিদেশীর মত জীবনযাপনে উপদেশ দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে, তুমি ইহজগৎকে বিদেশ বলেই গণ্য করবে। এ জগৎকে নিজের দেশ মনে করবে না। সুতরাং তোমার মূল পুঁজি অর্থাৎ আয়ুষ্কাল এবং তোমার যাবতীয় যোগ্যতা ও সক্ষমতা ইহকাল নির্মাণে খরচ করে ফেলো না; বরং তোমার প্রকৃত দেশ আখিরাত গড়ার পেছনে খরচ করো। ইহকালের পেছনে খরচ করবে কেবল ততটুকুই, যতটুকু এখানে থাকার জন্য প্রয়োজন হয়। এর অতিরিক্ত সবটাই আখিরাতের কাজে ব্যবহার করবে।
عَابِرُ سَبيْلٍ এর অর্থ পথিক। তুমি দুনিয়ায় থাকবে পথিকের মত। প্রকৃতপক্ষে তুমি একজন পথিকই বটে। তুমি অবিরাম আখিরাতের পথে চলছ। তোমার এই চলা শেষ হবে মৃত্যুতে। পথিক ব্যক্তি ক্ষণিকের জন্য কোনও পান্থশালায় বা গাছতলায় বিশ্রাম করে। তারপর আবার চলা শুরু করে। সে পান্থশালা বা গাছতলাকে নিজের বাসস্থান ও ঠিকানা মনে করে না। তাই একে নির্মাণ করা বা এর সাজানো-গোছানোর প্রতি সে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয় না। ক্ষণিকের অবস্থানের জন্য যতটুকু ঝাড়পোছের দরকার হয়, ব্যস অতটুকুই করে। তো তুমি যখন আখিরাতের পথের পথিক, তখন এ দুনিয়াকে পান্থশালা বা গাছতলার বেশি কিছু মনে করবে না। একজন পথিক পান্থশালা বা গাছতলার প্রতি যতটুকু মন দেয়, কেবল ততটুকুই। তোমার মূল ফিকির থাকবে আখিরাত। কিভাবে সেখানে মুক্তি পাবে, কিভাবে সেখানে নিবাস গড়ে তুলবে, সেটাই হবে তোমার জীবনের মূল লক্ষ্যবস্তু। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
إِنَّمَا هٰذِهِ الْحَيُوةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ
‘এই পার্থিব জীবন তো তুচ্ছ ভোগ মাত্র। নিশ্চয়ই আখিরাতই অবস্থিতির প্রকৃত নিবাস।’ ২২৩
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য হাদীছের এ শিক্ষাটি সরাসরি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে দিলেও এর উদ্দেশ্য ব্যাপক। তাঁর মাধ্যমে উম্মতের সকলকেই এ নসীহত করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দুনিয়ায় এভাবেই বসবাস করতেন। তিনি বলেন-
مَا لِي وَلِلدُّنْيَا ؟ مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اِسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا
'দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়ায় তো আমি একজন মুসাফিরস্বরূপ, যে কোনও গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করে, তারপর তা ছেড়ে চলে যায়।' ২২৪
কুরআন-হাদীছের যাবতীয় শিক্ষার মূলকথা এটাই যে, দুনিয়াকে নিজের আসল ঠিকানা মনে করো না। তোমার আসল ঠিকানা জান্নাত। এখানে যতদিন থাক, সেই ঠিকানার নির্মাণ ও বিন্যাসে সচেষ্ট থেকো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
'আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। '২২৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ
'হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।' ২২৬
সারকথা, আমরা ওই গোলামের মত, যাকে তার মনিব বিশেষ কাজের জন্য কোথাও পাঠিয়েছে। সে গোলামের যেমন কর্তব্য সেখানে গিয়ে অন্য কাজে মশগুল না হয়ে যে কাজের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, তারপর কাজ শেষ হওয়ামাত্র মনিবের কাছে ফিরে আসা, তেমনি আমাদেরও কর্তব্য দুনিয়ায় আমাদেরকে যে কাজে পাঠানো হয়েছে মৌলিকভাবে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, অন্য কোনও কাজে বিভোর না হওয়া। পরিশেষে মৃত্যুর মাধ্যমে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যকর্ম সম্পাদনকারী বান্দারূপে মহামনিব আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা আমাদের পাঠিয়েছেন দুনিয়াদারী করার জন্য নয়; বরং ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। তাই ইবাদত-বন্দেগীই হবে আমাদের আসল ব্যস্ততা। দুনিয়ার কাজকর্ম করব যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। তাতেও দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা।
কোনও কোনও বর্ণনায় এ হাদীছটির শেষে আরও আছে-
وَعُدَّ نَفْسَكَ فِي أَهْلِ القُبُوْرِ
(নিজেকে কবরবাসীদের একজন গণ্য করো)। ২২৭
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর উপদেশ
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তিনি উপদেশটি দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য বিখ্যাত তাবি'ঈ মুজাহিদ রহ.-কে।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- إِذَا أَمْسَيتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الْمَسَاء (তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না)। অর্থাৎ তোমার যখন সন্ধ্যা হয় তখন আর এই ভরসা করো না যে, ভোর পর্যন্ত বাঁচবে এবং পরের দিনটি পাবে। এমনিভাবে যখন ভোর হয় তখনও সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার ও আগামী রাত পাওয়ার ভরসায় থেকো না। হতে পারে এটাই তোমার শেষ রাত বা এটাই তোমার শেষ দিন।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হল কেমন আছেন? তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি কেমন থাকতে পারে বলে মনে কর, যে ব্যক্তি প্রতিদিন আখিরাতের দিকে এক এক মঞ্জিল করে অগ্রসর হচ্ছে?
দাউদ তাঈ রহ. বলতেন, রাত ও দিন কতগুলো মঞ্জিলের নাম। মানুষ প্রতিদিন ও প্রতি রাতে এক এক মঞ্জিল করে সামনে এগোচ্ছে। তার শেষ মঞ্জিল হবে ওইখানে, যেখানে তার সফর শেষ হবে। তোমার কর্তব্য প্রতি মঞ্জিলে তার পরবর্তী মঞ্জিলের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা। সফর শেষ হওয়ার দিন খুব কাছে। অতি নিকটে। তাই পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। যা করার তা দ্রুত করে ফেলো।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. প্রতি রাতে ঘুমাবার সময় পরিবারের লোকজনকে বলতেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। হয়তো এ ঘুমই হবে আমার শেষ ঘুম। আমার আর জাগা হবে না।
সা'ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলতেন, মুমিন ব্যক্তি যে দিনটিই পায় সেটাই তার বাড়তি লাভ।
সুতরাং এই যে রাত তুমি পেলে, এটা নষ্ট করো না। এ দিন নষ্ট করো না। এ সময়ের যা কাজ তা এখনই করে ফেলো। রাতের কাজ রাতেই সেরে ফেলো, দিনের জন্য রেখে দিয়ো না। এমনিভাবে দিনের কাজ দিনেই সেরে ফেলো, রাতের জন্য রেখে দিয়ো না।
বেঁচে থাকার ভরসায় দিনের কাজ রাতের জন্য বা রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়া হলে তা আর সহজে করা হয়ে ওঠে না। এতে করে কাজ জমতে থাকে। কর্তব্যকর্ম পড়ে থাকে। আরও বেঁচে থাকার ভরসা অন্তরে আলস্য সৃষ্টি করে। যত বেশি কাল বেঁচে থাকার আশা রাখা হয়, কাজে অলসতাও ততো বেশি হয়। অলসতা অর্থাৎ কর্মবিমুখতা সকল দোষের মূল। এতে কর্তব্যকর্ম পিছিয়ে থাকে তাই নয়, মনে অসৎ চিন্তাও বাসা বাঁধে। শয়তান মন-মস্তিষ্কে নানা খটকা, নানা সংশয় ও নানা কুচিন্তা জাগিয়ে দেয়। এমনকি ঈমানহারা করে ফেলার সুযোগ পায়। তাই অলস সময় না কাটিয়ে ব্যস্ত থাকা চাই।
প্রতি রাতের সুনির্দিষ্ট কাজ আছে। কাজ আছে প্রতি দিনেরও। আছে দুনিয়ার কাজও, আখিরাতের কাজও। আখিরাতের জরুরি কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত অনেক কাজও আছে। সেসব নফল কাজ আখিরাতমুখী বান্দার পক্ষে প্রকৃত অর্থে অতিরিক্ত নয় মোটেই। তাও কাম্য। দিবারাত্রে সেরকম বহু কাজ আছে। আসলে মুমিন-মুসলিমের সবটা সময়ই বিপুল কাজে ঠাসা। সে কখনকার কোন্ কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দেবে? পরবর্তী সে সময়েও তো বিস্তর কাজ আছে। আবার আছে নানা উপসর্গ। নানা প্রতিবন্ধকতা ও ওজর-অজুহাত আছে। তাই বেকার থাকার সুযোগ নেই। আজকের কাজ কালকের জন্য বা দিনের কাজ রাতের জন্য ও রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ (তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য)। অর্থাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তুমি কাজ করতে পারবে না। অসুস্থতা তোমার নানা আমলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখন যখন তুমি সুস্থ, যতবেশি পার আমল করে নাও। অন্যথায় অসুস্থতাকালে তোমার আক্ষেপ করতে হবে যে, আহা, সুস্থ অবস্থায় কেন সময় কাজে লাগালাম না! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُوْن فِيْهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ : الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ.
‘দুটি নি'আমত এমন, যে ক্ষেত্রে বহুলোক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তা হল সুস্থতা ও অবসর সময়।’ ২২৮
وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ ‘এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য'। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোনও আমল করার সুযোগ থাকে না। আবার মৃত্যু যে-কোনও সময়ই এসে হানা দিতে পারে। কখন আসবে কেউ জানে না। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত ইবন উমর রাযি. সবশেষে বলেছিলেন-
فَإِنَّكَ لَا تَدْرِي يَا عَبْدَ اللَّهِ مَا اسْمُكَ غَدًا (হে আল্লাহর বান্দা! তুমি জানো না আগামীকাল তোমার কী নাম হবে)। অর্থাৎ জীবিত ব্যক্তি হিসেবে তোমার প্রচলিত নামেই তোমাকে ডাকা হবে, নাকি তোমার মৃত্যু হয়ে যাবে ফলে তোমাকে মায়্যিত বা লাশ ইত্যাদি বলা হবে।
তাই এখন যখন বেঁচে আছ, আমল করে নাও। এখন অবহেলা করলে মৃত্যুকালে আক্ষেপ করতে হবে। সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَبِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ وَأَنْفِقُوا مِنْ مَّا رَزَقْنَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْ لَا أَخرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصّلِحِينَ
'হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এ রকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ ২২৯
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَّبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ أَنْ تَقُوْلَ نَفْسٌ يّٰحَسْرَتى عَلَى مَا فَرَّطْتُ فِي جَنْبِ اللَّهِ وَإِنْ كُنْتُ لَمِنَ السّٰخِرِينَ.
'এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না। যাতে কাউকে বলতে না হয় যে, হায়! আল্লাহর ব্যাপারে আমি যে অবহেলা করেছি তার জন্য আফসোস! প্রকৃতপক্ষে আমি (আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান নিয়ে) ঠাট্টাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ ২৩০
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ سَبْعًا ، هَلْ تَنْتَظِرُوْنَ إِلَّا فَقْرًا مُنْسِيا، أَوْ غِنى مُطْغيًا، أَوْ مَرَضًا مُفْسِدًا، أَوْ هَرَمًا مُفْنِدًا ، أَوْ مَوْتَا مُجْهِرًا ، أَوِ الدَّجَّالَ فَشَرُّ غَائِب يُنتَظَرُ، أَوِ السَّاعَةَ فَالسَّاعَةُ أَدْهٰى وَأَمَرُّ.
'তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও। তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? না এমন প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে? না এমন রোগ-ব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে? না এমন বার্ধক্যের, যা বুদ্ধি লোপ করে দেয়? না আকস্মিক আগত মৃত্যুর? না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে? না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত?' ২৩১
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ ، شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
'পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে সুবর্ণ সুযোগ মনে করো- বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকাকে। '২৩২
সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য দ্রুত আমলে লেগে যাওয়া। না জানি কখন কোন্ বাধা সামনে দাঁড়িয়ে যায়! তাই প্রতিটি মুহূর্তকে শেষ মুহূর্ত মনে করে সবচে' বেশি প্রয়োজনীয় কাজটি করে ফেলা চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও আসবাব-উপকরণে বেশি জড়াতে নেই। পরকালই আসল ঠিকানা। সেখানকার পাথেয় সংগ্রহেই বেশি ব্যস্ত থাকা চাই।
খ. আগামীতে বেঁচে থাকার কোনও ভরসা নেই। তাই নগদ যে সময় হাতে আছে সেটাকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
গ. সুস্থতা ও অবসর সময় আমলের মহাসুযোগ। এ সুযোগ হারাতে নেই।দীর্ঘদীন বেঁচে থাকার আশা শয়তানের ধোকা। সে এ পথে মানুষের অন্তরে অলসতা সৃষ্টি করে। তারপর যখন অকস্মাৎ মৃত্যু এসে যায় তখন দেখা যায় কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। তাই শয়তানের এ ধোঁকায় পড়তে নেই।
২২৩. সূরা গাফির (৪০), আয়াত ৩৯
২২৪. জামে' তিরমিযী: ২৩৭৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৩৭০৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫২২৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৩৫২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১৮৯৮: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৯৩০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩৫
২২৫. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬
২২৬. সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ১৮
২২৭. জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩০৪; মুসনাদে আহমাদ: ৫০০২; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১১৪; শুআবুল ঈমান: ১০০৫৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩০
২২৮. সহীহ বুখারী: ৬৪১২; জামে' তিরমিযী: ২৩০৪; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮০০; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩৭৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৭৮৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫২৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২০;
২২৯. সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ৯-১০
২৩০. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৫-৫৬
২৩১. জামে' তিরমিযী: ২৩৬০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৫৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৩৯৪৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
২৩২. মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩১৯; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮৩২; বায়হাকী, আল-আদাব : ৮০৯; শু'আবুল ঈমান: ৯৭৬৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
উপরের হাদীসে দুটো অংশ আছে : প্রথমটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী। আর দ্বিতীয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর বাণী। হাদীস-শাস্ত্রের পরিভাষা-অনুসারে প্রথমটিকে বলা হবে ‘মারফূ‚’ বর্ণনা। অর্থাৎ যে বর্ণনা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, কর্ম, সম্মতি কিংবা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে।
আর দ্বিতীয় অংশটি, যাতে ইবনে ওমর রা.-এর বাণী উল্লেখিত হয়েছে, তাকে বলা হবে, ‘মাওকূফ’। অর্থাৎ যে বর্ণনা সাহাবী পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় কোনো সাহাবীর কথা, কাজ বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে। সাধারণভাবে ‘মাওকূফ’ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এ শব্দের অন্য ব্যবহারও আছে, তবে তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।
আমাদের হাদীসের ইমামগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এত সতর্ক ছিলেন যে, বর্ণনায় মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্যও খুব যত্নের সাথে পরীক্ষা করতেন। তাদের নীতি এই ছিল যে, বর্ণনাটি উপর থেকে যেভাবে আসছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। যা উপর থেকে সাহাবীর বাণী হিসেবে বর্ণিত হয়ে এসেছে তাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। প্রত্যেক বর্ণনা আপনরূপে থাকতে হবে। এরপর সেই বর্ণনার বিষয়বস্তুর সূত্র-সন্ধান, অর্থাৎ সাহাবী এই কথাটি কোত্থেকে বলেছেন- তা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। সাহাবী যখন বলেছেন তা তো আল্লাহর রাসূলের কথাই হবে, কিংবা কথাটি তো খুব সুন্দর কথা, ধর্মীয় কথা, কাজেই একে আল্লাহর রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করে দেওয়া যায়- এজাতীয় চিন্তা তাদের কাছে শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা হিসেবে গণ্য ছিল। আর তাই মারফূ‚-মাওকূফের পার্থক্য না করা ছিল তাঁদের দৃষ্টিতে অনেক বড় শাস্ত্রীয় দোষ।
সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রেই যখন এই কথা তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য। বস্তুত দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণের এরকম সচেতনতা ও সতর্কতার কারণেই দ্বীন সংরক্ষিত থেকেছে এবং তা আমাদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে।
হাদীস শরীফের প্রথম অংশ
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
কাঁধে হাত দেওয়া স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করে। উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে তা অধিকতর ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবীকে আন্তরিকতার সাথে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা মুমিন-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। প্রিয় সাহাবীকে সম্বোধন করলেও এ শিক্ষা সকল মুমিনের জন্য- ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।’
ভিনদেশী বা পথিকজনের মতো হওয়ার অর্থ কী? হাদীসের ভাষ্যকারগণ এর ব্যাখ্যায় যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-
পৃথিবীর এই ঘর মানুষের স্থায়ী ঘর নয়। এখানে সে ক্ষণস্থায়ী, তাকে তার স্থায়ী ঘরে ফিরে যেতে হবে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এই মহাসত্য স্মরণ রাখা তার কর্তব্য। এই সত্য স্মরণ রাখার যে প্রভাব তার চিন্তা ও কর্মে পড়বে তা নিম্নরূপ :
এক. মুমিন কিছুতেই দুনিয়ার ব্যাপারে মোহগ্রস্ত হবে না এবং দুনিয়াকেই তার স্থায়ী আবাস হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তাই আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সবকিছু থেকে সে নিজেকে যত্নের সাথে দূরে সরিয়ে রাখবে।
সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় একথাটি এভাবে লিখেছেন-
مَعْنَى الْحَدِيثِ : لَا تَرْكَنْ إِلَى الدّنْيَا وَلَا تَتّخِذْهَا وَطَنًا، وَلَا تُحَدِّثْ نَفْسَكَ بِالْبَقَاءِ فِيهَا، وَلَا تَتَعَلّقْ مِنْهَا بِمَا لَا يَتَعَلّقُ بِهِ الْغَرِيبُ فِي غَيْرِ وَطَنِهِ.
দুই. দুনিয়ায় তার আগমনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে। মানুষ তো দুনিয়াতে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার জন্য আসেনি। সে এসেছে আল্লাহর বান্দা হয়ে, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য। দুনিয়ার জীবনে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব পালন করে তাকে তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে উপরের কথাটি এভাবে বলেছেন-
...فَالْمَرْءُ فِي الدّنْيَا كَعَبْدٍ أَرْسَلَهُ سَيِّدُهُ فِي حَاجَةٍ إِلَى غَيْرِ بَلَدِهِ، فَشَأْنُهُ أَنْ يُبَادِرَ بِفِعْلِ مَا أُرْسِلَ فِيهِ، ثُمّ يَعُودَ إِلَى وَطَنِهِ، وَلَا يَتَعَلّقُ بِشَيْءٍ غَيْرِ مَا هُوَ فِيهِ.
তিন. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলবে না। সর্বদা তা স্মৃতিতে জাগ্রত রাখবে। আখিরাতকে চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে। দুনিয়ার জীবনকে সে গ্রহণ করবে আখিরাতের জীবনের প্রস্তুতির সুযোগ ও অবসর হিসেবে।
ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে কথাটি এভাবে বলেছেন-
وَقَالَ غَيْرُهُ : الْمُرَادُ أَنْ يُنَزِّلَ الْمُؤْمِنُ نَفْسَهُ فِي الدّنْيَا مَنْزِلَةَ الْغَرِيبِ، فَلَا يَعْلَقُ قَلْبَهُ بِشَيْءٍ مِنْ بَلَدِ الْغُرْبَةِ، بَلْ قَلْبُهُ مُتَعَلِّقٌ بِوَطَنِهِ الّذِي يَرْجِعُ إِلَيْهِ، وَيَجْعَلُ إِقَامَتَهُ فِي الدّنْيَا لِيَقْضِيَ حَاجَتَهُ وَجِهَازَهُ لِلرّجُوعِ إِلَى وَطَنِهِ، وَهَذَا شَأْنُ الْغَرِيبِ، أَوْ يَكُونُ كَالْمُسَافِرِ لَا يَسْتَقِرّ فِي مَكَانٍ بِعَيْنِهِ، بَلْ هُوَ دَائِمُ السّيْرِ إِلَى بَلَدِ الْإِقَامَةِ.
এককথায় এ হাদীসটি হচ্ছে মানব-জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শেষ গন্তব্য, দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ ও ক্ষণস্থায়িত্ব এবং এইসকল কিছুর আলোকে দুনিয়াতে মুমিনের জীবন যাপনের পন্থা সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি।
লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ হাদীসে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার কথা বলা হয়নি। তা স্বাভাবিকও নয়, মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। হাদীস শরীফে দুনিয়ার বিষয়ে মোহগ্রস্ত না হওয়ার, হারাম ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার, পার্থিব বৈধ কাজকর্মে সীমাতিরিক্ত মগ্ন না হওয়ার এবং আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে শরীয়তের শিক্ষা ও বিধানের আলোকে জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরও বিভিন্ন স্তর হতে পারে। উপরোক্ত হাদীস শরীফেও তাকওয়ার একাধিক স্তরের দিকে ইশারা আছে। ‘ভীনদেশী’ ও ‘পথিক মুসাফিরের’ মধ্যকার পার্থক্যটুকু হচ্ছে এই দুই স্তরের মধ্যকার পার্থক্য। উভয়ের লক্ষ্য ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য অভিন্ন হলেও পর্যায়গত কিছু পার্থক্যও আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিল এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-
مَا لِي وَلِلدّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدّنْيَا إِلاّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمّ رَاحَ وَتَرَكَهَا.
দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে ঐ সওয়ারের মতো যে এক বৃক্ষের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে এরপর তা ছেড়ে চলে গিয়েছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৩৭৭
সাহাবায়ে কেরামের জীবনযাত্রা সাধারণভাবে ‘ভীনদেশী’ কিংবা ‘পথিক মুসাফির’- এই দুই পর্যায়ের কোনো এক পর্যায়েরই ছিল।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর নসীহত
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাঁর প্রিয় সাহাবীকে উপদেশ দিয়েছেন তেমনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্টদের নসীহত করেছেন। দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর নসীহত ও কল্যাণকামিতার ধারা অব্যাহত থাকা উচিত।
ইবনে ওমর রা.-এর উপদেশের মর্মবাণীও হচ্ছে, দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহ হওয়া এবং পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ করা।
إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ.
‘সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা কোরো না, আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কোরো না।’ অর্থাৎ পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ কর আর আখিরাতের সঞ্চয় যথাসম্ভব দ্রুত অর্জন কর।
পার্থিব আয়-উপার্জন ইত্যাদির ক্ষেত্রে লম্বা লম্বা প্রত্যাশা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ সত্যের উপলব্ধি খুবই কার্যকর যে, দুনিয়ার জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। যে কোনো সময় মৃত্যু এসে হাজির হয়ে যেতে পারে। কাজেই পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশার জালে জড়িয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। অতএব পার্থিব ক্ষেত্রে ঝামেলা কমিয়ে আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করাই বাঞ্ছনীয়।
কবি বলেন-
نسير إلي الآجال في كل لحظة+ وأيامنا تطوى وهن مراحل
ولم أر مثل الموت حقا كأنه+ إذا ما تخطته الأماني باطل
وما أقبح التفريط في زمن الصبا+فكيف به والشيب للرأس شاعل
ترحل من الدينا بزاد من التقى+ فعمرك أيام وهن قلائل
অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই ‘নির্ধারিত সময়’-এর দিকে। জীবনের প্রতিটি দিন এই অগস্ত্যযাত্রারই একেকটি মঞ্জিল, যা একে একে পিছিয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর মতো এমন অবধারিত সত্য আর দেখিনি, যা পার্থিব আশা-আকাক্সক্ষার ভীড়ে এমনই বিস্মৃত যে, তা যেন একেবারেই মিথ্যে।
জীবনের প্রভাতে শৈশবকালেও তো সময়ের অপচয় অগ্রহণযোগ্য, তাহলে প্রৌঢ়ত্বে যখন মাথার চুলে পাক ধরে- তখন তা কেমন?
কাজেই বন্ধু! সাবধান হও! পৃথিবী থেকে যখন যাবে, যেন তাকওয়ার সম্বল নিয়ে যেতে পার- সেই চিন্তা কর। পার্থিব জীবন তো অল্প কটি দিনই মাত্র।
আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উদ্যমী ও তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ইবনে ওমর রা. বলেছেন-
وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.
অর্থাৎ ভালো কাজের ক্ষেত্রে অলসতা না করে বর্তমানকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ একে তো জীবন ক্ষণস্থায়ী; যে কোনো সময় মৃত্যুর ডাক এসে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত জীবনের সময়টুকুও নির্ঝঞ্ঝাট-সক্ষমতার মধ্যে কাটবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই জীবন-যৌবন এবং সুস্থতা ও সক্ষমতার বিদ্যমান সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার কাম্য। যেন দিন শেষে অতীত সময়ের অপচয়ের জন্য আফসোস করতে না হয়।
اغتنم في الفراغ فضل ركوع+ عسى أن يكون موتك بغتة
كم صحيح مات من غير سقم+ ذهبت نفسه الصحيحة فلتة
অর্থাৎ অবসর সময়ে যদি একটি রুকুও বেশি করতে পার তাতে অবহেলা করো না/কে জানে, হঠাৎ কখন মৃত্যু এসে পড়ে/কত সুস্থ লোক রোগ-ব্যাধি ছাড়াই মারা গেছে/তার নিরোগ প্রাণ অকস্মাৎ উড়ে গেছে।
স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে সচেতন করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصِّحّةُ وَالفَرَاغُ.
দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার ব্যাপারে বহু মানুষ লোকসান-গ্রস্ত : সুস্থতা ও অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে নসীহত করে বলেছেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচ বিষয়ের আগে গনীমত মনে করো : তোমার যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতা আসার আগে, তোমার সচ্ছলতাকে অসচ্ছলতা আসার আগে, তোমার অবসরকে ব্যস্ততা আসার আগে, আর তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার আগে। -আলমুসতাদরাক, হাকেম, হাদীস ৭৮৪৬
কাজেই কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সৎকর্মে মশগুল থাকার মাধ্যমে বিদ্যমান সময়-সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক নিয়ত এবং সৎ ও উপযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই মানুষের জীবন সাফল্যমণ্ডিত হয়। কবি বলেন-
إنا لنفرح بالأيام نقطعها+ وكل يوم مضى يدني من الأجل
فاعمل لنفسك قبل الموت مجتهدا+ فإنما الربح والخسران في العمل
আমাদের দিন কাটছে তাই আমরা আনন্দে মেতে উঠি/অথচ চলে যাওয়া প্রতিটি দিন আমাদের নিকটবর্তী করছে সেই নির্ধারিত সময়ের/মৃত্যু আসার আগেই নিজের কল্যাণে কর্ম-প্রয়াসে মগ্ন হও/দিন শেষে লাভ-লোকসান তো কর্মেরই নিরিখে।
مضى أمسك الماضي شهيدا معدِّلا+ واعقبه يوم عليك جديد
فإن كنت بالأمس اقترفت إساءة+ فثن بإحسان وأنت حميد
فيومك إن اعتبته عاد نفعه+ عليك وماضي الأمس ليس يعود
ولا ترجئ فعل الخير يوما إلى غدٍ+ لعل غدًا يأتي وأنت فقيد.
অর্থাৎ তোমার বিগত দিনটি ভালো-মন্দের সাক্ষী হয়ে চলে গেছে/এখন তার জায়গায় এসেছে একটি নতুন দিন। গতকাল যদি ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে আজ ভালো কাজের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ কর/যে দিন গেছে তা তো আর কিছুতেই আসবে না, তবে আজকের এই দিনটাকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তাহলে এর সুফল অবশ্যই পাবে/কাজেই আজ যে ভালো কাজ সম্ভব তা আগামীকালের জন্য রেখে দিও না/এমনও তো হতে পারে যে, আগামী কাল আসবে কিন্তু তুমি থাকবে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।
২. এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে দুনিয়ায় অবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন এক মহান শিক্ষক। তাঁর শিক্ষার্থী সাহাবীগণকে বেজায় ভালোবাসতেন। যে ভালোবাসার পরিচয় মেলে এ শিক্ষাদানকালে সাহাবীর প্রতি তাঁর আচরণের ভেতরেও। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর দু'কাঁধ ধরেন, যাতে তিনি তাঁর শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন এবং অন্যসব লিপ্ততা থেকে বিমুখ হয়ে পরিপূর্ণরূপে তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করেন। দু'কাঁধ ধরে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ভেতর শিক্ষার বিষয়টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তারও ইঙ্গিত বহন করে। বলাবাহুল্য, এরূপ আচরণ এমন কারও সঙ্গেই করা হয়ে থাকে, যার প্রতি অন্তরে ভরপুর স্নেহ-মমতা বিরাজ করে। এমন গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টি কাউকে শিক্ষা দেওয়া হয় তা সে শিক্ষার্থীর মনে গভীর রেখাপাত করে, ফলে সে তা কখনও ভুলতে পারে না।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বললেন- كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيْبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ (তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথিক)। غَرِيْب মানে প্রবাসী, বিদেশে বসবাসকারী। যে ব্যক্তি বিদেশে বসবাস করে সে ওই দেশকে কখনও তার নিজের দেশ মনে করে না। একদিন এ দেশ ছেড়ে তাকে তার নিজের দেশে চলে যেতে হবে, এ কথাটি মাথায় রেখেই সে সব কাজ করে। সে যা-কিছু উপার্জন করে তা ওই দেশে খরচ করে ফেলে না; বরং নিজ দেশে পাঠায়, যাতে নিজ দেশের ঘরবাড়ি আবাদ হয় এবং ফিরে আসার পর সুখে-শান্তিতে সেখানে বসবাস করতে পারে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে বিদেশীর মত জীবনযাপনে উপদেশ দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে, তুমি ইহজগৎকে বিদেশ বলেই গণ্য করবে। এ জগৎকে নিজের দেশ মনে করবে না। সুতরাং তোমার মূল পুঁজি অর্থাৎ আয়ুষ্কাল এবং তোমার যাবতীয় যোগ্যতা ও সক্ষমতা ইহকাল নির্মাণে খরচ করে ফেলো না; বরং তোমার প্রকৃত দেশ আখিরাত গড়ার পেছনে খরচ করো। ইহকালের পেছনে খরচ করবে কেবল ততটুকুই, যতটুকু এখানে থাকার জন্য প্রয়োজন হয়। এর অতিরিক্ত সবটাই আখিরাতের কাজে ব্যবহার করবে।
عَابِرُ سَبيْلٍ এর অর্থ পথিক। তুমি দুনিয়ায় থাকবে পথিকের মত। প্রকৃতপক্ষে তুমি একজন পথিকই বটে। তুমি অবিরাম আখিরাতের পথে চলছ। তোমার এই চলা শেষ হবে মৃত্যুতে। পথিক ব্যক্তি ক্ষণিকের জন্য কোনও পান্থশালায় বা গাছতলায় বিশ্রাম করে। তারপর আবার চলা শুরু করে। সে পান্থশালা বা গাছতলাকে নিজের বাসস্থান ও ঠিকানা মনে করে না। তাই একে নির্মাণ করা বা এর সাজানো-গোছানোর প্রতি সে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয় না। ক্ষণিকের অবস্থানের জন্য যতটুকু ঝাড়পোছের দরকার হয়, ব্যস অতটুকুই করে। তো তুমি যখন আখিরাতের পথের পথিক, তখন এ দুনিয়াকে পান্থশালা বা গাছতলার বেশি কিছু মনে করবে না। একজন পথিক পান্থশালা বা গাছতলার প্রতি যতটুকু মন দেয়, কেবল ততটুকুই। তোমার মূল ফিকির থাকবে আখিরাত। কিভাবে সেখানে মুক্তি পাবে, কিভাবে সেখানে নিবাস গড়ে তুলবে, সেটাই হবে তোমার জীবনের মূল লক্ষ্যবস্তু। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
إِنَّمَا هٰذِهِ الْحَيُوةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ
‘এই পার্থিব জীবন তো তুচ্ছ ভোগ মাত্র। নিশ্চয়ই আখিরাতই অবস্থিতির প্রকৃত নিবাস।’ ২২৩
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য হাদীছের এ শিক্ষাটি সরাসরি হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে দিলেও এর উদ্দেশ্য ব্যাপক। তাঁর মাধ্যমে উম্মতের সকলকেই এ নসীহত করা হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও দুনিয়ায় এভাবেই বসবাস করতেন। তিনি বলেন-
مَا لِي وَلِلدُّنْيَا ؟ مَا أَنَا فِي الدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اِسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا
'দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়ায় তো আমি একজন মুসাফিরস্বরূপ, যে কোনও গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করে, তারপর তা ছেড়ে চলে যায়।' ২২৪
কুরআন-হাদীছের যাবতীয় শিক্ষার মূলকথা এটাই যে, দুনিয়াকে নিজের আসল ঠিকানা মনে করো না। তোমার আসল ঠিকানা জান্নাত। এখানে যতদিন থাক, সেই ঠিকানার নির্মাণ ও বিন্যাসে সচেষ্ট থেকো। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا
'আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখিরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা করো এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। '২২৫
আরও ইরশাদ হয়েছে-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ
'হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে।' ২২৬
সারকথা, আমরা ওই গোলামের মত, যাকে তার মনিব বিশেষ কাজের জন্য কোথাও পাঠিয়েছে। সে গোলামের যেমন কর্তব্য সেখানে গিয়ে অন্য কাজে মশগুল না হয়ে যে কাজের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, তারপর কাজ শেষ হওয়ামাত্র মনিবের কাছে ফিরে আসা, তেমনি আমাদেরও কর্তব্য দুনিয়ায় আমাদেরকে যে কাজে পাঠানো হয়েছে মৌলিকভাবে সে কাজেই ব্যস্ত থাকা, অন্য কোনও কাজে বিভোর না হওয়া। পরিশেষে মৃত্যুর মাধ্যমে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যকর্ম সম্পাদনকারী বান্দারূপে মহামনিব আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা আমাদের পাঠিয়েছেন দুনিয়াদারী করার জন্য নয়; বরং ইবাদত-বন্দেগীর জন্য। তাই ইবাদত-বন্দেগীই হবে আমাদের আসল ব্যস্ততা। দুনিয়ার কাজকর্ম করব যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু। তাতেও দিল-দেমাগে থাকবে আখিরাতের চিন্তা।
কোনও কোনও বর্ণনায় এ হাদীছটির শেষে আরও আছে-
وَعُدَّ نَفْسَكَ فِي أَهْلِ القُبُوْرِ
(নিজেকে কবরবাসীদের একজন গণ্য করো)। ২২৭
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর উপদেশ
বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায় তিনি উপদেশটি দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য বিখ্যাত তাবি'ঈ মুজাহিদ রহ.-কে।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- إِذَا أَمْسَيتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الْمَسَاء (তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং যখন ভোরে উপনীত হও, তখন আর সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না)। অর্থাৎ তোমার যখন সন্ধ্যা হয় তখন আর এই ভরসা করো না যে, ভোর পর্যন্ত বাঁচবে এবং পরের দিনটি পাবে। এমনিভাবে যখন ভোর হয় তখনও সন্ধ্যা পর্যন্ত বেঁচে থাকার ও আগামী রাত পাওয়ার ভরসায় থেকো না। হতে পারে এটাই তোমার শেষ রাত বা এটাই তোমার শেষ দিন।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হল কেমন আছেন? তিনি বললেন, ওই ব্যক্তি কেমন থাকতে পারে বলে মনে কর, যে ব্যক্তি প্রতিদিন আখিরাতের দিকে এক এক মঞ্জিল করে অগ্রসর হচ্ছে?
দাউদ তাঈ রহ. বলতেন, রাত ও দিন কতগুলো মঞ্জিলের নাম। মানুষ প্রতিদিন ও প্রতি রাতে এক এক মঞ্জিল করে সামনে এগোচ্ছে। তার শেষ মঞ্জিল হবে ওইখানে, যেখানে তার সফর শেষ হবে। তোমার কর্তব্য প্রতি মঞ্জিলে তার পরবর্তী মঞ্জিলের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা। সফর শেষ হওয়ার দিন খুব কাছে। অতি নিকটে। তাই পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। যা করার তা দ্রুত করে ফেলো।
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি' রহ. প্রতি রাতে ঘুমাবার সময় পরিবারের লোকজনকে বলতেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি। হয়তো এ ঘুমই হবে আমার শেষ ঘুম। আমার আর জাগা হবে না।
সা'ঈদ ইবন জুবায়র রহ. বলতেন, মুমিন ব্যক্তি যে দিনটিই পায় সেটাই তার বাড়তি লাভ।
সুতরাং এই যে রাত তুমি পেলে, এটা নষ্ট করো না। এ দিন নষ্ট করো না। এ সময়ের যা কাজ তা এখনই করে ফেলো। রাতের কাজ রাতেই সেরে ফেলো, দিনের জন্য রেখে দিয়ো না। এমনিভাবে দিনের কাজ দিনেই সেরে ফেলো, রাতের জন্য রেখে দিয়ো না।
বেঁচে থাকার ভরসায় দিনের কাজ রাতের জন্য বা রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়া হলে তা আর সহজে করা হয়ে ওঠে না। এতে করে কাজ জমতে থাকে। কর্তব্যকর্ম পড়ে থাকে। আরও বেঁচে থাকার ভরসা অন্তরে আলস্য সৃষ্টি করে। যত বেশি কাল বেঁচে থাকার আশা রাখা হয়, কাজে অলসতাও ততো বেশি হয়। অলসতা অর্থাৎ কর্মবিমুখতা সকল দোষের মূল। এতে কর্তব্যকর্ম পিছিয়ে থাকে তাই নয়, মনে অসৎ চিন্তাও বাসা বাঁধে। শয়তান মন-মস্তিষ্কে নানা খটকা, নানা সংশয় ও নানা কুচিন্তা জাগিয়ে দেয়। এমনকি ঈমানহারা করে ফেলার সুযোগ পায়। তাই অলস সময় না কাটিয়ে ব্যস্ত থাকা চাই।
প্রতি রাতের সুনির্দিষ্ট কাজ আছে। কাজ আছে প্রতি দিনেরও। আছে দুনিয়ার কাজও, আখিরাতের কাজও। আখিরাতের জরুরি কাজের পাশাপাশি অতিরিক্ত অনেক কাজও আছে। সেসব নফল কাজ আখিরাতমুখী বান্দার পক্ষে প্রকৃত অর্থে অতিরিক্ত নয় মোটেই। তাও কাম্য। দিবারাত্রে সেরকম বহু কাজ আছে। আসলে মুমিন-মুসলিমের সবটা সময়ই বিপুল কাজে ঠাসা। সে কখনকার কোন্ কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দেবে? পরবর্তী সে সময়েও তো বিস্তর কাজ আছে। আবার আছে নানা উপসর্গ। নানা প্রতিবন্ধকতা ও ওজর-অজুহাত আছে। তাই বেকার থাকার সুযোগ নেই। আজকের কাজ কালকের জন্য বা দিনের কাজ রাতের জন্য ও রাতের কাজ দিনের জন্য রেখে দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
হযরত ইবন উমর রাযি. বলেন- وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ (তুমি তোমার সুস্থকালীন সময়ে অর্জন করে নাও অসুস্থতাকালীন সময়ের জন্য)। অর্থাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তুমি কাজ করতে পারবে না। অসুস্থতা তোমার নানা আমলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখন যখন তুমি সুস্থ, যতবেশি পার আমল করে নাও। অন্যথায় অসুস্থতাকালে তোমার আক্ষেপ করতে হবে যে, আহা, সুস্থ অবস্থায় কেন সময় কাজে লাগালাম না! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
نِعْمَتَانِ مَغْبُوْن فِيْهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ : الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ.
‘দুটি নি'আমত এমন, যে ক্ষেত্রে বহুলোক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তা হল সুস্থতা ও অবসর সময়।’ ২২৮
وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ ‘এবং তোমার জীবনকালে (অর্জন করে নাও) মৃত্যুর জন্য'। অর্থাৎ মৃত্যুর পর কোনও আমল করার সুযোগ থাকে না। আবার মৃত্যু যে-কোনও সময়ই এসে হানা দিতে পারে। কখন আসবে কেউ জানে না। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত ইবন উমর রাযি. সবশেষে বলেছিলেন-
فَإِنَّكَ لَا تَدْرِي يَا عَبْدَ اللَّهِ مَا اسْمُكَ غَدًا (হে আল্লাহর বান্দা! তুমি জানো না আগামীকাল তোমার কী নাম হবে)। অর্থাৎ জীবিত ব্যক্তি হিসেবে তোমার প্রচলিত নামেই তোমাকে ডাকা হবে, নাকি তোমার মৃত্যু হয়ে যাবে ফলে তোমাকে মায়্যিত বা লাশ ইত্যাদি বলা হবে।
তাই এখন যখন বেঁচে আছ, আমল করে নাও। এখন অবহেলা করলে মৃত্যুকালে আক্ষেপ করতে হবে। সে আক্ষেপ কোনও কাজে আসবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَبِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ وَأَنْفِقُوا مِنْ مَّا رَزَقْنَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِي أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْ لَا أَخرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصّلِحِينَ
'হে মুমিনগণ! তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে গাফেল করতে না পারে। যারা এ রকম করবে (অর্থাৎ গাফেল হবে) তারাই (ব্যবসায়) ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারও মৃত্যু এসে যাবে আর তখন বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদাকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ ২২৯
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَّبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ أَنْ تَقُوْلَ نَفْسٌ يّٰحَسْرَتى عَلَى مَا فَرَّطْتُ فِي جَنْبِ اللَّهِ وَإِنْ كُنْتُ لَمِنَ السّٰخِرِينَ.
'এবং তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমাদের উপর উত্তম যা-কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ কর তোমাদের কাছে অতর্কিতভাবে শাস্তি আসার আগে, অথচ তোমরা তা জানতেও পারবে না। যাতে কাউকে বলতে না হয় যে, হায়! আল্লাহর ব্যাপারে আমি যে অবহেলা করেছি তার জন্য আফসোস! প্রকৃতপক্ষে আমি (আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান নিয়ে) ঠাট্টাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ ২৩০
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
بَادِرُوا بِالْأَعْمَالِ سَبْعًا ، هَلْ تَنْتَظِرُوْنَ إِلَّا فَقْرًا مُنْسِيا، أَوْ غِنى مُطْغيًا، أَوْ مَرَضًا مُفْسِدًا، أَوْ هَرَمًا مُفْنِدًا ، أَوْ مَوْتَا مُجْهِرًا ، أَوِ الدَّجَّالَ فَشَرُّ غَائِب يُنتَظَرُ، أَوِ السَّاعَةَ فَالسَّاعَةُ أَدْهٰى وَأَمَرُّ.
'তোমরা সাতটি জিনিস আসার আগে আগে দ্রুত আমলে লিপ্ত হও। তোমরা কি অপেক্ষা করছ এমন দারিদ্র্যের, যা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়? না এমন প্রাচুর্যের, যা অবাধ্য করে তোলে? না এমন রোগ-ব্যাধির, যা অথর্ব করে তোলে? না এমন বার্ধক্যের, যা বুদ্ধি লোপ করে দেয়? না আকস্মিক আগত মৃত্যুর? না দাজ্জালের- সে তো এমন নিকৃষ্টতম অনুপস্থিত, যার আত্মপ্রকাশের অপেক্ষা করা হচ্ছে? না কিয়ামতের, যে কিয়ামত কিনা অত্যন্ত বিভীষিকাময় ও অতি তিক্ত?' ২৩১
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন-
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ ، شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.
'পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে সুবর্ণ সুযোগ মনে করো- বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে বেঁচে থাকাকে। '২৩২
সুতরাং প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য দ্রুত আমলে লেগে যাওয়া। না জানি কখন কোন্ বাধা সামনে দাঁড়িয়ে যায়! তাই প্রতিটি মুহূর্তকে শেষ মুহূর্ত মনে করে সবচে' বেশি প্রয়োজনীয় কাজটি করে ফেলা চাই।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও আসবাব-উপকরণে বেশি জড়াতে নেই। পরকালই আসল ঠিকানা। সেখানকার পাথেয় সংগ্রহেই বেশি ব্যস্ত থাকা চাই।
খ. আগামীতে বেঁচে থাকার কোনও ভরসা নেই। তাই নগদ যে সময় হাতে আছে সেটাকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
গ. সুস্থতা ও অবসর সময় আমলের মহাসুযোগ। এ সুযোগ হারাতে নেই।দীর্ঘদীন বেঁচে থাকার আশা শয়তানের ধোকা। সে এ পথে মানুষের অন্তরে অলসতা সৃষ্টি করে। তারপর যখন অকস্মাৎ মৃত্যু এসে যায় তখন দেখা যায় কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। তাই শয়তানের এ ধোঁকায় পড়তে নেই।
২২৩. সূরা গাফির (৪০), আয়াত ৩৯
২২৪. জামে' তিরমিযী: ২৩৭৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১০৯; মুসনাদে আহমাদ: ৩৭০৯; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৫২২৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৬৩৫২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১১৮৯৮: বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৯৩০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩৫
২২৫. সূরা কাসাস (২৮), আয়াত ৭৬
২২৬. সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ১৮
২২৭. জামে তিরমিযী: ২৩৩৩; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩০৪; মুসনাদে আহমাদ: ৫০০২; সুনানে ইবন মাজাহ : ৪১১৪; শুআবুল ঈমান: ১০০৫৯; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০৩০
২২৮. সহীহ বুখারী: ৬৪১২; জামে' তিরমিযী: ২৩০৪; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮০০; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪১৭০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩৭৫; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ১০৭৮৬; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৬৫২৩; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২০;
২২৯. সূরা মুনাফিকূন (৬৩), আয়াত ৯-১০
২৩০. সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৫-৫৬
২৩১. জামে' তিরমিযী: ২৩৬০; মুসনাদে আবু ইয়া'লা: ৬৫৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত : ৩৯৪৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০০৮৮; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
২৩২. মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩১৯; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা : ১১৮৩২; বায়হাকী, আল-আদাব : ৮০৯; শু'আবুল ঈমান: ৯৭৬৭; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ৪০২২
