আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৭- নম্রতা ও যুহদের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬৪১২
৩৪১৩. যুহদের অধ্যায়ঃ নবী (ﷺ) এর বাণীঃ আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।
৫৯৭০। মক্কী ইবনে ইবরাহীম (রাহঃ) ......... ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ দুটি নিআমত এমন আছে, যে দু’টোতে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হল, সুস্থতা আর অবসর।
আব্বাস আম্বরী (রাহঃ) ......... সাঈদ ইবনে আবু হিন্দ (রাহঃ) থেকে ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) সূত্রে নবী (ﷺ) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

مغبون শব্দটির উৎপত্তি غبن থেকে, যার অর্থ বেচাকেনায় ঠকে যাওয়া। যে ক্রেতা কোনও মাল ন্যায্য মূল্য অপেক্ষা বেশি দামে কেনে তাকে مغبون বলা হয়। অনুরূপ বিক্রেতা যদি তার মাল উচিতমূল্য অপেক্ষা কমে বিক্রি করে, সেও مغبون । এ হাদীছে বান্দাকে ব্যবসায়ীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সুস্বাস্থ্য ও অবসর সময় যেন বান্দার মূলধন। ব্যবসায়ী যেমন তার মূলধন বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে, তদ্রূপ বান্দার উচিত তার এ মূলধন কাজে লাগিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করা। বান্দার প্রকৃত লাভ সেটাই, যা আখিরাতে কাজে আসে। অর্থাৎ যা দ্বারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাত লাভ করা যায়। বান্দা যদি তার সুস্বাস্থ্য ও সময়কে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনে ব্যয় করে, তবেই এ নি'আমত দুটির যথাযথ ব্যবহার হয়। তখন সে এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছে প্রভূত ছাওয়াব পেয়ে থাকে। তখন বলা হবে, সে তার মূলধন দ্বারা লাভবান হল। পক্ষান্তরে বান্দা যদি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, তবে স্বাস্থ্য ও সময়ের অপব্যবহার হয়। ফলে সে লোকসানের শিকার হয়। সে লোকসানের শিকার হয় অবহেলায় সময় নষ্ট করলেও। কেননা সময় তো বয়ে যায়ই এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে চলে যায় শরীরের শক্তি ও মনের জোরও। এভাবে সময় ও স্বাস্থ্য তো চলে গেল, কিন্তু আমল না করার কারণে তার বিপরীতে অর্জন হল না কিছুই। পুঁজি গেল, অথচ কিছু অর্জন হল না। এটা তো লোকসানই বটে।
বস্তুত ছাওয়াব ও পুণ্য অর্জনে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টা দুনিয়ার ব্যবসাবাণিজ্যের মতই। ব্যবসাবাণিজ্যে লাভবান হওয়ার জন্য যেমন মূলধন খাটাতে হয়, তেমনি ছাওয়াব কামাই করতে হলেও সময় ও সুস্বাস্থ্য নামক মূলধন ব্যবহার করতে হয়। এ মূলধনকে যে যতবেশি পরিমাণে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করবে, সে ততবেশি লাভবান হবে। অর্থাৎ তার ততবেশি পুণ্য অর্জন হবে। কাজেই এও এক ব্যবসাই বটে। এক হচ্ছে দুনিয়ার ব্যবসা, যাতে টাকাপয়সা লাভ হয়। আরেক হচ্ছে আখিরাতের ব্যবসা, যাতে ছাওয়াব অর্জিত হয়। ওই লোক দুনিয়ার ব্যবসায়ী, এই লোক আখিরাতের ব্যবসায়ী। আখিরাতের ব্যবসাই প্রকৃত ব্যবসা। কারণ এর লাভ মানুষের স্থায়ী জীবনে কাজে আসবে। অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে অনন্ত সুখের ও স্থায়ী বাসের জান্নাত লাভ হবে। তাই কুরআন মাজীদও মানুষকে এ ব্যবসার প্রতি উৎসাহ দান করেছে, যেমন ইরশাদ হয়েছে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ (10) تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (11) يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (12)

অর্থ : হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসায়ের সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? (তা এই যে,) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটা তোমাদের পক্ষে শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। এর ফলে আল্লাহ তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন উদ্যানে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে এবং এমন উৎকৃষ্ট বাসগৃহে, যা স্থায়ী জান্নাতে অবস্থিত। এটাই মহা সাফল্য।সুরা সাফ, আয়াত ১০-১২
দুনিয়ায় তো মানুষ বেশি লাভের স্থলে কম লাভকেও লোকসান নামে অভিহিত করে থাকে। কেউ দশ হাজার টাকা লাভ করতে পারত। সেখানে যদি পাঁচ হাজার টাকা লাভ হয়, তবে বলে বড় লোকসান হয়ে গেল। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সুস্বাস্থ্য ও অবসর নামক যে দুই পুঁজি দিয়েছেন তা খাটিয়ে বিপুল লাভ করা সম্ভব। একবার সুবহানাল্লাহ, একবার আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি যিকর করলে নেকীতে দাঁড়িপাল্লা ভরে যায়। দু' রাক'আত নফল নামাযের কত ছাওয়াব। কোনও রোগী দেখতে গেলে কিংবা অন্য কোনওভাবে কারও সাহায্য করলে কত নেকীই না অর্জিত হয়। ছোট ছোট আমল করেও হজ্জ ও উমরা আদায়ের ছাওয়াব অর্জন করা যায়। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে পুণ্যার্জনের হাজারও উপায় দিয়েছেন। সেইসঙ্গে দিয়েছেন ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে যদি সময় ও সুস্থতাকে সেসব উপায় অবলম্বনে ব্যবহার করা হয়, তবে কি ভাবা যায় কী পরিমাণ নেকী আমরা একেকজন কামাই করতে পারি? নেকী কামাইয়ের বিপুল সম্ভাবনা আমরা অবহেলায় সময় নষ্ট করে থাকি। এরচে' বড় লোকসান আর কী হতে পারে?
সময়ের সমষ্টির নামই তো জীবন। সে সময়ের ভেতর আবার যৌবনকাল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময়ে স্বাস্থ্য বেশি ভালো থাকে। শরীর ও মনে থাকে উদ্যম। কাজেই অবসর ও সুস্বাস্থ্য নামক যে নি'আমতের কথা এ হাদীছে বলা হয়েছে, তার মধ্যে সাধারণভাবে সারাটা জীবন এবং বিশেষভাবে যৌবনকাল এসে যায়। সুতরাং লোকসান থেকে বাঁচার জন্য কর্তব্য সাধারণভাবে গোটা জীবনই ‘ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকা। আর বিশেষভাবে যৌবনকালে। অন্যথায় গোটা জীবনই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। সে ক্ষতির প্রকাশ ঘটবে হাশরের ময়দানে, যখন আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে তাঁর নি'আমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সে জিজ্ঞাসার মধ্যে বিশেষভাবে এ দুটি বিষয়ও থাকবে।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন, বান্দা আল্লাহর সম্মুখ থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সরতে পারবে না। তার মধ্যে প্রথম দুই প্রশ্নই যথাক্রমে আয়ু ও যৌবনকাল সম্পর্কে। আল্লাহ তা'আলা জিজ্ঞেস করবেন, তোমার জীবনের সময়কালকে কী কাজে নিঃশেষ করেছ এবং তোমার যৌবনকালকে কী কাজে জরাজীর্ণ করেছ?
সূরা আল-'আসরে যে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন-

وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2)

(সময়ের শপথ! সমস্ত মানুষ রয়েছে ক্ষতির মধ্যে),

-এর ভেতর সংক্ষেপে সেদিকেই ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যদি তার জীবনকাল ও যৌবনের সময়টাকে আল্লাহর হুকুমমত ব্যবহার না করে, তবে সে ওই ব্যবসায়ীর মত হয়ে যায়, যে তার সবটা পুঁজি খরচ করে ফেলে, কিন্তু তার বিনিময়ে অর্জিত হয় না কিছুই। সুতরাং কিয়ামতের দিন যদি আমরা ক্ষতি থেকে বাঁচতে চাই এবং আল্লাহর সামনে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে চাই, তবে আমাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক সময় ও স্বাস্থ্যের ব্যবহার করা। সকল পাপকর্ম থেকে তো অবশ্যই বাঁচতে হবে, তার পাশাপাশি ‘ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কতবেশি পুণ্য অর্জন করা যায় সেই চেষ্টাও করতে হবে।
এ হাদীছে 'ফারাগ' অর্থাৎ অবসর সময়কে একটি বড় নি'আমত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । কেননা অনেক সময় এমন হয় যে, স্বাস্থ্য তো ভালো থাকে, কিন্তু দুনিয়াবী নানা ব্যস্ততার কারণে আলাদাভাবে 'ইবাদত-বন্দেগী করার সুযোগ হয় না। তখন যদিও দুনিয়াবী কাজকর্ম শরী'আতসম্মত পন্থায় করলে ছাওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু যিকর, তিলাওয়াত, নফল নামায, নফল রোযা ইত্যাদি যেসব আমল সরাসরি 'ইবাদত তার ছাওয়ার তো অনেক বেশি। অতিরিক্ত ব্যস্ততায় এরকম 'ইবাদত করতে না পারার কারণে সে ছাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়। এটা তো কম ক্ষতি নয়। তাছাড়া দুনিয়াবী ব্যস্ততা মানুষকে অনেক সময় এমন পেরেশান করে তোলে যে, তখন শরী'আতের সীমারেখা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে সেসব কাজে গুনাহ হয়ে যায়। অনেক সময় নিয়ত সহীহ থাকে না। দুনিয়াবী কাজকর্ম সহীহ নিয়তে মানুষ কমই করে থাকে। সে ক্ষেত্রে গুনাহ না হলেও ছাওয়াবও তো পাওয়া যায় না। ফলে সে ক্ষেত্রে সময় ও স্বাস্থ্যের অপচয়ই হয়। কাজেই যখন দুনিয়াবী ব্যস্ততা বেশি না থাকে, অর্থাৎ হাতে যখন অবসর থাকে, তখন মনে করতে হবে এটা আমার জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ। এ সময় আমার কর্তব্য বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকা এবং যতবেশি সম্ভব পুণ্যার্জন করে নেওয়া।
এ হাদীছে বলা হয়েছে, كثير من الناس - বহু মানুষ (ক্ষতিগ্রস্ত)। আরবীতে এর - বিপরীত শব্দ হল قليل من الناس - অল্প মানুষ। এর অর্থ দাঁড়ায়, সুস্বাস্থ্য ও অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে কম মানুষই লাভবান হয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ

অর্থ : আমার শোকরগুযার বান্দা বড় কম।সুরা সাবা, আয়াত ১৩

আল্লাহর প্রকৃত শোকর আদায় হলো তাঁর দেওয়া নি'আমতকে তাঁর হুকুম মোতাবেক ব্যবহার করা। সুস্বাস্থ্য ও অবসর সময় যখন আল্লাহ তা'আলার বিশেষ নি'আমত, তখন এর শোকর আদায়েরও গুরুত্ব অনেক বেশি। সে শোকর আদায় হবে তখনই, যখন আল্লাহ তা'আলার হুকুম মোতাবেক এর ব্যবহার হবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা করে না। সেজন্যই বলা হয়েছে- অধিকাংশ মানুষ এ দুই নি'আমতের ক্ষেত্রে ক্ষতির মধ্যে আছে। এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলার হুকুম মোতাবেক যারা এর ব্যবহার করে তাদের সংখ্যা অনেক কম। তাই এ আয়াতে বলা হয়েছে- আল্লাহর শোকরগুযার বান্দা বড় কম। এ ভাষাটি আক্ষেপের। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা চান না তাঁর বান্দা নাশোকর হোক। আমরা যদি আল্লাহর শোকরগুযার বান্দা হতে চাই ও নাশোকরদের দল থেকে আলাদা থাকতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যকর্তব্য হবে অবসর সময়টাকে "ইবাদত-বন্দেগীতে লাগানো এবং যখন স্বাস্থ্য ভালো থাকে তখন, বিশেষত যৌবনকালে বেশি বেশি পুণ্যের কাজে সচেষ্ট থাকা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সুস্বাস্থ্য আল্লাহ তা'আলার দেওয়া এক বড় নি'আমত। এর জন্য শোকর আদায় করা দরকার।

খ. সুস্বাস্থ্য যখন আল্লাহ তা'আলার একটি বড় নি'আমত, তখন এর হেফাজত করা অবশ্যকর্তব্য।

গ. মানুষ অবসর সময়কে হেলায় নষ্ট করে। অথচ এটা 'ইবাদত-বন্দেগীর এক বড় সুযোগ। সুতরাং প্রত্যেকের কর্তব্য এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।

ঘ. সুস্বাস্থ্য ও অবসর সময় ছাওয়াব কামাই করার জন্য মূলধনস্বরূপ। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য পুণ্যার্জন ছাড়া এ মূলধন যাতে নষ্ট না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন