রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৫. ঘুমানো ও মজলিসের আদব

হাদীস নং: ৮৪৩
ঘুমানো ও মজলিসের আদব
পরিচ্ছেদ:৪ স্বপ্ন ও স্বপ্ন সম্পর্কিত বিষয়াবলি
তিনটি কঠিনতম মিথ্যাচার
হাদীছ নং: ৮৪৩

হযরত আবুল আসকা' ওয়াছিলা ইবনুল আসকা' রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, গুরুতর মিথ্যাচারের একটি হল নিজের পিতা ছাড়া অন্য কারও পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করা অথবা নিজ চোখকে দেখানো যা সে দেখেনি কিংবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে এমন কথা বলা, যা তিনি বলেননি। -বুখারী
(সহীহ বুখারী : ৩৫০৯; মুসনাদে আহমাদ : ৫৯৯৯; মুসনাদুল বাযযার : ৬১২৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩২; তাবারানী, মুসনাদুশ শামিয়্যীন: ১০৫৩; আল মু'জামুল কাবীর: ১৭৮; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৪৯০ )
كتاب آداب النوم والاضطجاع والقعود والمجلس والجليس والرؤيا
باب الرؤيا وَمَا يتعلق بها
843 - وعن أَبي الأسقع واثِلةَ بن الأسقعِ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «إنَّ مِنْ أَعْظَمِ الفِرَى أَنْ يَدَّعِيَ الرَّجُلُ إِلَى غَيرِ أبِيهِ، أَوْ يُرِي عَيْنَهُ مَا لَمْ تَرَ (1)، أَوْ يَقُولَ عَلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - مَا لَمْ يَقُلْ». رواه البخاري. (2)
(5) -

হাদীসের ব্যাখ্যা:

الْفِرَى শব্দটি فِرْيةٌ এর বহুবচন। এর অর্থ কঠিন মিথ্যা। যেসকল মিথ্যাচার সর্বাপেক্ষা ভয়ানক ও গুরুতর, তার মধ্যে তিনটি এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এ তিনটি ভয়ানক এ কারণে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার উপর অপবাদ দেওয়া হয়। আল্লাহ তা'আলা যা করেননি, তাকে তাঁর কাজ বলে চালানো হয়। তার মধ্যে প্রথমটি হল-
أَنْ يَدَّعِيَ الرَّجُلُ إِلَى غَيْرِ أَبِيْهِ (নিজের পিতা ছাড়া অন্য কারও পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করা)। এটি গুরুতর মিথ্যা এ কারণে যে, এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার উপর মিথ্যারোপ করা হয়। কারণ যে ব্যক্তি নিজ পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে পরিচয় নেয়। সে যেন দাবি করে যে, আল্লাহ তা'আলা আমাকে সৃষ্টি করেছেন অমুকের ঔরসে। অথচ তার ঔরসে আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেননি। তিনি তো তাকে সৃষ্টি করেছেন তার জন্মদাতা পিতার ঔরসে। এ মিথ্যাচারের পরিণাম সুদূরপ্রসারী। এর প্রভাব পড়ে মীরাছের উপর। প্রকৃতপক্ষে সে যার ওয়ারিছ, তার বদলে অন্যায়ভাবে সে অন্যের মীরাছে ভাগ বসায়। আবার সে আগে মারা গেলে জন্মদাতা পিতা তার মীরাছ পেত। এ মিথ্যাচারের কারণে সে তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আর অন্যায়ভাবে তা অন্যের হস্তগত হচ্ছে। এমনিভাবে অন্যকে পিতা বলে পরিচয় দেওয়ায় তার বংশধরদের মধ্যেও মিথ্যা পরিচয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে। আর এভাবে যুগের পর যুগ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হতে থাকবে। মোটকথা এটা এক কঠিন মিথ্যাচার ও ভয়ানক পাপ। এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য। কেননা এর পরিণাম জাহান্নামের শাস্তি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ، وَهُوَ يَعْلَمُ فَالْجَنَّةُ عَلَيْهِ حَرَامٌ
'যে ব্যক্তি জেনেশুনে নিজ পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে পরিচয় দেয়, জান্নাত তার জন্য হারাম’।
(সহীহ বুখারী : ৪৩২৬; সহীহ মুসলিম: ৬৩; সুনানে আবু দাউদ: ৫১১৩; জামে' তিরমিযী: ২১২০; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৬১০; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ১৬৩১০; মুসনাদে আহমাদ: ১৪৯৫; মুসনাদে আবু ইয়া'লা : ৭০০; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৪২৭১; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৩৬৮৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৫৩৩৬)

দ্বিতীয়টি হল- أو يري عينه ما لم تر (অথবা নিজ চোখকে দেখানো, যা সে দেখেনি)। অর্থাৎ মানুষের কাছে মিথ্যা স্বপ্ন প্রচার করা। এরূপ বলা যে, আমি এই এই স্বপ্ন দেখেছি। অথচ সে তা দেখেনি। এটা গুরুতর মিথ্যা এ কারণে যে, স্বপ্ন দেখাটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। কাজেই বানিয়ে স্বপ্ন বললে তা আল্লাহ সম্পর্কেই মিথ্যা বানানো হয়।

প্রশ্ন হতে পারে, স্বপ্নের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার ক্ষতি অপেক্ষা জাগ্রত অবস্থায় মিথ্যা বলার ক্ষতি তো অনেক বেশি, যেমন কারও সম্পর্কে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তাঁর সম্পদ অন্যায়ভাবে অন্যের কবজায় চলে যেতে পারে, এমনকি তার প্রাণদণ্ডও হতে পারে, মিথ্যা স্বপ্ন বলার দ্বারা তো কারও এত বড় ক্ষতি হয় না, এ অবস্থায় বানিয়ে স্বপ্ন বলাটা কেন অধিকতর কঠিন মিথ্যা হবে?
এর উত্তর হল, এমনিতে তো মিথ্যা বলা কবীরা গুনাহসমূহের অন্যতম। মিথ্যা যার সম্পর্কেই বলা হোক তা কঠিন পাপ। তবে স্বপ্নের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাটা অন্য মিথ্যা অপেক্ষা বেশি গুরুতর পাপ এ কারণে যে, এরূপ মিথ্যা হয় আল্লাহ সম্পর্কে। আর জাগ্রত অবস্থায় বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, সাক্ষ্য ইত্যাদিতে যে মিথ্যা বলা হয় তার সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে। নিশ্চয়ই মানুষ সম্পর্কে মিথ্যা বলা অপেক্ষা আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা বলাটা অনেক বেশি ভয়ংকর। বানিয়ে মিথ্যা বলার শাস্তি সম্পর্কে ঘোষিত হয়েছে-
مَنْ تَحَلَّمَ بِحُلْمٍ لَمْ يَرَهُ، كُلِّفَ أَنْ يَعْقِدَ بَيْنَ شَعِيرَتَيْنِ، وَلَنْ يَفْعَلَ
'যে ব্যক্তি এমন স্বপ্ন দেখেছে বলে প্রকাশ করে, যা সে দেখেনি, তাকে দু'টি চুলের মধ্যে গিট দিতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু সে কিছুতেই তা দিতে পারবে না’।
(সহীহ বুখারী: ৭০৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ১১৯২৩; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২১৮)

তৃতীয় কঠিন মিথ্যাচার হল- أَوْ يَقُوْلَ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ مَا لَمْ يَقُلْ (কিংবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে এমন কথা বলা, যা তিনি বলেননি)। অর্থাৎ বানিয়ে বানিয়ে হাদীছ বলা বা জাল হাদীছ বর্ণনা করা গুরুতর পাপসমূহের একটি। কারণ এ মিথ্যা কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কেই না; আল্লাহ তা'আলার সম্পর্কেও হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছসমূহও মূলত ওহী। তার ভাষা তাঁর, কিন্তু ভাব আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে। কাজেই মিথ্যা হাদীছ বলার অর্থ দাঁড়ায় এর ভাব ও বিষয়বস্তু আল্লাহর তা'আলার পক্ষ থেকেই এসেছে। অথচ বাস্তবতা তা নয়। তা তো ওই ব্যক্তির মনগল্প এ কারণেই যে ব্যক্তি মিথ্যা হাদীছ বলে, তার সম্পর্কে জাহান্নামের শাস্তির সতর্কবউ উচ্চারিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
'যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়’।
(সহীহ বুখারী: ১১০; সহীহ মুসলিম : ৩; সুনানে আবূ দাউদ: ৩৬৫১; জামে তিরমিযী: ২২৫৭; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৫৮৮৩; সুনানে ইবন মাজাহ: ২৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা : ২৬২৩৮; মুসনাদে আহমাদ: ৫৮৪; সুনানে দারিমী: ২৩৭; মুসনাদুল বাযার: ৩৮৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ২৫৮; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ৫৬১৯)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বানিয়ে স্বপ্ন বলা কঠিনতম মিথ্যাচার। এর থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।

খ. নিজ পিতা ছাড়া কিছুতেই অন্য কাউকে পিতা বলে পরিচয় দিতে নেই। এটাও কঠিনতম মিথ্যাচার।

গ. বানিয়ে হাদীছ বলা বা জাল হাদীছ বর্ণনা করার দ্বারা কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিই মিথ্যারোপ করা হয় না; আল্লাহ তা'আলার প্রতিও মিথ্যারোপ হয়। এর থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৮৪৩ | মুসলিম বাংলা