রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৫. ঘুমানো ও মজলিসের আদব

হাদীস নং: ৮৩৭
ঘুমানো ও মজলিসের আদব
পরিচ্ছেদ:৪ স্বপ্ন ও স্বপ্ন সম্পর্কিত বিষয়াবলি

الرؤيا এর অর্থ দেখা। এর মূল ধাতু رؤية । সাধারণভাবে যে-কোনও দেখাকে رؤية বলে। মানুষ যেমন জাগ্রত অবস্থায় দেখে,তেমনি ঘুমন্ত অবস্থায়ও। যেমন কুরআন মাজীদে আছে, হযরত ইয়সুফ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন-

إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ …
'আমি স্বপ্নে দেখছি...।' (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)
ঘুমন্ত অবস্থায় দেখাকে স্বপ্ন বলে। তাই দুই দেখার জন্য শব্দটির দুই রূপ ব্যবহৃত হয়। জাগ্রত অবস্থায় দেখার অর্থে 'رؤية আর ঘুমন্ত অবস্থায় দেখার অর্থে رؤيا ।
স্বপ্ন অর্থে আরও একটি শব্দের ব্যবহার আছে। তা হল حُلُم, বহুবচনে أحلام। তবে رؤيا ও حلم এর মধ্যে পার্থক্য আছে। حلم বলা হয় ভয় ও উদ্বেগ জাতীয় স্বপ্নকে, যার সম্পর্ক অতীত ও বর্তমান উভয় অবস্থার সঙ্গে হয়ে থাকে। মানুষ ক্লান্ত, অসুস্থ কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে এ জাতীয় স্বপ্ন দেখে। সাধারণত এ জাতীয় স্বপ্ন হয় অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত ধরনের। পক্ষান্তরে رؤيا 'বলা হয় এমন স্বপ্নকে, যার সম্পর্ক হয় ভবিষ্যতের সঙ্গে, অতীতের সঙ্গে নয়।
স্বপ্ন কখনও হয় আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আবার কখনও হয় তা শয়তানের কারসাজি। অনেক সময় অবচেতন মন জাগ্রত অবস্থার বিভিন্ন বিষয় কল্পনা করে। এরূপ কল্পনাকেও আমরা স্বপ্ন বলে থাকি। তাহলে স্বপ্ন তিন রকম হল। হাদীছেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الرُّؤْيَا ثَلاَثَةٌ فَرؤْيَا الصَّالِحَة بُشْرَى مِنَ اللهِ وَالرُّؤْيَا تَحْزِينٌ مِنَ الشَّيْطَانِ وَالرُّؤْيَا مِنَ الشَّيْءِ يُحَدِّثُ بِهِ المرؤ نَفْسَهُ
'স্বপ্ন তিন প্রকার। সত্য-সঠিক স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। শয়তাদে পক্ষ থেকে দুশ্চিন্তাজনক স্বপ্ন। ওই স্বপ্ন, যা মানুষ নিজ মনে কল্পনা করে।'
(সহীহ মুসলিম: ২২৬৩; সুনানে আবূ দাউদ: ৫০১৯; জামে তিরমিযী: ২২৭০: নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ১০৬৮০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৮১৭৪; মুসনাদে আহমাদ: ৭৬৩০ সুনানে দারিমী: ২১৮৯; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩০৫০৯; মুসনাদুল বাযযার: ৯৮২৮। বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৪৪৩০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২৭৯)
অর্থাৎ সব স্বপ্নই সত্যিকারের স্বপ্ন নয়। তাই যে-কোনও স্বপ্নের ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। ব্যাখ্যা থাকেও না। ব্যাখ্যা থাকে কেবল সেই স্বপ্নের, যা সত্যিকারের স্বপ্ন অর্থাৎ যা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হয়। যে স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে নয় তা দেখলে শুধু শুধু পেরেশান হতে নেই। তাকে অবাস্তব ঠাওরিয়ে শান্তমনে আপন কাজে লেগে থাকাই শ্রেয়।
সত্য-সঠিক স্বপ্ন এরকম যে, মানুষ ঘুমের ভেতর তার রূহানী দৃষ্টি দ্বারা ভবিষ্যতে ঘটবে এমন বিভিন্ন বিষয় জানতে পারে এবং বাস্তবে তা সত্যও হয়ে থাকে। এরূপ স্বপ্ন তিন প্রকার।
(ক) এমন সত্য স্বপ্ন, যা ব্যাখ্যা করার দরকার হয় না। বাস্তবে যেমন ঘটবে হুবহু। তেমনই দেখা হয়। যেমন পুত্র জবাই সম্পর্কে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন।
(খ) এমন সত্য স্বপ্ন, যার কিছুটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। যেমন হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্ন। তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন এগারোটি তারকা এবং সূর্য ও চন্দ্র তাঁকে সিজদা করছে। পরে ঘটেছিল এমন যে, তাঁর সম্মানার্থে তাঁর পিতা-মাতাও এগারো ভাই তাঁর সামনে সিজদা করে।
(গ) এমন সত্য স্বপ্ন, যা পুরোপুরি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল। যেমন কারাগারে হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালামের দুই সঙ্গীর দেখা স্বপ্ন কিংবা মিশরের বাদশার দেখা স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ও হযরত ইয়ূসুফ আলাইহিস সালাম কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা সূরা ইয়ূসুফে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বপ্ন দেখেছেন। তার প্রতিটি বাস্তবে ঘটেছে। তাঁর নবুওয়াতের সূচনাও সত্যস্বপ্ন দ্বারাই হয়েছিল। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন-
أول ما بدئ به رسول الله صلى الله عليه وسلم من الوحي الرؤيا الصالحة في النوم، فكان لا يرى رؤيا إلا جاءت مثل فلق الصبح
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সর্বপ্রথম যে ওহী আসে তা ছিল ঘুমের ভেতর সত্য-সঠিক স্বপ্ন। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের আলোর মতো সঠিক হয়ে দেখা দিত’।
(সহীহ বুখারী: ৩; সহীহ মুসলিম: ১৬০; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৩৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৯৭১৯; মুসনাদে ইসহাক ইবন রাহূয়াহ: ৮৪০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৪৮৪৩; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা: ১৭৭২১)
সত্য ও নবী-রাসুলগণের স্বপ্ন ওহীর মর্যাদা রাখে। তাঁদের স্বপ্ন হত সর্বাপেক্ষা উচ্চপর্যায়ের। তাই তাঁদের স্বপ্ন দ্বারা বিধান প্রতিষ্ঠিত হত এবং তা অনুসরণযোগ্য হত। সত্য ও সঠিক স্বপ্ন সাধারণ মানুষও দেখে থাকে। তবে তা ওই মর্যাদা রাখে না। তাই তাদের স্বপ্ন ভালো কিছুর প্রতি ইঙ্গিতবাহী হয় বটে, কিন্তু তার অনুসরণ অপরিহার্য হয় না। এমনকি শরী'আতের পরিপন্থি হয়, তবে জায়েযই হয় না।
স্বপ্ন প্রত্যেকেই দেখে। এটা মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ভালো হোক বা মন্দ, যে-কোনও প্রকারের স্বপ্ন মানুষ মাত্রই দেখে থাকে। তা মানুষকে প্রভাবিতও করে। মানুষ ভালো স্বপ্ন দেখলে খুশি হয়। মন্দ স্বপ্ন দেখলে মন খারাপ হয়। কখনও আতঙ্কিতও হয়। স্বপ্ন দেখে মানুষ কাজে উজ্জীবিত হয়। আবার স্বপ্ন দেখে দমেও যায়। যেহেতু মানবজীবনে স্বপ্নের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে, তাই ইসলাম একে উপেক্ষা করেনি; বরং ভারসাম্যপূর্ণ একটা গুরুত্বও দিয়েছে। একদম উড়িয়েও দেয়নি, যেমন অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়। আবার একে এমন বড় করেও দেখেনি যে, সবকিছুকে এর উপর নির্ভরশীল করে রাখা হবে। ইসলাম স্বপ্নকে একটা মাঝামাঝি অবস্থান দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষ ভবিষ্যৎ বিষয়ে কোনও সুসংবাদ লাভ করতে পারে। পেতে পারে সতর্ক সংকেতও। স্বপ্নে দেখা বিষয় শরী'আতবিরোধী না হলে মানুষ তা অনুসরণও করতে পারে। মোটকথা শরী'আতের মর্যাদাসম্পন্ন না হলেও এক পর্যায়ের জ্ঞান মানুষ স্বপ্ন দ্বারা অর্জন করতে পারে। বস্তুত সবকিছু আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই হয়। তিনি যেমন জাগ্রত অবস্থায় মানুষের অন্তরে ইলম ও জ্ঞান সঞ্চারিত করে থাকেন, তেমনি ঘুমন্ত মানুষের অন্তরেও যে-কোনও বিষয়ের অনুভূতি দান করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে অনুভূতিশক্তি কার্যকর রাখা বা বিলোপ করা ঘুম ও জাগরণের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। এটা সম্পূর্ণই আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাধীন। তিনি চাইলে জাগ্রত অবস্থায়ও মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন আবার চাইলে ঘুমন্ত অবস্থায়ও অনুভূতির শক্তি দিতে পারেন।
মোটকথা স্বপ্নের একটা বাস্তবতা অবশ্যই আছে। তবে মনে রাখতে হবে দীনের এমন কোনও বিষয় নয়, যার ভিত্তিতে কারও বিশেষ কোনও মর্যাদা নিরূপিত হতে পারে। স্বপ্ন যত ভালোই হোক, তা দ্বারা কেউ শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় না। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত তাকওয়া-পরহেযগারীর মধ্যে। কারও মধ্যে যদি তাকওয়া-পরহেযগারী থাকে, কিন্তু জীবনেও কোনও ভালো স্বপ্ন না দেখে, তবুও সে আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ভালো ভালো স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সে সুন্নাতের অনুসরণ করে না এবং তার মধ্যে তাকওয়া-পরহেযগারীও নেই, তবে শরী’আতের দৃষ্টিতে তার কোনও বিশেষ মর্যাদাও নেই। তাই স্বপ্ন দ্বারা স্বপ্নদ্রষ্টার নিজের বা অন্য কারও বিভ্রান্ত হলে চলবে না। এ বিষয়ে স্বপ্নব্যাখ্যায় শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি বিখ্যাত তাবি’ঈ মুহাম্মাদ সীরীন রহ.-এর একটি বাণী খুবই মূল্যবান। তিনি বলেন, স্বপ্ন মুমিনদের আনন্দ দেয়, ধোঁকায় ফেলে না। একবার এক ব্যক্তি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. এর কাছে এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি আপনি জান্নাতে। তিনি বললেন, শোনো হে! স্বপ্ন মুমিনকে আনন্দ দেয়, তাকে ধোঁকায় ফেলে না। অমুক ব্যক্তি সম্পর্কেও এমন স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, যেমনটা তুমি বলছ। কিন্তু দেখো আজ সে খারিজী সম্প্রদায়ের মতো আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করে। সুতরাং স্বপ্ন সম্পর্কে অবশ্যই মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দিতে। হবে। বাড়াবাড়ি করা চলবে না।
যাহোক ইসলামে স্বপ্নের এক পর্যায়ের গুরুত্ব রয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্মপন্থা দ্বারা সে গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। তাঁর অভ্যাস ছিল প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর সাহাবায়ে কেরামের স্বপ্নের তা'বীর করে দেওয়া। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, আজ রাতে তোমাদের মধ্যে কেউ কি কোনও স্বপ্ন দেখেছে? কেউ দেখে থাকলে তা প্রকাশ করত এবং তিনি তার ব্যাখ্যা দিতেন। বিভিন্ন হাদীছে ভালো ও মন্দ স্বপ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশনাও দেওয়া আছে। ভালো স্বপ্ন দেখলে কী করণীয়, মন্দ স্বপ্ন দেখলে কী করতে হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের উচিত তা জেনে নিয়ে আপন আপন স্বপ্নের বেলায় তা অনুসরণ করা।

'স্বপ্ন...' সম্পর্কিত একটি আয়াত
وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ
অর্থ: এবং তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে রাত ও দিনে তোমাদের ঘুম।(সূরা রূম, আয়াত ২৩)

ব্যাখ্যা
ঘুম আল্লাহ তা'আলার কুদরতের নিদর্শন। আল্লাহ তা'আলা মানবদেহ নির্মাণে যে বিস্ময়কর কৌশল অবলম্বন করেছেন, তারই এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হল ঘুম। এর দ্বারা দেহের ক্লান্তি ও অবসন্নতা দূর হয়। ঘুমের পর শরীর-মন সজীবতা লাভ করে। ফলে নতুন উদ্যমে কাজকর্মে লেগে পড়া সম্ভব হয়। শরীর ও মস্তিষ্কের যে প্রক্রিয়ায় ঘুম আসে, তা চিন্তা করলে এর ভেতর আল্লাহ তা'আলার কুদরতের কিছুটা আভাস লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ঘুমের দ্বারা যেভাবে মানুষ এক পর্যায়ে নিষ্ক্রিয় ও অচেতন হয়ে পড়ে, তারপর ঘুম ভাঙলে সে পূর্ণ সক্রিয় ও সচেতন হয়ে যায়, সেদিকে লক্ষ করলে মানুষের মৃত্যু এবং তারপর কিয়ামতে পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠা সম্পর্কে কিছু ধারণাও লাভ হয়। এটাও মানুষকে আল্লাহর কুদরত স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঘুমের একটা সম্পর্ক রয়েছে স্বপ্নের সঙ্গেও। জাগ্রত অবস্থায় মানুষ দৃশ্যজগতে বিচরণ করে। ঘুমের ভেতর সে চলে যায় আরেক জগতে। স্বপ্নের জগৎ। সে জগতে কখনও তার অবচেতন মন চেতনার জগৎ নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় দৃশ্যমান জগতের বস্তুরাজি ও ঘটনাবলি নানা রূপে তার সামনে ভেসে ওঠে। এটা অবচেতন মনের কল্পনা। কখনও তার শারীরিক ও মানসিক স্থবিরতার সুযোগে শয়তান তাকে নিয়ে মেতে ওঠে। তখন অপ্রীতিকর ও ভয়ংকর নানা দৃশ্য সে দেখতে পায়। সে আতঙ্কিত হয়। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। এটা দুঃস্বপ্ন। আবার কখনও এ উভয় হতে মুক্ত থেকে তার সম্পর্ক স্থাপিত হয় ঊর্ধ্বজগতের সঙ্গে। তখন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তার সামনে নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যায়। সে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে পায় নানা বার্তা। হয়তো লাভ করে কোনও সুখবর। পায় আশুবিপদের কোনও সতর্কসংকেত। তাকে দেওয়া হয় কোনও কর্তব্যকর্মের নির্দেশনা। এমনকি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঊর্ধ্বজগতের পরিভ্রমণে। সবই হয় ঘুমের ভেতর। সুতরাং ঘুম মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের এক বিস্ময়কর নিদর্শন।
মৌলিকভাবে রাতই ঘুমের উপযুক্ত সময়। দিন কর্মব্যস্ততার জন্য। তবে দিনের প্রথমার্ধের পরিশ্রমের পর শরীরে কিছুটা ক্রান্তি দেখা দেয়। ফলে দুপুরবেলা অনেকেরই ঘুম পায়। কেউ কেউ এ সময় ঘুমায়ও। খানিকটা ঘুমিয়ে নিলে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ফের তাজা শরীরে কাজের উদ্যম তৈরি হয়। কাজেই ঘুম যেমন আল্লাহ তা'আলার কুদরতের এক নিদর্শন, তেমনি বান্দার পক্ষে এটা এক বিরাট নি'আমতও বটে।

আয়াতটির শিক্ষা
ক. ঘুম আল্লাহ তা'আলার কুদরতের নিদর্শন। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়া, ঘুমের পর শরীর ও মন-মস্তিষ্ক পূর্ণোদ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠা এবং ঘুম সম্পর্কিত শরীর ও মস্তিষ্কের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়ার প্রতি লক্ষ করলে আল্লাহ তা'আলার কুদরত ও সৃষ্টিকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়।
খ. ঘুম আল্লাহ তা'আলার অনেক বড় এক নি'আমত। এর জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করা উচিত।
গ. রাতই ঘুমের আসল সময়। তাই মৌলিকভাবে ঘুমের জন্য রাতকেই বেছে নেওয়া উচিত।
ঘ. দিনের বেলায়ও খানিকটা বিশ্রাম করা ভালো।
স্বপ্নের হাকীকত
হাদীছ নং: ৮৩৭

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নবুওয়াতের কিছুই অবশিষ্ট নেই মুবাশশিরাত ছাড়া। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, মুবাশশিরাত কী? তিনি বললেন, সঠিক স্বপ্ন। -বুখারী ৩২
(সহীহ বুখারী : ৬৯৯০; জামে’ তিরমিযী: ২২৭২; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৮৯৭; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর : ৩০৫১; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৩২৭২; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৮১৭১)
كتاب آداب النوم والاضطجاع والقعود والمجلس والجليس والرؤيا
باب الرؤيا وَمَا يتعلق بها: قَالَ الله تَعَالَى: {وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ} [الروم: 23].
837 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «لَمْ يَبْقَ مِنَ النُّبوَّةِ إِلاَّ المُبَشِّرَاتِ» قالوا: وَمَا المُبَشِّرَاتُ؟ قَالَ: «الرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ». رواه البخاري (1).

হাদীসের ব্যাখ্যা:

لَمْ يَبْقَ مِنَ النُّبُوَّةِ إِلَّا الْمُبَشِّرَاتِ (নবুওয়াতের কিছুই অবশিষ্ট নেই মুবাশশিরাত ছাড়া)। অর্থাৎ আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পর কোনও নবী নেই। কাজেই আমার মৃত্যুতে ওহীর ধারা বন্ধ হয়ে যাবে। যখন ওহীর ধারা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন ভবিষ্যতে যা ঘটবে তা জানার কোনও মাধ্যম থাকবে না। থাকবে কেবল মুবাশশিরাত। মুবাশশিরাত অর্থ সুসংবাদদাতা।

সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, মুবাশশিরাত কী? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- اَلرُّؤْيَا الصَّالِحَةُ (সঠিক স্বপ্ন)। অর্থাৎ বাস্তবসম্মত স্বপ্ন। যে স্বপ্নের ফল বাস্তবে পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে যা ঘটবে ঠিক তাই যে স্বপ্নে দেখা হয় বা জানানো হয়, সেটাই সঠিক স্বপ্ন। কোনও কোনও হাদীছে এরূপ স্বপ্নকে الرُّؤْيَا الصَّادِقَةُ (সত্য স্বপ্ন)-ও বলা হয়েছে। এটা সুসংবাদ-দুঃসংবাদ দু-ই হতে পারে। ভবিষ্যতে ভালো যা ঘটবে, স্বপ্নে আগাম তা জানিয়ে দেওয়া হয় বলে এরূপ স্বপ্নকে মুবাশশিরাত বা সুসংবাদ হয়, যার সম্পর্ক ভবিষ্যতের মন্দ বা অপ্রীতিকর কোনওকিছুর সঙ্গে। এরূপ স্বপ্ন দ্বারা বান্দাকে আগেভাগে সতর্ক করে দেওয়া হয়। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া, যাতে সে আগে থেকেই সেই বিষয়ে মানসিক ও বাস্তবিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সঠিক স্বপ্ন দু'প্রকার। সুসংবাদদাতা স্বপ্ন ও সতর্ককারী স্বপ্ন। হাদীছে উভয়প্রকার স্বপ্নকেই সুসংবাদদাতা বলা হয়েছে। এটা বলা হয়েছে ভালোকে মন্দের উপর প্রাধান্যদানের নীতিতে। এটা আরবী অলংকারশাস্ত্রের একটা নিয়ম। অনেক সময় দু'টি বিষয়ের একটিকে অন্যটির উপর প্রাধান্য দিয়ে উভয়ের জন্য একই শব্দ বা একই নাম ব্যবহার করা হয়। পরিভাষায় একে 'তাগলীব' বলা হয়।

এ হাদীছ দ্বারা বোঝা যাচ্ছে সত্য-সঠিক স্বপ্ন নবুওয়াতের একটা অংশ। তা এ হিসেবে যে, নবুওয়াত দ্বারা যে বিভিন্ন রকমের জ্ঞান লাভ হয়ে থাকে, তার মধ্যে একটা হল ভবিষ্যৎ বিষয়ে আগাম খবর। এ ধরনের জ্ঞান স্বপ্ন দ্বারাও লাভ হয়। স্বপ্নে ভবিষ্যৎ বিষয়ে হয়তো সুসংবাদ জানানো হয় অথবা সতর্ক করা হয়। কেবল এই এতটুকু বিষয়ে নবুওয়াতের সঙ্গে মিল আছে। সে হিসেবেই স্বপ্নকে নবুওয়াতের অংশ বলা হয়েছে। কিন্তু নবুওয়াত অনেক ব্যাপক। বিশেষত তা দ্বারা শরী'আত বা বিধি-বিধানের জ্ঞান লাভ হয় এবং নবুওয়াতী জ্ঞান অকাট্য ও সন্দেহাতীত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে স্বপ্ন দ্বারা কখনও বিধি-বিধান সাব্যস্ত হয় না এবং তা অকাট্য ও সন্দেহাতীতও নয়। পার্থক্য বিপুল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. স্বপ্ন মাত্রই ভিত্তিহীন নয়। কোনও কোনও স্বপ্ন বাস্তবসম্মতও বটে।

খ. সত্য ও সঠিক স্বপ্ন দ্বারা ভবিষ্যতে ঘটবে এমন প্রীতিকর বিষয়ে সুসংবাদ দেওয়া হয় কিংবা অপ্রীতিকর বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক করা হয়।

গ. হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনও নবী নেই। ফলে তাঁর মৃত্যুতে ওহী নাযিলের ধারা সমাপ্ত হয়ে গেছে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)