রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

৩. আহার-পানীয় গ্রহণের আদব

হাদীস নং: ৭৫১
পরিচ্ছেদ: ১০ তিন আঙ্গুলে খাওয়া, আঙ্গুল চেটে খাওয়া, চাটার আগে আঙ্গুল না মোছা, পাত্র চেটে খাওয়া, যে খাবার পড়ে যায় তা তুলে খাওয়া, চেটে খাওয়ার পর সে আঙ্গুল হাতের বাহু বা পায়ে কিংবা অন্য কিছুতে মোছা
হাদীছ নং: ৭৫১
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি অবস্থায় উপস্থিত হয়। এমনকি সে তার খাওয়ার সময়ও উপস্থিত হয়। কাজেই তোমাদের কারও কোনও লোকমা পড়ে গেলে সে যেন তা তুলে নেয়। তারপর তাতে লেগে থাকা ময়লা দূর করে যেন তা খেয়ে নেয়, শয়তানের জন্য তা না রাখে। তারপর যখন খাওয়া শেষ হবে, তখন যেন তার আঙ্গুলগুলো চেটে নেয়। কেননা সে জানে না তার খাদ্যের কোন অংশে বরকত। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ২০৩৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৫৪৬৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২৮৭৭)
باب استحباب الأكل بثلاث أصابع، واستحباب لعق الأصابع، وكراهة مسحها قبل لعقها
واستحباب لعق القصعة وأخذ اللقمة الَّتي تسقط منه وأكلها، ومسحها بعد اللعق بالساعد والقدم وغيرها
751 - وعنه: أنَّ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «إنَّ الشَّيْطَانَ يَحْضُرُ أحَدَكُمْ عِنْدَ كُلِّ شَيْءٍ مِنْ شَأنِهِ، حَتَّى يَحْضُرَهُ عِنْدَ طَعَامِهِ، فإذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أحَدِكُمْ فَلْيَأخُذْهَا فَليُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أذىً، ثُمَّ لِيَأْكُلْهَا وَلاَ يَدَعْهَا للشَّيْطَانِ، فإذا فَرَغَ فَلْيَلْعَقْ أصابِعَهُ، فإنَّهُ لا يَدْري في أيِّ طعامِهِ البَرَكَةُ». رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এই হাদীসটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনা, সংক্ষিপ্ত আবার কোন কোন বর্ণনা বিস্তারিত। নিম্নে সকল বর্ণনার আলোকে ব্যাখ্যা পেশ করা হল।

বর্ণনাগুলোতে খানা খাওয়ার কয়েকটি আদব শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন-

(ক) আঙ্গুল চেটে খাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও আঙ্গুল চেটে খেতেন এবং আমাদেরকেও চেটে খাওয়ার আদেশ করেছেন।

(খ) তিনটি আঙ্গুল দিয়ে খাওয়া। আঙ্গুল তিনটি হল বৃদ্ধাঙ্গুলি, তর্জনি ও মধ্যমা। হযরত কা'ব ইবন উজরা রাযি. থেকে এক হাদীছে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন-
رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْكُلُ بِأَصَابِعِهِ الثَّلَاثِ بِالْابهَامِ، وَالَّتِي تَلِيهَا ، وَالْوُسْطَى ، ثُمَّ رَأَيْتُهُ يَلْعَقُ أَصَابِعَهُ الثَّلَاثَ قَبْلَ أَنْ يَمْسَحَهَا، وَيَلْعَقُ الْوُسْطَى، ثُمَّ الَّتِي تَلِيهَا ، ثُمَّ الْإِبْهَامَ.
‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর তিন আঙ্গুল দিয়ে খেতে দেখেছি। বৃদ্ধাঙ্গুলি, তার পাশের আঙ্গুল ও মধ্যমা। তারপর তাঁকে তাঁর আঙ্গুল তিনটি মোছার আগে চাটতে দেখেছি। প্রথমে চেটেছেন মধ্যমা, তারপর তার পাশেরটি, তারপর বৃদ্ধাঙ্গুলি।’ (তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত: ১৬৪৯; জামে' মা'মার ইবন রাশিদ: ১৯৫৫৬)

উল্লেখ্য, খাওয়ায় তিনটি আঙ্গুল ব্যবহার করা রুটি বা এরূপ শুকনো খাবারের বেলায় সহজ। ভাত জাতীয় খাবারের বেলায় এটা কঠিন। তাই সাধারণভাবে সকল খাবারে তিনটি আঙ্গুল ব্যবহার করার কথা বলাটা সঙ্গত নয়।

তবে আঙ্গুল যতটিই ব্যবহার করা হোক, খাওয়ার শেষে তা চেটে খাওয়া অবশ্যই সুন্নত। হাদীছে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তা চাটতেন। এর দ্বারা যেমন খাদ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়, তেমনি এর দ্বারা বিনয়ও প্রকাশ পায়। এতে লজ্জাবোধ করাটা অহংকারের লক্ষণ।

(গ) পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে পরিষ্কার করে খাওয়া। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِطْ عَنْهَا الْأَذى، وَلِيَأْكُلْهَا
(তোমাদের কারও লোকমা পড়ে গেলে তা থেকে ময়লা দূর করে নেবে এবং তা খেয়ে ফেলবে)। অর্থাৎ খাদ্য আল্লাহ তা'আলার নি'আমত। কাজেই প্লেট বা হাত থেকে কোনও খাবার নিচে পড়ে গেলে তা অবশ্যই তুলে খেতে হবে। এটা নি'আমতের শোকর। ফেলে রাখাটা নাশোকরি। কাজেই পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খেতে লজ্জাবোধ করতে নেই। সেটা অহমিকা। খাদ্যের ক্ষেত্রে অহমিকা দেখানো নিতান্তই নিন্দনীয়।

পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়ার হুকুম দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলেছেন যে, তাতে ময়লা লেগে থাকলে তা পরিষ্কার করে নেবে। এটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি ইসলামের বিশেষ গুরুত্বদানের প্রমান বহন করে। ইসলামে পাক-পবিত্রতার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যত্নবান থাকার প্রতিও তাগিদ রয়েছে। পড়ে যাওয়া খাদ্য যখন পরিষ্কার করে খেতে বলা হয়েছে, তখন যে-কোনও খাদ্য খাওয়ার আগেও যে তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয় তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়। খাদ্যসহ যাবতীয় বিষয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার নির্দেশনা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ রয়েছে। তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একরকম অবহেলা লক্ষ করা যায়। এটা বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়; বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুসরণে আমাদের সামগ্রিক গাফলাতিরই অংশ।

পড়ে যাওয়া খাদ্য ফেলে রাখা কিছুতেই উচিত নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ (তা শয়তানের জন্য ফেলে রাখবে না)। অর্থাৎ ফেলে রাখলে তা শয়তান খাবে। শয়তান মানুষের ঘোর শত্রু। মানুষ যখন যে হালে থাকে, তাতেই সে শরীক হয়ে মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। খাওয়ার বেলায়ও সে তাতে সচেষ্ট থাকে। কাজেই সে যাতে ক্ষতি করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। এজন্যই এ হাদীছে পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খেতে বলা হয়েছে। তা তুলে না খেলে শয়তান নিয়ে নেবে। হয় তা সে নিজে খাবে, কিংবা তা দ্বারা মানুষের কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। যদি সে নিজে খায়ও, তাও তো মু'মিনদের জন্য এক প্রকার ক্ষতিই বটে। কেননা শত্রুর খেয়ে-দেয়ে পরিপুষ্ট হওয়াটাও ক্ষতির কারণ বৈ কি।

খানা খাওয়া বা অন্য কোনও কাজের সময় শয়তানের উপস্থিতি আমরা টের না পেলেও এ হাদীছ যখন বলছে সে উপস্থিত হয়, তখন আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতেই হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত প্রতিটি কথা বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য জরুরি। আমরা দেখতে পাই না বলে সন্দেহ করার কোনও সুযোগ নেই। শয়তানকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে আমাদের কাছে থেকেও চোখের আড়াল থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ
‘সে ও তার দল এমন স্থান থেকে তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।’ (সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২৭)

(ঘ) পাত্র চেটে খাওয়া। হাদীছে বলা হয়েছে- وَأَمَرَ أَنْ تُسْلَتَ الْقَصْعَةُ (তিনি পেয়ালা চেটে খাওয়ারও আদেশ করেছেন)। পেয়ালা বলতে যে প্লেটে খাওয়া হয় কেবল সেটিই নয়; বরং খাবার বেলায় খাদ্যসামগ্রীতে যা-কিছু ব্যবহার হয় তার সবগুলোই এর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশের জন্য এর মধ্যে রয়েছে ভাত বা খিচুড়ির গামলা, তরকারির পেয়ালা ও চামচ। এর প্রত্যেকটিই ভালোভাবে পরিষ্কার করে এবং চাটার বস্তু হলে চেটে খাওয়া চাই। কেন চেটে খেতে বলা হয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فَإِنَّكُمْ لَا تَدْرُوْنَ فِي أَيِّ طَعَامِكُمُ الْبَرَكَةِ (তোমরা জান না তোমাদের খাবারের কোন অংশে বরকত থাকে)। যা খাওয়া হয়েছে তাতে, না পাত্র ও আঙ্গুলে লেগে থাকা খাদ্যে, নাকি খাদ্যের পড়ে যাওয়া অংশে। এর প্রত্যেকটিতেই বরকত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই সবটাই ভালোভাবে খেয়ে নিতে হবে। বরকত অবহেলার বিষয় নয়। তা আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমতের প্রকাশ। তা যতটা লাভ করা যায়, ততোই সৌভাগ্য। তা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের জন্যই কল্যাণকর। কাজেই কে কী বলে না বলে বা লোকে কী মনে করে না করে, তার তোয়াক্কা না করে আগ্রহের সঙ্গেই আমাদেরকে বরকত অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। সে লক্ষ্যে আঙ্গুল ও পাত্র চেটে খেতে হবে এবং নিচে পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খেয়ে নিতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. খানা খাওয়ায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়।

খ. খানা খাওয়ায় যথাসম্ভব কম আঙ্গুল ব্যবহার করা চাই। তবে তিনটির কম নয়।

গ. খাওয়ার থালা-বাসন ভালোভাবে চেটে খেতে হবে।

ঘ. খাওয়া শেষ হলে হাত মোছা বা ধোওয়ার আগে আঙ্গুলসমূহ ভালোভাবে চেটে নেওয়া উচিত।

ঙ. খাদ্যেও বরকত আছে। সুন্নত মোতাবেক খাওয়ার দ্বারাই সে বরকতলাভ সম্ভব।

চ. খাদ্যেও শয়তান শরীক থাকার চেষ্টা করে। সে যাতে তাতে সক্ষম না হয় সেজন্য সুন্নত মোতাবেক খাওয়া উচিত।

ছ. আঙ্গুল ও পাত্র চেটে খাওয়া এবং পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া যখন সুন্নত, তখন লোকে কী না কী বলে তার তোয়াক্কা না করে গৌরবের সঙ্গেই এ সুন্নতটি পালন করতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৭৫১ | মুসলিম বাংলা