রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৬০৮
অধ্যায় : ৭১ মুমিনদের প্রতি বিনয় ও নম্রতাপূর্ণ আচরণ।
খানা খাওয়ার কয়েকটি সুন্নত
হাদীছ নং: ৬০৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ এমন কোনও নবী পাঠাননি, যিনি ছাগল চরাননি। সাহাবীগণ বললেন, আপনিও? তিনি বললেন, হাঁ, আমি মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম কয়েক কীরাতের বিনিময়ে। -বুখারী
(সহীহ বুখারী: ২২৬২; সুনানে ইবন মাজাহ: ২১৪৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ২১৮৬; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা : ১১৬৪১)
71 - باب التواضع وخفض الجناح للمؤمنين
608 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - عن النبيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «مَا بَعَثَ الله نَبِيًّا إِلاَّ رَعَى الغَنَمَ» قَالَ أصْحَابُهُ: وَأنْتَ؟ فَقَالَ: «نَعَمْ، كُنْتُ أرْعَاهَا عَلَى قَرَارِيطَ لأَهْلِ مَكَّةَ». رواه البخاري. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে জানানো হয়েছে যে, সব নবী-রাসূলই ছাগল চরিয়েছেন। সকলেই যখন চরিয়েছেন, এর দ্বারা বোঝা যায় যে, তাঁদের জন্য আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কেন এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? উলামায়ে কেরাম বলেন, নবুওয়াতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া অনেক কঠিন কাজ। নবীগণকে মানুষের মধ্যে দাওয়াতী দায়িত্ব পালন করতে হয়। দাওয়াত দিতে গেলে মানুষের পক্ষ থেকে নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। কেউ সহজে সাড়া দেয়, কেউ উল্টো তাড়া দেয়, কাউকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয়, কেউ বা কূটতর্ক জুড়ে দেয়। যারা সাড়া দেয় না, তাদের অনেকে ঘোর শত্রুও হয়ে যায়। সাড়া দানকারীদের মধ্যে নানা স্বভাব-চরিত্রের মানুষ থাকে। তাদেরকে নিয়ে একসঙ্গে চলা খুব সহজ কথা নয়। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে তাঁর অনুসারীগণ বিভিন্ন সময় কেমন কেমন আচরণ করেছে, কুরআন মাজীদে তা তুলে ধরা হয়েছে। সেরকম আচরণ কিছু না কিছু সব নবীর সঙ্গেই করা হয়েছে। অসামান্য ধৈর্য ও নেতৃত্বগুণ ছাড়া এরূপ ক্ষেত্রে সকলকে নিয়ে চলা সম্ভব হয় না। এর জন্য আগে থেকেই প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন হয়। ছাগল চরানো মূলত সে প্রশিক্ষণেরই এক ব্যবস্থা। ছাগল খুবই উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির হয়ে থাকে। আবার প্রাণীটি শারীরিকভাবে খুব দুর্বল। ছোটখাটো হওয়ায় বাঘ-সিংহ তো বটেই, কুকুর-নেকড়েরও শিকার হয়ে যায়। সহজে চুরিও হয়ে যায়। প্রাণীটি শীত ও তাপেও খুব কাবু হয়ে যায়। তাই এর রাখালি করা বড় বড় গবাদি পশুর রাখালি অপেক্ষা অনেক কঠিন। এর জন্য অনেক ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রয়োজন। প্রয়োজন সতর্ক দৃষ্টির। নিজ মেযাজ-মর্জির অনেক কুরবানী দেওয়ার দরকার হয়। একটা সময় পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করতে থাকলে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, বিনয়, নম্রতা, পরিশ্রম ও কষ্টসহিষ্ণুতা, সতর্কতা এবং ত্যাগ ও কুরবানীর ভালো প্রশিক্ষণ হয়, যা কিনা একজন নবীর আপন উম্মতের পরিচালনা জন্য খুবই জরুরি। সম্ভবত এ লক্ষ্যেই তাদেরকে দিয়ে এ কাজ করানো হয়েছে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা তাঁকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছেন। তিনি আবার নিজে এ কথা স্বীকারও করেছেন। এটা তাঁর পরম বিনয়ের পরিচায়ক। সেইসঙ্গে তাঁর পক্ষ থেকে এটা আল্লাহ তা'আলার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। যেন বোঝাচ্ছেন, একসময় আমাকে বকরি চরিয়ে জীবিকা উপার্জন করতে হয়েছে। আর আজ আল্লাহ তা'আলা আমাকে কোথায় পৌঁছিয়ে দিয়েছেন! তিনি ছিলেন সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে মদীনার বাদশা বানিয়েছিলেন। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে যাঁকে একদিন ছাগল চরাতে হয়েছিল, আজ সমগ্র আরব তাঁর পবিত্র পদযুগলে নিবেদিত, তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় লক্ষপ্রাণ কুরবান যেতে প্রস্তুত। একদিন যাঁর নিজের ক্ষুধা নিবারণ ছিল অনেক কষ্টের, আজ তিনি আরবের ঘরে ঘরে খাদ্য বিতরণ করছেন।

قراريط (কারারীত) শব্দটি قيراط-এর বহুবচন। দিরহাম ও দীনারের অংশবিশেষকে কীরাত বলে। এক কীরাত সমান ১.৮ রতি = ০.২১৮৭ গ্রাম।

কারও কারও মতে কারারীত মক্কা মুকাররামার একটি চারণক্ষেত্রের নাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই চারণক্ষেত্রে ছাগল চরিয়েছিলেন। ইবন নাসির রহ., ইবনুল জাওযী রহ. প্রমুখ এ মতকেই সঠিক বলেছেন। কিন্তু মক্কাবাসীদের কাছে এরূপ নামের কোনও স্থান পরিচিত নয় বলে অনেকে এ মত প্রত্যাখ্যানও করেছেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ছাগল একটি বরকতপূর্ণ পশু। এর প্রতিপালনকে তুচ্ছ মনে করতে নেই।

খ. নিজ অতীত কষ্ট-ক্লেশের কথা প্রকাশ করাতে কোনও লজ্জা নেই; বরং এটা এক রকম শোকরগুযারী বটে।

গ. বর্তমান সুখ-সাচ্ছন্দ্যের কারণে অতীত অবস্থা ভুলে যেতে নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৬০৮ | মুসলিম বাংলা