রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৫৮৭
ভূমিকা অধ্যায়
পরহেযগারী অবলম্বন ও সন্দেহযুক্ত বিষয়াবলি পরিহার
الْوَرَعُ এর অর্থ পরিহার করা, ক্ষতিকর বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। الشُّبُهَاتُ শব্দটি شبهة এর বহুবচন। এর অর্থ সন্দেহযুক্ত বিষয়। অর্থাৎ এমন বিষয়, যা হালাল না হারাম, বৈধ না অবৈধ তা স্পষ্ট নয়। এরূপ বিষয় পরিহার করাকে الْوَرَعُ বলা হয়। শব্দটি 'তাকওয়া'-এর সমার্থবোধক। তাকওয়ার বিভিন্ন স্তর আছে। এর সাধারণ স্তর হল হারাম ও নাজায়েয বিষয়াবলি থেকে বেঁচে থাকা। মধ্যম স্তর হল সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। সাধারণত এ স্তরের তাকওয়াকে اَلْوَرَعُ বলা হয়। তাকওয়া ও الْوَرَعُ এর সর্বোচ্চ স্তর হল এমনসব বিষয় পরিহার করা, যা দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট করে।
উলামায়ে কেরাম বিভিন্নভাবে اَلْوَرَعُ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইয়াহইয়া ইবন মু‘আয রাযী রহ. বলেন, ওয়ারা‘ (اَلْوَرَعْ) হল কোনওরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া জ্ঞানের সীমারেখায় থেমে যাওয়া। এটা দু'প্রকার- প্রকাশ্য ওয়ারা‘ ও গুপ্ত ওয়ারা‘। প্রকাশ্য ওয়ারা‘ হল যাবতীয় নড়াচড়া কেবল আল্লাহরই জন্য হওয়া। আর গুপ্ত ওয়ারা‘ হল অন্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্যকিছুর স্থান না দেওয়া।
ইয়ূনুস ইবন উবায়দ রহ. বলেন, যে-কোনও সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে দূরে থাকা এবং প্রতিটি পলকে নিজের হিসাব নেওয়াকে ওয়ারা‘ বলা হয়।
সুফয়ান ছাওরী রহ. বলেন, ওয়ারা‘র চেয়ে সহজ জিনিস দেখিনি। তোমার মনে যা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় তা ছেড়ে দাও। ব্যস এটাই ওয়ারা‘।
হাসান বসরী রহ. তাঁর এক গোলামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দীনের নিয়ন্ত্রক বস্তু কী? গোলাম বলল, ওয়ারা‘। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর আপদ কী? সে বলল, লোভ। হাসান বসরী রহ. তার এ কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
ব্যক্তিজীবন গঠনে ওয়ারা‘র বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এর দ্বারা মানুষের দীন ও ঈমানের হেফাজত হয়। বাঁচা যায় সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে। যার মধ্যে এ গুণ আছে, তার দ্বারা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সৎকর্ম হয়ে থাকে। এমনকি এর দ্বারা মানুষের ইজ্জত-সম্মানও রক্ষা পায়। ওয়ারা‘র অধিকারী ব্যক্তি কখনও এমন কোনও কাজ করবে না, যা দ্বারা আত্মসম্মান নষ্ট হয়। সে কেবল মুমিন-মুসলিমের কাছেই নয়; বরং সমস্ত মানুষ এমনকি দুই কাঁধের ফিরিশতাসহ অন্য সকল ফিরিশতা ও কুলমাখলুকের কাছে আত্মসম্মান রক্ষায় যত্নবান থাকবে। সে প্রতিটি কাজ করবে আল্লাহ তা'আলাকে হাজির- নাজির জেনে। এরূপ ব্যক্তির পক্ষে কি আদৌ গুনাহ করা সম্ভব? সে তো বেশি বেশি নেককাজই করবে। তার সমগ্র জীবন নিবেদিত থাকবে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায়।
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাক্যের মধ্যে ওয়ারা‘র যাবতীয় বিষয় নিয়ে এসেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ
ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা-কিছু অনর্থক তা ছেড়ে দেওয়া।(জামে' তিরমিযী: ২৩১৭; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৭৬)
সুতরাং অনর্থক কথা, অনর্থক দেখা, অনর্থক শোনা, অনর্থক ধরা, অনর্থক চলা, অনর্থক চিন্তা করা, এমনিভাবে প্রকাশ্য ও গুপ্ত অনর্থক যা-কিছু আছে তা সবই পরিহার করতে হবে। এটাই পূর্ণাঙ্গ ওয়ারা‘। এর দ্বারা একজন মুসলিমের ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়। এর দ্বারা ব্যক্তি একজন সুন্দর ও সত্যিকারের মুসলিম হয়।
সারকথা, ইসলামে ওয়ারা‘ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। আমাদের প্রত্যেকেরই এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। কুরআন মাজীদের বহু আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপুল হাদীছে এর প্রতি উৎসাহদান করা হয়েছে। ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে তার কয়েকটি উদ্ধৃত করেছেন। আমরা সেগুলোর বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘পরহেযগারী অবলম্বন…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (15)
অর্থ: আর তোমরা এ ব্যাপারটাকে মামুলি মনে করছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৫)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা নূরের ১৫ নং আয়াতের একটি অংশ। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (15)
‘যখন তোমরা নিজ রসনা দ্বারা তা একে অন্যের থেকে প্রচার করছিলে এবং নিজ মুখে এমন কথা বলছিলে, যে সম্পর্কে তোমাদের কিছু জানা নেই আর তোমরা এ ব্যাপারটাকে মামুলি মনে করছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর।’
এ আয়াত এবং এর আগের ও পরের কয়েকটি আয়াতের সম্পর্ক ‘ইফক’-এর ঘটনার সঙ্গে। ‘ইফক’-এর অর্থ অপবাদ দেওয়া, বিশেষত কোনও চরিত্রবতী নারীর চরিত্র সম্পর্কে নোংরা অপবাদ দেওয়া। একদল মুনাফিক উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. সম্পর্কে এরূপ অপবাদ দিয়েছিল। সে অপবাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সূরা নূরের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল হয়। তা দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, মুনাফিকদের রটনা সম্পূর্ণই মিথ্যা এবং আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. সর্বোচ্চ স্তরের একজন পূতঃপবিত্র চরিত্রের মহিয়সী নারী। নিচে ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া গেল।
‘ইফক’-এর ঘটনা
মদীনা মুনাউওয়ারায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের পর ইসলামের ক্রমবিস্তারে যে গতি সঞ্চার হয়, তা দেখে কুফরী শক্তি ক্ষোভে-আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করছিল। কাফেরদের মধ্যে একদল ছিল মুনাফিক, যারা মুখে মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তাদের অন্তর ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিদ্বেষে ভরা। তাদের সার্বক্ষণিক চেষ্টা ছিল কীভাবে মুসলিমদের বদনাম করা যায় এবং কী উপায়ে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা যায়। খোদ মদীনা মুনাউওয়ারার ভেতরই তাদের একটি বড়সড় দল বাস করত।
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনুল মুস্তালিকের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালান। সে অভিযানে মুনাফিকদের একটি দলও অংশগ্রহণ করেছিল। উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. এ যুদ্ধে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। যুদ্ধে বনুল মুস্তালিক পরাজিত হয়। তারপর নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধবন্দী ও গনীমতের মালামাল নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।
ফেরার পথে এক জায়গায় বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে হযরত আয়েশা রাযি. প্রয়োজন সারার জন্য খানিকটা দূরে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর দেখেন গলার হারটি সঙ্গে নেই। তিনি সেটির খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে কথা জানা ছিল না। তিনি যথাসময়ে সৈন্যদেরকে রওয়ানা হওয়ার হুকুম দিলেন। সবাই প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হয়ে পড়লেন। ওদিকে হযরত আয়েশা রাযি. হার খোঁজায় ব্যস্ত। তিনি ফিরে এসে দেখেন কাফেলা চলে গেছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ সংযমশক্তি দিয়েছিলেন। তিনি অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি না করে সেখানেই বসে থাকলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন টের পাবেন তিনি কাফেলায় নেই, তখন হয় নিজেই তাঁর খোঁজে এখানে আসবেন অথবা অন্য কাউকে পাঠাবেন।
যে-কোনও সফর থেকে ফেরার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে কাফেলার পেছনে রেখে আসতেন। সেই ব্যক্তির কাজ ছিল কাফেলা চলে যাওয়ার পর কেউ কোনওকিছু ফেলে গেল কি না তার খোঁজ নেওয়া। এ কাফেলায় এ কাজের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সাফওয়ান ইবন মুআত্তাল রাযি.-কে। তিনি খোঁজ নিতে গিয়ে যখন হযরত আয়েশা রাযি. যেখানে ছিলেন সেখানে পৌঁছলেন, তখন চমকে উঠলেন। বুঝতে দেরি হল না কী ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কালবিলম্ব না করে নিজের উটটি হযরত উম্মুল মুমিনীনের সামনে পেশ করলেন। তারপর নিজে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ালেন। উম্মুল মুমিনীন রাযি. দ্রুত তাতে সওয়ার হলেন। সাফওয়ান রাযি. সেটির লাগাম ধরে মদীনা মুনাউওয়ারায় নিয়ে আসলেন।
মুনাফিকরা তো সর্বদাই সুযোগের সন্ধানে থাকত। তাদের সর্দার আবদুল্লাহ ইবন উবাঈ এ ঘটনা জানতে পেরে তাদের দুরভিসন্ধি পূরণের একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে সম্পূর্ণ অপবাদমূলক উক্ত ঘটনার প্রচারে লেগে গেল। সে ছিল বড়ই নীচ মানসিকতার লোক। আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় এ মায়ের প্রতি এমনই ন্যাক্কারজনক অপবাদ দিল, যা কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুসলিমের পক্ষে কিছুতেই উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। আবদুল্লাহ ইবন উবাঈ এ অপবাদকে এতটাই প্রসিদ্ধ করে তুলল যে, জনাকয়েক সরলমতি মুসলিমও তার প্রচারণার ফাঁদে পড়ে গেল। মুনাফিক শ্রেণি বেশ মাথামুণ্ডুহীন বিষয় নিয়ে মেতে রইল। পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলল। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কিন্তু এসবের কিছুই জানা ছিল না। তিনি জানতে পারেন অনেক দিন পর। জানার পর শোক ও দুঃখে তাঁর কী যে অবস্থা হয়েছিল, অন্য কারও পক্ষে তা কতটুকু অনুভব করা সম্ভব? দিনের পর দিন কান্নার মধ্যেই কাটছিল। চোখে কোনও ঘুম ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার পিতা-মাতা মনে করছিলেন কান্নার কারণে আমার কলিজা বুঝি ফেটে যাবে। এভাবে একমাস পার হয়ে গেল। আম্মাজান রাযি.-এর শরীর একদম ভেঙে পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু ছিল না। এর ভেতর নানারকম ঘটনা ঘটল। হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহে তা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
পরিশেষে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সিদ্দীকা রাযি. -এর শিয়রে এসে বসলেন। কিছু কথাবার্তা হল। এরই ভেতর ওহী নাযিলের ভাব তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেল। মুহূর্তের মধ্যে আচ্ছন্নতার ভাব কেটে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস ফুটে উঠল। তিনি সর্বপ্রথম যে কথা উচ্চারণ করলেন তা ছিল- সুসংবাদ নাও হে আয়েশা! আল্লাহ তা'আলা তোমার পবিত্রতা প্রকাশ করেছেন। এ সময় সূরা নূরের ১১ থেকে ২৬ নং পর্যন্ত মোট ১৬টি আয়াত নাযিল হয়। এর দ্বারা একদিকে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর চারিত্রিক নির্মলতার পক্ষে ঐশী সনদ দিয়ে দেওয়া হয়, অন্যদিকে যারা চক্রান্তটির রুই-কাতলা ছিল তাদেরকে দেওয়া হয় কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারী বার্তা।
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমার বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই আমার পবিত্রতা ঘোষণা করবেন, যেহেতু আরোপিত অপবাদ থেকে আমি ছিলাম সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। কিন্তু আমার সম্পর্কে যে ওহী নাযিল হবে, যা কিনা মানুষ তিলাওয়াত করবে, এরকম ধারণা আমার ছিল না। কেননা আমার দৃষ্টিতে সে তুলনায় আমার অবস্থা তো অতি নগণ্য। আমার আশা ছিল কেবল এতটুকুই যে, আল্লাহ তা'আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনও স্বপ্ন দেখাবেন এবং তার মাধ্যমে আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন।
এক হাদীছে আছে, আল্লাহ তা'আলা যার মঙ্গল কামনা করেন, তাকে বিপদ-আপদে আক্রান্ত করেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদের এ মহিয়সী মা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর মঙ্গল চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে ‘ইফক’-এর মতো এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছিলেন। একজন চরিত্রবতী নারীর পক্ষে এরচে' বড় কোনও বিপদ হতে পারে না। সে বিপদে তিনি সবর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর সুফলও পেয়েছেন অভাবনীয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর চরিত্রের পক্ষে ওহীর সনদ দিয়ে দিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ কুরআন মাজীদে তাঁর সে চারিত্রিক সার্টিফিকেট পাঠ করতে থাকবে। আর জগতের সর্বত্র ধ্বনিত হতে থাকবে তাঁর চারিত্রিক পবিত্রতার মহিমা। এ তো তাঁর পার্থিব পুরস্কার। আর আখিরাতে এর জন্য তিনি যে অকল্পনীয় পুরস্কার পাবেন সে তো রয়েছেই।
‘ইফক’-এর ঘটনা সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ওইসকল সরলপ্রাণ মুসলিমদের তিরস্কার করেছেন, যারা মুনাফিকদের প্রচারণার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাদের লক্ষ্য করে বলেন-
إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ (যখন তোমরা নিজ রসনা দ্বারা তা একে অন্যের থেকে প্রচার করছিলে)। অর্থাৎ তোমরা একে অন্যকে অপবাদের সে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলে এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছাচ্ছিলে। তাদের কারও সঙ্গে যখন কারও সাক্ষাৎ হতো তখন বলত, আমার কাছে এই এই খবর পৌছেছে বা আমি এই এই শুনেছি। তুমি কি তা শুনেছ? তুমি এ বিষয়ে কী জান? এর বাস্তবতা কতটুকু?
وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ (এবং নিজ মুখে এমন কথা বলছিলে, যে সম্পর্কে তোমাদের কিছু জানা নেই)। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মুখে এমন বিষয়ে কথা বলছিলে, যার বাস্তব কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তোমরা পরস্পর যা নিয়ে কথা বলছিলে, সে সম্পর্কে তোমাদের কোনও জ্ঞান ছিল না, তা থাকতেও পারে না। কেননা কোনও বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য তার বাস্তব অস্তিত্ব তো থাকতে হবে! মুনাফিকরা যা রটনা করছিল, তার তো কোনও বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। তার পুরোটাই ছিল নির্জলা অপবাদ, সম্পূর্ণ মিথ্যা।
উল্লেখ্য, খাঁটি মুমিনদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যকই মুনাফিকদের প্রচারণার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ সাহাবীই তাদের কথায় বিশ্বাস করেননি। একবার হযরত আবু আইয়ূব আনসারী রাযি. ঘরে আসলে তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, আপনি কি শুনেছেন লোকে আয়েশা সম্পর্কে কি কি সব কথা বলে? তিনি উত্তর দিলেন, ওরা সব মিথ্যুক। হে আইয়ুবের মা! তুমি কি এরূপ কাজ করতে পারবে? উত্তরে বললেন, কখনওই নয়। হযরত আবু আইয়ূব রাযি. বললেন, আয়েশা তো তোমার চেয়ে বেশি পবিত্র ও উত্তম (তাঁর পক্ষে এটা কী করে করা সম্ভব?)।
وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا (আর তোমরা এ ব্যাপারটাকে মামুলি মনে করছিলে)। এর দু'টি অর্থ হতে পারে। এক অর্থ এই যে, তোমরা অপবাদের ঘটনাটিকে তুচ্ছ বিষয় মনে করছিলে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, তোমরা অপবাদের প্রচারণাকে তুচ্ছ কাজ মনে করছিলে। তার পরিণতি কত মন্দ ও কত ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্পর্কে তোমাদের ধারণা ছিল না, যে কারণে তোমরা অবলীলায় পরস্পর তা বলাবলি করছিলে। তোমাদের উচিত ছিল তাতে একদম কান না দেওয়া। এমনকি উচিত ছিল তার প্রতিবাদ করা। যেমন পরে এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ قُلْتُمْ مَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهَذَا سُبْحَانَكَ هَذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ (16)
‘তোমরা যখন এ কথা শুনেছিলে তখনই কেন বলে দিলে না- এ কথা মুখে আনার কোনও অধিকার আমাদের নেই; হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র। এটা তো মারাত্মক অপবাদ।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৬)
وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর)। অর্থাৎ অন্যের নামে অপবাদ দেওয়া বা অপবাদের ঘটনা প্রচার করে বেড়ানো আল্লাহ তা'আলার কাছে গুরুতর অপরাধ এবং কঠিন শাস্তির কারণ। কোনও চরিত্রবতী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা যে কী কঠিন পাপ, সে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেন-
«اجْتَنِبُوا السَّبْعَ المُوبِقَاتِ» ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: «الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ اليَتِيمِ، وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ المُحْصَنَاتِ المُؤْمِنَاتِ الغَافِلاَتِ»
‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে বেঁচে থেকো। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলো কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা; জাদুটোনা করা; আল্লাহ যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করা, তবে ন্যায়ানুগভাবে হলে ভিন্ন কথা; সুদ খাওয়া; এতিমের মাল গ্রাস করা, যুদ্ধের দিনে পলায়ন করা এবং চরিত্রবতী সরলা মুমিন নারীর চরিত্রে অপবাদ দেওয়া।(সহীহ বুখারী: ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম: ৭৯; সুনানে নাসাঈ ৩৬৭১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৫৫৬১; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৮৯৪; শু'আবুল ঈমান: ২৮০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪৫)
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ قَذْفَ الْمُحْصَنَةِ يَهْدِمُ عَمَلَ مِائَةِ سَنَةٍ
‘চরিত্রবতী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ একশ বছরের আমল ধ্বংস করে দেয়।(হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ৮৭১২; মুসনাদুল বাযযার: ১০৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর: ৩০২৩
هو ضعيف مرفوعا، قال البزار: هذا الحديث لا نعلم أحدا أسنده إلا ليث (هو ابن أبي سليم)، ولا عن ليث إلا موسى بن أعين، وقد رواه جماعة عن أبي إسحاق عن صلة، عن حذيفة موقوفا اهـ (المحرر)
সাধারণ কোনও মুমিন চরিত্রবতী নারীর প্রতি কলঙ্ক আরোপ যদি এত বড় কঠিন পাপ হয়, তবে চিন্তা করা যায় এরূপ কলঙ্ক আরোপ যদি করা হয় আল্লাহ তা'আলার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন স্ত্রীর প্রতি, আবার নিজেদের মধ্যে তার প্রচারণাও চালানো হয়, তবে তার ভয়াবহতা কত কঠিন হয়? কেননা তা দ্বারা কেবল নবীপত্নিরই সম্মানহানি হয় না; স্বয়ং নবীরও অসম্মান হয়। এখানে তো রয়েছেন সকল নবী-রাসূলের সেরা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তাঁর এ স্ত্রীও হলেন সেই মহিয়সী নারী, যাঁর সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন-
فضلَ عائشةَ على النِّساءِ ، كفضل الثَّريدِ على سائرِ الطَّعامِ
‘সমস্ত নারীর উপর আয়েশার শ্রেষ্ঠত্ব সমস্ত খাদ্যের উপর ছারীদের শ্রেষ্ঠত্বের মতো।(সহীহ বুখারী: ৩৪১১; সহীহ মুসলিম: ২৪৩১; জামে তিরমিযী: ৩৮৮৭; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩২৮০; সুনানে নাসাঈ ৩৯৪৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩২২৮১; সুনানে দারিমী: ২১১৩)
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতটা প্রিয় ছিলেন তা এর দ্বারা অনুমান করা যায় যে, একদিন তিনি তাঁর সামনে আদরের কন্যা হযরত ফাতিমা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
أَي بُنَيَّةُ أَلَسْت تُحِبّينَ مَا أُحِبُّ ؟ فَقَالَتْ : بَلَى ، قَالَ : فَأَحِبِّي هَذِهِ
‘প্রিয় কন্যা! আমি যাকে ভালোবাসি, তুমি কি তাকে ভালোবাস না? তিনি বললেন, অবশ্যই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তুমি একে ভালোবেসো।(সহীহ বুখারী: ২৫৮১; সহীহ মুসলিম: ২৪৪২; সুনানে নাসাঈ: ৩৯৪৪)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. নির্দোষ ব্যক্তির উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া কঠিন পাপ।
খ. কেউ কারও উপর ব্যভিচারের অপবাদ দিলে তাতে কর্ণপাত করতে নেই।
দুই নং আয়াত
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ
অর্থ: নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সকলের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।(সূরা ফাজর (৮৯), আয়াত ১৪)
ব্যাখ্যা
الْمِرْصَاد অর্থ ঘাঁটি, চৌকি, যেখানে প্রহরী বা সৈন্য ঘাপটি মেরে থাকে। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হয়- তোমার প্রতিপালক ঘাঁটিতে আছেন। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি বান্দার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। বান্দার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত- আনুগত্য করা। বান্দা সে কর্তব্য পালন করছে কি না, তিনি সেদিকে লক্ষ রাখেন। তাঁর জ্ঞান সর্বব্যাপী। কোনওকিছুই তাঁর অগোচরে থাকে না। ঘাঁটিতে অবস্থানকারী প্রহরীকে যেমন কেউ ফাঁকি দিয়ে যেতে পারে না, তেমনি আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টিকেও কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। সুতরাং তিনি মানুষকে তাদের কর্ম অনুযায়ী পরিপূর্ণ প্রতিদান দেবেন। কিন্তু মানুষ বড় গাফেল। দুনিয়ার ভোগ-আসক্তিতেই মত্ত। আখিরাত সম্পর্কে একদম চিন্তা করছে না। এ মত্ততা পরিহার করে তাদের সতর্ক ও সচেতন হয়ে যাওয়া উচিত। আর সে সচেতনতার দাবি তারা সবরকম পাপকর্ম ছেড়ে দেবে। পাপকর্ম তো করবেই না, এমনকি যেসব কাজ সন্দেহপূর্ণ, জায়েযও হতে পারে নাজায়েযও হতে পারে, তা করলে গুনাহ হওয়ারও আশঙ্কা আছে, তা থেকেও বেঁচে থাকবে। এরূপ কাজ থেকে বেঁচে থাকাকে পরহেযগারী বলে। আল্লাহ তা'আলার ভয় যার মধ্যে পুরোপুরি আছে, সে দুনিয়ায় যতদিন বেঁচে থাকবে, পরহেযগার হয়েই থাকবে। এটাই এ আয়াতের বার্তা।
আয়াতটির শিক্ষা
আমরা সর্বক্ষণ আল্লাহ তা'আলার সতর্কদৃষ্টির মধ্যে রয়েছি। সুতরাং কোনও অবস্থায়ই আমরা তাঁর অবাধ্যতা করব না। এমনকি যে কাজে অবাধ্যতা বা পাপের আশঙ্কা থাকে, তাও পরিহার করে চলব। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দিন।
الْوَرَعُ এর অর্থ পরিহার করা, ক্ষতিকর বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। الشُّبُهَاتُ শব্দটি شبهة এর বহুবচন। এর অর্থ সন্দেহযুক্ত বিষয়। অর্থাৎ এমন বিষয়, যা হালাল না হারাম, বৈধ না অবৈধ তা স্পষ্ট নয়। এরূপ বিষয় পরিহার করাকে الْوَرَعُ বলা হয়। শব্দটি 'তাকওয়া'-এর সমার্থবোধক। তাকওয়ার বিভিন্ন স্তর আছে। এর সাধারণ স্তর হল হারাম ও নাজায়েয বিষয়াবলি থেকে বেঁচে থাকা। মধ্যম স্তর হল সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। সাধারণত এ স্তরের তাকওয়াকে اَلْوَرَعُ বলা হয়। তাকওয়া ও الْوَرَعُ এর সর্বোচ্চ স্তর হল এমনসব বিষয় পরিহার করা, যা দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট করে।
উলামায়ে কেরাম বিভিন্নভাবে اَلْوَرَعُ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইয়াহইয়া ইবন মু‘আয রাযী রহ. বলেন, ওয়ারা‘ (اَلْوَرَعْ) হল কোনওরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া জ্ঞানের সীমারেখায় থেমে যাওয়া। এটা দু'প্রকার- প্রকাশ্য ওয়ারা‘ ও গুপ্ত ওয়ারা‘। প্রকাশ্য ওয়ারা‘ হল যাবতীয় নড়াচড়া কেবল আল্লাহরই জন্য হওয়া। আর গুপ্ত ওয়ারা‘ হল অন্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্যকিছুর স্থান না দেওয়া।
ইয়ূনুস ইবন উবায়দ রহ. বলেন, যে-কোনও সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে দূরে থাকা এবং প্রতিটি পলকে নিজের হিসাব নেওয়াকে ওয়ারা‘ বলা হয়।
সুফয়ান ছাওরী রহ. বলেন, ওয়ারা‘র চেয়ে সহজ জিনিস দেখিনি। তোমার মনে যা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় তা ছেড়ে দাও। ব্যস এটাই ওয়ারা‘।
হাসান বসরী রহ. তাঁর এক গোলামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, দীনের নিয়ন্ত্রক বস্তু কী? গোলাম বলল, ওয়ারা‘। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এর আপদ কী? সে বলল, লোভ। হাসান বসরী রহ. তার এ কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
ব্যক্তিজীবন গঠনে ওয়ারা‘র বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এর দ্বারা মানুষের দীন ও ঈমানের হেফাজত হয়। বাঁচা যায় সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে। যার মধ্যে এ গুণ আছে, তার দ্বারা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সৎকর্ম হয়ে থাকে। এমনকি এর দ্বারা মানুষের ইজ্জত-সম্মানও রক্ষা পায়। ওয়ারা‘র অধিকারী ব্যক্তি কখনও এমন কোনও কাজ করবে না, যা দ্বারা আত্মসম্মান নষ্ট হয়। সে কেবল মুমিন-মুসলিমের কাছেই নয়; বরং সমস্ত মানুষ এমনকি দুই কাঁধের ফিরিশতাসহ অন্য সকল ফিরিশতা ও কুলমাখলুকের কাছে আত্মসম্মান রক্ষায় যত্নবান থাকবে। সে প্রতিটি কাজ করবে আল্লাহ তা'আলাকে হাজির- নাজির জেনে। এরূপ ব্যক্তির পক্ষে কি আদৌ গুনাহ করা সম্ভব? সে তো বেশি বেশি নেককাজই করবে। তার সমগ্র জীবন নিবেদিত থাকবে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায়।
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বাক্যের মধ্যে ওয়ারা‘র যাবতীয় বিষয় নিয়ে এসেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ
ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা-কিছু অনর্থক তা ছেড়ে দেওয়া।(জামে' তিরমিযী: ২৩১৭; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৭৬)
সুতরাং অনর্থক কথা, অনর্থক দেখা, অনর্থক শোনা, অনর্থক ধরা, অনর্থক চলা, অনর্থক চিন্তা করা, এমনিভাবে প্রকাশ্য ও গুপ্ত অনর্থক যা-কিছু আছে তা সবই পরিহার করতে হবে। এটাই পূর্ণাঙ্গ ওয়ারা‘। এর দ্বারা একজন মুসলিমের ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়। এর দ্বারা ব্যক্তি একজন সুন্দর ও সত্যিকারের মুসলিম হয়।
সারকথা, ইসলামে ওয়ারা‘ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। আমাদের প্রত্যেকেরই এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। কুরআন মাজীদের বহু আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপুল হাদীছে এর প্রতি উৎসাহদান করা হয়েছে। ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে তার কয়েকটি উদ্ধৃত করেছেন। আমরা সেগুলোর বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
‘পরহেযগারী অবলম্বন…’ সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (15)
অর্থ: আর তোমরা এ ব্যাপারটাকে মামুলি মনে করছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৫)
ব্যাখ্যা
এটি সূরা নূরের ১৫ নং আয়াতের একটি অংশ। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (15)
‘যখন তোমরা নিজ রসনা দ্বারা তা একে অন্যের থেকে প্রচার করছিলে এবং নিজ মুখে এমন কথা বলছিলে, যে সম্পর্কে তোমাদের কিছু জানা নেই আর তোমরা এ ব্যাপারটাকে মামুলি মনে করছিলে, অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর।’
এ আয়াত এবং এর আগের ও পরের কয়েকটি আয়াতের সম্পর্ক ‘ইফক’-এর ঘটনার সঙ্গে। ‘ইফক’-এর অর্থ অপবাদ দেওয়া, বিশেষত কোনও চরিত্রবতী নারীর চরিত্র সম্পর্কে নোংরা অপবাদ দেওয়া। একদল মুনাফিক উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাযি. সম্পর্কে এরূপ অপবাদ দিয়েছিল। সে অপবাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সূরা নূরের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল হয়। তা দ্বারা স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে, মুনাফিকদের রটনা সম্পূর্ণই মিথ্যা এবং আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. সর্বোচ্চ স্তরের একজন পূতঃপবিত্র চরিত্রের মহিয়সী নারী। নিচে ঘটনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া গেল।
‘ইফক’-এর ঘটনা
মদীনা মুনাউওয়ারায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের পর ইসলামের ক্রমবিস্তারে যে গতি সঞ্চার হয়, তা দেখে কুফরী শক্তি ক্ষোভে-আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করছিল। কাফেরদের মধ্যে একদল ছিল মুনাফিক, যারা মুখে মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তাদের অন্তর ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিদ্বেষে ভরা। তাদের সার্বক্ষণিক চেষ্টা ছিল কীভাবে মুসলিমদের বদনাম করা যায় এবং কী উপায়ে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা যায়। খোদ মদীনা মুনাউওয়ারার ভেতরই তাদের একটি বড়সড় দল বাস করত।
হিজরী ৬ষ্ঠ সনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনুল মুস্তালিকের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালান। সে অভিযানে মুনাফিকদের একটি দলও অংশগ্রহণ করেছিল। উন্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. এ যুদ্ধে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন। যুদ্ধে বনুল মুস্তালিক পরাজিত হয়। তারপর নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধবন্দী ও গনীমতের মালামাল নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।
ফেরার পথে এক জায়গায় বিশ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে হযরত আয়েশা রাযি. প্রয়োজন সারার জন্য খানিকটা দূরে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর দেখেন গলার হারটি সঙ্গে নেই। তিনি সেটির খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে কথা জানা ছিল না। তিনি যথাসময়ে সৈন্যদেরকে রওয়ানা হওয়ার হুকুম দিলেন। সবাই প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হয়ে পড়লেন। ওদিকে হযরত আয়েশা রাযি. হার খোঁজায় ব্যস্ত। তিনি ফিরে এসে দেখেন কাফেলা চলে গেছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ সংযমশক্তি দিয়েছিলেন। তিনি অস্থির হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি না করে সেখানেই বসে থাকলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন টের পাবেন তিনি কাফেলায় নেই, তখন হয় নিজেই তাঁর খোঁজে এখানে আসবেন অথবা অন্য কাউকে পাঠাবেন।
যে-কোনও সফর থেকে ফেরার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে কাফেলার পেছনে রেখে আসতেন। সেই ব্যক্তির কাজ ছিল কাফেলা চলে যাওয়ার পর কেউ কোনওকিছু ফেলে গেল কি না তার খোঁজ নেওয়া। এ কাফেলায় এ কাজের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সাফওয়ান ইবন মুআত্তাল রাযি.-কে। তিনি খোঁজ নিতে গিয়ে যখন হযরত আয়েশা রাযি. যেখানে ছিলেন সেখানে পৌঁছলেন, তখন চমকে উঠলেন। বুঝতে দেরি হল না কী ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কালবিলম্ব না করে নিজের উটটি হযরত উম্মুল মুমিনীনের সামনে পেশ করলেন। তারপর নিজে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ালেন। উম্মুল মুমিনীন রাযি. দ্রুত তাতে সওয়ার হলেন। সাফওয়ান রাযি. সেটির লাগাম ধরে মদীনা মুনাউওয়ারায় নিয়ে আসলেন।
মুনাফিকরা তো সর্বদাই সুযোগের সন্ধানে থাকত। তাদের সর্দার আবদুল্লাহ ইবন উবাঈ এ ঘটনা জানতে পেরে তাদের দুরভিসন্ধি পূরণের একটি মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে সম্পূর্ণ অপবাদমূলক উক্ত ঘটনার প্রচারে লেগে গেল। সে ছিল বড়ই নীচ মানসিকতার লোক। আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় এ মায়ের প্রতি এমনই ন্যাক্কারজনক অপবাদ দিল, যা কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মুসলিমের পক্ষে কিছুতেই উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। আবদুল্লাহ ইবন উবাঈ এ অপবাদকে এতটাই প্রসিদ্ধ করে তুলল যে, জনাকয়েক সরলমতি মুসলিমও তার প্রচারণার ফাঁদে পড়ে গেল। মুনাফিক শ্রেণি বেশ মাথামুণ্ডুহীন বিষয় নিয়ে মেতে রইল। পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলল। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর কিন্তু এসবের কিছুই জানা ছিল না। তিনি জানতে পারেন অনেক দিন পর। জানার পর শোক ও দুঃখে তাঁর কী যে অবস্থা হয়েছিল, অন্য কারও পক্ষে তা কতটুকু অনুভব করা সম্ভব? দিনের পর দিন কান্নার মধ্যেই কাটছিল। চোখে কোনও ঘুম ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার পিতা-মাতা মনে করছিলেন কান্নার কারণে আমার কলিজা বুঝি ফেটে যাবে। এভাবে একমাস পার হয়ে গেল। আম্মাজান রাযি.-এর শরীর একদম ভেঙে পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু ছিল না। এর ভেতর নানারকম ঘটনা ঘটল। হাদীছ ও সীরাত গ্রন্থসমূহে তা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
পরিশেষে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সিদ্দীকা রাযি. -এর শিয়রে এসে বসলেন। কিছু কথাবার্তা হল। এরই ভেতর ওহী নাযিলের ভাব তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেল। মুহূর্তের মধ্যে আচ্ছন্নতার ভাব কেটে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় আনন্দের উদ্ভাস ফুটে উঠল। তিনি সর্বপ্রথম যে কথা উচ্চারণ করলেন তা ছিল- সুসংবাদ নাও হে আয়েশা! আল্লাহ তা'আলা তোমার পবিত্রতা প্রকাশ করেছেন। এ সময় সূরা নূরের ১১ থেকে ২৬ নং পর্যন্ত মোট ১৬টি আয়াত নাযিল হয়। এর দ্বারা একদিকে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর চারিত্রিক নির্মলতার পক্ষে ঐশী সনদ দিয়ে দেওয়া হয়, অন্যদিকে যারা চক্রান্তটির রুই-কাতলা ছিল তাদেরকে দেওয়া হয় কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারী বার্তা।
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমার বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই আমার পবিত্রতা ঘোষণা করবেন, যেহেতু আরোপিত অপবাদ থেকে আমি ছিলাম সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। কিন্তু আমার সম্পর্কে যে ওহী নাযিল হবে, যা কিনা মানুষ তিলাওয়াত করবে, এরকম ধারণা আমার ছিল না। কেননা আমার দৃষ্টিতে সে তুলনায় আমার অবস্থা তো অতি নগণ্য। আমার আশা ছিল কেবল এতটুকুই যে, আল্লাহ তা'আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনও স্বপ্ন দেখাবেন এবং তার মাধ্যমে আমার পবিত্রতা প্রকাশ করে দেবেন।
এক হাদীছে আছে, আল্লাহ তা'আলা যার মঙ্গল কামনা করেন, তাকে বিপদ-আপদে আক্রান্ত করেন। আল্লাহ তা'আলা আমাদের এ মহিয়সী মা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর মঙ্গল চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে ‘ইফক’-এর মতো এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছিলেন। একজন চরিত্রবতী নারীর পক্ষে এরচে' বড় কোনও বিপদ হতে পারে না। সে বিপদে তিনি সবর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর সুফলও পেয়েছেন অভাবনীয়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর চরিত্রের পক্ষে ওহীর সনদ দিয়ে দিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ কুরআন মাজীদে তাঁর সে চারিত্রিক সার্টিফিকেট পাঠ করতে থাকবে। আর জগতের সর্বত্র ধ্বনিত হতে থাকবে তাঁর চারিত্রিক পবিত্রতার মহিমা। এ তো তাঁর পার্থিব পুরস্কার। আর আখিরাতে এর জন্য তিনি যে অকল্পনীয় পুরস্কার পাবেন সে তো রয়েছেই।
‘ইফক’-এর ঘটনা সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ওইসকল সরলপ্রাণ মুসলিমদের তিরস্কার করেছেন, যারা মুনাফিকদের প্রচারণার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাদের লক্ষ্য করে বলেন-
إِذْ تَلَقَّوْنَهُ بِأَلْسِنَتِكُمْ (যখন তোমরা নিজ রসনা দ্বারা তা একে অন্যের থেকে প্রচার করছিলে)। অর্থাৎ তোমরা একে অন্যকে অপবাদের সে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলে এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছাচ্ছিলে। তাদের কারও সঙ্গে যখন কারও সাক্ষাৎ হতো তখন বলত, আমার কাছে এই এই খবর পৌছেছে বা আমি এই এই শুনেছি। তুমি কি তা শুনেছ? তুমি এ বিষয়ে কী জান? এর বাস্তবতা কতটুকু?
وَتَقُولُونَ بِأَفْوَاهِكُمْ مَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ (এবং নিজ মুখে এমন কথা বলছিলে, যে সম্পর্কে তোমাদের কিছু জানা নেই)। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মুখে এমন বিষয়ে কথা বলছিলে, যার বাস্তব কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তোমরা পরস্পর যা নিয়ে কথা বলছিলে, সে সম্পর্কে তোমাদের কোনও জ্ঞান ছিল না, তা থাকতেও পারে না। কেননা কোনও বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য তার বাস্তব অস্তিত্ব তো থাকতে হবে! মুনাফিকরা যা রটনা করছিল, তার তো কোনও বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। তার পুরোটাই ছিল নির্জলা অপবাদ, সম্পূর্ণ মিথ্যা।
উল্লেখ্য, খাঁটি মুমিনদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যকই মুনাফিকদের প্রচারণার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ সাহাবীই তাদের কথায় বিশ্বাস করেননি। একবার হযরত আবু আইয়ূব আনসারী রাযি. ঘরে আসলে তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, আপনি কি শুনেছেন লোকে আয়েশা সম্পর্কে কি কি সব কথা বলে? তিনি উত্তর দিলেন, ওরা সব মিথ্যুক। হে আইয়ুবের মা! তুমি কি এরূপ কাজ করতে পারবে? উত্তরে বললেন, কখনওই নয়। হযরত আবু আইয়ূব রাযি. বললেন, আয়েশা তো তোমার চেয়ে বেশি পবিত্র ও উত্তম (তাঁর পক্ষে এটা কী করে করা সম্ভব?)।
وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا (আর তোমরা এ ব্যাপারটাকে মামুলি মনে করছিলে)। এর দু'টি অর্থ হতে পারে। এক অর্থ এই যে, তোমরা অপবাদের ঘটনাটিকে তুচ্ছ বিষয় মনে করছিলে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, তোমরা অপবাদের প্রচারণাকে তুচ্ছ কাজ মনে করছিলে। তার পরিণতি কত মন্দ ও কত ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্পর্কে তোমাদের ধারণা ছিল না, যে কারণে তোমরা অবলীলায় পরস্পর তা বলাবলি করছিলে। তোমাদের উচিত ছিল তাতে একদম কান না দেওয়া। এমনকি উচিত ছিল তার প্রতিবাদ করা। যেমন পরে এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَلَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ قُلْتُمْ مَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَتَكَلَّمَ بِهَذَا سُبْحَانَكَ هَذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ (16)
‘তোমরা যখন এ কথা শুনেছিলে তখনই কেন বলে দিলে না- এ কথা মুখে আনার কোনও অধিকার আমাদের নেই; হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র। এটা তো মারাত্মক অপবাদ।(সূরা নূর (২৪), আয়াত ১৬)
وَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمٌ (অথচ আল্লাহর কাছে এটা ছিল গুরুতর)। অর্থাৎ অন্যের নামে অপবাদ দেওয়া বা অপবাদের ঘটনা প্রচার করে বেড়ানো আল্লাহ তা'আলার কাছে গুরুতর অপরাধ এবং কঠিন শাস্তির কারণ। কোনও চরিত্রবতী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা যে কী কঠিন পাপ, সে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেন-
«اجْتَنِبُوا السَّبْعَ المُوبِقَاتِ» ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: «الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ اليَتِيمِ، وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ المُحْصَنَاتِ المُؤْمِنَاتِ الغَافِلاَتِ»
‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে বেঁচে থেকো। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলো কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা; জাদুটোনা করা; আল্লাহ যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করা, তবে ন্যায়ানুগভাবে হলে ভিন্ন কথা; সুদ খাওয়া; এতিমের মাল গ্রাস করা, যুদ্ধের দিনে পলায়ন করা এবং চরিত্রবতী সরলা মুমিন নারীর চরিত্রে অপবাদ দেওয়া।(সহীহ বুখারী: ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম: ৭৯; সুনানে নাসাঈ ৩৬৭১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৫৫৬১; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার: ৮৯৪; শু'আবুল ঈমান: ২৮০; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ৪৫)
অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ قَذْفَ الْمُحْصَنَةِ يَهْدِمُ عَمَلَ مِائَةِ سَنَةٍ
‘চরিত্রবতী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ একশ বছরের আমল ধ্বংস করে দেয়।(হাকিম, আল-মুস্তাদরাক: ৮৭১২; মুসনাদুল বাযযার: ১০৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর: ৩০২৩
هو ضعيف مرفوعا، قال البزار: هذا الحديث لا نعلم أحدا أسنده إلا ليث (هو ابن أبي سليم)، ولا عن ليث إلا موسى بن أعين، وقد رواه جماعة عن أبي إسحاق عن صلة، عن حذيفة موقوفا اهـ (المحرر)
সাধারণ কোনও মুমিন চরিত্রবতী নারীর প্রতি কলঙ্ক আরোপ যদি এত বড় কঠিন পাপ হয়, তবে চিন্তা করা যায় এরূপ কলঙ্ক আরোপ যদি করা হয় আল্লাহ তা'আলার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন স্ত্রীর প্রতি, আবার নিজেদের মধ্যে তার প্রচারণাও চালানো হয়, তবে তার ভয়াবহতা কত কঠিন হয়? কেননা তা দ্বারা কেবল নবীপত্নিরই সম্মানহানি হয় না; স্বয়ং নবীরও অসম্মান হয়। এখানে তো রয়েছেন সকল নবী-রাসূলের সেরা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তাঁর এ স্ত্রীও হলেন সেই মহিয়সী নারী, যাঁর সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন-
فضلَ عائشةَ على النِّساءِ ، كفضل الثَّريدِ على سائرِ الطَّعامِ
‘সমস্ত নারীর উপর আয়েশার শ্রেষ্ঠত্ব সমস্ত খাদ্যের উপর ছারীদের শ্রেষ্ঠত্বের মতো।(সহীহ বুখারী: ৩৪১১; সহীহ মুসলিম: ২৪৩১; জামে তিরমিযী: ৩৮৮৭; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩২৮০; সুনানে নাসাঈ ৩৯৪৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা ৩২২৮১; সুনানে দারিমী: ২১১৩)
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতটা প্রিয় ছিলেন তা এর দ্বারা অনুমান করা যায় যে, একদিন তিনি তাঁর সামনে আদরের কন্যা হযরত ফাতিমা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-
أَي بُنَيَّةُ أَلَسْت تُحِبّينَ مَا أُحِبُّ ؟ فَقَالَتْ : بَلَى ، قَالَ : فَأَحِبِّي هَذِهِ
‘প্রিয় কন্যা! আমি যাকে ভালোবাসি, তুমি কি তাকে ভালোবাস না? তিনি বললেন, অবশ্যই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তুমি একে ভালোবেসো।(সহীহ বুখারী: ২৫৮১; সহীহ মুসলিম: ২৪৪২; সুনানে নাসাঈ: ৩৯৪৪)
আয়াতটির শিক্ষা
ক. নির্দোষ ব্যক্তির উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া কঠিন পাপ।
খ. কেউ কারও উপর ব্যভিচারের অপবাদ দিলে তাতে কর্ণপাত করতে নেই।
দুই নং আয়াত
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ
অর্থ: নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সকলের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।(সূরা ফাজর (৮৯), আয়াত ১৪)
ব্যাখ্যা
الْمِرْصَاد অর্থ ঘাঁটি, চৌকি, যেখানে প্রহরী বা সৈন্য ঘাপটি মেরে থাকে। এ হিসেবে আয়াতটির অর্থ হয়- তোমার প্রতিপালক ঘাঁটিতে আছেন। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য তিনি বান্দার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। বান্দার কর্তব্য আল্লাহ তা'আলার ইবাদত- আনুগত্য করা। বান্দা সে কর্তব্য পালন করছে কি না, তিনি সেদিকে লক্ষ রাখেন। তাঁর জ্ঞান সর্বব্যাপী। কোনওকিছুই তাঁর অগোচরে থাকে না। ঘাঁটিতে অবস্থানকারী প্রহরীকে যেমন কেউ ফাঁকি দিয়ে যেতে পারে না, তেমনি আল্লাহ তা'আলার দৃষ্টিকেও কেউ ফাঁকি দিতে পারে না। সুতরাং তিনি মানুষকে তাদের কর্ম অনুযায়ী পরিপূর্ণ প্রতিদান দেবেন। কিন্তু মানুষ বড় গাফেল। দুনিয়ার ভোগ-আসক্তিতেই মত্ত। আখিরাত সম্পর্কে একদম চিন্তা করছে না। এ মত্ততা পরিহার করে তাদের সতর্ক ও সচেতন হয়ে যাওয়া উচিত। আর সে সচেতনতার দাবি তারা সবরকম পাপকর্ম ছেড়ে দেবে। পাপকর্ম তো করবেই না, এমনকি যেসব কাজ সন্দেহপূর্ণ, জায়েযও হতে পারে নাজায়েযও হতে পারে, তা করলে গুনাহ হওয়ারও আশঙ্কা আছে, তা থেকেও বেঁচে থাকবে। এরূপ কাজ থেকে বেঁচে থাকাকে পরহেযগারী বলে। আল্লাহ তা'আলার ভয় যার মধ্যে পুরোপুরি আছে, সে দুনিয়ায় যতদিন বেঁচে থাকবে, পরহেযগার হয়েই থাকবে। এটাই এ আয়াতের বার্তা।
আয়াতটির শিক্ষা
আমরা সর্বক্ষণ আল্লাহ তা'আলার সতর্কদৃষ্টির মধ্যে রয়েছি। সুতরাং কোনও অবস্থায়ই আমরা তাঁর অবাধ্যতা করব না। এমনকি যে কাজে অবাধ্যতা বা পাপের আশঙ্কা থাকে, তাও পরিহার করে চলব। আল্লাহ তা'আলা তাওফীক দিন।
সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার ও কলবের ইসলাহ করার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ৫৮৭
হযরত নু‘মান ইবন বাশীর রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়। বহু মানুষ তা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল ঠিক ওই রাখালের মতো, যে হিমা (সরকারি সংরক্ষিত ভূমি)-এর আশেপাশে পশু চড়ায়। তার অসতর্কতাবশত হিমায় ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। শোনো হে! প্রত্যেক বাদশারই হিমা (সংরক্ষিত ভূমি) থাকে। শোনো হে! আল্লাহর হিমা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। শোনো হে! শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে। সেটি ঠিক থাকলে সমস্ত শরীর ঠিক থাকে। আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়। শোনো হে! তা হল কলব (হৃৎপিণ্ড)। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫২; সহীহ মুসলিম: ১৫৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৯৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২২০৩; সুনানে দারিমী: ২৫৭৩; জামে তিরমিযী: ১২০৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৫৬৯)
হাদীছ নং: ৫৮৭
হযরত নু‘মান ইবন বাশীর রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়। বহু মানুষ তা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল ঠিক ওই রাখালের মতো, যে হিমা (সরকারি সংরক্ষিত ভূমি)-এর আশেপাশে পশু চড়ায়। তার অসতর্কতাবশত হিমায় ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। শোনো হে! প্রত্যেক বাদশারই হিমা (সংরক্ষিত ভূমি) থাকে। শোনো হে! আল্লাহর হিমা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। শোনো হে! শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে। সেটি ঠিক থাকলে সমস্ত শরীর ঠিক থাকে। আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়। শোনো হে! তা হল কলব (হৃৎপিণ্ড)। -বুখারী ও মুসলিম
(সহীহ বুখারী: ৫২; সহীহ মুসলিম: ১৫৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৯৮৫; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ২২০৩; সুনানে দারিমী: ২৫৭৩; জামে তিরমিযী: ১২০৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৫৬৯)
مقدمة الامام النووي
68 - باب الورع وترك الشبهات
قَالَ اللهُ تَعَالَى: {وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللهِ عَظِيمٌ} [النور: 15]، وقال تَعَالَى: {إنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ} [الفجر: 14].
قَالَ اللهُ تَعَالَى: {وَتَحْسَبُونَهُ هَيِّنًا وَهُوَ عِنْدَ اللهِ عَظِيمٌ} [النور: 15]، وقال تَعَالَى: {إنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ} [الفجر: 14].
587 - وعن النعمان بن بشيرٍ رضي الله عنهما، قَالَ: سَمِعْتُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ الحَلاَلَ بَيِّنٌ، وَإنَّ الحَرامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبَهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ، اسْتَبْرَأَ لِدِينهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ في الحَرَامِ، كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ، ألاَ وَإنَّ لكُلّ مَلِكٍ حِمَىً، ألاَ وَإنَّ حِمَى اللهِ مَحَارِمُهُ، ألاَ وَإنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَت صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، ألاَ وَهِيَ القَلْبُ». متفقٌ عَلَيْهِ، (1) وروياه مِنْ طرقٍ بِألفَاظٍ متقاربةٍ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কয়েকটি হাদীছকে কেন্দ্র করে সমগ্র দীন ও শরী'আত আবর্তিত হয়, এটি তার অন্যতম। সেরকম হাদীছ তিনটি। আরেকটি হাদীছ হল-
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى (সমস্ত আমল নিয়তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করে)।(সহীহ বুখারী: ১: সহীহ মুসলিম: ১৯০৭; সুনানে আবু দাউদ: ২২০১; জামে তিরমিযী: ১৬৪৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২২৭ )
আর তৃতীয় হাদীছ হল- مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ (ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা-কিছু অনর্থক তা ছেড়ে দেওয়া)।(জামে' তিরমিযী: ২৩১৭: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৭৬)
ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর মতে এরকম মৌলিক হাদীছ হল চারটি। এ তিনটি, আর চতুর্থটি হল- لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ (তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে)।(সহীহ বুখারী: ১৩; সহীহ মুসলিম: ৪৫; জামে তিরমিযী: ২৫১৫। সুনানে নাসাঈ হাদীছ: ৫০১৬)
সে হিসেবে উলামায়ে কেরাম বলেন, এ হাদীছটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক-চতুর্থাংশ।
এ হাদীছটির এতটা গুরুত্বের কারণ এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মুমিন ও মুসলিম হতে হলে খাদ্য, পানীয়, পোশাক, বিবাহ ইত্যাদি বৈধ ও হালাল পন্থায় হতে হবে আর সেজন্য কোনটা হালাল ও কোনটা হারাম তা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। আর যেসব বিষয় সন্দেহযুক্ত, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তা থেকে বিরত থাকার দ্বারা নিজ দীন ও সম্মান রক্ষা পায়। তিনি এ বিষয়টিকে একটা দৃষ্টান্ত দ্বারাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর কলব ও আত্মার সংশোধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এসবের দিকে লক্ষ করে কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেম বলেন, এই একটি হাদীছ থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধান নির্ণয় করা সম্ভব।
إِنَّ الْحَلَالَ بَينٌ (নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ শরী'আত যা হালাল করেছে তা এমনই স্পষ্ট, যার ভেতর কোনও সন্দেহ নেই। হয়তো তা কুরআন-হাদীছে সুনির্দিষ্টভাবে হালাল বলে দেওয়া হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা হালাল সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন খাদ্যশস্য ও ফল-ফলাদি, গবাদি পশু, পবিত্র পানীয়, তুলা, পশম ইত্যাদির তৈরি পোশাক, বেচাকেনা, মীরাছ, হিবা ও হাদিয়াসূত্রে অর্জিত মালামাল, গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ ইত্যাদি।
وَإِنَّ الْحَرَامَ بَينٌ (এবং হারামও সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ কুরআন-হাদীছে যেসব বিষয়কে হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা যা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে, তার মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই। সকলের কাছেই তা হারাম হিসেবে পরিষ্কার। যেমন মৃতজন্তু, রক্ত ও শূকরের গোশত খাওয়া, মদপান করা, মাহরাম নারীকে বিবাহ করা, ব্যভিচার করা, পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক পরিধান করা, সুদ-ঘুষ ও চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে হস্তগত সম্পদ ভোগ করা ইত্যাদি।
وَبَيْنَهُمَا مُشتَبَهَاتٌ (উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়)। অর্থাৎ হালাল ও হারাম বিষয়াবলির মাঝখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা হালাল না হারাম সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। একদিক থেকে তা হালালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সে হিসেবে তা হালাল বলে মনে হয়। আবার অন্যদিক থেকে হারামের সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে। সে কারণে তাকে হারাম বলেও মনে হয়। এমনিভাবে কোনও কোনও দলীল দ্বারা মনে হয় তা হালাল। আবার কোনও কোনও দলীল দ্বারা হারামও বোঝা যায়। এ অবস্থায় সেরকম বিষয়কে হালাল মনে করা হবে না হারাম, এ নিয়ে সন্দেহ জন্মায়। যেমন ঘোড়া ও গাধা খাওয়া, হিংস্র পশুর চামড়া দ্বারা তৈরি পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি। কোনও বিষয়ে হালাল বা হারাম হওয়ার সন্দেহ দেখা দেয় বিভিন্ন কারণে। যেমন-
(ক) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য অতি অল্পসংখ্যক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছে। ফলে সমস্ত আলেমের কাছে তা পৌঁছায়নি।
(খ) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য দু'রকম আছে। এক হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হালাল, অন্য হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হারাম।
(গ) হয়তো সে বিষয়ে হাদীছের সুস্পষ্ট ভাষ্য নেই। ফলে হাদীছের কোনও সাধারণ ভাষ্য বা সুনির্দিষ্ট কোনও বিষয় সম্পর্কিত ভাষ্যের বিপরীত অর্থ কিংবা কিয়াস দ্বারা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর তা নিতে গিয়ে মুজতাহিদ আলেমদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়।
(ঘ) হয়তো সে সম্পর্কে কোনও আদেশ বা নিষেধসূচক বাণী আছে। এখন সে আদেশটিকে অবশ্যপালনীয় অর্থে ধরা হবে না অনুমোদন অর্থে, এটা অনেকের পক্ষেই সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তা সম্ভব হয় অল্পসংখ্যক আলেমের পক্ষে, শরী'আতের পরিভাষায় যাদেরকে মুজতাহিদ বলা হয়।
যখন কোনও জিনিস নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় যে, সেটি হালাল না হারাম, আর সে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর কোনও স্পষ্ট নির্দেশনা বা ইজমা' থাকে না, তখন মুজতাহিদ আলেম তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি নিজ গবেষণার ভিত্তিতে সেটিকে হালালের কাতারে ফেলেন অথবা হারামের কাতারে। তখন সেটি হালাল বা হারাম সাব্যস্ত হয়। কখনও কখনও মুজতাহিদের পক্ষেও সে বিষয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয় না। ফলে সেটিকে হালাল ধরা হবে না হারাম, তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় পরহেযগারীর দাবি তা থেকে বেঁচে থাকা। এরূপ বিষয়কে সাধারণত মাকরূহ বলা হয়।
لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ (বহু মানুষ তা জানে না)। অর্থাৎ সাধারণ স্তরের মানুষ বুঝতে পারে না তা হালাল না হারাম। কিন্তু যারা পরিপক্ক আলেম তারা ঠিকই বুঝতে পারে। তাদের কাছে সে বিষয়ে কোনও অস্পষ্টতা থাকে না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের করণীয় নির্ভরযোগ্য আলেমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি যে ফয়সালা দেন সে অনুযায়ী আমল করা।
কেউ যদি সেরকম কোনও আলেমের সন্ধান না পায়, তবে তার কর্তব্য সে বিষয়টিকে সন্দেহের স্থানে রেখে দেওয়া, নিজের পক্ষ থেকে কোনও ফয়সালা গ্রহণ না করা। কেননা হতে পারে সে বিষয়টিকে হালাল মনে করছে অথচ বাস্তবিকপক্ষে সেটি হারাম। এ অবস্থায় সে তা ভোগ করলে হারাম বস্তু ভোগ করা হবে। তাই হাদীছটির পরের অংশে এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ (সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল)। অর্থাৎ লোকে তার দীনদারী নিয়ে কোনও অভিযোগ তুলতে পারবে না। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হলে যারা সেটিকে হারাম মনে করে তারা এই বলে সমালোচনা করবে যে, সে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তার মান-সম্মানও ক্ষুণ্ণ হবে।
وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ (পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল)। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে থাকলে এক পর্যায়ে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর সে অভ্যাস পর্যায়ক্রমে মানুষকে হারামের দিকে টেনে নেয়। পরিশেষে এরূপ ব্যক্তি নির্দ্বিধায় হারামেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। বাক্যটির এরূপ ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে যে, কোনও ব্যক্তি যেই সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হয়েছে, সে বিষয়টি বাস্তবিকপক্ষে হারাম হতে পারে। এ অবস্থায় সে তো মনে করেছিল সন্দেহযুক্ত কাজ করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে করল হারাম কাজ।
উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজ বেশি বেশি করে, পরহেযগারী ত্যাগ করার কারণে তার অন্তর ক্রমান্বয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ফলে সে অজান্তেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাকওয়া-পরহেযগারীর নূর না থাকায় সে তা উপলব্ধি করতে পারে না।
বলা হয়ে থাকে, মাকরূহ হল হালাল ও হারামের মধ্যবর্তী একটি ঘাঁটি। যে ব্যক্তি বেশি বেশি মাকরূহ কাজে লিপ্ত হয়, সে মধ্যবর্তী ঘাঁটিটি পার হয়ে যায় আর এভাবে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অতএব হারাম থেকে বাঁচার জন্য মাকরূহ থেকেও বাঁচা জরুরি। সুতরাং হাদীছটির এক বর্ণনায় আছে-
فَمَنْ تَرَكَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ، كَانَ لِمَا اسْتَبَانَ لَهُ أَتْرَكَ ، وَمَنِ اجْتَرَأَ عَلَى مَا شَكّ فِيهِ، أَوْشَكَ أَنْ يُوْقَعَ فِي الْحَرَامِ
‘যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহ আছে এমন বিষয় পরিত্যাগ করে, সে সুস্পষ্ট গুনাহ আরও বেশিই পরিত্যাগ করবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজে ধৃষ্টতা দেখায়, সে অচিরেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে।(সহীহ বুখারী: ২০৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১০৪০১; শু'আবুল ঈমান: ৫৩৫৭)
كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوْشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ ‘ঠিক ওই রাখালের মতো, যে হিমা (সরকারি সংরক্ষিত ভূমি)-এর আশেপাশে পশু চড়ায়। তার অসতর্কতাবশত হিমায় ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। اَلْحِمَى -এর অর্থ সরকারি চারণভূমি, যে ভূমি সরকারি পশু চরানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। তাতে জনসাধারণের পশু চরানো নিষেধ থাকে। প্রাচীনকালে গোত্রপ্রধানেরাও নিজেদের জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করত। তারা ঘোষণা করে দিত, এ ভূমিতে অন্য কেউ পশু চরাতে পারবে না।
এটা একটা দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যমে সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির অবস্থা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে যে, এ ব্যক্তির অবস্থা হল ওই রাখালের মতো, যে সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চরায়। ওই রাখালের ক্ষেত্রে যেমন আশঙ্কা রয়েছে তার পশু যে-কোনও সময় সংরক্ষিত ভূমির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে, তেমনি সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও যে-কোনও সময় হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নিষিদ্ধ ভূমিতে পশু চরানোর দায়ে যেমন রাখাল দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারে, তেমনি হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার কারণে এ ব্যক্তিরও শাস্তিভোগের আশঙ্কা থাকে। সে শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় একটাই- সন্দেহযুক্ত কাজ পরিহার করা, যেমন রাখালেরও দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার উপায় হল নিষিদ্ধভূমির আশেপাশে পশু চরানো হতে বিরত থাকা।
أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِك حِمى ‘শোনো হে! প্রত্যেক বাদশারই হিমা (সংরক্ষিত ভূমি) থাকে'। অর্থাৎ প্রত্যেক বাদশাই রাষ্ট্রীয় পশু চরানোর জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করে থাকে। বাদশার পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হয় কেউ যেন ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে না যায়। যে ব্যক্তি সরকারি শাস্তির ভয় রাখে এবং তা থেকে বাঁচতে চায়, সে কখনও ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে যায় না। ফলে সে শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। আর যার সেই ভয় নেই, সে ঠিকই ওই ভূমির পাশে পশু চরায়। তার পশু যে নিষিদ্ধ ভূমিতে ঢুকে পড়বে না, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর তা যদি ঢুকে পড়েই, তবে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللَّهِ مَحَارِمُهُ (শোনো হে! আল্লাহর হিমা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ)। অর্থাৎ আল্লাহ হলেন সমস্ত রাজার রাজা। রাজাদের যেমন হিমা বা সংরক্ষিত স্থান থাকে, তেমনি সকল রাজার রাজা আল্লাহরও সংরক্ষিত স্থান আছে। আর তা হচ্ছে ওইসমস্ত বিষয়, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের কোনও একটিতে লিপ্ত হবে, সে শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছাবে, তার যে-কোনও সময় তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ারও আশঙ্কা আছে। কাজেই আল্লাহর শাস্তি থেকে যে ব্যক্তি বাঁচতে চায়, তার কর্তব্য হবে হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের ধারেকাছেও না যাওয়া। মনে রাখতে হবে, রাজা-বাদশার শাস্তির ভয়ে যখন তাদের হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকেও বিরত থাকা হয়, তখন মহান আল্লাহর হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকে তো আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে দূরে থাকা উচিত। কেননা তাঁর শাস্তি রাজা-বাদশাদের শাস্তি অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি কঠিন।
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً (শোনো হে! শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে)। এই বলে কলব বা হৃদয়ের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কেননা তার সঙ্গে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিহার করা না করার গভীর সম্পর্ক আছে। হাদীছটির শেষে মাংসপিণ্ডটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে 'কলব'-এর দ্বারা। কলব অর্থ হৃৎপিণ্ড। এটা অন্তর বা আত্মার বাহন। এটি মানবদেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র হলেও এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য এটি রাজার মতো। রাজার মতোই সে অন্যসব অঙ্গকে পরিচালনা করে। রাজা ভালো হলে তার পরিচালনা ভালো হয়। মন্দ হলে পরিচালনাও মন্দ হয়। কলবের বিষয়টাও সেরকমই। সুতরাং হাদীছটির পরের অংশে ইরশাদ হয়েছে-
إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ (সেটি ঠিক থাকলে সমস্ত শরীর ঠিক থাকে। আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়)। অর্থাৎ অন্তর যদি হিদায়াতের আলোয় আলোকিত থাকে, তাতে ঈমান থাকে পরিপক্ক, দীন সম্পর্কে থাকে পরিপূর্ণ ধারণা, থাকে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতমুখিতা, তবে সে অন্তর হয় সুস্থ ও পরিশুদ্ধ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আনুগত্যে প্রস্তুত করে। ফলে তা দ্বারা সর্বাবস্থায় সৎকর্ম সম্পন্ন হয় ও উন্নত আখলাক-চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি থাকে হিদায়াতশূন্য এবং তাতে থাকে কুফর ও জাহিলিয়াতের অন্ধকার, তবে সে অন্তর হয় নষ্ট ও অসুস্থ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে নষ্ট কাজেই ব্যবহার করে। ফলে তা দ্বারা নানারকম পাপাচার হয় ও দুশ্চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।
বোঝা গেল অন্তরের ইসলাহ ও সংশোধন করা অতীব জরুরি। অন্তরের ইসলাহ না হলে কেবল আইন-কানুন বা শাসন দ্বারা অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে না। অপরাধ ও পাপকর্ম তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই হয়। যে হৃদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচালনা করে, তা যদি সুস্থ না হয়, তবে কেবল আইন দ্বারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থ ব্যবহার কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এ কারণেই যারা আত্মিক চিকিৎসকের দ্বারা আপন অন্তরের আরোগ্যসাধনা করে, তাদের সুপথে পরিচালনার জন্য সরকারি আইনের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে যারা এ চিকিৎসার ধার ধারে না, কোনও আইন ও শাসন তাদেরকে অন্যায়-অনাচার থেকে ফেরাতে পারে না। সুতরাং উন্নত, সুস্থ ও পরিশুদ্ধ জীবন প্রত্যাশীদের উচিত সবার আগে নিজ আত্মিক পরিশুদ্ধিতে মনোনিবেশ করা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যেসব বিষয় হালাল না হারাম তা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তা পরিহার করাই তাকওয়ার দাবি।
খ. সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার দ্বারা নিজ দীনদারি ও সম্মান রক্ষা পায়।
গ. সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
ঘ. কলব বা অন্তরের ইসলাহ অতীব জরুরি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ হতে বাঁচানোর এটাই প্রধান উপায়।
ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা উলামায়ে কেরাম বিশেষত মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয়।
চ. এর দ্বারা সুলুক ও তাসাউওফের চর্চা, যা দ্বারা কিনা অন্তরের ইসলাহ করাই মূল উদ্দেশ্য, এর গুরুত্বও বুঝে আসে।
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى (সমস্ত আমল নিয়তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করে)।(সহীহ বুখারী: ১: সহীহ মুসলিম: ১৯০৭; সুনানে আবু দাউদ: ২২০১; জামে তিরমিযী: ১৬৪৭; সুনানে ইবন মাজাহ: ৪২২৭ )
আর তৃতীয় হাদীছ হল- مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ (ব্যক্তির ইসলামের একটি সৌন্দর্য হল যা-কিছু অনর্থক তা ছেড়ে দেওয়া)।(জামে' তিরমিযী: ২৩১৭: সুনানে ইবন মাজাহ : ৩৯৭৬)
ইমাম আবূ দাউদ রহ.-এর মতে এরকম মৌলিক হাদীছ হল চারটি। এ তিনটি, আর চতুর্থটি হল- لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيْهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ (তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তা পসন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে)।(সহীহ বুখারী: ১৩; সহীহ মুসলিম: ৪৫; জামে তিরমিযী: ২৫১৫। সুনানে নাসাঈ হাদীছ: ৫০১৬)
সে হিসেবে উলামায়ে কেরাম বলেন, এ হাদীছটি ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা এক-চতুর্থাংশ।
এ হাদীছটির এতটা গুরুত্বের কারণ এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, মুমিন ও মুসলিম হতে হলে খাদ্য, পানীয়, পোশাক, বিবাহ ইত্যাদি বৈধ ও হালাল পন্থায় হতে হবে আর সেজন্য কোনটা হালাল ও কোনটা হারাম তা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। আর যেসব বিষয় সন্দেহযুক্ত, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তা থেকে বিরত থাকার দ্বারা নিজ দীন ও সম্মান রক্ষা পায়। তিনি এ বিষয়টিকে একটা দৃষ্টান্ত দ্বারাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তারপর কলব ও আত্মার সংশোধনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এসবের দিকে লক্ষ করে কোনও কোনও বিজ্ঞ আলেম বলেন, এই একটি হাদীছ থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধান নির্ণয় করা সম্ভব।
إِنَّ الْحَلَالَ بَينٌ (নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ শরী'আত যা হালাল করেছে তা এমনই স্পষ্ট, যার ভেতর কোনও সন্দেহ নেই। হয়তো তা কুরআন-হাদীছে সুনির্দিষ্টভাবে হালাল বলে দেওয়া হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা হালাল সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন খাদ্যশস্য ও ফল-ফলাদি, গবাদি পশু, পবিত্র পানীয়, তুলা, পশম ইত্যাদির তৈরি পোশাক, বেচাকেনা, মীরাছ, হিবা ও হাদিয়াসূত্রে অর্জিত মালামাল, গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহ ইত্যাদি।
وَإِنَّ الْحَرَامَ بَينٌ (এবং হারামও সুস্পষ্ট)। অর্থাৎ কুরআন-হাদীছে যেসব বিষয়কে হারাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অথবা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত মূলনীতি দ্বারা যা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে, তার মধ্যে কোনও অস্পষ্টতা নেই। সকলের কাছেই তা হারাম হিসেবে পরিষ্কার। যেমন মৃতজন্তু, রক্ত ও শূকরের গোশত খাওয়া, মদপান করা, মাহরাম নারীকে বিবাহ করা, ব্যভিচার করা, পুরুষের জন্য রেশমি পোশাক পরিধান করা, সুদ-ঘুষ ও চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে হস্তগত সম্পদ ভোগ করা ইত্যাদি।
وَبَيْنَهُمَا مُشتَبَهَاتٌ (উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়)। অর্থাৎ হালাল ও হারাম বিষয়াবলির মাঝখানে এমন কিছু বিষয় আছে, যা হালাল না হারাম সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। একদিক থেকে তা হালালের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সে হিসেবে তা হালাল বলে মনে হয়। আবার অন্যদিক থেকে হারামের সঙ্গেও সাদৃশ্য আছে। সে কারণে তাকে হারাম বলেও মনে হয়। এমনিভাবে কোনও কোনও দলীল দ্বারা মনে হয় তা হালাল। আবার কোনও কোনও দলীল দ্বারা হারামও বোঝা যায়। এ অবস্থায় সেরকম বিষয়কে হালাল মনে করা হবে না হারাম, এ নিয়ে সন্দেহ জন্মায়। যেমন ঘোড়া ও গাধা খাওয়া, হিংস্র পশুর চামড়া দ্বারা তৈরি পোশাক পরিধান করা ইত্যাদি। কোনও বিষয়ে হালাল বা হারাম হওয়ার সন্দেহ দেখা দেয় বিভিন্ন কারণে। যেমন-
(ক) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য অতি অল্পসংখ্যক বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছে। ফলে সমস্ত আলেমের কাছে তা পৌঁছায়নি।
(খ) হয়তো সে সম্পর্কে হাদীছের ভাষ্য দু'রকম আছে। এক হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হালাল, অন্য হাদীছ দ্বারা বোঝা যায় হারাম।
(গ) হয়তো সে বিষয়ে হাদীছের সুস্পষ্ট ভাষ্য নেই। ফলে হাদীছের কোনও সাধারণ ভাষ্য বা সুনির্দিষ্ট কোনও বিষয় সম্পর্কিত ভাষ্যের বিপরীত অর্থ কিংবা কিয়াস দ্বারা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর তা নিতে গিয়ে মুজতাহিদ আলেমদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়।
(ঘ) হয়তো সে সম্পর্কে কোনও আদেশ বা নিষেধসূচক বাণী আছে। এখন সে আদেশটিকে অবশ্যপালনীয় অর্থে ধরা হবে না অনুমোদন অর্থে, এটা অনেকের পক্ষেই সহজে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তা সম্ভব হয় অল্পসংখ্যক আলেমের পক্ষে, শরী'আতের পরিভাষায় যাদেরকে মুজতাহিদ বলা হয়।
যখন কোনও জিনিস নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয় যে, সেটি হালাল না হারাম, আর সে সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর কোনও স্পষ্ট নির্দেশনা বা ইজমা' থাকে না, তখন মুজতাহিদ আলেম তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি নিজ গবেষণার ভিত্তিতে সেটিকে হালালের কাতারে ফেলেন অথবা হারামের কাতারে। তখন সেটি হালাল বা হারাম সাব্যস্ত হয়। কখনও কখনও মুজতাহিদের পক্ষেও সে বিষয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয় না। ফলে সেটিকে হালাল ধরা হবে না হারাম, তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। এ অবস্থায় পরহেযগারীর দাবি তা থেকে বেঁচে থাকা। এরূপ বিষয়কে সাধারণত মাকরূহ বলা হয়।
لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ (বহু মানুষ তা জানে না)। অর্থাৎ সাধারণ স্তরের মানুষ বুঝতে পারে না তা হালাল না হারাম। কিন্তু যারা পরিপক্ক আলেম তারা ঠিকই বুঝতে পারে। তাদের কাছে সে বিষয়ে কোনও অস্পষ্টতা থাকে না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের করণীয় নির্ভরযোগ্য আলেমের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি যে ফয়সালা দেন সে অনুযায়ী আমল করা।
কেউ যদি সেরকম কোনও আলেমের সন্ধান না পায়, তবে তার কর্তব্য সে বিষয়টিকে সন্দেহের স্থানে রেখে দেওয়া, নিজের পক্ষ থেকে কোনও ফয়সালা গ্রহণ না করা। কেননা হতে পারে সে বিষয়টিকে হালাল মনে করছে অথচ বাস্তবিকপক্ষে সেটি হারাম। এ অবস্থায় সে তা ভোগ করলে হারাম বস্তু ভোগ করা হবে। তাই হাদীছটির পরের অংশে এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে।
فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ (সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল)। অর্থাৎ লোকে তার দীনদারী নিয়ে কোনও অভিযোগ তুলতে পারবে না। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হলে যারা সেটিকে হারাম মনে করে তারা এই বলে সমালোচনা করবে যে, সে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তার মান-সম্মানও ক্ষুণ্ণ হবে।
وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ (পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল)। কেননা সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হতে থাকলে এক পর্যায়ে মানুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আর সে অভ্যাস পর্যায়ক্রমে মানুষকে হারামের দিকে টেনে নেয়। পরিশেষে এরূপ ব্যক্তি নির্দ্বিধায় হারামেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। বাক্যটির এরূপ ব্যাখ্যাও করা যেতে পারে যে, কোনও ব্যক্তি যেই সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হয়েছে, সে বিষয়টি বাস্তবিকপক্ষে হারাম হতে পারে। এ অবস্থায় সে তো মনে করেছিল সন্দেহযুক্ত কাজ করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে করল হারাম কাজ।
উলামায়ে কেরাম বলেন, যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজ বেশি বেশি করে, পরহেযগারী ত্যাগ করার কারণে তার অন্তর ক্রমান্বয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। ফলে সে অজান্তেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাকওয়া-পরহেযগারীর নূর না থাকায় সে তা উপলব্ধি করতে পারে না।
বলা হয়ে থাকে, মাকরূহ হল হালাল ও হারামের মধ্যবর্তী একটি ঘাঁটি। যে ব্যক্তি বেশি বেশি মাকরূহ কাজে লিপ্ত হয়, সে মধ্যবর্তী ঘাঁটিটি পার হয়ে যায় আর এভাবে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অতএব হারাম থেকে বাঁচার জন্য মাকরূহ থেকেও বাঁচা জরুরি। সুতরাং হাদীছটির এক বর্ণনায় আছে-
فَمَنْ تَرَكَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ، كَانَ لِمَا اسْتَبَانَ لَهُ أَتْرَكَ ، وَمَنِ اجْتَرَأَ عَلَى مَا شَكّ فِيهِ، أَوْشَكَ أَنْ يُوْقَعَ فِي الْحَرَامِ
‘যে ব্যক্তি গুনাহের সন্দেহ আছে এমন বিষয় পরিত্যাগ করে, সে সুস্পষ্ট গুনাহ আরও বেশিই পরিত্যাগ করবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত কাজে ধৃষ্টতা দেখায়, সে অচিরেই হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে।(সহীহ বুখারী: ২০৫১; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা ১০৪০১; শু'আবুল ঈমান: ৫৩৫৭)
كَالرَّاعِي يَرْعَى حَوْلَ الْحِمَى يُوْشِكُ أَنْ يَرْتَعَ فِيهِ ‘ঠিক ওই রাখালের মতো, যে হিমা (সরকারি সংরক্ষিত ভূমি)-এর আশেপাশে পশু চড়ায়। তার অসতর্কতাবশত হিমায় ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। اَلْحِمَى -এর অর্থ সরকারি চারণভূমি, যে ভূমি সরকারি পশু চরানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। তাতে জনসাধারণের পশু চরানো নিষেধ থাকে। প্রাচীনকালে গোত্রপ্রধানেরাও নিজেদের জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করত। তারা ঘোষণা করে দিত, এ ভূমিতে অন্য কেউ পশু চরাতে পারবে না।
এটা একটা দৃষ্টান্ত। এর মাধ্যমে সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির অবস্থা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে যে, এ ব্যক্তির অবস্থা হল ওই রাখালের মতো, যে সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চরায়। ওই রাখালের ক্ষেত্রে যেমন আশঙ্কা রয়েছে তার পশু যে-কোনও সময় সংরক্ষিত ভূমির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে, তেমনি সন্দেহযুক্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও যে-কোনও সময় হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে নিষিদ্ধ ভূমিতে পশু চরানোর দায়ে যেমন রাখাল দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারে, তেমনি হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার কারণে এ ব্যক্তিরও শাস্তিভোগের আশঙ্কা থাকে। সে শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় একটাই- সন্দেহযুক্ত কাজ পরিহার করা, যেমন রাখালেরও দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার উপায় হল নিষিদ্ধভূমির আশেপাশে পশু চরানো হতে বিরত থাকা।
أَلَا وَإِنَّ لِكُلِّ مَلِك حِمى ‘শোনো হে! প্রত্যেক বাদশারই হিমা (সংরক্ষিত ভূমি) থাকে'। অর্থাৎ প্রত্যেক বাদশাই রাষ্ট্রীয় পশু চরানোর জন্য চারণভূমি সংরক্ষণ করে থাকে। বাদশার পক্ষ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হয় কেউ যেন ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে না যায়। যে ব্যক্তি সরকারি শাস্তির ভয় রাখে এবং তা থেকে বাঁচতে চায়, সে কখনও ওই ভূমির আশেপাশে পশু নিয়ে যায় না। ফলে সে শাস্তি থেকে বেঁচে যায়। আর যার সেই ভয় নেই, সে ঠিকই ওই ভূমির পাশে পশু চরায়। তার পশু যে নিষিদ্ধ ভূমিতে ঢুকে পড়বে না, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। আর তা যদি ঢুকে পড়েই, তবে তাকে অবশ্যই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
أَلَا وَإِنَّ حِمَى اللَّهِ مَحَارِمُهُ (শোনো হে! আল্লাহর হিমা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ)। অর্থাৎ আল্লাহ হলেন সমস্ত রাজার রাজা। রাজাদের যেমন হিমা বা সংরক্ষিত স্থান থাকে, তেমনি সকল রাজার রাজা আল্লাহরও সংরক্ষিত স্থান আছে। আর তা হচ্ছে ওইসমস্ত বিষয়, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি সেই নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের কোনও একটিতে লিপ্ত হবে, সে শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি তাতে লিপ্ত হওয়ার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছাবে, তার যে-কোনও সময় তাতে লিপ্ত হয়ে পড়ারও আশঙ্কা আছে। কাজেই আল্লাহর শাস্তি থেকে যে ব্যক্তি বাঁচতে চায়, তার কর্তব্য হবে হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের ধারেকাছেও না যাওয়া। মনে রাখতে হবে, রাজা-বাদশার শাস্তির ভয়ে যখন তাদের হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকেও বিরত থাকা হয়, তখন মহান আল্লাহর হিমার ধারেকাছে যাওয়া থেকে তো আরও বেশি সতর্কতার সঙ্গে দূরে থাকা উচিত। কেননা তাঁর শাস্তি রাজা-বাদশাদের শাস্তি অপেক্ষা অনেক অনেক বেশি কঠিন।
أَلَا وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً (শোনো হে! শরীরের ভেতর একটি মাংসপিণ্ড আছে)। এই বলে কলব বা হৃদয়ের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কেননা তার সঙ্গে নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিহার করা না করার গভীর সম্পর্ক আছে। হাদীছটির শেষে মাংসপিণ্ডটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে 'কলব'-এর দ্বারা। কলব অর্থ হৃৎপিণ্ড। এটা অন্তর বা আত্মার বাহন। এটি মানবদেহের একটি ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র হলেও এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য এটি রাজার মতো। রাজার মতোই সে অন্যসব অঙ্গকে পরিচালনা করে। রাজা ভালো হলে তার পরিচালনা ভালো হয়। মন্দ হলে পরিচালনাও মন্দ হয়। কলবের বিষয়টাও সেরকমই। সুতরাং হাদীছটির পরের অংশে ইরশাদ হয়েছে-
إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ (সেটি ঠিক থাকলে সমস্ত শরীর ঠিক থাকে। আর সেটি নষ্ট হয়ে গেলে সমস্ত শরীর নষ্ট হয়ে যায়)। অর্থাৎ অন্তর যদি হিদায়াতের আলোয় আলোকিত থাকে, তাতে ঈমান থাকে পরিপক্ক, দীন সম্পর্কে থাকে পরিপূর্ণ ধারণা, থাকে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতমুখিতা, তবে সে অন্তর হয় সুস্থ ও পরিশুদ্ধ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর আনুগত্যে প্রস্তুত করে। ফলে তা দ্বারা সর্বাবস্থায় সৎকর্ম সম্পন্ন হয় ও উন্নত আখলাক-চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি থাকে হিদায়াতশূন্য এবং তাতে থাকে কুফর ও জাহিলিয়াতের অন্ধকার, তবে সে অন্তর হয় নষ্ট ও অসুস্থ। এরূপ অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে নষ্ট কাজেই ব্যবহার করে। ফলে তা দ্বারা নানারকম পাপাচার হয় ও দুশ্চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।
বোঝা গেল অন্তরের ইসলাহ ও সংশোধন করা অতীব জরুরি। অন্তরের ইসলাহ না হলে কেবল আইন-কানুন বা শাসন দ্বারা অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে না। অপরাধ ও পাপকর্ম তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই হয়। যে হৃদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচালনা করে, তা যদি সুস্থ না হয়, তবে কেবল আইন দ্বারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থ ব্যবহার কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এ কারণেই যারা আত্মিক চিকিৎসকের দ্বারা আপন অন্তরের আরোগ্যসাধনা করে, তাদের সুপথে পরিচালনার জন্য সরকারি আইনের প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে যারা এ চিকিৎসার ধার ধারে না, কোনও আইন ও শাসন তাদেরকে অন্যায়-অনাচার থেকে ফেরাতে পারে না। সুতরাং উন্নত, সুস্থ ও পরিশুদ্ধ জীবন প্রত্যাশীদের উচিত সবার আগে নিজ আত্মিক পরিশুদ্ধিতে মনোনিবেশ করা।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. যেসব বিষয় হালাল না হারাম তা নিয়ে সন্দেহ থাকে, তা পরিহার করাই তাকওয়ার দাবি।
খ. সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করার দ্বারা নিজ দীনদারি ও সম্মান রক্ষা পায়।
গ. সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
ঘ. কলব বা অন্তরের ইসলাহ অতীব জরুরি। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ হতে বাঁচানোর এটাই প্রধান উপায়।
ঙ. এ হাদীছটি দ্বারা উলামায়ে কেরাম বিশেষত মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা সম্পর্কেও ধারণা লাভ হয়।
চ. এর দ্বারা সুলুক ও তাসাউওফের চর্চা, যা দ্বারা কিনা অন্তরের ইসলাহ করাই মূল উদ্দেশ্য, এর গুরুত্বও বুঝে আসে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)