রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫৮০
ভূমিকা অধ্যায়
পুরুষদের জন্য কবর যিয়ারত মুস্তাহাব হওয়া প্রসঙ্গ এবং কবর যিয়ারতের দু‘আ
মানুষ মারা গেলে মাটির ভেতর দাফন করার নিয়ম প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এটা মানুষের জন্য আল্লাহ তা'আলার বিশেষ সম্মাননা। অন্যসব প্রাণী মারা গেলে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে। কিন্তু মানুষকে মাটির ভেতর ঘর বানিয়ে ইজ্জতের সঙ্গে তাতে শুইয়ে রাখা হয়। এর সূচনা হয়েছে হযরত আদম আলাইহিস সালামের পুত্র হাবীল থেকে। হাবীল তার ভাই কাবীলের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কাবীল বুঝতে পারছিল না হাবীলের লাশ কী করবে। এর আগে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে তার জানা ছিল না এ ক্ষেত্রে কী করণীয়। তার মধ্যে অপরাধবোধও কাজ করছিল। তাই লাশটি তার লুকানোর প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে কোথায় লুকাবে? সুতরাং এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলা এক কৌতূহলোদ্দীপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ব্যবস্থাটি ছিল এরকম যে, কাবীল দেখতে পেল একটি কাক এসে মাটি খুঁড়ছে। এভাবে সে একটি গর্ত তৈরি করল। তারপর একটি মরা কাক সেই গর্তে রেখে মাটি দ্বারা ঢেকে দিল। অমনি কাবীলের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমিও তো এরকম করতে পারি! সুতরাং কাকটির দেখাদেখি সেও মাটি খুঁড়ে একটি গর্ত বানাল। তারপর ভাইয়ের লাশ তার ভেতর রেখে মাটি দ্বারা ঢেকে দিল। কুরআন মাজীদে সে ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
فَبَعَثَ اللَّهُ غُرَابًا يَبْحَثُ فِي الْأَرْضِ لِيُرِيَهُ كَيْفَ يُوَارِي سَوْءَةَ أَخِيهِ قَالَ يَاوَيْلَتَا أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَذَا الْغُرَابِ فَأُوَارِيَ سَوْءَةَ أَخِي فَأَصْبَحَ مِنَ النَّادِمِينَ (31)
‘অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের লাশ কীভাবে গোপন করবে তা তাকে দেখানোর লক্ষ্যে মাটি খনন করতে লাগল। (এটা দেখে) সে বলে উঠল, হায় আফসোস! আমি কি এই কাকটির মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি! এভাবে পরিশেষে সে অনুতপ্ত হল।’(সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৩১)
সুতরাং শুরু থেকে মানবজাতির মধ্যে এ নিয়মই চলে আসছে। এ নিয়ম সবদিক থেকেই সুন্দর। এর দ্বারা যেমন মৃতব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা হয়, তেমনি পরিবেশও দূষণ থেকে রক্ষা পায়। তাছাড়া কবর দ্বারা মানুষের উপদেশগ্রহণেরও সুযোগ হয়। সামনে কবর পড়লে অন্তরে এ চিন্তা জাগ্রত করা সহজ হয় যে, ইহজীবন স্থায়ী নয়। সকলকেই এ জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হয়। একদিন আমারও মরণ হবে। তারপর আমাকেও এভাবে মাটির ভেতর অন্ধকার ও সংকীর্ণ স্থানে রেখে দেওয়া হবে। এ পরিণতির কথা ভুলে আমি কিসের মোহে পড়ে আছি? এর জন্য আমার প্রস্তুতি কই? কেন আমি ইহজীবনের ক্ষণিকের ফুর্তিতে মাতোয়ারা হয়ে নিজ পরিণতির কথা বিস্মৃত হয়ে আছি? এভাবে কবর মানুষের সম্বিৎ ফিরিয়ে আনে। তাকে তার পরিণাম সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন করে। ফলে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের দিকে ঝোঁকে এবং ইহজীবন শুদ্ধ ও সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সচেষ্ট হয়।
কবর দেখার মধ্যে এরূপ ফায়দা নিহিত আছে বলে ইসলাম মানুষকে কবর যিয়ারত করতে উৎসাহ দিয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কবর যিয়ারত করতেন। উম্মতকেও তা করতে বলেছেন। এর জন্য তিনি কিছু নির্দেশনাও দান করেছেন, যেমন কবরের সামনে কীভাবে দাঁড়াতে হবে, কী বলতে হবে, কেন কবর যিয়ারত করতে হবে ইত্যাদি।
কবর যিয়ারত দ্বারা যেমন নিজের নসীহত লাভ হয়, তেমনি দু'আ করলে কবরবাসীরও ফায়দা হয়। এ কারণে বিশেষভাবে পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের কবর মাঝেমধ্যে যিয়ারত করা উচিত।
ইমাম নাওয়াবী রহ. এ অধ্যায়ে কবর যিয়ারত সম্পর্কে কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
পরকালচিন্তা বাড়ানোর লক্ষ্যে কবর যিয়ারত
হাদীছ নং: ৫৮০

হযরত বুরায়দা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা তা যিয়ারত করো। -মুসলিম
(সহীহ মুসলিম: ৯৭৭; সুনানে আবু দাউদ: ৩২৩৫; জামে তিরমিযী: ১০৫৪; সুনানে নাসাঈ: ২০৩২; সুনানে ইবন মাজাহ ১৫৭২; সহীহ ইবন হিব্বান: ৯৮১; মুআত্তা মালিক: ১৭৬৭)
অপর এক বর্ণনায় আছে, অতএব যে ব্যক্তি কবর যিয়ারত করতে চায় সে যিয়ারত করুক। কারণ তা আমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।
مقدمة الامام النووي
66 - باب استحباب زيارة القبور للرجال وما يقوله الزائر
580 - عن بُرَيْدَة - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عن زِيَارَةِ القُبُورِ فَزُوروها». رواه مسلم. (1)
وفي رواية: «فَمَنْ أرَادَ أَنْ يَزُورَ القُبُورَ فَلْيَزُرْ؛ فإنَّهَا تُذَكِّرُنَا الآخِرَةَ».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

প্রথমদিকে কবর যিয়ারত করা নিষেধ ছিল। শাহ ওয়ালিয়্যুল্লাহ রহ.-এর মতে এর কারণ ছিল শিরকের পথ বন্ধ করা। তিনি বলেন, কবর যিয়ারত কবর পূজার দুয়ার খোলে। পরে যখন ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং মানুষের চিন্তা-চেতনায় গায়রুল্লাহর ইবাদত হারাম হওয়ার বিষয়টি বদ্ধমূল হয়ে যায়, তখন (কবরপূজার আশঙ্কা দূর হয়ে যায়, ফলে) কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়।

এ হাদীছে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আগে কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞা রহিত করে দেওয়া হয়েছে এবং যিয়ারত করার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন অনুমতি দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন হাদীছে তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে এরকম-
فَإِنَّهَا تُذَكَّرُنَا الْآخِرَةَ (কারণ তা আমাদেরকে আখিরাত স্মরণ করিয়ে দেয়)। অর্থাৎ কবরস্থানে গেলে সামনাসামনি লক্ষ করা যায় যারা একদিন এ মাটির উপর বিচরণ করত, দুনিয়ার হাজারও নি'আমত ভোগ ও উপভোগ করত, কীভাবে তারা সবকিছু থেকে চিরবিদায় নিয়ে একদম খালিহাতে মাটির নিচে চলে গেছে! সেখানে তারা সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। মাটির অন্ধকার কক্ষে সম্পূর্ণ অসহায়। যাদের চলে যাওয়া পুরোনো হয়ে গেছে, তারা তো মাটিতে মিশেই গেছে। একদিন আমারও এ দশা হবে। অতএব শুধু শুধু কেন লম্বা-চওড়া স্বপ্নের জাল বোনা? এভাবে চিন্তা করতে থাকলে দুনিয়ার লোভ-লালসা ঘুচে যায় এবং মন আখিরাতের দিকে ঝোঁকে। মন আখিরাতমুখী হলে আমলে তার আছর পড়ে। তখন মন্দকাজের প্রবণতা কমে এবং সৎকাজের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। সৎকাজ দ্বারাই আখিরাতে মুক্তিলাভ হয়। সুতরাং কবর যিয়ারত আখিরাতের মুক্তিলাভের পক্ষে খুব সহায়ক। তাই এটা মাঝেমধ্যেই করা উচিত।

কবর যিয়ারতের এ অনুমতি নারী-পুরুষ সকলের জন্যই। হযরত ফাতিমা রাযি. প্রতি জুমু'আর দিন হযরত হামযা রাযি.-এর কবর যিয়ারত করতে যেতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কবর যিয়ারতে গিয়ে কী বলব? তিনি বলেছিলেন-
قُوْلِي : السَّلَامُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ، وَيَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْن
‘তুমি বলবে, হে মুমিন ও মুসলিম কবরবাসীগণ! তোমাদের প্রতি সালাম। আল্লাহ তা'আলা আমাদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ও যারা পশ্চাদবর্তী, সকলের প্রতি দয়া করুন। ইনশাআল্লাহ আমরাও তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব।’(সহীহ মুসলিম: ৯৭৪; মুসনাদে আহমাদ: ২৫৮৫৫; সহীহ ইবন হিব্বান: ৭১১০; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৬৭১২; সুনানে নাসাঈ ২০৩৭; তাবারানী, আদ-দু'আ: ১২৪৬)

কোনও কোনও হাদীছে যে মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারতের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়, সে নিষেধাজ্ঞা সকলের জন্য সাধারণ নয়। তা কেবল তাদের জন্যই প্রযোজ্য, যারা বারবার কবরস্থানে যায়, সেখানে গিয়ে বিলাপ করে, পর্দারও বরখেলাফ করে ও নানারকম সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হয়। যারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় এবং কোনওরকম সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত হয় না, এরকম মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত নিষেধ নয়। কবর যিয়ারতের যে দীনী উপকারিতা, তা যেমন পুরুষের জন্য প্রয়োজন, তেমনি নারীদের জন্যও প্রয়োজন বটে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

দুনিয়ার মোহ ঘুচানো ও আখিরাতের ফিকির বাড়ানোর লক্ষ্যে মাঝেমাঝে কবর যিয়ারত করা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)